11:05 am, Monday, 23 December 2024

অচেনা সৌরভ : জনজীবনের আদিগন্ত রূপ

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 95 ভিউ
শেয়ার করুন

লেখক ‘রেজাউল করিম খোকন’ বাংলা সাহিত্য জগতে নতুন মুখ নয় বরং বলা যায় লেখার দীর্ঘতা লেখক হিসেবে নিজেকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন আপন দক্ষতায়। তার লেখনীর নিরবচ্ছিন্ন স্রোত থেকে বের হয়ে এসেছে এ পর্যন্ত উপন্যাস ও গল্প বই নিয়ে ৫৫টা গ্রন্থ। তাই লেখনীর পরিসরে রয়েছে বিরামহীন নিষ্ঠা ও শ্রম। পরিচিতির বলয়ে রয়েছে সুনাম ও সুখ্যাতি। কিছুদিন আগে হাতে পেয়েছিলাম গল্পকার রেজাউল করিম খোকনের ‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থ। অর্থবহ সাধারণ প্রচ্ছদে ঢাকা বইটি বেশ আদুরে। মোট সাতটা ছোট বড় গল্পে সজ্জিত বইটি। বেশ আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়লাম। চমৎকার সব গল্প সমাজের নি¤œ, নি¤œ-মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণির মাঝে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব, সমস্যার স্বরূপ বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা গল্পে গল্পে বর্ণময় হয়েছে। গল্পকারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, সূ² চিন্তাধারা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় চলমান অসঙ্গতিগুলোর প্রতি দৃষ্টি আপতিত হয়েছে আর তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিপুণভাবে খুবই সাহজিকতায় তারগ্রন্থে। গল্প পড়লেই মুহূর্তেই সমাজের আশপাশের চিত্র জীবন্ত হয়ে মনতারল্যে আলোড়ন তোলে। গল্পে এমনভাবে ঘটনার প্রবেশ ঘটেছে তা গল্পকারের উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় কখনো অহেতুক বা অনাহূত মনে হয়নি বরং তা ঘটনা প্রবাহকে যৌক্তিক করে তুলেছে। গল্পকার তার প্রতিটা গল্পের ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে দেননি বরং পাঠককুলের কাছে অবস্থার করুণ পরিণতিকে নিপীড়নের যূপকাষ্ঠে বলির উপাদানের আবশ্যকতা যথার্থ বলেই প্রকাশ করেছেন অবলীলায়। গল্পকার সমাজের এই সমস্যা, অসামঞ্জস্য, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহের ফুলকি তুলেছেন নিপাট শব্দের যূথবন্ধনে। গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য
পর্যালোচনা করলে প্রতিটি গল্প ছোট গল্পের আদলে রচিত হয়েছে।

দুই. গল্পগ্রন্থেরপ্রথম গল্প হলো ‘পরিচয়’। এখানে
গল্পকার পতিতা পল্লীতে জন্মগ্রহণকারী ‘আরমান’-এর এইচএসসি পরীক্ষায় জন্মনিবন্ধন জটিলতার কথা বর্ণিত হয়েছে দারুণ এক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেখানে পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে নানান জটিলতার উদ্ভব হয়েছে। লেখক এখানে একজন পরীক্ষার্থীর মানসিক অবস্থার করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। পতিতালয়ে জন্ম হওয়ার বিড়ম্বনা প্রকট হয়ে গল্পের প্লটকে ভারি করে তুলেছে। সমাজে পতিতা ও তাদের ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তান অপাংতেয় হওয়ায় বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা যে পদে পদে তা প্রতিফলিত হয়েছে। তারপরও সমাজে এমন মানুষ ও রয়েছে তারা সব বুঝে একজন পতিতা সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে এগিয়ে এলেও সমাজের লোকলজ্জার ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। গল্পের প্লটে জগলুল সাহেবের অবতারণা করেছেন তেমন একটা চরিত্র নিয়ে অথচ সরকারের যথাযথ পদক্ষেপে তার সমাধান হলেও ‘আরমান’র মতো অনেকের মানসিক স্তরে সমস্যাটা থেকেই যায়। গল্পকার এখানে গল্পের পরিসমাপ্তি করেছেন আরমানের জীবনের আংশিক ঘটনাকে অর্থাৎ খণ্ড জীবনের দুঃখচিত্রকে উপস্থাপন করে। পূর্ণজীবনকে উপস্থাপন করেননি গল্পে।
গল্পগ্রন্থের ২য় গল্প হলো তৃষ্ণা। এ গল্পে শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এবং নিয়মশৃঙ্খলার বাঁধনে পিষ্ট মুক্ত জীবনের হাঁসফাঁস করার কথা বর্ণিত। বর্ণিত হয়েছে জীবন সয়াহ্নে এসে নানাবিধ রোগের কারণে নিয়ম করে বেঁধে দেয়া রুটিনের কাছে হার মেনেছে ইচ্ছার স্বাধীনতা তাই গল্পে দেখা যায় মিনারা বেগম নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চাইছেন। অথচ মেয়ে রিমি ও নাতি সাকিরের কথা ও ফেলতে পারছেন না কারণ ওরা তার ওপর যত শারীরিক সুস্থতার জন্য বিধিনিষেধের বেড়াজালে বেষ্টিত করলে ও তিনি তাদের কাউকে ছেড়ে যেতে চান না। গল্পে মিনারা বেগমের দুধরনের তৃষ্ণা স্পষ্ট হয়েছে এক তিনি ভরা সংসার ফেলে যেমন ইহলোক ত্যাগ করতে চান না অর্থাৎ বেঁচে থাকার তৃষ্ণা অন্যদিকে নিয়মের অতিরিক্ত জল খাওয়ার তৃষ্ণা দুটোই প্রকট হয়ে তুলে ধরেছেন। এ গল্পে মিনারা বেগমের রোগাক্রান্ত জীবনের খণ্ডচিত্র প্রতিভাত হয়েছে। মিনারা বেগমের পূর্ণজীবন কাহিনি এখানে বিধৃত হয়নি। গল্পের শেষটা অপূর্ণতা থেকে গেছে গল্পের প্রধান চরিত্র মিনারার জীবনের অপূর্ণতার মতো। গল্পের নামকরণ সার্থক।
মহারাজ গল্পগ্রন্থের ৩য় গল্প। গল্পে একজন সাধারণ ছাত্রের কলেজের তুচ্ছ মারামারি থেকে সমাজের তথাকথিত বড় ভাইয়ের বা গড-ফাদারের প্রশ্রয়ে দাগি খুনি সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার গল্প। গল্পে কিভাবে একজন শান্ত নিরীহ ছাত্র মানুষ খুন করছে নেতাদের আদেশে তারই একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রাজ যে ছাত্র ছাত্রজীবনের শুরুতে একজন শিল্পী বা আঁকিয়ে হওয়ার কথা যাকে নিয়ে তার পিতার স্বপ্ন ছিল তাকে মহারাজ ডাকত সেই শেষপর্যন্ত আলোর ঝলমলে পথ ছেড়ে অন্ধকারের পথে পা বাড়াল জীবন-মৃত্যুকে বাজি রেখে। শুরুতে রাজকে মৃত্যুভয় ছুঁতে না পারলেও একসময় খুন খারাবির পথে হাঁটতে গিয়ে পরিবার থেকে সর্বোপরি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকিত্বকে মেনে নিয়ে মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এটা এক ধরনের এলিনিয়েশন। এখানে খুনের মতো সমাজবিরোধী কাজকর্মে নিজেকে লিপ্ত রাখতে রাখতে একসময় পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গল্পে এর ছায়া পড়েছে। রাজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলে ও খুন খারাবির মতো কাজে আবিষ্ট থাকাতে আইনের পরিপন্থি হওয়ায় তার ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও থাকে শেষাবধি ধরা পড়তে হলো এবং আইনের আওতায় পড়তে হলো। এখানে গল্পকার দেখাতে সচেষ্ট হলেন যেসব অপরাধের শেষ আছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। দেখাতে পেরেছেন যেমন কর্ম তেমন ফল। দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে সমাজের একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার কারণে সহজ সরল সম্ভাবনাময় ছাত্র সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়ে আঁধারের গলিপথে ঢুকে পড়ে নিজের অজান্তে।
‘পারফিউম’ গল্পগ্রন্থের ৪র্থ গল্প। গল্পের প্লট এখানে এমনভাবে সজ্জিত হয়েছে যে যেখানে অভিজাত মহলের অর্থের বৈভবের কাছে নুয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত নি¤œ মধ্যবিত্তের সম্ভ্রম।

তিন. গল্পগ্রন্থের ৫ম গল্প হলো ‘অনিন্দিতা’। গল্পে দেখা যায় ‘জারিন’ একজন হাসিখুশি, চনমনে ও প্রাণবন্ত মেধাবী এক মেয়ে। টিভিতে অ্যাংকারিং করাসহ নানা সোশ্যাল কাজ নিয়ে ফেসবুক সেলিব্রিটি হিসেবে বেশ পরিচিত। চৌকস তরুণী হিসেবে তার ফ্যান ফলোয়ারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। গল্পে দেখা যায় তারও একটা ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়া’ নামে মানসিক বিকার রয়েছে। এটা হলো এমন এক মানসিক রোগ যা হলো কারো অজ্ঞাতে মূল্যবান জিনিসপত্র লুকিয়ে চুরি করা। জারিন ও ক্লেপ্টোম্যানিয়ার কারণে গুলশানের এক অভিজাত দোকান ‘এক্সক্লুসিভ’ থেকে মা-বাবার জন্মদিনে গিফট কিনতে গিয়ে দোকানে কর্মরত কর্মচারীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা মূল্যবান পণ্য চুরি করে বসে। কিন্তু ‘জারিন’ জানতে ও পারেনি দোকানে বসানো সিসি টিভি ক্যামরায় তা ধরা পড়ে। দোকানের কর্মচারীদের কেউ না জানলেও দোকানের ম্যানেজার জগলুল তা জেনে নিয়ে ‘জারিন’কে ব্লেকমেইল করে তার বিকৃতি রুচি চরিতার্থ করার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে। আর সেই বিকৃতি রুচির শিকার হয়ে শেষাবধি জারিন আত্মহননের পথ বেচে নিতে বাধ্য হয়। এখানে গল্পকার সমাজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিকৃত রুচির যৌন লালসাগ্রস্ত নরপশুদের অবস্থান ও একইসঙ্গে পরিবার, সমাজ সর্বোপরি নিজের থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আত্মহননের চিত্ররূপ তুলে ধরেছেন যা সত্যিই সমাজের অবক্ষয়ের এক বিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহের ইঙ্গিত প্রদান করে।
গল্পকার এ গল্পের শেষাংশ আলোকপাত করেননি যেমন এই আত্মহত্যার কারণ খুঁজে মূল নায়ককে শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনার কোনো কথাই ওঠে আসেনি। লেখক বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার এ অনিয়মের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন।
প্রতিপক্ষ গল্পগ্রন্থের ষষ্ঠ গল্প যেখানে সমাজের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সমাজে ছল-চাতুরীতে পড়া এক গ্রামীণ সহজ সরল মেয়ের এক দুঃখের উপাখ্যান হলো এ গল্প। এ গল্পের নায়িকা হলো জমিলা। অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়ে জমিলা অনেক কষ্টে এনজিও সংস্থার এক কর্মকর্তা ‘মেরিনা’র সাহায্যে গাজীপুরে ডায়মন্ড অ্যাপারেলস এ চাকরি খুঁজে নেয় এবং নিজের চেষ্টায় সাধারণ হেলপার থেকে সুইং অপারেটর হয়ে ওঠে। সবদিক বিবেচনা করে জমিলা নিজের নিরাপত্তা ও একটা সুখের সংসারের জন্য রতনকে বিয়ে করে। করিৎকর্মা এ রতন ছিল লোভী। সে জমিলাকে বিদেশে পাঠিয়ে একদিকে যেমন জমিলাকে যেমন অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে ঠিক তেমনি তার কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছে আর একদিন প্রবাসের নারকীয় জীবন থেকে মুক্ত হয়ে দেশে এসেছে তখন সে তার স্বামী রতনকে দেখেছে অন্যভাবে। সে আরেকটা বিয়ে করেছে এবং তাকে গ্রহণ করতে যেমন অস্বীকার করছে অন্যদিকে বিদেশ থেকে পাঠানো জমিলার অর্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছে। জমিলা এর প্রতিকার চেয়ে কোর্টে মামলা করেছে রতন এর প্রতিপক্ষ হয়ে। জমিলার যে রূপ গল্পে গল্পকার তুলে ধরেছেন তা আজ রতনের মতো লম্পট পাষণ্ডের অন্তরাত্মাও কেঁপে উঠেছে। মামলার ফল কি হবে তা জানা না গেলেও জমিলাকে প্রকৃত প্রতিপক্ষ হিসেবে ঠিকই দাঁড় করাতে পেরেছেন।
‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থের সর্বশেষ গল্প। গল্পটা বর্তমান সময়ে গার্মেন্টস কোম্পানিতে কাজ করা এক অসহায় মেয়ের সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। গল্পের প্রধান চরিত্র গার্মেন্টস কর্মী কলমিকে একরকম স্বামী সিএনজি চালক দুলালকে নিয়ে দুলালের ২য় স্ত্রী হিসেবে সংসার করতে দেখা যায়। গল্পে স্বামী হিসেবে দুলালকে দায়িত্ববান হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংসার তাদের ভালোই চলছিল কিন্তু একদিন দুলাল এক্সিডেন্ট করে যখন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল তখন তাকে সারিয়ে তুলতে কলমিকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয়ভার এত বেশি যে তার সংকুলান করা কলমির জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। টাকার জন্য সে গার্মন্টস ফ্যাক্টরিতে ২৫০০০ টাকা অগ্রিমও চেয়েছে কিন্তু পায়নি ফলে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে সে সহকর্মী রাজিয়ার মাধ্যমে আকমল সিকদারের কাছ থেকে ২৫০০০ টাকা পাবার প্রতিশ্রæতি পায়। আকমল সিকদার একজন নারী লোভী মানুষ। সেও একজন গার্মেন্টস কর্মী ছিল। পরে জুটের ব্যবসা ও সাব-কন্ট্রাক্টারি করে সে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে উঠে। তাই সে গার্মেন্টস মহিলা কর্মীদের একদিকে সাহায্য করলেও অন্যদিকে মেয়েদের ভোগের সামগ্রী করে সর্বস্ব লুটে নিত। কলমির এর ক্ষেত্রেও তার কার্পণ্য হয়নি। একসময়ের কঠিন ও সৎ চরিত্রের কলমির অসহায়ত্ব ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আকমল সিকদারও তার সর্বস্ব তথা সম্ভ্রম লুটে নিয়েছে। সারাদিনের হাঁড়ভাঙা পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ মুছতে আকমল তাকে সেন্টের সুরভীতে ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই সৌরভ কলমির মনকে ছুঁতে পারেনি অচেনা এক পরপুরুষের গন্ধ তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে। ঝুম বৃষ্টিতে আকমল সাহেবের দেয়া সেন্টের গন্ধ হয়তো ধুয়ে যাবে কিন্তু পরপুরুষের যে সৌরভ নিয়ে সে দুলালের কাছে যাচ্ছে তা দুলালের কাছে চিরদিনই অচেনা থেকে যাবে।

চার. প্রায় ৬ ফর্মার ‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থের সাদামাটা, দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। প্রকাশিত হয়েছে ‘কারুবাক’ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লক্স ২৫৩- ২৫৪, ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক কাঁটাবন, ঢাকা থেকে। মুদ্রিত হয়েছে ওমাসিস প্রিন্টার্স এ। মুদ্রণ স্বচ্ছ হলেও ছাপাখানার ভূত তাড়াতে পারেনি। ফলে বানান ভুল রয়েছে অনেক জায়গায়। মুদ্রণে আরো মনোযোগী হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। গল্পগ্রন্থের ৭টি গল্পই ছোট গল্পের আদল পেয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজের সমসাময়িক সমাজ জীবনের বাস্তব ঘটনাবলি গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পকার প্রতিটা গল্প তার লেখনীর মুন্সিয়ানায় জীবন্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পের শেষ গল্প ‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থের প্রাণ। গল্পের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে গল্পের ও গল্পগ্রন্থের নামকরণ যথার্থ হয়েছে বলে অনুমিত হয়। আমি উক্ত গল্পগ্রন্থের পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি।

রূপক বর

 

#
জনপ্রিয়

অচেনা সৌরভ : জনজীবনের আদিগন্ত রূপ

আপডেটের সময় : ০৭:০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

লেখক ‘রেজাউল করিম খোকন’ বাংলা সাহিত্য জগতে নতুন মুখ নয় বরং বলা যায় লেখার দীর্ঘতা লেখক হিসেবে নিজেকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন আপন দক্ষতায়। তার লেখনীর নিরবচ্ছিন্ন স্রোত থেকে বের হয়ে এসেছে এ পর্যন্ত উপন্যাস ও গল্প বই নিয়ে ৫৫টা গ্রন্থ। তাই লেখনীর পরিসরে রয়েছে বিরামহীন নিষ্ঠা ও শ্রম। পরিচিতির বলয়ে রয়েছে সুনাম ও সুখ্যাতি। কিছুদিন আগে হাতে পেয়েছিলাম গল্পকার রেজাউল করিম খোকনের ‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থ। অর্থবহ সাধারণ প্রচ্ছদে ঢাকা বইটি বেশ আদুরে। মোট সাতটা ছোট বড় গল্পে সজ্জিত বইটি। বেশ আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়লাম। চমৎকার সব গল্প সমাজের নি¤œ, নি¤œ-মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণির মাঝে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব, সমস্যার স্বরূপ বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা গল্পে গল্পে বর্ণময় হয়েছে। গল্পকারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, সূ² চিন্তাধারা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় চলমান অসঙ্গতিগুলোর প্রতি দৃষ্টি আপতিত হয়েছে আর তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিপুণভাবে খুবই সাহজিকতায় তারগ্রন্থে। গল্প পড়লেই মুহূর্তেই সমাজের আশপাশের চিত্র জীবন্ত হয়ে মনতারল্যে আলোড়ন তোলে। গল্পে এমনভাবে ঘটনার প্রবেশ ঘটেছে তা গল্পকারের উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় কখনো অহেতুক বা অনাহূত মনে হয়নি বরং তা ঘটনা প্রবাহকে যৌক্তিক করে তুলেছে। গল্পকার তার প্রতিটা গল্পের ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে দেননি বরং পাঠককুলের কাছে অবস্থার করুণ পরিণতিকে নিপীড়নের যূপকাষ্ঠে বলির উপাদানের আবশ্যকতা যথার্থ বলেই প্রকাশ করেছেন অবলীলায়। গল্পকার সমাজের এই সমস্যা, অসামঞ্জস্য, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহের ফুলকি তুলেছেন নিপাট শব্দের যূথবন্ধনে। গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য
পর্যালোচনা করলে প্রতিটি গল্প ছোট গল্পের আদলে রচিত হয়েছে।

দুই. গল্পগ্রন্থেরপ্রথম গল্প হলো ‘পরিচয়’। এখানে
গল্পকার পতিতা পল্লীতে জন্মগ্রহণকারী ‘আরমান’-এর এইচএসসি পরীক্ষায় জন্মনিবন্ধন জটিলতার কথা বর্ণিত হয়েছে দারুণ এক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেখানে পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে নানান জটিলতার উদ্ভব হয়েছে। লেখক এখানে একজন পরীক্ষার্থীর মানসিক অবস্থার করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। পতিতালয়ে জন্ম হওয়ার বিড়ম্বনা প্রকট হয়ে গল্পের প্লটকে ভারি করে তুলেছে। সমাজে পতিতা ও তাদের ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তান অপাংতেয় হওয়ায় বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা যে পদে পদে তা প্রতিফলিত হয়েছে। তারপরও সমাজে এমন মানুষ ও রয়েছে তারা সব বুঝে একজন পতিতা সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে এগিয়ে এলেও সমাজের লোকলজ্জার ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। গল্পের প্লটে জগলুল সাহেবের অবতারণা করেছেন তেমন একটা চরিত্র নিয়ে অথচ সরকারের যথাযথ পদক্ষেপে তার সমাধান হলেও ‘আরমান’র মতো অনেকের মানসিক স্তরে সমস্যাটা থেকেই যায়। গল্পকার এখানে গল্পের পরিসমাপ্তি করেছেন আরমানের জীবনের আংশিক ঘটনাকে অর্থাৎ খণ্ড জীবনের দুঃখচিত্রকে উপস্থাপন করে। পূর্ণজীবনকে উপস্থাপন করেননি গল্পে।
গল্পগ্রন্থের ২য় গল্প হলো তৃষ্ণা। এ গল্পে শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এবং নিয়মশৃঙ্খলার বাঁধনে পিষ্ট মুক্ত জীবনের হাঁসফাঁস করার কথা বর্ণিত। বর্ণিত হয়েছে জীবন সয়াহ্নে এসে নানাবিধ রোগের কারণে নিয়ম করে বেঁধে দেয়া রুটিনের কাছে হার মেনেছে ইচ্ছার স্বাধীনতা তাই গল্পে দেখা যায় মিনারা বেগম নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চাইছেন। অথচ মেয়ে রিমি ও নাতি সাকিরের কথা ও ফেলতে পারছেন না কারণ ওরা তার ওপর যত শারীরিক সুস্থতার জন্য বিধিনিষেধের বেড়াজালে বেষ্টিত করলে ও তিনি তাদের কাউকে ছেড়ে যেতে চান না। গল্পে মিনারা বেগমের দুধরনের তৃষ্ণা স্পষ্ট হয়েছে এক তিনি ভরা সংসার ফেলে যেমন ইহলোক ত্যাগ করতে চান না অর্থাৎ বেঁচে থাকার তৃষ্ণা অন্যদিকে নিয়মের অতিরিক্ত জল খাওয়ার তৃষ্ণা দুটোই প্রকট হয়ে তুলে ধরেছেন। এ গল্পে মিনারা বেগমের রোগাক্রান্ত জীবনের খণ্ডচিত্র প্রতিভাত হয়েছে। মিনারা বেগমের পূর্ণজীবন কাহিনি এখানে বিধৃত হয়নি। গল্পের শেষটা অপূর্ণতা থেকে গেছে গল্পের প্রধান চরিত্র মিনারার জীবনের অপূর্ণতার মতো। গল্পের নামকরণ সার্থক।
মহারাজ গল্পগ্রন্থের ৩য় গল্প। গল্পে একজন সাধারণ ছাত্রের কলেজের তুচ্ছ মারামারি থেকে সমাজের তথাকথিত বড় ভাইয়ের বা গড-ফাদারের প্রশ্রয়ে দাগি খুনি সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার গল্প। গল্পে কিভাবে একজন শান্ত নিরীহ ছাত্র মানুষ খুন করছে নেতাদের আদেশে তারই একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রাজ যে ছাত্র ছাত্রজীবনের শুরুতে একজন শিল্পী বা আঁকিয়ে হওয়ার কথা যাকে নিয়ে তার পিতার স্বপ্ন ছিল তাকে মহারাজ ডাকত সেই শেষপর্যন্ত আলোর ঝলমলে পথ ছেড়ে অন্ধকারের পথে পা বাড়াল জীবন-মৃত্যুকে বাজি রেখে। শুরুতে রাজকে মৃত্যুভয় ছুঁতে না পারলেও একসময় খুন খারাবির পথে হাঁটতে গিয়ে পরিবার থেকে সর্বোপরি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকিত্বকে মেনে নিয়ে মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এটা এক ধরনের এলিনিয়েশন। এখানে খুনের মতো সমাজবিরোধী কাজকর্মে নিজেকে লিপ্ত রাখতে রাখতে একসময় পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গল্পে এর ছায়া পড়েছে। রাজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলে ও খুন খারাবির মতো কাজে আবিষ্ট থাকাতে আইনের পরিপন্থি হওয়ায় তার ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও থাকে শেষাবধি ধরা পড়তে হলো এবং আইনের আওতায় পড়তে হলো। এখানে গল্পকার দেখাতে সচেষ্ট হলেন যেসব অপরাধের শেষ আছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। দেখাতে পেরেছেন যেমন কর্ম তেমন ফল। দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে সমাজের একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার কারণে সহজ সরল সম্ভাবনাময় ছাত্র সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়ে আঁধারের গলিপথে ঢুকে পড়ে নিজের অজান্তে।
‘পারফিউম’ গল্পগ্রন্থের ৪র্থ গল্প। গল্পের প্লট এখানে এমনভাবে সজ্জিত হয়েছে যে যেখানে অভিজাত মহলের অর্থের বৈভবের কাছে নুয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত নি¤œ মধ্যবিত্তের সম্ভ্রম।

তিন. গল্পগ্রন্থের ৫ম গল্প হলো ‘অনিন্দিতা’। গল্পে দেখা যায় ‘জারিন’ একজন হাসিখুশি, চনমনে ও প্রাণবন্ত মেধাবী এক মেয়ে। টিভিতে অ্যাংকারিং করাসহ নানা সোশ্যাল কাজ নিয়ে ফেসবুক সেলিব্রিটি হিসেবে বেশ পরিচিত। চৌকস তরুণী হিসেবে তার ফ্যান ফলোয়ারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। গল্পে দেখা যায় তারও একটা ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়া’ নামে মানসিক বিকার রয়েছে। এটা হলো এমন এক মানসিক রোগ যা হলো কারো অজ্ঞাতে মূল্যবান জিনিসপত্র লুকিয়ে চুরি করা। জারিন ও ক্লেপ্টোম্যানিয়ার কারণে গুলশানের এক অভিজাত দোকান ‘এক্সক্লুসিভ’ থেকে মা-বাবার জন্মদিনে গিফট কিনতে গিয়ে দোকানে কর্মরত কর্মচারীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা মূল্যবান পণ্য চুরি করে বসে। কিন্তু ‘জারিন’ জানতে ও পারেনি দোকানে বসানো সিসি টিভি ক্যামরায় তা ধরা পড়ে। দোকানের কর্মচারীদের কেউ না জানলেও দোকানের ম্যানেজার জগলুল তা জেনে নিয়ে ‘জারিন’কে ব্লেকমেইল করে তার বিকৃতি রুচি চরিতার্থ করার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে। আর সেই বিকৃতি রুচির শিকার হয়ে শেষাবধি জারিন আত্মহননের পথ বেচে নিতে বাধ্য হয়। এখানে গল্পকার সমাজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিকৃত রুচির যৌন লালসাগ্রস্ত নরপশুদের অবস্থান ও একইসঙ্গে পরিবার, সমাজ সর্বোপরি নিজের থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আত্মহননের চিত্ররূপ তুলে ধরেছেন যা সত্যিই সমাজের অবক্ষয়ের এক বিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহের ইঙ্গিত প্রদান করে।
গল্পকার এ গল্পের শেষাংশ আলোকপাত করেননি যেমন এই আত্মহত্যার কারণ খুঁজে মূল নায়ককে শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনার কোনো কথাই ওঠে আসেনি। লেখক বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার এ অনিয়মের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন।
প্রতিপক্ষ গল্পগ্রন্থের ষষ্ঠ গল্প যেখানে সমাজের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সমাজে ছল-চাতুরীতে পড়া এক গ্রামীণ সহজ সরল মেয়ের এক দুঃখের উপাখ্যান হলো এ গল্প। এ গল্পের নায়িকা হলো জমিলা। অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়ে জমিলা অনেক কষ্টে এনজিও সংস্থার এক কর্মকর্তা ‘মেরিনা’র সাহায্যে গাজীপুরে ডায়মন্ড অ্যাপারেলস এ চাকরি খুঁজে নেয় এবং নিজের চেষ্টায় সাধারণ হেলপার থেকে সুইং অপারেটর হয়ে ওঠে। সবদিক বিবেচনা করে জমিলা নিজের নিরাপত্তা ও একটা সুখের সংসারের জন্য রতনকে বিয়ে করে। করিৎকর্মা এ রতন ছিল লোভী। সে জমিলাকে বিদেশে পাঠিয়ে একদিকে যেমন জমিলাকে যেমন অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে ঠিক তেমনি তার কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছে আর একদিন প্রবাসের নারকীয় জীবন থেকে মুক্ত হয়ে দেশে এসেছে তখন সে তার স্বামী রতনকে দেখেছে অন্যভাবে। সে আরেকটা বিয়ে করেছে এবং তাকে গ্রহণ করতে যেমন অস্বীকার করছে অন্যদিকে বিদেশ থেকে পাঠানো জমিলার অর্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছে। জমিলা এর প্রতিকার চেয়ে কোর্টে মামলা করেছে রতন এর প্রতিপক্ষ হয়ে। জমিলার যে রূপ গল্পে গল্পকার তুলে ধরেছেন তা আজ রতনের মতো লম্পট পাষণ্ডের অন্তরাত্মাও কেঁপে উঠেছে। মামলার ফল কি হবে তা জানা না গেলেও জমিলাকে প্রকৃত প্রতিপক্ষ হিসেবে ঠিকই দাঁড় করাতে পেরেছেন।
‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থের সর্বশেষ গল্প। গল্পটা বর্তমান সময়ে গার্মেন্টস কোম্পানিতে কাজ করা এক অসহায় মেয়ের সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। গল্পের প্রধান চরিত্র গার্মেন্টস কর্মী কলমিকে একরকম স্বামী সিএনজি চালক দুলালকে নিয়ে দুলালের ২য় স্ত্রী হিসেবে সংসার করতে দেখা যায়। গল্পে স্বামী হিসেবে দুলালকে দায়িত্ববান হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংসার তাদের ভালোই চলছিল কিন্তু একদিন দুলাল এক্সিডেন্ট করে যখন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল তখন তাকে সারিয়ে তুলতে কলমিকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয়ভার এত বেশি যে তার সংকুলান করা কলমির জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। টাকার জন্য সে গার্মন্টস ফ্যাক্টরিতে ২৫০০০ টাকা অগ্রিমও চেয়েছে কিন্তু পায়নি ফলে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে সে সহকর্মী রাজিয়ার মাধ্যমে আকমল সিকদারের কাছ থেকে ২৫০০০ টাকা পাবার প্রতিশ্রæতি পায়। আকমল সিকদার একজন নারী লোভী মানুষ। সেও একজন গার্মেন্টস কর্মী ছিল। পরে জুটের ব্যবসা ও সাব-কন্ট্রাক্টারি করে সে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে উঠে। তাই সে গার্মেন্টস মহিলা কর্মীদের একদিকে সাহায্য করলেও অন্যদিকে মেয়েদের ভোগের সামগ্রী করে সর্বস্ব লুটে নিত। কলমির এর ক্ষেত্রেও তার কার্পণ্য হয়নি। একসময়ের কঠিন ও সৎ চরিত্রের কলমির অসহায়ত্ব ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আকমল সিকদারও তার সর্বস্ব তথা সম্ভ্রম লুটে নিয়েছে। সারাদিনের হাঁড়ভাঙা পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ মুছতে আকমল তাকে সেন্টের সুরভীতে ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই সৌরভ কলমির মনকে ছুঁতে পারেনি অচেনা এক পরপুরুষের গন্ধ তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে। ঝুম বৃষ্টিতে আকমল সাহেবের দেয়া সেন্টের গন্ধ হয়তো ধুয়ে যাবে কিন্তু পরপুরুষের যে সৌরভ নিয়ে সে দুলালের কাছে যাচ্ছে তা দুলালের কাছে চিরদিনই অচেনা থেকে যাবে।

চার. প্রায় ৬ ফর্মার ‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থের সাদামাটা, দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। প্রকাশিত হয়েছে ‘কারুবাক’ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লক্স ২৫৩- ২৫৪, ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক কাঁটাবন, ঢাকা থেকে। মুদ্রিত হয়েছে ওমাসিস প্রিন্টার্স এ। মুদ্রণ স্বচ্ছ হলেও ছাপাখানার ভূত তাড়াতে পারেনি। ফলে বানান ভুল রয়েছে অনেক জায়গায়। মুদ্রণে আরো মনোযোগী হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। গল্পগ্রন্থের ৭টি গল্পই ছোট গল্পের আদল পেয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজের সমসাময়িক সমাজ জীবনের বাস্তব ঘটনাবলি গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পকার প্রতিটা গল্প তার লেখনীর মুন্সিয়ানায় জীবন্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পের শেষ গল্প ‘অচেনা সৌরভ’ গল্পগ্রন্থের প্রাণ। গল্পের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে গল্পের ও গল্পগ্রন্থের নামকরণ যথার্থ হয়েছে বলে অনুমিত হয়। আমি উক্ত গল্পগ্রন্থের পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি।

রূপক বর