8:51 pm, Sunday, 22 December 2024

জার্মানির রূপকথা : একটি স্বর্ণখণ্ডও হ্যান্স

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৫:৩৮:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 327 ভিউ
শেয়ার করুন

আবু রেজা

হ্যান্স সাত বছর ধরে তার মনিবের কাজ করছে। তাই এবার সে মনিবকে বলল, আমার চুক্তি শেষ হয়েছে। এবার আমি বাড়ি ফিরতে চাই। আমি আমার মায়ের কাছে যাব। আপনি আমার মজুরি দিয়ে দিন।
মনিব বললেন, তুমি বিশ্বস্ততা আর সততার সঙ্গে কাজ করেছ। তোমার এই কাজের জন্য তোমাকে পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই বলে মনিব হ্যান্সকে একখণ্ড স্বর্ণ দিলেন, যা দেখতে ঠিক হ্যান্সের মাথার সমান বড়। হ্যান্স পকেট থেকে একটা রুমাল বের করল। স্বর্ণখণ্ডটি এর মধ্যে বাঁধল, পুটলিটি কাঁধে তুলে নিল। তারপর বাড়ির পথে রওনা হলো।
হ্যান্স পথ চলতে খেয়াল করে দেখল, সে সব সময় অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। সে আরো দেখল, এক তরুণ ঘোড়সওয়ার একটা টগবগে ঘোড়ায় চড়ে বেশ দুলকি চালে উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে চলছে। হ্যান্স তার উদ্দেশে উচ্চস্বরে বলল, আহ্ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলাকী মজা! ঘোড়ার পিঠে, ঠিক যেন চেয়ারের উপর বসে আছ। পাথরে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা নেই। জুতাও নষ্ট হবে না। কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছ তা টেরই পাবে না।
ঘোড়সওয়ার তরুণ তার কথা শুনে ঘোড়া থামাল। বলল, হ্যালো, তুমি কেন পায়ে হেঁটে যাচ্ছ?
হ্যান্স বলল, আমাকে তো যেতেই হবে। কেননা, আমার তো ঘোড়া নেই। আমাকে এই পুটলিটা নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। এটা সত্য যে, এর ভিতরে আছে একটা স্বর্ণখণ্ড। এ কারণে আমি মাথা সোজা করে থাকতে পারছি না। এজন্য এটাকে আমার কাঁধে রাখতে হচ্ছে।

ঘোড়সওয়ার বলল, আমি বলি কি, আস আমরা বদলা-বদলি করি। আমি তোমাকে আমার ঘোড়াটা দেব। এর বিনিময়ে তুমি স্বর্ণখণ্ডটি আমাকে দেবে।
হ্যান্স বলল, আমি মন থেকে তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করছি। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটা এতটা ভারি যে এটা নিয়ে তোমাকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হবে।
গোড়সওয়ার নামল, স্বর্ণখণ্ডটি নিয়ে নিল। এরপর হ্যান্সকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করল। ঘোড়ার লাগাম তার হাতে দিয়ে দিল। বলল, যদি তুমি দ্রুত গতিতে ছুটতে চাও তবে তোমাকে জিহ্বা দিয়ে তালুতে আঘাত করে টক টক করে শব্দ করতে হবে, আর বলতে হবে যাহ্ যাহ্।
হ্যান্স পরম আনন্দে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ চলার পর সে ভাবল আরো দ্রুত গতিতে চলা উচিত। সে জিহ্বা দিয়ে তালুতে আঘাত করে টকটক শব্দ করল আর বলল যাহ্ যাহ। ঘোড়াটা চলার গতি বাড়িয়ে দিল। হ্যান্স ছিটকে সড়ক আর ক্ষেতের মাঝে খাদে গিয়ে পড়ল। এক পথচারী একটি গাভি নিয়ে এই পথ দিয়ে এদিকেই আসছিল। সে না থামালে ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যেত।

এদিকে ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে হ্যান্সের হাত-পায়ের অবস্থা এমন হয়েছে যে ওর মনে হচ্ছে ওগুলো অকেজো হয়ে গেছে। তবুও সে পায়ের উপর ভর দিয়ে কোনো রকমে দাঁড়াল। এই বিড়ম্বনার জন্য সে খুব বিরক্ত। সে পথচারীকে বলল, এই ঘোড়ায় চড়া একটা বাজে ব্যাপার। যখন কেউ এরকম একটা মাদি ঘোড়ায় চড়ে তখন তা বাজে ধরনের ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়। যদি ঘোড়টা লাফিয়ে আরোহীকে ফেলে দেয়, তবে আরোহীর হাত-পা কিম্বা কাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি আর কখনো এই ঘোড়ার চড়ব না। এখন তোমার এই গাভীটাকে আমার পছন্দ। আমি এর পেছনে শান্তভাবে হাঁটতে পারব। প্রতিদিন দুধ, মাখন আর পনির পাওয়া যাবে। এরকম একটা গাভীর জন্য আমি যে কোনো কিছু দিতে পারি।
পথচারী বলল, ঠিক আছে, আমি এই গাভীটা তোমাকে দিয়ে দেব। এর বিনিময়ে আমার ঘোড়াটা চাই।
হ্যান্স এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। পথচারী গাভিটা হ্যান্সকে দিয়ে লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসল। তারপর দ্রুত চলে গেল।

হ্যান্স এগিয়ে চলল। পিছন পিছন খুব শান্তভাবে যাচ্ছে গাভিটা। আর সে ভাবছিল ঘোড়া দিয়ে গাভি বিনিময়ে লাভের কথা। সে ভাবছে, ‘আমার যদি এক টুকরা খাবারও থাকে, কিংবা তাও না থাকে তো কোনো অসুবিধা নেই। যখন খুশি তখন আমি মাখন খেতে পারব। পনির খেতে পারব। আমি পিপাসা পেলে গাভির দুধ দুইয়ে দুধ পান করতে পারব। আর কি চাই?’
নানা কিছু ভাবতে ভাবতে একটা সরাইখানার কাছে এসে হ্যান্স থামল। তার কাছে যা কিছু টাকা-পয়সা তা দিয়ে রাতের এখানে খাবার খেয়ে নিল। অল্প অর্থের বিনিময়ে আধা গ্লাস পানীয় গ্রহণ করল। তারপর গাভিটিকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। সেই গ্রামে আছে তার মা।
মধ্য দুপুরের কাছাকাছি সময়। খুবই অসহনীয় গরম। এমন সময়ে সে এসে পৌঁছল একটা বিরান ভূমিতে। এই এলাকাটা পাড়ি দিতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগবে। কিন্তু খুব পিপাসা লেগেছে। পিপাসায় জিহ্বা শুকিয়ে মুখের তালুতে লেগে গেছে। হ্যান্স ভাবল। আমি খুব সহজেই পিপাসা মেটাতে পারি। আমি এখন গাভির দুধ দোয়াব। সেই দুধ পান করে পিপাসা মিটাব।

এসব কথা ভেবে সে একটা মরা গাছে গাভিটাকে বাঁধল। তার সঙ্গে কোনো পাত্র না থাকায় সে তার চামড়ার টুপিটা গাভির নিচে ধরল। তারপর দুধ দোয়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করল। কিন্তু এক ফোটা দুধও পেল না। তারপরও সে জোর চেষ্টা চালাতে লাগল। গাভিটা অধৈর্য্য হয়ে তার মাথায় একটা লাথি বসিয়ে দিল। লাথি খেয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অনেক ক্ষণ পর্যন্ত সে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রইল। এমনকি অনেক ক্ষণ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারল না সে কোথায় আছে।
সে সময় এ পথ দিয়ে ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল এক কসাই। ঠেলাগাড়ির মধ্যে শুয়ে ছিল একটা তাগড়া শূকর। হ্যান্স চিৎকার করে বলে উঠল, এটা কেমন ধরনের চালাকি? ঘোড়া নিয়ে অবাধ্য একটা গাভি দিয়ে চলে গেল। আর সেই গাভিটা দুধ দোয়াতে দেয় না। একটুও দুধ পেলাম না।
কসাই হ্যান্সকে উঠতে সহায়তা করল। তারপর হ্যান্স কসাইকে সব ঘটনা খুলে বলল। কসাই তার ফ্লাক্সটা হ্যান্সের হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই নাও, একটু চা পান কর, তাহলে সতেজ হবে। এই গাভিটি কখনোই দুধ দেবে না। কারণ, গাভিটি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। এটা একমাত্র চাষবাসের কাজে লাগবে। আর না হয় কসাইয়ের কাজে লাগবে।

ভালো খুব ভালো, ভালো মানুষ পেয়ে লোকটা আমাকে ঠকাল হ্যান্স বলল। তারপর কিছুক্ষণ দম নিয়ে হ্যান্স মাথায় হাত বুলিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলল, এটা কে ভেবে দেখেছিল? আমি তো এটা ভেবে দেখিনি। যার মাংস প্রয়োজন, সে এই পশুটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কেটে-কুটে মাংস খেতে পারবে। তার জন্য এটা খুব ভালো। কিন্তু আমি মাংস খেতে খুব একটা পছন্দ করি না। এটা আমার জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। এর চেয়ে একটা তাগড়া শূকর আমার খুব প্রয়োজন। এর সাদ সম্পূর্ণ আলাদা। শূকর থেকে অনেক সসেজ তৈরি করা যায়।
কসাই বলল, শোন, শুধু তোমার খাতিরে আমি এই অদল-বদল মেনে নিতে পারি, এই গাভির বদলে শূকরটা তোমাকে দিয়ে দিব।
হ্যান্স বলল, তুমি মহান। ঈশ্বর তোমার ভালো করবেন। এই বলে হ্যান্স কসাইকে গাভিটা দিয়ে দিল। তারপর ঠেলাগাড়ি থেকে শূকরের বাঁধন খুলে ফেলল। শূকরের গলায় বাঁধা দড়িটা তুলে নিল নিজ হাতে।

হ্যান্স এগিয়ে চলল। নিজে নিজে ভাবল, কীভাবে সব কিছু তার প্রত্যাশা মতো হয়ে যাচ্ছে। যখনই সে কোনো বিড়ম্বনার মুখোমুখি হচ্ছে, তখনই তার একটা সুষ্ঠু সুরাহা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পথচারী একটি সাদা রাজহাস নিয়ে হাজির হলো তার কাছে। তারা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাল। তারপর হ্যান্স তার সৌভাগ্যের কথা বলতে লাগল। কীভাবে সে প্রতিবারই দরকষাকষি করে একটার বদলে আরেকটা ভালো জিনিস বদলে নিচ্ছে।
পথচারী লোকটি তাকে বলল, একটা নামকরণ উৎসবের খাওয়া-দাওয়ার জন্য আমি এই রাজহাঁসটি নিয়ে যাচ্ছি। সে আরো বলল, এই রাজহাঁসটিকে হাতে নিয়ে দেখুন, পাখা দুটি ধরে তুলে ধরুন, দেখুন কত ভারি! গত আট সপ্তাহ ধরে এটাকে খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়েছে। এই রাজহাঁসের রোস্টে যে কামড় বসাবে তার মুখ রসে ভরে যাবে।
হ্যান্স রাজহাঁস হাতে নিয়ে দেখল। বলল, হ্যাঁ, এটা বেশ ভারী। কিন্তু আমার শূকরটাও খারাপ নয়।

এমন সময়ে সে পথচারী সন্দেহের দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। সে বলল, আমার মনে হয় তোমার এই শূকর নিয়ে একটা ঝামেলা আছে। আমি যে শহর পেরিয়ে এলাম, সেই শহরের মেয়রের খোয়াড় থেকে একটা শূকর চুরি হয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে, আপনার শূকরটাই সেই চুরি হওয়া শূকর। মেয়র কিছু লোককে শূকরটা খুঁজতে পাঠিয়েছে। এ দিকে দেখ, মনে হয় সেই লোকগুলোই আসছে। যদি তোমাকে শূকরটসহ ধরতে পারে তো তোমার অবস্থা খুব খারাপ হবে। সব শেষে তোমাকে অন্ধকার কুঠুরিতে কারাবন্দি করে রাখা হবে।
ভালো মানুষ হ্যান্স এ কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে বলল, হে ঈশ্বর আমাকে সাহায্য কর, আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। তুমি আমার চেয়ে এ জায়গাটা ভালো চেনো। তুমি আমার শূকরটা নিয়ে চলে যাও। আর তোমার রাজহাঁসটা আমাকে দাও।
পথচারী বলল, এই কাজে ঝুঁকি আছে। তবুও আমি তোমাকে বিপদে পড়তে দেব না। এই বলে সে শূকরের গলায় বাঁধা দড়িটা হাঁতে নিল। তারপররাজহাঁসটা হ্যান্সকে দিয়ে শূকরটা নিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথ ধরে চলে গেল।

ভালো মানুষ হ্যান্স যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। রাজহাঁসটা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে চলল। সে আনমনে বলল, আমি ভেবে-চিন্তে যে সিদ্ধান্ত নিই, তাতে আমি লাভবান হই। শূকরের বিনিময়ে রাজহাঁসটা পেয়ে আমার লাভ হয়েছে। প্রথমত রাজহাঁসটা থেকে রোস্ট করার মতো মাংস পাওয়া যাবে। এর থেকে প্রচুর চর্বি পাওয়া যাবে, যা দিয়ে প্রায় তিন মাস রুটি ভাজা যাবে। এছাড়া আছে সাদা সাদা সুন্দর পালক, যা আমি বালিশে ভরতে পারব। সেই বালিশে আমি আরামে ঘুমাতে পারব। এগুলো পেয়ে আমার মা কত খুশি হবে!
হ্যান্স সবশেষে যে শহর পার হচ্ছিল সেখানে দেখতে পেল, একটা চাকাওয়ালা যন্ত্রসহ দাঁড়িয়ে আছে এক ছুরি-কাঁচি ধার করার কারিগর। ছুরি-কাঁচি ধার বলে অনেকে তাকে বলে শানওয়ালা। সে ছুরি-কাঁচি ধার করার চাকা ঘুরাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছেÑ
ছুরি-কাঁচি ধার করাবেন ধার,
ছুরি-কাঁচি ধার করাবেন ধার।

হ্যান্স ঠায় দাঁড়িয়ে গেল, তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখল। অবশেষে তার সঙ্গে কথা বলল। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার দিনকাল খুব ভালোই চলছে না? তুমি ছুরি-কাঁচি ধার করার যন্ত্র চালিয়ে বেশ সুখে আছ?

 

শানওয়ালা বলল, হ্যাঁ, এই ব্যবসায় সোনালি অতীত আছে, ঐতিহ্য আছে। প্রকৃত পক্ষে ছুরি-কাঁচি কারিগর এমন মানুষ, যার পকেটে হাত দিলে পাবে সোনাদানা। সে কথা থাক। তুমি বল, সুন্দর রাজহাঁসটা কোথা থেকে কিনেছ?

হ্যান্স বলল, আমি এটা কিনি নি। শূকরের বিনিময়ে আমি এটা পেয়েছি।

শানওয়ালা বলল, শূকরটা কীভাবে পেয়েছিলে?

হ্যান্স বলল, সেটা পেয়েছিলাম একটা গাভির বিনিময়ে।

শানওয়ালা বলল, গাভিটা কীভাবে পেলে?

হ্যান্স বলল, সেটা পেয়েছিলাম একটা ঘোড়ার বিনিময়ে।

শানওয়ালা বলল, ঘোড়াটা কীভাবে পেলে?

হ্যান্স বলল, এর বিনিময়ে আমি দিয়েছিলাম আমার মাথার সমান বড় একটা স্বর্ণখণ্ড।

শানওয়ালা বলল, স্বর্ণখণ্ড কীভাবে পেলে?

হ্যান্স বলল, সেটা দিল আমার সাত বছরের কাজের মজুরি।

 

শানওয়ালা বলল, তুমি প্রতিবারই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনেক বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর বুদ্ধি খাটিয়ে ভালো ভালো জিনিস জিতে নিয়েছ। তুমি যদি তোমার পকেটে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি শুনতে চাও, তাহলে তোমার ভাগ্য তোমাকেই গড়তে হবে।

হ্যান্সি জানতে চাইল, আমি তা কীভাবে গড়ব?

শানওয়ালা বলল, তোমাকে আমার মতো ছুরি-কাঁচি ধার করার কারিগর হতে হবে। এজন্য তোমার তেমন কিছুই প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র তোমার একটা ছুরি-কাঁচি ধার করার যন্ত্র থাকতে হবে। এই ধর, আমার যেমন আছে। অবশ্য এটা খুব কম দিন ব্যবহৃত হয়েছে। তুমি এটা নিতে পারো। এর বিনিময়ে শুধুমাত্র তোমার রাজহাঁসটা আমাকে দিতে হবে। এছাড়া তেমন কিছুই দিতে হবে না। তুমি কি এটা নিতে চাও?

হ্যান্স বলল, তুমি এমন করে কেন বলছ? যদি পকেটে হাত দিলে টাকা পাই, তবে আমি হব পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। আমি আর অর্থেকষ্টে ভুগতে চাই না। এই বলে হ্যান্স তাকে রাজহাঁসটা দিয়ে দিল। এর বিনিময়ে ছুরি-কাঁচি ধার করার পাথর ও যন্ত্রটা নিয়ে নিল।

 

শানওয়ালার কাছে ছিল একটা সাধারণ বড় পাথর। শানওয়ালা বলল, এখানে তোমার জন্য আছে একটা বড় পাথর। এর উপর তুমি হাতুড়ি চালাতে পারবে। পেরেক ঠুকতে পারবে। পেরেক, গজাল, তারকাটা সোজা করতে পারবে। বুড়ো নখ ঘসে পলিশ করতে পারবে। এটা তুমি নাও, খুব যত্ন করে রেখে দাও।

হ্যান্স পাথরটাও নিয়ে নিল। তারপর পরিতৃপ্তি নিয়ে এগিয়ে চলল। তার চোখ দুটোতে দেখা যাচ্ছিল আনন্দের ঝিলিক। সে চিৎকার করে বলছিল, আমি নিশ্চয়ই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলাম। আমি যা চাচ্ছি আমার জীবনে তাই ঘটছে যেন আমি সৌভাগ্যের বরপুত্র।

সেই ভোর বেলা থেকে এখন পর্যন্ত সে পায়ের উপর চলছে। কোথাও একটু সময়ের জন্যও বসেনি। সে এখন খুব ক্লান্ত। খুব ক্ষুধাও পেয়েছে। দর কষাকষি করে সে যখন গাভিটা জিতেছিল, তখন খুশিতে সব খাবার একবারে খেয়ে নিয়েছিল। অনেক কষ্টে সে এগিয়ে চলল। তবে প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল এখন তাকে থামতে হবে। পাথরটির অত্যধিক ভারে সে ভীষণ নুয়ে পড়ছিল। সে ভাবছিল, যদি তাকে এসব ভার বহন করতে না হতো তবে অনেক ভালো হতো।

 

হ্যান্স অবশেষে শামুকের মতো হামাগুড়ি দিয়ে মাঠের মধ্যে একটা কুয়োর ধারে গেল। সে ভাবল এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবে। ঠান্ডা পানিতে নিজেকে কিছুটা সতেজ করবে। সে কুয়োর ধারে গিয়ে ধিরেসুস্থে পাথরের বোঝা নামিয়ে রাখল। তারপর সে এর পাশে বসল। সে ঝুঁকে পড়ে পানি খেল। এরপর পাথরে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ছুরি-কাঁচি ধার করার যন্ত্র ও পাথরখণ্ডÑ এ দুটোই তার শরীরের চাপে পানিতে পড়ে গেল। হ্যান্স যখন নিজ চোখে এগুলোকে পানিতে তলিয়ে যেতে দেখল, তখন সে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ওই ভারী পাথরখণ্ড হ্যান্সকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তা থেকে মুক্ত করার জন্য জলভরা চোখে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল। তাকে অনুগ্রহ করা ও সুপথ দেখানোর জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাল। আর নিজেকে নিন্দা জানানো ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।

হ্যান্স গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো সৌভাগ্যবান মানুষ নেই। এই বলে হ্যান্স ফুরফুরে মনে সূর্যের নিচে দৌড়ে দৌড়ে ছুটতে লাগল গাঁয়ের পথে, যতক্ষণ না সে বাড়িতে পৌঁছল মায়ের কাছে।

#
জনপ্রিয়

জার্মানির রূপকথা : একটি স্বর্ণখণ্ডও হ্যান্স

আপডেটের সময় : ০৫:৩৮:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

আবু রেজা

হ্যান্স সাত বছর ধরে তার মনিবের কাজ করছে। তাই এবার সে মনিবকে বলল, আমার চুক্তি শেষ হয়েছে। এবার আমি বাড়ি ফিরতে চাই। আমি আমার মায়ের কাছে যাব। আপনি আমার মজুরি দিয়ে দিন।
মনিব বললেন, তুমি বিশ্বস্ততা আর সততার সঙ্গে কাজ করেছ। তোমার এই কাজের জন্য তোমাকে পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই বলে মনিব হ্যান্সকে একখণ্ড স্বর্ণ দিলেন, যা দেখতে ঠিক হ্যান্সের মাথার সমান বড়। হ্যান্স পকেট থেকে একটা রুমাল বের করল। স্বর্ণখণ্ডটি এর মধ্যে বাঁধল, পুটলিটি কাঁধে তুলে নিল। তারপর বাড়ির পথে রওনা হলো।
হ্যান্স পথ চলতে খেয়াল করে দেখল, সে সব সময় অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। সে আরো দেখল, এক তরুণ ঘোড়সওয়ার একটা টগবগে ঘোড়ায় চড়ে বেশ দুলকি চালে উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে চলছে। হ্যান্স তার উদ্দেশে উচ্চস্বরে বলল, আহ্ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলাকী মজা! ঘোড়ার পিঠে, ঠিক যেন চেয়ারের উপর বসে আছ। পাথরে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা নেই। জুতাও নষ্ট হবে না। কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছ তা টেরই পাবে না।
ঘোড়সওয়ার তরুণ তার কথা শুনে ঘোড়া থামাল। বলল, হ্যালো, তুমি কেন পায়ে হেঁটে যাচ্ছ?
হ্যান্স বলল, আমাকে তো যেতেই হবে। কেননা, আমার তো ঘোড়া নেই। আমাকে এই পুটলিটা নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। এটা সত্য যে, এর ভিতরে আছে একটা স্বর্ণখণ্ড। এ কারণে আমি মাথা সোজা করে থাকতে পারছি না। এজন্য এটাকে আমার কাঁধে রাখতে হচ্ছে।

ঘোড়সওয়ার বলল, আমি বলি কি, আস আমরা বদলা-বদলি করি। আমি তোমাকে আমার ঘোড়াটা দেব। এর বিনিময়ে তুমি স্বর্ণখণ্ডটি আমাকে দেবে।
হ্যান্স বলল, আমি মন থেকে তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করছি। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটা এতটা ভারি যে এটা নিয়ে তোমাকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হবে।
গোড়সওয়ার নামল, স্বর্ণখণ্ডটি নিয়ে নিল। এরপর হ্যান্সকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করল। ঘোড়ার লাগাম তার হাতে দিয়ে দিল। বলল, যদি তুমি দ্রুত গতিতে ছুটতে চাও তবে তোমাকে জিহ্বা দিয়ে তালুতে আঘাত করে টক টক করে শব্দ করতে হবে, আর বলতে হবে যাহ্ যাহ্।
হ্যান্স পরম আনন্দে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ চলার পর সে ভাবল আরো দ্রুত গতিতে চলা উচিত। সে জিহ্বা দিয়ে তালুতে আঘাত করে টকটক শব্দ করল আর বলল যাহ্ যাহ। ঘোড়াটা চলার গতি বাড়িয়ে দিল। হ্যান্স ছিটকে সড়ক আর ক্ষেতের মাঝে খাদে গিয়ে পড়ল। এক পথচারী একটি গাভি নিয়ে এই পথ দিয়ে এদিকেই আসছিল। সে না থামালে ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যেত।

এদিকে ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে হ্যান্সের হাত-পায়ের অবস্থা এমন হয়েছে যে ওর মনে হচ্ছে ওগুলো অকেজো হয়ে গেছে। তবুও সে পায়ের উপর ভর দিয়ে কোনো রকমে দাঁড়াল। এই বিড়ম্বনার জন্য সে খুব বিরক্ত। সে পথচারীকে বলল, এই ঘোড়ায় চড়া একটা বাজে ব্যাপার। যখন কেউ এরকম একটা মাদি ঘোড়ায় চড়ে তখন তা বাজে ধরনের ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়। যদি ঘোড়টা লাফিয়ে আরোহীকে ফেলে দেয়, তবে আরোহীর হাত-পা কিম্বা কাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি আর কখনো এই ঘোড়ার চড়ব না। এখন তোমার এই গাভীটাকে আমার পছন্দ। আমি এর পেছনে শান্তভাবে হাঁটতে পারব। প্রতিদিন দুধ, মাখন আর পনির পাওয়া যাবে। এরকম একটা গাভীর জন্য আমি যে কোনো কিছু দিতে পারি।
পথচারী বলল, ঠিক আছে, আমি এই গাভীটা তোমাকে দিয়ে দেব। এর বিনিময়ে আমার ঘোড়াটা চাই।
হ্যান্স এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। পথচারী গাভিটা হ্যান্সকে দিয়ে লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসল। তারপর দ্রুত চলে গেল।

হ্যান্স এগিয়ে চলল। পিছন পিছন খুব শান্তভাবে যাচ্ছে গাভিটা। আর সে ভাবছিল ঘোড়া দিয়ে গাভি বিনিময়ে লাভের কথা। সে ভাবছে, ‘আমার যদি এক টুকরা খাবারও থাকে, কিংবা তাও না থাকে তো কোনো অসুবিধা নেই। যখন খুশি তখন আমি মাখন খেতে পারব। পনির খেতে পারব। আমি পিপাসা পেলে গাভির দুধ দুইয়ে দুধ পান করতে পারব। আর কি চাই?’
নানা কিছু ভাবতে ভাবতে একটা সরাইখানার কাছে এসে হ্যান্স থামল। তার কাছে যা কিছু টাকা-পয়সা তা দিয়ে রাতের এখানে খাবার খেয়ে নিল। অল্প অর্থের বিনিময়ে আধা গ্লাস পানীয় গ্রহণ করল। তারপর গাভিটিকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। সেই গ্রামে আছে তার মা।
মধ্য দুপুরের কাছাকাছি সময়। খুবই অসহনীয় গরম। এমন সময়ে সে এসে পৌঁছল একটা বিরান ভূমিতে। এই এলাকাটা পাড়ি দিতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগবে। কিন্তু খুব পিপাসা লেগেছে। পিপাসায় জিহ্বা শুকিয়ে মুখের তালুতে লেগে গেছে। হ্যান্স ভাবল। আমি খুব সহজেই পিপাসা মেটাতে পারি। আমি এখন গাভির দুধ দোয়াব। সেই দুধ পান করে পিপাসা মিটাব।

এসব কথা ভেবে সে একটা মরা গাছে গাভিটাকে বাঁধল। তার সঙ্গে কোনো পাত্র না থাকায় সে তার চামড়ার টুপিটা গাভির নিচে ধরল। তারপর দুধ দোয়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করল। কিন্তু এক ফোটা দুধও পেল না। তারপরও সে জোর চেষ্টা চালাতে লাগল। গাভিটা অধৈর্য্য হয়ে তার মাথায় একটা লাথি বসিয়ে দিল। লাথি খেয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অনেক ক্ষণ পর্যন্ত সে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রইল। এমনকি অনেক ক্ষণ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারল না সে কোথায় আছে।
সে সময় এ পথ দিয়ে ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল এক কসাই। ঠেলাগাড়ির মধ্যে শুয়ে ছিল একটা তাগড়া শূকর। হ্যান্স চিৎকার করে বলে উঠল, এটা কেমন ধরনের চালাকি? ঘোড়া নিয়ে অবাধ্য একটা গাভি দিয়ে চলে গেল। আর সেই গাভিটা দুধ দোয়াতে দেয় না। একটুও দুধ পেলাম না।
কসাই হ্যান্সকে উঠতে সহায়তা করল। তারপর হ্যান্স কসাইকে সব ঘটনা খুলে বলল। কসাই তার ফ্লাক্সটা হ্যান্সের হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই নাও, একটু চা পান কর, তাহলে সতেজ হবে। এই গাভিটি কখনোই দুধ দেবে না। কারণ, গাভিটি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। এটা একমাত্র চাষবাসের কাজে লাগবে। আর না হয় কসাইয়ের কাজে লাগবে।

ভালো খুব ভালো, ভালো মানুষ পেয়ে লোকটা আমাকে ঠকাল হ্যান্স বলল। তারপর কিছুক্ষণ দম নিয়ে হ্যান্স মাথায় হাত বুলিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলল, এটা কে ভেবে দেখেছিল? আমি তো এটা ভেবে দেখিনি। যার মাংস প্রয়োজন, সে এই পশুটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কেটে-কুটে মাংস খেতে পারবে। তার জন্য এটা খুব ভালো। কিন্তু আমি মাংস খেতে খুব একটা পছন্দ করি না। এটা আমার জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। এর চেয়ে একটা তাগড়া শূকর আমার খুব প্রয়োজন। এর সাদ সম্পূর্ণ আলাদা। শূকর থেকে অনেক সসেজ তৈরি করা যায়।
কসাই বলল, শোন, শুধু তোমার খাতিরে আমি এই অদল-বদল মেনে নিতে পারি, এই গাভির বদলে শূকরটা তোমাকে দিয়ে দিব।
হ্যান্স বলল, তুমি মহান। ঈশ্বর তোমার ভালো করবেন। এই বলে হ্যান্স কসাইকে গাভিটা দিয়ে দিল। তারপর ঠেলাগাড়ি থেকে শূকরের বাঁধন খুলে ফেলল। শূকরের গলায় বাঁধা দড়িটা তুলে নিল নিজ হাতে।

হ্যান্স এগিয়ে চলল। নিজে নিজে ভাবল, কীভাবে সব কিছু তার প্রত্যাশা মতো হয়ে যাচ্ছে। যখনই সে কোনো বিড়ম্বনার মুখোমুখি হচ্ছে, তখনই তার একটা সুষ্ঠু সুরাহা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পথচারী একটি সাদা রাজহাস নিয়ে হাজির হলো তার কাছে। তারা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাল। তারপর হ্যান্স তার সৌভাগ্যের কথা বলতে লাগল। কীভাবে সে প্রতিবারই দরকষাকষি করে একটার বদলে আরেকটা ভালো জিনিস বদলে নিচ্ছে।
পথচারী লোকটি তাকে বলল, একটা নামকরণ উৎসবের খাওয়া-দাওয়ার জন্য আমি এই রাজহাঁসটি নিয়ে যাচ্ছি। সে আরো বলল, এই রাজহাঁসটিকে হাতে নিয়ে দেখুন, পাখা দুটি ধরে তুলে ধরুন, দেখুন কত ভারি! গত আট সপ্তাহ ধরে এটাকে খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়েছে। এই রাজহাঁসের রোস্টে যে কামড় বসাবে তার মুখ রসে ভরে যাবে।
হ্যান্স রাজহাঁস হাতে নিয়ে দেখল। বলল, হ্যাঁ, এটা বেশ ভারী। কিন্তু আমার শূকরটাও খারাপ নয়।

এমন সময়ে সে পথচারী সন্দেহের দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। সে বলল, আমার মনে হয় তোমার এই শূকর নিয়ে একটা ঝামেলা আছে। আমি যে শহর পেরিয়ে এলাম, সেই শহরের মেয়রের খোয়াড় থেকে একটা শূকর চুরি হয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে, আপনার শূকরটাই সেই চুরি হওয়া শূকর। মেয়র কিছু লোককে শূকরটা খুঁজতে পাঠিয়েছে। এ দিকে দেখ, মনে হয় সেই লোকগুলোই আসছে। যদি তোমাকে শূকরটসহ ধরতে পারে তো তোমার অবস্থা খুব খারাপ হবে। সব শেষে তোমাকে অন্ধকার কুঠুরিতে কারাবন্দি করে রাখা হবে।
ভালো মানুষ হ্যান্স এ কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে বলল, হে ঈশ্বর আমাকে সাহায্য কর, আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। তুমি আমার চেয়ে এ জায়গাটা ভালো চেনো। তুমি আমার শূকরটা নিয়ে চলে যাও। আর তোমার রাজহাঁসটা আমাকে দাও।
পথচারী বলল, এই কাজে ঝুঁকি আছে। তবুও আমি তোমাকে বিপদে পড়তে দেব না। এই বলে সে শূকরের গলায় বাঁধা দড়িটা হাঁতে নিল। তারপররাজহাঁসটা হ্যান্সকে দিয়ে শূকরটা নিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথ ধরে চলে গেল।

ভালো মানুষ হ্যান্স যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। রাজহাঁসটা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে চলল। সে আনমনে বলল, আমি ভেবে-চিন্তে যে সিদ্ধান্ত নিই, তাতে আমি লাভবান হই। শূকরের বিনিময়ে রাজহাঁসটা পেয়ে আমার লাভ হয়েছে। প্রথমত রাজহাঁসটা থেকে রোস্ট করার মতো মাংস পাওয়া যাবে। এর থেকে প্রচুর চর্বি পাওয়া যাবে, যা দিয়ে প্রায় তিন মাস রুটি ভাজা যাবে। এছাড়া আছে সাদা সাদা সুন্দর পালক, যা আমি বালিশে ভরতে পারব। সেই বালিশে আমি আরামে ঘুমাতে পারব। এগুলো পেয়ে আমার মা কত খুশি হবে!
হ্যান্স সবশেষে যে শহর পার হচ্ছিল সেখানে দেখতে পেল, একটা চাকাওয়ালা যন্ত্রসহ দাঁড়িয়ে আছে এক ছুরি-কাঁচি ধার করার কারিগর। ছুরি-কাঁচি ধার বলে অনেকে তাকে বলে শানওয়ালা। সে ছুরি-কাঁচি ধার করার চাকা ঘুরাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছেÑ
ছুরি-কাঁচি ধার করাবেন ধার,
ছুরি-কাঁচি ধার করাবেন ধার।

হ্যান্স ঠায় দাঁড়িয়ে গেল, তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখল। অবশেষে তার সঙ্গে কথা বলল। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার দিনকাল খুব ভালোই চলছে না? তুমি ছুরি-কাঁচি ধার করার যন্ত্র চালিয়ে বেশ সুখে আছ?

 

শানওয়ালা বলল, হ্যাঁ, এই ব্যবসায় সোনালি অতীত আছে, ঐতিহ্য আছে। প্রকৃত পক্ষে ছুরি-কাঁচি কারিগর এমন মানুষ, যার পকেটে হাত দিলে পাবে সোনাদানা। সে কথা থাক। তুমি বল, সুন্দর রাজহাঁসটা কোথা থেকে কিনেছ?

হ্যান্স বলল, আমি এটা কিনি নি। শূকরের বিনিময়ে আমি এটা পেয়েছি।

শানওয়ালা বলল, শূকরটা কীভাবে পেয়েছিলে?

হ্যান্স বলল, সেটা পেয়েছিলাম একটা গাভির বিনিময়ে।

শানওয়ালা বলল, গাভিটা কীভাবে পেলে?

হ্যান্স বলল, সেটা পেয়েছিলাম একটা ঘোড়ার বিনিময়ে।

শানওয়ালা বলল, ঘোড়াটা কীভাবে পেলে?

হ্যান্স বলল, এর বিনিময়ে আমি দিয়েছিলাম আমার মাথার সমান বড় একটা স্বর্ণখণ্ড।

শানওয়ালা বলল, স্বর্ণখণ্ড কীভাবে পেলে?

হ্যান্স বলল, সেটা দিল আমার সাত বছরের কাজের মজুরি।

 

শানওয়ালা বলল, তুমি প্রতিবারই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনেক বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর বুদ্ধি খাটিয়ে ভালো ভালো জিনিস জিতে নিয়েছ। তুমি যদি তোমার পকেটে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি শুনতে চাও, তাহলে তোমার ভাগ্য তোমাকেই গড়তে হবে।

হ্যান্সি জানতে চাইল, আমি তা কীভাবে গড়ব?

শানওয়ালা বলল, তোমাকে আমার মতো ছুরি-কাঁচি ধার করার কারিগর হতে হবে। এজন্য তোমার তেমন কিছুই প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র তোমার একটা ছুরি-কাঁচি ধার করার যন্ত্র থাকতে হবে। এই ধর, আমার যেমন আছে। অবশ্য এটা খুব কম দিন ব্যবহৃত হয়েছে। তুমি এটা নিতে পারো। এর বিনিময়ে শুধুমাত্র তোমার রাজহাঁসটা আমাকে দিতে হবে। এছাড়া তেমন কিছুই দিতে হবে না। তুমি কি এটা নিতে চাও?

হ্যান্স বলল, তুমি এমন করে কেন বলছ? যদি পকেটে হাত দিলে টাকা পাই, তবে আমি হব পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। আমি আর অর্থেকষ্টে ভুগতে চাই না। এই বলে হ্যান্স তাকে রাজহাঁসটা দিয়ে দিল। এর বিনিময়ে ছুরি-কাঁচি ধার করার পাথর ও যন্ত্রটা নিয়ে নিল।

 

শানওয়ালার কাছে ছিল একটা সাধারণ বড় পাথর। শানওয়ালা বলল, এখানে তোমার জন্য আছে একটা বড় পাথর। এর উপর তুমি হাতুড়ি চালাতে পারবে। পেরেক ঠুকতে পারবে। পেরেক, গজাল, তারকাটা সোজা করতে পারবে। বুড়ো নখ ঘসে পলিশ করতে পারবে। এটা তুমি নাও, খুব যত্ন করে রেখে দাও।

হ্যান্স পাথরটাও নিয়ে নিল। তারপর পরিতৃপ্তি নিয়ে এগিয়ে চলল। তার চোখ দুটোতে দেখা যাচ্ছিল আনন্দের ঝিলিক। সে চিৎকার করে বলছিল, আমি নিশ্চয়ই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলাম। আমি যা চাচ্ছি আমার জীবনে তাই ঘটছে যেন আমি সৌভাগ্যের বরপুত্র।

সেই ভোর বেলা থেকে এখন পর্যন্ত সে পায়ের উপর চলছে। কোথাও একটু সময়ের জন্যও বসেনি। সে এখন খুব ক্লান্ত। খুব ক্ষুধাও পেয়েছে। দর কষাকষি করে সে যখন গাভিটা জিতেছিল, তখন খুশিতে সব খাবার একবারে খেয়ে নিয়েছিল। অনেক কষ্টে সে এগিয়ে চলল। তবে প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল এখন তাকে থামতে হবে। পাথরটির অত্যধিক ভারে সে ভীষণ নুয়ে পড়ছিল। সে ভাবছিল, যদি তাকে এসব ভার বহন করতে না হতো তবে অনেক ভালো হতো।

 

হ্যান্স অবশেষে শামুকের মতো হামাগুড়ি দিয়ে মাঠের মধ্যে একটা কুয়োর ধারে গেল। সে ভাবল এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবে। ঠান্ডা পানিতে নিজেকে কিছুটা সতেজ করবে। সে কুয়োর ধারে গিয়ে ধিরেসুস্থে পাথরের বোঝা নামিয়ে রাখল। তারপর সে এর পাশে বসল। সে ঝুঁকে পড়ে পানি খেল। এরপর পাথরে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ছুরি-কাঁচি ধার করার যন্ত্র ও পাথরখণ্ডÑ এ দুটোই তার শরীরের চাপে পানিতে পড়ে গেল। হ্যান্স যখন নিজ চোখে এগুলোকে পানিতে তলিয়ে যেতে দেখল, তখন সে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ওই ভারী পাথরখণ্ড হ্যান্সকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তা থেকে মুক্ত করার জন্য জলভরা চোখে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল। তাকে অনুগ্রহ করা ও সুপথ দেখানোর জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাল। আর নিজেকে নিন্দা জানানো ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।

হ্যান্স গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো সৌভাগ্যবান মানুষ নেই। এই বলে হ্যান্স ফুরফুরে মনে সূর্যের নিচে দৌড়ে দৌড়ে ছুটতে লাগল গাঁয়ের পথে, যতক্ষণ না সে বাড়িতে পৌঁছল মায়ের কাছে।