.সাইফুর রহমান বাংলাদেশের লেখক। হয়তো তেমন খ্যাতিমান নন, তবে ভবিষ্যতে তিনি লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবেন বলেই আমার মনে হয়। আর এ অনুমানের পেছনে কারণটি হল অতি সম্প্রতি আমি তার কিছু গল্পের একটি সংকলন পড়েছি। সংকলনটির নাম ‘মরিচপোড়া’। এ সংকলনটিতে মোট আটটি গল্প আছে। গল্পগুলোর নাম ‘মরিচপোড়া’, ‘দেনা-পাওনা’, ‘কালো কঙ্কাল’, ‘অনাহূত অতিথি’, ‘লেখকের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘গোরস্থানে একজন রহস্যময় যুবক!’, ‘রবিবাবুর হারানো রত্ন’ এবং ‘অভিনব হত্যাকাণ্ড’।
প্রথম গল্প মরিচপোড়া আমাকে মুগ্ধ করেছে এর এক প্রগাঢ় রহস্যময়তার জন্য। উত্তম পুরুষে যে চরিত্রটি তিনি তৈরি করেছেন তা তার শক্তিমত্তারই পরিচয় বহন করছে। এ চরিত্রটির মধ্যে যে বিভ্রমটা রয়েছে তার ভেতরে জাদু বাস্তবের ছায়া পাই। এ গল্পে এক গ্রামীণ মহিলাকে কত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তার বেদনাবহ বর্ণনা আছে। এদের যেন সুখের জীবনযাপন করতে নেই। প্রোষিতভর্তৃকা মিতুজা নাম্মী মেয়েটিকে যে পুরুষের কাছে শরীর দিতে হল সে তার সম্পর্কে গুরুজন। অল্প আয়াসে মেয়েটির অসহায়তা ভারি ভালো ফুটিয়েছেন সাইফুর।
এ সংকলনটির আরেকটি উপভোগ্য গল্প হল ‘দেনা-পাওনা’। নাজিমগড়ের নবাব আসাফউদ্দোলার রসবোধ ও জীবনযাপনের ভেতরে একটু উঁকি দিয়ে আসার চেষ্টা আর কী। এক আগন্তুক গায়কের সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মদের ঘোরে তাকে জায়গির দিয়ে দিলেন, তারপর আর জায়গির প্রদানের উচ্চবাচ্য নেই। গায়ক যখন তার দাবি-দাওয়া নিয়ে উপস্থিত হল তখন নবাব অম্লান বদনে বললেন- বাপু হে, তোমার গান যেমন আমার কানে মধু ঢেলেছে তেমনি আমিও তোমার কানে মধু ঢেলেছি জায়গিরের কথা বলে। বেশ লাগল গল্পটি। সাইফুরের ভাষা অতীব সরল এবং বিবরণ বাস্তবমুখী বলেই এসব গল্পের একটা সহজ আবেদন আছে।
অনাহূত অতিথিও একটি সহজ করুণ রসের কাহিনী। এতে গ্রাম্য মানুষের অহঙ্কার, প্রতিশোধস্পৃহা এবং তৎসহ আনুষঙ্গিক জটিলতা একটি বিয়েবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মুঠো মন্তাজের চরিত্রটিও অভিনব। একটু আগে যা বলেছি, সাইফুরের সহজ বিবরণধর্মী ভাষাশৈলী গল্পটিকে পাঠযোগ্যতা দিয়েছে। মিনহাজের বিনা আমন্ত্রণে বিয়েবাড়িতে খাওয়ার শাস্তিটি বড়ই নিষ্ঠুর।
এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের জীবনের দুটি কাহিনীকে গল্পে রূপ দিয়েছেন। প্রয়াসটি মন্দ নয়, অনেকের কাছেই গল্প দুটি খুব কৌতূহল সৃষ্টিকারী হবে, সন্দেহ নেই। আরেকটি গল্প আছে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে। তার এ অনাবিষ্কৃত ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমি অবহিত নই, তবু এ ধরনের গল্পেরও উপযোগিতা আছে নিশ্চয়ই।
‘গোরস্থানে একজন রহস্যময় যুবক!’ গল্পটিও বেশ। তবে লেখক এটাকে আরও একটু বিস্তার দিতে পারতেন। গোরস্থানের কবরে সমাহিত লাশ নিয়ে যে কী কারবার হয় তা জেনে চমকে উঠতে হবে। তবে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মানুষকে রুটিরুজির জন্য এরকম অনেক হীন কাজে লিপ্ত হতে হয়। গল্পের উপসংহারটিও আমাদের চোখ খুলে দেয়। তবে গল্পটিতে বেশকিছু বিরতিচিহ্নের গোলমাল আছে।
সাইফুরের বিশিষ্টতা হল তিনি তৃণমূল স্তরের মানুষকে অনেকটা চেনেন। না হলে ‘কালো কঙ্কাল’ গল্পটা লিখতে পারতেন না। তালেব মিয়া, লতু আর আকেলের গল্প। গল্পটির মধুর সমাপ্তি বেশ উপভোগ্য। গরিব মানুষকে বাঁচার জন্য কত কী যে করতে হয় তা তালেব মিয়ার জীবনযাপনের সংক্ষিপ্ত বিবরণের ভেতর দিয়ে ভালোই ফুটেছে আর সাহিত্যানুরাগী লতুকেও পাঠকের পছন্দ হবে।
রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আর হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে তিনটি গল্পের আলোচনা করছি না, কারণ এ তিনটি গল্পই খানিকটা আংশিক জীবনীর মতো। ঠিক সৃজনশীল গল্পের আওতায় আসে না।
লেখক সাইফুরের এ প্রয়াসটি হয়তো দিকনির্দেশক নয়, তবে চর্চা বজায় রাখলে তিনি যে পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠবেন তাতে আমার সন্দেহ নেই। আমি তার মরিচপোড়া গল্প সংকলনটির সাফল্য কামনা করি।
জুননু রাইন