দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। এই বদল শুধু প্রকৃতি ও পরিবেশগত নয়- মনোভুবনেরও। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এক শতাব্দীর পরিবর্তন এখন এক দশকে ঘটছে- বহুরৈখিক ও নানা আঙ্গিকে। মানুষের মূল্যবোধ, সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে জীবনপ্রবাহে এসেছে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন। এই সাংস্কৃতিক ক্যানভাসের পরিবর্তন রেনেসাঁসও যৌক্তিকভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ বাঙালি সংস্কৃতির প্রবণতা এখন মেকি শহুরে; গভীরতা ও শিকড়হীন এক দেখানিপনানির্ভর। সহমর্মিতা, মানবিকতা সাধারণ জনসমাজে তো বটেই, মার্জিত রুচির দাবিদার বৌদ্ধিক সমাজেও প্রতিনিয়ত লুপ্ত।
আমরা বাস করছি সারথি করে অস্থিরতা, অবিশ^াস ও বিচ্ছিন্নতা ধারণ করে। বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাটুকুর যে তলানি আমরা অবলোকন করি, সেই উপলক্ষের সংস্কৃতি বললে বোধ করি অন্যায় হবে না। এমন তো ছিল না আমাদের সংস্কৃতির ভুবন। বাংলা সাহিত্যের কল্লোল যুগ থেকে পঞ্চকবির হাত ধরে দেশভাগ পর্বে সঞ্জীবনী পায়। পাকিস্তান পর্বেই রাষ্ট্রীয় মারকুটে আচরণের মধ্যেও আমাদের সংস্কৃতি স্বকীয় দিশা নিয়ে এগিয়েছে। হয়তো বা প্রতিবাদী চেতনার বিপরীতে স্ববিরোধিতার প্রভাব নিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু পুরো সমাজ কাঠামোয় সংস্কৃতির চর্চা জ্বালানি সরবরাহ করেছে।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে স্বাধীন দেশে বহুদিনের প্রার্থিত দেশজ সংস্কৃতি পাখা মেলার সুযোগ পায়। সঙ্গত কারণেই গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে নবধারার সংস্কৃতির ফসল ফলে কবিতা, চলচ্চিত্র, গান, নাটকসহ নানা মাধ্যমে। এ সময় সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার কর্মীদের মধ্যে আন্তঃদেশীয় ও বহির্বিশে^র সংযোগের প্রগাঢ় প্রবণতা লক্ষণীয়। চিন্তার জমিনে যুক্ত হয় উন্নত বিশে^র নানামুখী প্রভাব, প্রাচ্যবাদ, উত্তর আধুনিক তত্ত্ব ইত্যাদি। সংস্কৃতিচর্চায় নতুন বলয়ও দৃশ্যমান হয়। বিশ^ রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ, বিশ^ায়ন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণা ও কার্যকারণ গত পাঁচ দশকে জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বৈরশাসন এবং গণতন্ত্রের মুখ বন্ধের প্রচেষ্টাও সংস্কৃতির চর্চা চলে আলোচনা ও সমালোচনা সঙ্গে নিয়ে। প্রতিনিয়ত জীবনকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিদিন চ্যালেঞ্জ বাড়ছেই।
এ কারণে মনের কৃষি বা সংস্কৃতিচর্চা সংকুচিত ও অর্থ সংযোগ উদ্দেশ্যধর্মী হয়ে উঠছে। তা আমাদের গহিন অন্ধকারের বার্তা দিচ্ছে। প্রাণের উত্তাপহীন এই জনসমাজে সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবহারিক, পারিবারিক জীবন এখন অসহনীয় মাত্রার অর্থনির্ভর। সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের প্রতি মানুষের যে প্রবণতা, মানুষ অন্তর্গরজ থেকে সৌন্দর্যচেতনা, কল্যাণবুদ্ধি, শুভচিন্তা, কল্যাণনিষ্ঠ ভেদহীন সমাজের জন্য যে সুকুমার কলার চর্চা করত- প্রতিদিন মানুষ ওই পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষকে সীমাহীন চাহিদা ঘুমাতে দেয় না। ওই কালপর্বে কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীতের নির্মোহ চর্চা করবে কে? তিন-চার দশক আগেও সংস্কৃতিসেবীরা সৃজন আনন্দে বিভোর থাকত, আর্থিক সংযোগের দিকে খেয়ালটা কম ছিল।
এখন চিত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একেবারে উল্টো। সংস্কৃতিসেবার নামে চলে খোলসের খেলা। সংস্কৃতিচর্চা যেন অনেকাংশে অর্থসম্পদ অর্জনের এক মোক্ষম দাওয়াই। আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেটের সংযোগ ইত্যাদি কারণে মাটির সংস্কৃতিচর্চাও পিছিয়ে পড়ার এক বড় কারণ। এর মধ্যে রসদ জুগিয়েছে রাজনীতির কূটচাল, রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপরীত্য ইত্যাদি। আধুনিকতার অজুহাতে হিন্দি ও পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির মিশ্ররূপ, এর বর্ণিল বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য প্রধান হয়ে নতুন প্রজন্মকে কাছে টানছে। এখন গণসংগীত, লোকজ্ঞান, লোকগান কীভাবে বিস্তার করবে। নদী, বন-বনানীর লয়ে প্রকৃতির ওসব অনুষঙ্গনির্ভর সংস্কৃতির উপকরণ কীভাবে পাখা মিলবে। আমরা যেমন এখন প্রান্তিকের মানুষ নই। আমাদের জীবনেও প্রান্তিকের ব্রাত্যজনের সংযোগ কম। গ্রামীণ জীবন থেকে আমরা এখন শহুরে নাগরিক। জীবনের কেন্দ্র এখন শহরে। আমরা এখন নগরজন। এ নগরই আমাদের জীবনকে রূপায়ণের নিয়ামক।
নগরে প্রতিনিয়ত স্বার্থের সংঘাত, দলরাজ, মতলববাজ, ভাঁড়ামি, হাস্যস্রােত আবার নিষ্ঠুরতানির্ভর জীবন আমাদের। একদ- আয়েশ নেই, দীর্ঘ বিশ্রাম নেই- শুধু ছুটে চলা। বাড়িতে উঠান নেই, মাঠ নেই, ব্যালকনি নেই- শুধু জড়থবু হয়ে থাকা। সংস্কৃতিসেবীদের চর্চার মাধ্যমে পেশাভিত্তিক জীবন গড়ার সুযোগ নেই, প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহের সুযোগ নেই। সামষ্টিক অর্থে এই শহরেরও কোনো ব্যালকনি নেই- যেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে একটা আড্ডার ব্যবস্থা করা যায়। এ বিষয়টি সংস্কৃতির বিকাশে ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টি কারও মাথায় গভীরভাবে নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র যাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, তারা মশগুল থাকে ব্যক্তিভা-ার পূর্ণতার দিকে।বর্তমানে নগর সংস্কৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি বৈপরীত্য লক্ষণীয়। জীবনাচরণের বহু ভঙ্গিমরূপেও সংস্কৃতির যাত্রা আজ বহুধাবিভক্ত। সমাজের ভেতর জাতীয় ঐক্য স্বাধীনতার পাঁচ দশকে স্থাপন না হওয়ায় শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সহজাতভাবেই সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিচর্চার রূপও মোটা দাগে বিভক্ত। এর দায়ভার অবধারিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর অনেকটুকু বর্তায়।
এ কথা স্বীকার্য- কাল বহমান, সমাজও অস্থির। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতার ভেতরও একদ- নিটোল সময় করে নিতে হবে সৃজনমনস্ক ব্যক্তিদের। কোনো সাহিত্য বা শিল্প সৃষ্টিই আকাশবিহারি নয়। এ জন্য সংস্কৃতিকর্মীদের আদর্শনির্ভর মনস্তাত্ত্বিক বলিষ্ঠতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ তো ব্যক্তির জন্ম-মৃত্যুর ধারায় প্রবহমান জনস্রােত। এই প্রবহমান ধারায় সংস্কৃতির উপাদানের কর্ষণে উন্নত রুচি ও উৎকর্ষময় চিত্ত নিয়ে সংস্কৃতি সাধনা প্রয়োজন। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় কি আমরা ওই পথে হাঁটছি? সোজাসাপটা উত্তর মিলবে ‘না’। সংস্কার বা রেনেসাঁস কিংবা পরিমার্জনই সংস্কৃতির অভীলক্ষ্য। তবে চলমান সময়ের সমাজ প্রগতির রেনেসাঁসের গন্তব্য কোথায়?অধ্যাপক আহমদ শরীফকে দোহাই দিয়ে বলা যায়- বহুকাল ধরে অবক্ষয়গ্রস্ত একটি দেশ, কাল ও সমাজের অনেক শিক্ষিত মানুষ নতুন চিন্তাচেতনায় প্রবুদ্ধ হয়ে এতকালের জাতীয় জড়তা এবং জীর্ণতার মধ্যে জীবন ও জীবিকার নানা ক্ষেত্রে কথায়, কাজে, লেখায় নতুন কিছু বলে করে, গড়ে, লেখে এবং এঁকে জনগণকে নতুন কিছু শিখিয়ে, জানিয়ে লোকমনে শক্তি, সাহস, আত্মপ্রত্যয় ও আশা জাগিয়ে এবং মাটি ও মানুষের প্রতি, স্বদেশ এবং স্বভাষার প্রতি, জগতের ও জীবনের প্রতি মানুষের অনুরাগ বাড়িয়ে- এক কথায় যা কিছু শ্রেয়, এরই নাম রেনেসাঁস।এখন প্রশ্ন- সামনে সমাসীন সমাজ জাগৃতির বাতিঘরে কে বা কারা আলো জ্বালাবে। এই সমাজে কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু মানুষ খুব একটা নেই, কোনো জীবন চেতনার প্রশ্ন নেই, প-িতের খোলসধারীদের দর্শন নেই, চিন্তার খোরাক নেই- তা হলে আলো জ্বালাবে কে? সম্প্রতি মহামারী করোনা পুরো বিশ^ব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছে। বাড়তি নেতিবাচক মাত্রা জুগিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পুরো মানবগ্রহে এই বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যেই সামাজিক জীবনে নতুন ধ্রুপদ হাজির হচ্ছে। টিকে থাকার সংগ্রাম আরও কঠিনতর হবে- এর পূর্বাভাস লক্ষণীয়। বদলে যাওয়া দুনিয়ায় মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের মিথস্ক্রিয়া আরও দৃঢ় হবে। সামনের দিনের যান্ত্রিক মানুষের লোকজ্ঞান, লোকপুরাণ ও দেশজ সংস্কৃতির বন্ধন আরও ভঙ্গুর হওয়ার প্ল্যাটফরম তৈরি হচ্ছে। এই বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে ভাবীকালের বাঙালি তথাকথিত বস্তুবাদী প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সঙ্গে কীভাবে একই মগজে নিজস্ব সংস্কৃতির লড়াই চালাবে! এখন আমাদের গন্তব্যের খোঁজ করতেই হবে। আমরা সংস্কৃতির নিজস্বতা হারিয়ে আকাশ সংস্কৃতির পরাধীনতায় নিজেদের সঁপে দেব, নাকি চ্যালেঞ্জের মধ্যেও স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজস্ব ব্যক্তিক ও জাতীয় পরিচয় বিরাজমান রাখতে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে খাপ খাইয়ে নেব মাটির সংস্কৃতির সঙ্গে। আমাদের যাত্রা সুড়ঙ্গের সুদূরপ্রান্তে যে এক চিলতে আলো দেখা যাচ্ছে, এদিকে হবে- নাকি সুড়ঙ্গের গহিন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে। সব প্রশ্নের মীমাংসা আমাদেরই করতে হবে। কেননা আমরা যে এ মাটির ভূমিজ সন্তান।
অবস্থা যতই বৈরী হোক, নিজেকে নিজের মতো করে উপলব্ধির জন্য আমাদের জাতীয় চালচিত্রের স্বরূপের লক্ষ্য ভেদ করতে নিজস্ব সংস্কৃতির যথার্থ পরিতোষণ আবশ্যক। আমরা নিজেকে এ থেকে বিচ্যুতি ও বিয়োজন ঘটাতে পারি না। ওই পথেই বিলম্বে হলেও ঐকতানে হাঁটব আমরা- পথ চেয়ে রই।