11:13 pm, Sunday, 1 December 2024

ঢাকার প্রথম পাঠাগার রামমোহন রায় লাইব্রেরি

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৯:৩২:৪৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪
  • 105 ভিউ
শেয়ার করুন

নুরুল করিম

২৬শে বৈশাখ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। সাদা পাঞ্জাবি ধুতি পরে রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে হাজির প্রেম প্রকৃতির বিশ্বজনীন কবি জীবনানন্দ দাশ। তার পাশেই বসা ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য গুপ্ত। সেদিন তারা কোনো বইয়ের খোঁজে আসেননি কিংবা সাহিত্য আড্ডায় অংশ নিতেও নয়। একে একে হাজির বুদ্ধদেব বসু, অতিজকুমার দত্তসহ তার কবিবন্ধুরা। আমন্ত্রিত অতিথিরা যখন একে একে উপস্থিত হলেন, তখনই লাবণ্য গুপ্তের কপালে সিঁদুর পরানোর সব রকমের ব্যবস্থা করলেন বিয়ের আচার্য মনমোহন চক্রবর্তী। তিনি জীবনানন্দ দাসের পিসেমশাই।

সম্ভবত এই বাংলায় পাঠাগারে বিয়ে করার প্রথম এবং শেষ ঘটনাটাই ঘটিয়েছেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। এখানে বিয়ে হওয়ার যথাযথ কারণও আছে; লাবণ্য ছিলেন ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক অমৃত লাল গুপ্তের ভাইঝি। তাছাড়া কবি পাত্রের জন্য এমন জায়গায়ই তো সবচেয়ে উপযুক্ত!

পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে ছিল রামমোহন রায় লাইব্রেরির অবস্থান। ব্রিটিশ আমল, দেশভাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী ভবন সংকট, নানান চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এখনো টিকে আছে ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিটি। যুগে যুগে প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এ লাইব্রেরি আলোকিত করলেও, বর্তমানে পাঠক খুঁজেই পাওয়া যায় না!

ইতিহাসের খোঁজে

কাঠের পাটাতন। পুরোনো আমলের অপ্রশস্ত খাড়া সিঁড়ি। দিনের বেলায়ও কিছুটা অন্ধকার। বাতি জ্বালালেই তবে মেটানো যাবে জ্ঞানের অতল তৃষ্ণা। বর্তমানে পুরান ঢাকার ব্রাহ্মমন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে চালু রয়েছে পাঠাগারটি। আগের সেই জৌলুস অনেকাংশেই ক্ষয় হলেও, ১৫৫ বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে পাঠাগারটিকে।

মুঘল আমলে গ্রন্থাগার বলতে ছিল গুটি কয়েক মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা হয়ে ওঠে উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের শহর। তখন মূলত পাবলিক গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেয় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ। ঢাকায় ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার সময়, ১৮৬৯ সালে দোতলার একটি কক্ষে ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ।

তবে পৃথক ভবনে রামমোহন রায় লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয় ১৯১০ সালে। এই ভবনের গায়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সালটি লেখা রয়েছে ১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি। তখন এই পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেইসঙ্গে পাঠকের সংখ্যাও বেড়ে যায় বহুগুণ। কিছু বই ছিল একেবারেই দুর্লভ। সে সময় প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ পাঠক এই পাঠাগারে আসতেন।

কেমন দুর্লভ বই ছিল, কীভাবে লোপাট হলো

১৯৪৭ সালে রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের বেশি। রাজা রামমোহন রায়ের মুদ্রিত পুস্তকের প্রথম সংস্করণ, বেদান্ত দর্শন, পারসি ভাষায় লেখা তোফায়াতুল মোহাম্মাদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র ও তাদের সমকালীন অন্য লেখকদের রচনাবলির প্রথম সংস্করণ, গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কোরআন শরিফ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ এই লাইব্রেরিতেই সংরক্ষিত ছিল। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী ৫০ বছরের সরকারি সব গেজেট। বর্তমানে এসব দুর্লভ বই ও নথির কিছুই অবশিষ্ট নেই বললেই চলে!

ঢাকাবাসীর স্মৃতিধন্য লাইব্রেরিটির সংগ্রহ ২৫ মার্চ রাতে এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। ওই রাতে গণহত্যার পর পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এরপর লুটপাট করা হয় মূল্যবান বই, পত্রিকা ও অন্য সংগ্রহশালা। সেগুলো কেজি দরে বিক্রি হয়। এমনকি মহামূল্যবান বই ও পত্রিকাগুলোর পাতা দোকানের ঠোঙা বানানোর কাজেও ব্যবহূত হয়।

১৯৭২ সালের ১০ মে দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, এক রাতেই লোপাট হয় ২০ হাজারের বেশি দুষ্প্রাপ্য বই ও নথি। আড়াইশ’ বছর আগে খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলা অক্ষরে যে বই ছাপানোর উদ্যোগ নেন, তার কয়েকটি কপিও ছিল এখানে। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা, ঢাকা নিউজ, বেঙ্গল টাইমস, তত্ত্ববোধিনী, তত্ত্বকোমুদি, শান্তিনিকেতন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, হিতবাদী, বসুমতী, বিচিত্রা ও ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রথম থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বঙ্গদর্শন-এর মূলকপি, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত কপিও ছিল এ গ্রন্থাগারে।

স্বাধীনতার পর গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে লুট হওয়া বই কেউ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে থাকলে তা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি পরবর্তীকালে সেসব বই ও নথি উচ্চমূল্যে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ‘প্রবাসী’ পত্রিকার দু’টি কপি ও বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত গবেষক বদরুদ্দীন উমরের হাতে পৌঁছানো একটি বই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে তিনি ফেরত দেন। কিন্তু গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বইটি ফেরত না নিয়ে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে তাকেই আবার উপহার দেন।

নিয়মিত পাঠক ছিলেন বিখ্যাতরা

রামমোহন রায় লাইব্রেরির সংগ্রহশালা নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন তার জীবনীগ্রন্থে। ‘কালের ধুলোয় লেখা’ বইয়ে কবি লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত এ গ্রন্থাগার আমার সামনে খুলেছিল আলাদা এক জগত্। বেড়ে গেল আমার পাঠস্পৃহা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার বেশি পরিচয় তো হলোই, বঙ্কিমচন্দ্র ও শরত্চন্দ্রের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠলাম।’

১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই লাইব্রেরিতে এসেছিলেন। এখানকার সংগ্রহশালা মুগ্ধ করেছিল তাকেও। কবিগুরু মূলত এখানে এসেছিলেন লীলা রায়ের শ্রী সংঘের নারী সমাবেশে প্রধান অতিথি হয়ে। অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে পাঠাগার নিয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি শোনা যায় বারবার।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এখানকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দেবীও। এখানে বসে তিনি নিমগ্ন থাকতেন গবেষণায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, সুফি মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামালসহ আরো অনেক খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জ্ঞানগৃহের সঙ্গে।

রামমোহন রায় লাইব্রেরির বর্তমান

পুরান ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটলে একটু সামনেই সুমনা হাসপাতাল। হাসপাতালের পাশে তিন নং লয়াল স্ট্রিটের গলিতে ঢুকে সামনেই ব্রাহ্মমন্দিরের ফটক। ওদিক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা প্রজাতির ফুলে ভরা বাগান। বাগানের সামনেই ব্রাহ্মমন্দির। ভবনের দোতলার একটি অংশে ২০১৪ সালে পুনরায় চালু করা হয়েছে পাঠাগারটি।

পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল জানান, স্বাধীনতার পরই পাঠাগারের মূল দ্বিতল ভবনটি এখনো জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। ধসে পড়ার আশঙ্কায় ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ৭ দিনের মধ্যে ভবনটি  ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ২০০৪ থেকে ’১৪ সাল—এই ১০ বছর এভাবেই কাটে। তখন পাঠাগারটি বন্ধ রাখতে হয়। ২০০৯ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন জানায়, রাজউকের করা ঢাকার ঐতিহাসিক ও নান্দনিক স্থাপনার তালিকার ৯৩টি স্থাপনার মধ্যে এই পাঠাগারটিও রয়েছে। সেজন্য রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত স্থাপনার আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ ও ও পরিবর্ধন করা যাবে না।

বর্তমানে পাঠাগারটিতে প্রায় ৬০০টি বই আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিশ্ববাণী প্রকাশিত মহাভারতের ২১ পর্ব, বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলি, ব্রাহ্ম ধর্মভিত্তিক প্রায় সব বই, রাজা রামমোহন, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলি, আছে সব পবিত্র ধর্মগ্রন্থও। কিন্তু পাঠাগারের আগের সে জৌলুস নেই বললেই চলে!

সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ০৮ মার্চ ২০২৪

#
জনপ্রিয়

ঢাকার প্রথম পাঠাগার রামমোহন রায় লাইব্রেরি

আপডেটের সময় : ০৯:৩২:৪৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪
শেয়ার করুন

নুরুল করিম

২৬শে বৈশাখ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। সাদা পাঞ্জাবি ধুতি পরে রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে হাজির প্রেম প্রকৃতির বিশ্বজনীন কবি জীবনানন্দ দাশ। তার পাশেই বসা ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য গুপ্ত। সেদিন তারা কোনো বইয়ের খোঁজে আসেননি কিংবা সাহিত্য আড্ডায় অংশ নিতেও নয়। একে একে হাজির বুদ্ধদেব বসু, অতিজকুমার দত্তসহ তার কবিবন্ধুরা। আমন্ত্রিত অতিথিরা যখন একে একে উপস্থিত হলেন, তখনই লাবণ্য গুপ্তের কপালে সিঁদুর পরানোর সব রকমের ব্যবস্থা করলেন বিয়ের আচার্য মনমোহন চক্রবর্তী। তিনি জীবনানন্দ দাসের পিসেমশাই।

সম্ভবত এই বাংলায় পাঠাগারে বিয়ে করার প্রথম এবং শেষ ঘটনাটাই ঘটিয়েছেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। এখানে বিয়ে হওয়ার যথাযথ কারণও আছে; লাবণ্য ছিলেন ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক অমৃত লাল গুপ্তের ভাইঝি। তাছাড়া কবি পাত্রের জন্য এমন জায়গায়ই তো সবচেয়ে উপযুক্ত!

পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে ছিল রামমোহন রায় লাইব্রেরির অবস্থান। ব্রিটিশ আমল, দেশভাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী ভবন সংকট, নানান চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এখনো টিকে আছে ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিটি। যুগে যুগে প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এ লাইব্রেরি আলোকিত করলেও, বর্তমানে পাঠক খুঁজেই পাওয়া যায় না!

ইতিহাসের খোঁজে

কাঠের পাটাতন। পুরোনো আমলের অপ্রশস্ত খাড়া সিঁড়ি। দিনের বেলায়ও কিছুটা অন্ধকার। বাতি জ্বালালেই তবে মেটানো যাবে জ্ঞানের অতল তৃষ্ণা। বর্তমানে পুরান ঢাকার ব্রাহ্মমন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে চালু রয়েছে পাঠাগারটি। আগের সেই জৌলুস অনেকাংশেই ক্ষয় হলেও, ১৫৫ বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে পাঠাগারটিকে।

মুঘল আমলে গ্রন্থাগার বলতে ছিল গুটি কয়েক মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা হয়ে ওঠে উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের শহর। তখন মূলত পাবলিক গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেয় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ। ঢাকায় ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার সময়, ১৮৬৯ সালে দোতলার একটি কক্ষে ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ।

তবে পৃথক ভবনে রামমোহন রায় লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয় ১৯১০ সালে। এই ভবনের গায়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সালটি লেখা রয়েছে ১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি। তখন এই পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেইসঙ্গে পাঠকের সংখ্যাও বেড়ে যায় বহুগুণ। কিছু বই ছিল একেবারেই দুর্লভ। সে সময় প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ পাঠক এই পাঠাগারে আসতেন।

কেমন দুর্লভ বই ছিল, কীভাবে লোপাট হলো

১৯৪৭ সালে রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের বেশি। রাজা রামমোহন রায়ের মুদ্রিত পুস্তকের প্রথম সংস্করণ, বেদান্ত দর্শন, পারসি ভাষায় লেখা তোফায়াতুল মোহাম্মাদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র ও তাদের সমকালীন অন্য লেখকদের রচনাবলির প্রথম সংস্করণ, গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কোরআন শরিফ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ এই লাইব্রেরিতেই সংরক্ষিত ছিল। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী ৫০ বছরের সরকারি সব গেজেট। বর্তমানে এসব দুর্লভ বই ও নথির কিছুই অবশিষ্ট নেই বললেই চলে!

ঢাকাবাসীর স্মৃতিধন্য লাইব্রেরিটির সংগ্রহ ২৫ মার্চ রাতে এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। ওই রাতে গণহত্যার পর পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এরপর লুটপাট করা হয় মূল্যবান বই, পত্রিকা ও অন্য সংগ্রহশালা। সেগুলো কেজি দরে বিক্রি হয়। এমনকি মহামূল্যবান বই ও পত্রিকাগুলোর পাতা দোকানের ঠোঙা বানানোর কাজেও ব্যবহূত হয়।

১৯৭২ সালের ১০ মে দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, এক রাতেই লোপাট হয় ২০ হাজারের বেশি দুষ্প্রাপ্য বই ও নথি। আড়াইশ’ বছর আগে খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলা অক্ষরে যে বই ছাপানোর উদ্যোগ নেন, তার কয়েকটি কপিও ছিল এখানে। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা, ঢাকা নিউজ, বেঙ্গল টাইমস, তত্ত্ববোধিনী, তত্ত্বকোমুদি, শান্তিনিকেতন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, হিতবাদী, বসুমতী, বিচিত্রা ও ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রথম থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বঙ্গদর্শন-এর মূলকপি, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত কপিও ছিল এ গ্রন্থাগারে।

স্বাধীনতার পর গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে লুট হওয়া বই কেউ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে থাকলে তা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি পরবর্তীকালে সেসব বই ও নথি উচ্চমূল্যে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ‘প্রবাসী’ পত্রিকার দু’টি কপি ও বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত গবেষক বদরুদ্দীন উমরের হাতে পৌঁছানো একটি বই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে তিনি ফেরত দেন। কিন্তু গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বইটি ফেরত না নিয়ে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে তাকেই আবার উপহার দেন।

নিয়মিত পাঠক ছিলেন বিখ্যাতরা

রামমোহন রায় লাইব্রেরির সংগ্রহশালা নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন তার জীবনীগ্রন্থে। ‘কালের ধুলোয় লেখা’ বইয়ে কবি লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত এ গ্রন্থাগার আমার সামনে খুলেছিল আলাদা এক জগত্। বেড়ে গেল আমার পাঠস্পৃহা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার বেশি পরিচয় তো হলোই, বঙ্কিমচন্দ্র ও শরত্চন্দ্রের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠলাম।’

১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই লাইব্রেরিতে এসেছিলেন। এখানকার সংগ্রহশালা মুগ্ধ করেছিল তাকেও। কবিগুরু মূলত এখানে এসেছিলেন লীলা রায়ের শ্রী সংঘের নারী সমাবেশে প্রধান অতিথি হয়ে। অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে পাঠাগার নিয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি শোনা যায় বারবার।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এখানকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দেবীও। এখানে বসে তিনি নিমগ্ন থাকতেন গবেষণায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, সুফি মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামালসহ আরো অনেক খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জ্ঞানগৃহের সঙ্গে।

রামমোহন রায় লাইব্রেরির বর্তমান

পুরান ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটলে একটু সামনেই সুমনা হাসপাতাল। হাসপাতালের পাশে তিন নং লয়াল স্ট্রিটের গলিতে ঢুকে সামনেই ব্রাহ্মমন্দিরের ফটক। ওদিক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা প্রজাতির ফুলে ভরা বাগান। বাগানের সামনেই ব্রাহ্মমন্দির। ভবনের দোতলার একটি অংশে ২০১৪ সালে পুনরায় চালু করা হয়েছে পাঠাগারটি।

পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল জানান, স্বাধীনতার পরই পাঠাগারের মূল দ্বিতল ভবনটি এখনো জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। ধসে পড়ার আশঙ্কায় ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ৭ দিনের মধ্যে ভবনটি  ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ২০০৪ থেকে ’১৪ সাল—এই ১০ বছর এভাবেই কাটে। তখন পাঠাগারটি বন্ধ রাখতে হয়। ২০০৯ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন জানায়, রাজউকের করা ঢাকার ঐতিহাসিক ও নান্দনিক স্থাপনার তালিকার ৯৩টি স্থাপনার মধ্যে এই পাঠাগারটিও রয়েছে। সেজন্য রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত স্থাপনার আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ ও ও পরিবর্ধন করা যাবে না।

বর্তমানে পাঠাগারটিতে প্রায় ৬০০টি বই আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিশ্ববাণী প্রকাশিত মহাভারতের ২১ পর্ব, বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলি, ব্রাহ্ম ধর্মভিত্তিক প্রায় সব বই, রাজা রামমোহন, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলি, আছে সব পবিত্র ধর্মগ্রন্থও। কিন্তু পাঠাগারের আগের সে জৌলুস নেই বললেই চলে!

সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ০৮ মার্চ ২০২৪