3:23 pm, Sunday, 22 December 2024

রাতভর ভূতের খপ্পরে : আবু রেজা

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০১:৩১:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 140 ভিউ
শেয়ার করুন

সাজু এই মাত্র কলেজ থেকে এসেছে। কাপড়চোপড় ছেড়ে চলে গেছে পুকুর ঘাটে। ঝটপট গোসল সেরে খেতে বসবে। পুকুরে নামতে না নামতেই বাবার হাঁক-ডাক শোনা যাচ্ছে। বাবা বলছেন, জলদি গোসল সেরে পুকুর থেকে ওঠ। মা বলছেন, তোকে নাগরপুর যেতে হবে।
এরই মধ্যে মা ভাত বেড়ে ফেলেছেন। সাজুকে খেতে আসার তাগিদ দিচ্ছেন। সাজু ঝটপট মাথা মুছে, চুলটা আঁচড়ে খেতে বসেছে। পাশে বসে বাবাই প্রথম কথটা তুললেন। তোর ছোট চাচির অবস্থা খুব খারাপ। তার বাপের বাড়ি খবর দিতে হবে। তোকেই এখনই যেতে হবে খবর দিতে।
সাজু বলে- কাল আমার পরীক্ষা আছে। এখন গেলে ফিরব কখন?

বাবা বলেন- এখনই তুই রওনা দে। প্রয়োজনে রাতে-রাতেই ফিরে আসবি। তুই ছাড়া যাওয়ার কেউ নেই।
অগত্যা সাজু খাবার শেষ করে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। কাপড়চোপড় পরে সাইকেল নিয়ে বের হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল।
সাজু বড় সড়ক ধরে এগিয়ে চলল। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সড়ক ধরে সাজু পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সূর্যের আলো সাজুর চোখে-মুখে পড়ছে। এজন্য ও সামনের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না। চোখ বুঝে আসতে চায়, আপনা-আপনি। মুখ যন্ত্রণায় কুচকে আছে। তারপরও যতটুকু সম্ভব জোর গতিতে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে করটিয়া পৌঁছতে ওর সন্ধ্যা হয়ে গেল। টাঙ্গাইল সদর পর্যন্ত যেতে এখান থেকে আরো বেশ কয়েক মাইল যেতে হবে। খুব জোর গতিতে সাইকেল চালালেও কমপক্ষে আধ-ঘণ্টা খানেক লেগে যাবে। সেখান থেকে নাগরপুরের পথ ধরতে হবে। এ পথে মাইল পনেরো গেলে সিংহরাগি গ্রামে ওর গন্তব্য।

টাঙ্গাইল সদরে ওঠেই সাইকেলের টায়ার ফেটে গেল। টায়ার সারাতে দিয়ে সাজু বসল চায়ের দোকানে। জিলিপি আর পরোটা খেল। চাও খেল এক কাপ। ততক্ষণে টায়ার সারানো শেষ। ও পয়সা চুকিয়ে সাইকেল নিয়ে রওনা হলো। আরো ঘণ্টা দুয়েক সাইকেল চালিয়ে সাজু পৌঁছে গেল সিংহরাগি গ্রামে। ছোট চাচির বাপের বাড়ি পৌঁছুতে প্রায় নটা বেজে গেল।

সাজুকে দেখেই ও বাড়ির সবাই হাঁক-ডাক শুরু করে দিল। দেখ কে এসেছে? ওই হাসু… ওই কাসু… দেখ কে এসেছে? ওকে হাত-মুখ ধোয়ার পানি দে। তোর দাদিকে ডাক। এত হাঁক-ডাকের মধ্যে সাজু আসল খবরটাই বলতে পারছে না। ও হাঁসফাস করছে খবরটা বলে ফেলতে পারলেই বাঁচে।

এ সময় দাদি এলেন। সাজুকে দেখেই আদর করে কাছে টেনে নিলেন। হাত ধরে আদর করে জানতে চাইলেন এত রাতে কীভাবে এলে? কী হয়েছে?
এতক্ষণে সাজু আসল কথাটা বলার একটা সুযোগ পেয়ে গেল। সাজু জানাল, ছোট চাচির অবস্থা ভালো না। তার শরীর খুবই খারাপ। সে আপনাকে দেখতে চায়। কাল ভোরেই আপনাকে যেতে হবে।
দাদি বললেন, ঠিক আছে তুমি থাকো। কাল সকালে এক সঙ্গে যাব।
সাজু বলল, আমি থাকতে পারব না। কাল আমার পরীক্ষা আছে। আজ রাতেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
দাদি বলেন, তা বোধ হয় ঠিক হবে না। পথ-ঘাট ভালো না। রাতটা থেকেই যাও।

সাজু নাছোড়বান্দা। ওকে বিদায় নিতেই হবে। দাদি শেষমেষ জোর জবরদস্তি করে রাতের খাবার খাইয়ে তবে ছাড়লেন। রাত দশটার দিকে সাজু রওনা হলো জেলাসদরের দিকে।
অমাবশ্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চের আলো জ্বেলে পথ চলছে। সাইকেলের সামনে হেডলাইটের মতো এক ব্যাটারি চালিত একটা লাইট আছে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। সাজু টর্চের আলো ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
কার্তিক মাস। হেমন্তের হিম করা ঠাণ্ডা। শীতকাল এখনো শুরু না হলেও এখনই বেশ ভালো ঠাণ্ডা পড়েছে। তাই লোকজন তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। একে তো গাঁও-গেরাম। তায় আবার কারেন্ট নাই। যখনকার কথা বলছি তখন গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল হারিকেন আর কুপি বাতির আলো। তাই রাস্তার ধারে দু’চারটা বাড়ি থাকলেও তার আলো রাস্তায় পৌঁছে না। রাস্তাটাও বেশ নির্জন। রাস্তার ধারে ছোটো-খাটো মুদি বা চায়ের দোকান থাকার কথা। তাও বন্ধ হয়ে গেছে। পথে কোনো বাজার পড়লে হয়তো লোকজনের দেখা মিলবে।

এমনি পথে সাইকেল চালিয়ে পার হলো ঘণ্টা খানেক নাকি ঘণ্টা দুয়েক Ñ তা ঠাওর করতে পারছে না সাজু। সঙ্গে ঘড়ি নেই বলে বুঝতে পারছে না এখন কয়টা বাজে। তবে এখন যে মধ্যরাত এটা বেশ বুঝতে পারছে। মধ্যদুপুরে কিম্বা ঠিক মধ্যরাতে এক ধরনের স্তব্ধতা বিরাজ করে প্রকৃতিতে। কেমন যেন শূন্যতা চারদিকে। সব হালকা হাওয়ায় ভাসছে। প্রকৃতির সবকিছু যেন হালকা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যতায়। সাজুর নিজেকে কেমন হালকা লাগছে। সাইকেল বসে চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মনে হচ্ছে সাইকেলসহ বাতাসে ভেসে যাচ্ছে সে। গায়ে কাপড়চোপড় আছে ঠিকই কিন্তু শরীর যেন নেই। কাপড়ের অবয়বটাই সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

#
জনপ্রিয়

রাতভর ভূতের খপ্পরে : আবু রেজা

আপডেটের সময় : ০১:৩১:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

সাজু এই মাত্র কলেজ থেকে এসেছে। কাপড়চোপড় ছেড়ে চলে গেছে পুকুর ঘাটে। ঝটপট গোসল সেরে খেতে বসবে। পুকুরে নামতে না নামতেই বাবার হাঁক-ডাক শোনা যাচ্ছে। বাবা বলছেন, জলদি গোসল সেরে পুকুর থেকে ওঠ। মা বলছেন, তোকে নাগরপুর যেতে হবে।
এরই মধ্যে মা ভাত বেড়ে ফেলেছেন। সাজুকে খেতে আসার তাগিদ দিচ্ছেন। সাজু ঝটপট মাথা মুছে, চুলটা আঁচড়ে খেতে বসেছে। পাশে বসে বাবাই প্রথম কথটা তুললেন। তোর ছোট চাচির অবস্থা খুব খারাপ। তার বাপের বাড়ি খবর দিতে হবে। তোকেই এখনই যেতে হবে খবর দিতে।
সাজু বলে- কাল আমার পরীক্ষা আছে। এখন গেলে ফিরব কখন?

বাবা বলেন- এখনই তুই রওনা দে। প্রয়োজনে রাতে-রাতেই ফিরে আসবি। তুই ছাড়া যাওয়ার কেউ নেই।
অগত্যা সাজু খাবার শেষ করে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। কাপড়চোপড় পরে সাইকেল নিয়ে বের হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল।
সাজু বড় সড়ক ধরে এগিয়ে চলল। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সড়ক ধরে সাজু পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সূর্যের আলো সাজুর চোখে-মুখে পড়ছে। এজন্য ও সামনের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না। চোখ বুঝে আসতে চায়, আপনা-আপনি। মুখ যন্ত্রণায় কুচকে আছে। তারপরও যতটুকু সম্ভব জোর গতিতে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে করটিয়া পৌঁছতে ওর সন্ধ্যা হয়ে গেল। টাঙ্গাইল সদর পর্যন্ত যেতে এখান থেকে আরো বেশ কয়েক মাইল যেতে হবে। খুব জোর গতিতে সাইকেল চালালেও কমপক্ষে আধ-ঘণ্টা খানেক লেগে যাবে। সেখান থেকে নাগরপুরের পথ ধরতে হবে। এ পথে মাইল পনেরো গেলে সিংহরাগি গ্রামে ওর গন্তব্য।

টাঙ্গাইল সদরে ওঠেই সাইকেলের টায়ার ফেটে গেল। টায়ার সারাতে দিয়ে সাজু বসল চায়ের দোকানে। জিলিপি আর পরোটা খেল। চাও খেল এক কাপ। ততক্ষণে টায়ার সারানো শেষ। ও পয়সা চুকিয়ে সাইকেল নিয়ে রওনা হলো। আরো ঘণ্টা দুয়েক সাইকেল চালিয়ে সাজু পৌঁছে গেল সিংহরাগি গ্রামে। ছোট চাচির বাপের বাড়ি পৌঁছুতে প্রায় নটা বেজে গেল।

সাজুকে দেখেই ও বাড়ির সবাই হাঁক-ডাক শুরু করে দিল। দেখ কে এসেছে? ওই হাসু… ওই কাসু… দেখ কে এসেছে? ওকে হাত-মুখ ধোয়ার পানি দে। তোর দাদিকে ডাক। এত হাঁক-ডাকের মধ্যে সাজু আসল খবরটাই বলতে পারছে না। ও হাঁসফাস করছে খবরটা বলে ফেলতে পারলেই বাঁচে।

এ সময় দাদি এলেন। সাজুকে দেখেই আদর করে কাছে টেনে নিলেন। হাত ধরে আদর করে জানতে চাইলেন এত রাতে কীভাবে এলে? কী হয়েছে?
এতক্ষণে সাজু আসল কথাটা বলার একটা সুযোগ পেয়ে গেল। সাজু জানাল, ছোট চাচির অবস্থা ভালো না। তার শরীর খুবই খারাপ। সে আপনাকে দেখতে চায়। কাল ভোরেই আপনাকে যেতে হবে।
দাদি বললেন, ঠিক আছে তুমি থাকো। কাল সকালে এক সঙ্গে যাব।
সাজু বলল, আমি থাকতে পারব না। কাল আমার পরীক্ষা আছে। আজ রাতেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
দাদি বলেন, তা বোধ হয় ঠিক হবে না। পথ-ঘাট ভালো না। রাতটা থেকেই যাও।

সাজু নাছোড়বান্দা। ওকে বিদায় নিতেই হবে। দাদি শেষমেষ জোর জবরদস্তি করে রাতের খাবার খাইয়ে তবে ছাড়লেন। রাত দশটার দিকে সাজু রওনা হলো জেলাসদরের দিকে।
অমাবশ্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চের আলো জ্বেলে পথ চলছে। সাইকেলের সামনে হেডলাইটের মতো এক ব্যাটারি চালিত একটা লাইট আছে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। সাজু টর্চের আলো ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
কার্তিক মাস। হেমন্তের হিম করা ঠাণ্ডা। শীতকাল এখনো শুরু না হলেও এখনই বেশ ভালো ঠাণ্ডা পড়েছে। তাই লোকজন তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। একে তো গাঁও-গেরাম। তায় আবার কারেন্ট নাই। যখনকার কথা বলছি তখন গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল হারিকেন আর কুপি বাতির আলো। তাই রাস্তার ধারে দু’চারটা বাড়ি থাকলেও তার আলো রাস্তায় পৌঁছে না। রাস্তাটাও বেশ নির্জন। রাস্তার ধারে ছোটো-খাটো মুদি বা চায়ের দোকান থাকার কথা। তাও বন্ধ হয়ে গেছে। পথে কোনো বাজার পড়লে হয়তো লোকজনের দেখা মিলবে।

এমনি পথে সাইকেল চালিয়ে পার হলো ঘণ্টা খানেক নাকি ঘণ্টা দুয়েক Ñ তা ঠাওর করতে পারছে না সাজু। সঙ্গে ঘড়ি নেই বলে বুঝতে পারছে না এখন কয়টা বাজে। তবে এখন যে মধ্যরাত এটা বেশ বুঝতে পারছে। মধ্যদুপুরে কিম্বা ঠিক মধ্যরাতে এক ধরনের স্তব্ধতা বিরাজ করে প্রকৃতিতে। কেমন যেন শূন্যতা চারদিকে। সব হালকা হাওয়ায় ভাসছে। প্রকৃতির সবকিছু যেন হালকা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যতায়। সাজুর নিজেকে কেমন হালকা লাগছে। সাইকেল বসে চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মনে হচ্ছে সাইকেলসহ বাতাসে ভেসে যাচ্ছে সে। গায়ে কাপড়চোপড় আছে ঠিকই কিন্তু শরীর যেন নেই। কাপড়ের অবয়বটাই সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।