বহুকাল আগে ছিল এক রাজা। তার অনন্য সুন্দর এক আপেলের বাগান ছিল। সে বাগানে যে আপেল হল তা ছিল সোনার। প্রতিদিন সকালে মালি আপেল গুনে রাজার হাতে তুলে দিত। একদিন একটা আপেল কম হলো। রাজা তাতে ভীষণ রেগে গেলেন।
পরদিন মালী তার বড় ছেলেকে রাতে আপেল আগান পাহারা দিতে বললেন। বেড়ছেলে পাহারা দিতে দিতে মধ্যরাতে ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন ও একটা আপেল কম হলো। রাজা আবারও রেগে যান। পরদিন মালী তার মেঝছেলেকে পাহারা দিতে বললেন। মধ্যরাতে মেঝছেলেও ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন ও একটা আপেল কম হয়ে গেলো। এদিন রাজা আরও বেশি রেগে যায়।
পরের দিন মালী তার ছোটছেলেকে পাহারা দিতে বললেন। ছোটছেলে রাত জেগে আপেলবাগান পাহারা দিতে থাকে। মধ্যরাতে কিসের যেন খসখস আওয়াজ শুনতে পায়। সে শতর্ক হয়ে খুজতে থাকে। হঠাৎ দেখে একটা সোনার পাখি এসে আপেল ছিড়তে যাচ্ছে। সে নিশানা করে পাখিকে তীর মারে। তীর পাখির গায়ে লাগে না ঠিক কিন্তু পাখির একটা পালক ছিড়ে পড়ে। পালকটা নিয়ে রাজাকে দেখায়। রাজা মহামূল্যবান সোনার পালক দেখে পুরো পাখিটাকেই পেতে চায়। রাজা বললেন, কে পারবে ওই পাখিটাকে আমার কাছে এনে দিতে?
মালির বড় ছেলে রাজী হল। রাজা তাকে বাহবা দেয়। বড়ছেলে এই কাজের দায়িত্ব নিয়ে জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে। পথে একটা শিয়ালের দেখা পায়। সে শিয়ালটিকে মারতে তীর বের করে।
শিয়াল বলে আমাকে মেরো না। আমি জানি তুমি সোনালী পাখিকে ধরতে এসেছো। আমি তোমাকে ভাল উপদেশ দিব। যা বলি মন দিয়ে শোনÑ যেতে যেতে সামনে দুটো পান্থশালা দেখতে পাবে। একটা খুব সুন্দর ও মনোরম আর একটা ভাঙাচোরা কুড়ে ঘর। তুমি কুড়ে ঘরে গিয়ে রাত যাপন করবে।
মালির ছেলে মনে মনে ভাবে এ ব্যাপারে শিয়াল কি জানে। তাই সে শিয়ালকে তাক করে তীর ছুঁড়ে, কিন্তু শেয়ালের গায়ে লাগে না। শিয়াল পালিয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে গভীর বনের মধ্যে সে দুইটা পান্থশালা দেখতে পায়। একটিতে সুন্দরী মেয়েরা গানবাজনা করছে, আর তাতে সাজানো রয়েছে ভাল ভাল খাবার-দাবারে। অন্যটি বেশ নেংরা। পথ চলতে চলতে তার বেশ খিদে পেয়েছিল। তাই সে ভাল ভাল খাবার আর মনোরম পান্থশালায় গিয়ে মেয়েদের সাথে গানবাজনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। সোনালী পাখি আর দেশের কথা সে ভুলে গেল।
বড়ছেলে ফিরে না আসাতে মালির মেঝ ছেলে একই দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বনের মধ্যে আসতেই শেয়ালের সাথে দেখা হয়। শেয়াল ওকে ঠিক ওই কথাই বলে। যখন সে ওই পান্থশালার কাছে আসে বড় ভাই ওকে সুন্দর পান্থশালার দিকে ডাকে। সে ও চলে চায় আর সোনালী পাখি আর দেশের কথা একেবারে ভুলে যায়। সময় গড়িয়ে যায়…
এবার ছোটছেলে সোনালী পাখির খোঁজে যেতে চায়। বাবা বাধা দিয়ে বলে, আমি আমার দুই ছেলেকে হারিয়েছি তোকে হারাতে চাই না। ছোটছেলে বলে চিন্তা করো না ঠিকই সোনালী পাখি ও বড়দের সাথে নিয়ে ফির আসবো। তুমি দোয়া কর। এই বলে ছোটছেলেও বিদায় নেই।
বনের মধ্যে আসতেই শেয়ালের সাথে দেখা হয় ও একই উপদেশ শু তে পায়। সে শেয়ালকে ধন্যবাদ দেয়। শেয়াল বলে আমার পিঠে বসে, আমি তোমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাব। শিঘ্রই তারা সেখানে পৌছে। মালির ছোটছেলে ভাঙা কুড়ে ঘরে সারারাত বিশ্রাম নেই। সকালে শেয়াল আসে আরও একটা ভাল উপদেশ দিতে।
শেয়াল বলে এখান থেকে সোজা হাঁটতে হাঁটতে একটা রাজপ্রসাদ দেখতে পাবে। সামনে প্রহরীরা ঘুমান অবস্থায় থাকবে। তাদের কিছু করতে হবে না। তুমি সোজা প্রসাদে ঢুকে যাবে। সেখানে একটা কাঠের খাচায় আটকানো সোনার পাখি রাখা আছে। ভুল করেও তুমি খাঁচা বদলাবে না। তাহলে পস্তাবে। সে প্রসাদে ঢুকলো এবং ঠিক ঠিক দেখতে পেল। সে ভাবল সোনার পাখি এই কাঠের খাঁচায় একদম বেমানান! খাঁচাটি বদলিয়ে নিই। যেই বদলাতে গেল অমনি পাখি ডাকাডাকি শুরু করলো। পাখির ডাকে প্রহরীদের ঘুম ভেঙে যায় এবং তাকে আটক করে।
পরদিন রাজসভায় ওর বিচার হয়। ওর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সে রাজার কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। রাজা বলে একটা শর্তে তোমাকে ছাড়তে পারি। তুমি আমাকে সোনার ঘোড়া এনে দিতে হবে। তাহলে তোমাকে আমি ছেড়ে দেব আর ওই পাকিও তোমাকে দিয়ে দেব।
সে ঘোড়া খুঁজতে বের হয় আর রাস্তায় সেই শেয়ালের সাথে দেখা হয়। শেয়াল বলে দেখলে তো আমার উপদেশ শোননি বলে তেমার বিপদ হল। তুমি ভাল ছেলে তাই তোমাকে আমি সাহায্য করবো। সোনালী ঘোড়া খুঁজতে তুমি এখান তেকে সোজা চলতে থাকবে যতক্ষন না তুমি রাজপ্রসাদে পৌছবে। প্রসাদের সামনে দেখবে সোনালী ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে আর পাশে সহিস ঘুমিয়ে আছে। তুমি ঘোড়াটি আস্তে আস্তে নিয়ে আসবে। কিন্তু মনে রাখবে ওখানে দুইটা জিন থাকবে একটা পুরানো চামড়ার আর একটি সোনার। তুমি পুরানো জিনটি নিবে।
সে ভাবল পুরানো জিনটা এই ঘোড়ার সাথে মানায় না। তাই সে যখনই সোনার জিনটা হাতে নেয় ঘোড়া ডাকতে শুরু করলো। সহিসের ঘুম ভেঙে যায় এবং চোর চোর বলে চিৎকার দিল। সাথে সাথে প্রহরা এসে তাকে আটক করলো। পরদিন রাজদরবারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু আর একবার ছেলেটি প্রাণ ভিক্ষা চায়। রাজা তাকে বলে তুমি যদি সুন্দরী রাজকুমারীকে এনে দিতে পার তবে তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি আর ওই সোনার পাখি ও ঘোড়া তোমাকে উপহা দিব।
তারপর সে নিজের পথে বেরিয়ে যায়। পথে সেই শেয়ালের সাথে দেখা হয়। শেয়াল বলল তুমি যদি আমার কথা শুনতে তাহলে পাখি ও ঘোড়া দুটোই নিয়ে যেতে পারতে। তবুও তোমাকে আর একটা সুযোগ দিতে চাই। সোজা চলতে থাকবে যতক্ষন না রাজপ্রসাদে পৌছুবো। রাজপ্রাসাদে গিয়ে রাজকুমারীর কক্ষে ঢুকবে ওরাজকুমারীর সাথে হাত মেলাবে। ও তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে বলবে। কিন্তু মনে রেখ কোনমতে যেন রাজকুমারী তার বাবা মায়ের অনুমতি নিতে না পারে।
ছেলেটি ঠিক ঠিক মত সবই করলো। রাজকুমারীও তার সাথে পালাতে রাজি হয় কিন্তু কাকুতি-মিনতি করল যেন একটিবারের জন্য তার বাবা-মায়ের অনুমতির জন্য। অবশেষে ছেলেটি রাজি হয়ে যায়। সেই রাজকুমারী বাবামায়ের কাছে আছে অমনি ছেলেটিবে বন্ধি করা হয়।
রাজা বলে তুমি আমার মেয়েকে কোনতিন পাবে না, যদি আমার জানালার সামনে ওই পাহাড় আট দিনের মধ্যে ভাঙতে না পার। ছেলেটি আট দিনে সামান্যই ভাঙতে পেরেছিল ওই বিশাল পাহাড়ের। তারপর সে হতাশ হয়ে বসে রইল। এমন সময় সেই শেয়াল এসে বলল তুমি ঘুমিয়ে পড়, আমি দেখছি। অতপর সে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে উঠে দেখল পাহাড় নেই, সব ভাঙা হয়ে গেছে। রাজা খুশি হয়ে ছেলেটির সাথে রাজকামারীর বিয়ে দিল। সে রাজকামারীকে নিয়ে বের হয় এমন সময় সেই শেয়াল এসে বলল, তুমি তিনটি জিনিষই পেতে পার রাজকুমারী, ঘোড়া ও সোনার পাখি।
ছেলেটি বলল কি করে? শেয়াল বলল, তুমি রাজকুমারীকে নিয়ে আগের রাজার কাছে ফেরত দিবে। রাজা খুশি হয়ে তোমাকে সোনালী ঘোড়াটি দিবে। তারপর তুমি রাজকুমারী চট করে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসবে।
তারপর পরের প্রসাদে যাবে যেখানে সেনার পাখিটি আছে। আমি রাজকুমারীকে নিয়ে প্রসাদের বাইরে থাকব। ঘোড়াটি নিয়ে রাজাকে দেখাবে। রাজা খুশি হয়ে সোনার পাখিটি নিয়ে আসবে। তুমি বলবে পাখিটি তুমি একবার হাতে নিয়ে দেকতে চাও আসলে সোনার পাখি কি না? যখনই পাখিটি তোমার হাতে দিবে অমনি পাখিটি নিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে প্রসাদ থেকে পালাবে।
সে তাই করলো আর প্রসাদের বাইরে রাজকুমারীকে পেয়ে শিয়ালকে ধন্যবাদ জানাল। শিয়াল তাকে বলল তাই যদি হয় তাহলে আমাকে মেরে ফেল। ছেলেটি বলল আমি একাজ করতে পারবো না তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু।
শিয়াল বলল তুমি এখন যাও তবে দুইটা কথা মনে রাখবে। কেউ ফাঁসি কাষ্টে থাকলে তাকে টাকা দিয়ে বাঁচাবে না আর নদীর পাড়ে বসবে না।
ছেলেটি রাজকুমারীতে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে ও সেই গ্রামে পৌছে যেখানে ওর দুই ভাই ছিল। সেখানে গিয়ে সে খুব চেচমেচির আওয়াজ শুনতে পায়। কাছে গিয়ে দেখে তার বড় দুই ভাইকে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে। তারা ডাকাত হয়ে গেছে। ছেলেটি বলে যত টাকা লাগে আমি দিচ্ছি কিন্তু আমার ভাইয়ের ছেড়ে দিন।
ভাইদের ছাড়িয়ে এনে তারা একসাথে বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দিল। সামনে একটি নদী দেখতে পেয়ে বড় দুইভাই বলল, চল গিয়ে একটু নদীর পাড়ে জিড়িয়ে নিই। শিয়ালের উপদেশ ভুলে গিয়ে ছেলেটি নদীর পাড়ে গিয়ে বসল। অমনি দুইভাই তাকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। তারপর রাজকুমারী, ঘোড়া ও পাখি নিয়ে রাজপ্রসাদে আসে। দুইভাই বলে, হে মহারাজ আমরা সবকিছু জয় করে এনেছি নিজেদের যোগ্যতায়।
রাজ্যের সবাই খুব খুশি হয়। কিন্তু রাজকুমারী শুধু কাঁদতে থাকে, ঘোড়া খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে পাখি আর গান গায় না। ভাগ্য ভালো ছেলেটির নদীতে পানি কম ছিল। সে প্রাণে বেছে গিয়েছিল। সে নদী থেকে উঠতে পারছিল না। আবার শিয়াল তাকে বাঁচাতে এলো। সে লেজ নামিয়ে দিল ছেলেটি শিয়ালের লেজ ধরে উঠে এলো। তোমাকে এত করে উপদেশ দিলাম, তুমি কিছুতেই শুনলে না। তবুও তুমি আমার বন্ধু। তুমি রাজ্যে গেলে তোমার ভাইয়েরা তোমাকে মেরে ফেলবে। তাই ছদ্দবেশে মে রাজপ্রসাদে যায়। রাজকুমারীর কান্না থেমে যায়, ঘোড়াও খেতে শুরু করে, পাখিও গান গাইতে থাকে। তারপর রাজার কাছে ছেলেটি তার ভাইদের সব কথা খুলে বলে। ভাইদের বন্দি করে শঅস্তি দেওয়া হয়। ছোটছেলের সাথে রাকুমারীর বিয়ে দেওয়া হয়। রাজার মৃত্যুর পর সেই ছেলেটিই রাজা হয়। তারা সুখের দিন কাটতে লাগলো। অনেক দিন পর তার বলে ঘুরতে বের হয়। পথে সেই শিয়ালের সাথে দেখা হয়। শিয়াল কেঁদে মিনতি করে তার হাতেই যেন তার মৃত্যু হয়। শিয়াল বলে দয়া কর বন্ধু আমি তো তোমার কাছে একটা জিনিষই চেয়েছি।
ছেলেটি দুঃখ পেলেও শিয়ালের কথা রাখল। তয়োয়ার দিয়ে শিয়ালটিকে মেরে ফেলতেই শিয়ালটি একটি মানুষে পরিণত হল। তারপর জানা যায় শিয়ালটি ছিল রাজকুমারীর ভাই। বহু বছর আগে সে এই বলে হারিয়ে গিয়েছিল।