পথনাটক
পথ নাটক বলতে নাট্যশালার বাইরে পথে প্রান্তরে এবং উন্মুক্তস্থানে প্রদর্শিত নাটক। এতে নেই কোন সেট কিংবা বিশেষ মঞ্চব্যবস্থা। কস্টিউম, সংলাপ, অভিনয় সঙ্গীতই প্রধান। নাটকের সময়কাল বিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। পথনাটক হয় বিশেষ সময়ের দর্শকদের জন্য, থাকে বিশেষ বার্তা। পথ নাটকের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পথনাটক একটি স্বতন্ত্র নাট্যধারা হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত।
পঞ্চাশের দশকে ভারতে পথনাটকের চর্চা শুরু করে গণনাট্য সংঘ। নাটকের মূল বিষয় ছিল রাজনীতি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণকে প্রতিবাদী করে তোলা। পথনাটকের প্রবাদপুুরুষ বলা হয় ভারতের নাট্যকার সফদর হাসমিকে। ষাট এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে “লিভিং নিউজ পেপার” অগাস্ত বৌলের ‘থিয়েটার অব অপ্রেস’ এবং সানফ্রানসিসকো মাইমাট্রপের’ কমেদিয়া দেল আর্থ’ এর সব পথনাটক ছিল রাজনীতির বিষয়বস্তু। ইউরোপেও নিয়ে পথনাটক এবং প্রদর্শনী হয় একই ধারায়।
১৯৬৯ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে উত্তাল গণআন্তোলরে সময় ‘না’ নামে একটি নাটক পথে প্রদর্শনী হয়। নাট্যকার ছিলেন সৌমেন চন্দ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর, মুক্তস্বদেশের বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা বিকশিত হতে থাকে।
গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় মিলন চৌধুরীর ‘যায়দিন ফাগুনও দিন’ পথনাটক নিয়ে রাস্তায় নামে। ট্রাকের পাটাতনকে ব্যবহার করে নগরীর পথে পথে নাটক করে। ১৯৭৭ সালে ঢাকা থিয়েটার সেলিম আল দীনের ‘চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’ পথনাটক নিয়ে রাস্তায় নামে। কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়, প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। তার দু’বছরের মাথায় ১৯৭৯ সালে পদাতিক নাট্য সংসদ রাস্তায় নামে এসএম সোলায়মানের “ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল” নাটক নিয়ে। স্বাধীন দেশে যুদ্ধাহত এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান, শহীদ মিনারে অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নাটক। ওই সময় দু’শতাধিক প্রদর্শনী হয় এই পথনাটকের।
পথনাটকের মাধ্যমে জনতার পাশে দাঁড়িয়ে রাজপথের আন্দোলনের একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে একটি স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আসে। এতে গণবিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে গণতন্ত্রের পক্ষে, দুঃশাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। পথনাটক নিয়ে নেমে আসে নাট্যকর্মীরাও। রাজধানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে পথনাটক প্রদর্শনী। তুমুল গণআন্দোলনে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
থেমে থাকেনি পথনাটক। গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে পথনাটক হতে থাকে। ১৯৯৩ সালে গড়ে উঠে পথনাটক পরিষদ।
চল্লিশটি নাট্যদল ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে শুরু হয় নিয়মিত পথনাটকের প্রদর্শনী। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে থাকে পথনাটক উৎসব। ১৯৯৪ সালে আটটি নাটক নিয়ে ‘নাচাও রাস্তা নাচাও’ নামে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন প্রকাশ করে প্রথম পথনাটক সংকলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ ২৮টি নাটক নিয়ে প্রকাশ করে “বাংলাদেশের পথনাটক” গ্রন্থ।
প্রসঙ্গ : নাটক নাটক চতুষ্টয়
‘নাটক চতুষ্টয়’ গ্রন্থে চার অবয়বের চারটি পথনাটক। রচিত হয় সময়ের প্রয়োজনে, পথনাটকের মূল চেতনাকে ধারণ করে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী সরকারের আমলে রাজপথে ও শিক্ষাঙ্গণে ঝরে পড়া লাশ নিয়ে ‘সারি সারি লাশ’। ১৯৯৫ সালে ‘তারামন বিবি’ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লেখা, ২০০৪ সালে দুর্নীতি ও নষ্ট রাজনীতি নিয়ে লেখা হয় ‘চোর’ এবং ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে রচিত হয় ‘ট্রাইব্যুনাল’। আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের একটি প্রতীক বিচারের পথনাটক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের বিভিন্নস্থানে জনমত তৈরির সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতেও ‘ট্রাইব্যুনাল নাটক অন্তর্ভুক্ত করে। রাষ্ট্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।
কাজী রফিক
সূচিপত্র
তারামন বিবি : ০৯
ট্রাইব্যুনাল : ৩৩
সারি সারি লাশ : ৫৩
চোর : ৭১