নুরুল করিম :
হেমন্তের কুয়াচ্ছন্ন সন্ধ্যা। কতশত ভিড় ঠেলে উপস্থিত লালকুঠির ঘাটে। চোখের সামনে ‘কমলা রকেট’! অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, স্বপ্নময় যাত্রার শুরুটা বোধহয় এমনই হয়। লঞ্চের ভেঁপুর আওয়াজে হুটহাট ঘোর কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ যাত্রীদের কাছে হয়তো, প্যাডেল স্টিমার যাত্রা খুবই সাধারণ ঘটনা।
সন্ধ্যা ৬ টায় স্টিমারের সাইরেন বেজে উঠল। ডুবো ডুবো সূর্যের বিপরীতে নোঙর উঠল স্টিমারের। সামনে স্রোতস্বিনী নদী আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে, দু’পাড়ে মানবজীবন চোখে ধরা দিচ্ছে অদ্ভুত সব রূপে। কানে হেডফোন, সেখানে হয়তো বাজছে শ্রেয়া ঘোষাল আর বাবুল সুপ্রিয়’র গান— ফুটপাতে ভীড় জাহাজের ডাক ফিরে চলে যায়…
দেশের নৌ পরিবহনের একমাত্র ‘এন্টিক সার্ভিস’ রকেট স্টিমারে প্রথম ভ্রমণের দৃশ্যপট ঠিক এভাবেই স্মৃতির পাতায় লেপ্টে আছে। ‘রকেট স্টিমার’ বা ‘প্যাডেল স্টিমারের’ নাম অনেকেই শুনেছেন। যারা শোনেননি, তাদের বলি—নদীমাতৃক বাংলাদেশের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে দেড়শ’ বছর ধরে চলা একটি জনপ্রিয় নৌযান প্যাডেল স্টিমার।
দেশে রকেট স্টিমার এলো যেভাবে
১৮৭৮ সালে রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানি প্যাডেল স্টিমার সার্ভিস চালু করে। ফ্লেমিংগো, ফ্লোরিকান, লেপচা, টার্ন, অস্ট্রিচ, বেলুচিসহ স্টিমারের আরো কত কী নাম! বলা হয়ে থাকে, সেই সময়ে ব্রিটিশ সরকার বরিশালে রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ব্যবসা হারানোর ভয়ে স্টিমারের মালিকরা ব্রিটেন বসে কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে বরিশাল রেলপথ যায়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এর মালিকানা পায় বিআইডব্লিউটিসি। একসময় কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া-আসা করলেও দেশ স্বাধীনের পর কমে আসে যাত্রাপথ। নদীর নাব্যতা বিবেচনায় সদরঘাট থেকে কখনো খুলনা, কখনো বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করত।
তেরো নদীর বুকে বিশ ঘণ্টা
শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ১০০৮ নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ। প্যাডেল স্টিমার ভ্রমণে গিয়ে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি চেনা নদীকে ছুঁয়ে যাওয়া সম্ভব। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, পদ্মা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, বাঁশখালি, গাবখান নদী, সন্ধ্যা নদী অন্যতম। অন্তত তেরোটি নদীর বুক চিরেই ঢাকা থেকে মোড়েলগঞ্জ পৌঁছাত প্যাডেল স্টিমার।
বিআইডাব্লিউটিসির এই পরিবহনের কাগুজে নাম ‘রকেট সার্ভিস’। সদরঘাট থেকে মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত এই প্যাডেল স্টিমারে যেতে সময় লাগত প্রায় ২০ ঘণ্টা। ধীরগতির এই জলযানের নাম কী করে রকেট হয়? কিন্তু একটা সময়ে এই প্যাডেল স্টিমারগুলোই ছিল সবচেয়ে দ্রুততম জলযান। সে কারণেই হয়তো এই সার্ভিসের নামকরণ করা হয়েছে রকেটের নামে!
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি
বর্তমান বিশ্বে প্যাডেল স্টিমার আছে হাতে গোনা অল্প কিছু। বাংলাদেশে আছে চারটি, এর মধ্যে তিনটি সচলযোগ্য। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হওয়ার ৭ মাস পর যাত্রী চাহিদার কারণে ঈদ উপলক্ষে দেখা যায় এই স্টিমার। যাত্রীর অভাবে আবারও প্যাডেল স্টিমার চলাচল বন্ধ রয়েছে। আর কোনোদিনও ভেঁপু বাজিয়ে নদীর বুক চিরে চলতে দেখা যাবে না।
বর্তমানে বাবুবাজার লাগোয়া বাদামতলী ঘাটে গেলেই দেখা মিলবে পিএস মাহসুদ ও পিএস লেপচা। বাকি দুটি নারায়ণগঞ্জ ডকওয়ার্ড ও কাঞ্চন ব্রিজের কাছে রয়েছে। এমভি মধুমতির মাস্টার আব্দুল হাই বলেন, ‘আমি একসময় পিএস মাসউদ চালিয়েছি। এ স্টিমার একসময় বাষ্পীয় ইঞ্জিনে চলত। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে এক কয়লার ডিপোও ছিল। পিএস মাসউদকে ১৯৯০ সালের পরে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়। এগুলোর স্পিড নেই, মান্ধাতার আমলের, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী।’
ঐতিহ্যের প্যাডেল স্টিমার আর যাত্রীসেবায় ফিরছে না। এগুলোর মধ্যে সর্বশেষ সেবা দেওয়া পিএস মাসউদ সংরক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাকিগুলোকে ভাসমান হোটেলও করা হতে পারে। সদরঘাট, কাঞ্চন ব্রিজ, চাঁদপুর ও বরিশালে ঠাঁই হবে সেগুলোর।
সাইরেন বাজিয়ে ঘাট ছাড়ে লঞ্চ। সদরঘাটের বাতাসে সেই শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সুর মেলায় আরেকটি লঞ্চ। কিন্তু স্টিমারের শেষ সাইরেন যে একেবারেই মিলিয়ে গেল, তা শুধুই ইতিহাস হয়ে থাকবে। জমা থাকবে স্মৃতির পাতায়।
চড়েছেন বিখ্যাত ব্যক্তিরা, হয়েছে সিনেমা
প্যাডেল ইঞ্জিনচালিত স্টিমারের প্রধান বৈশিষ্ট্য দুই পাশে প্র্রপেলার। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছাদের রেলিং ও দোতলার সম্মুখভাগ। অনেক বিদেশি শুধু এটাতে চড়তেই বাংলাদেশে আসতেন। প্যাডেল স্টিমারের যাত্রীর তালিকায় আছে কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নামও। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই নৌযানে চড়েন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোসহ দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মৃতি রয়েছে এ বাহনে চড়ার।
অসংখ্য বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে প্যাডেল স্টিমারে। তবে শুধুই প্যাডেল স্টিমারকে কেন্দ্রে রেখে ২০১৮ সালে নির্মিত হয় ‘কমলা রকেট’ । কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ ও ‘সাইপ্রাস’ নামক দুটি গল্প অবলম্বনে সিনেমাটি পরিচালনা করেন নূর ইমরান মিঠু। চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষ অব্দি পুরোটাই শুটিং করা হয় স্টিমারে। ছিয়ানব্বই মিনিটের সেলুলয়েড যাত্রাপথে দেখানো হয় কমলা রঙের রকেটে চড়ে বসে সমাজের আপার ক্লাস, লোয়ার ক্লাস আর মৃত একটি লাশ।