9:13 pm, Sunday, 22 December 2024

কবি বন্দে আলী মিয়ার বিরল প্রতিভা

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:৩২:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 260 ভিউ
শেয়ার করুন

ফারুক আহমেদ

বিশ্বসাহিত্যে অমর কথাসাহিত্যিক কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর মূল্যবান রচনা পড়লে মনের আকাশজুড়ে এক অনন্য নিদর্শন আকাশ তৈরি হয়। গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, ছোটদের জন্য অফুরন্ত রচনা, স্মৃতিকথাসহ একাধিক বিষয়ে বই লিখেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যসেবায় তাঁর অনন্য প্রয়াস সার্থক করেছে বাংলাকে। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে। তবু তিনি অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে গেলেন। কেন তিনি আজ বড় প্রাসঙ্গিক হয়েও আড়ালে রয়ে যাচ্ছেন? তার উত্তর আজও অধরা। মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন যে লেখক, সেই লেখক যদি উপেক্ষিত হন, তবে কার না দুঃখ হয়! ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে-নাহি কেহ পর’খ্যাত কবিকে আমরা ভুলে যাচ্ছি একটু একটু করে। এই বঙ্গে তাঁর চর্চা হচ্ছে কই?

পাঠ্যপুস্তকেও এই খ্যাতিমান কবি ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। শিশু ও বড়দের অনুপ্রেরণা দিতে ও নতুন সাহিত্য সাধনায় এগিয়ে আসতে সাহস জোগান এসব কবি–সাহিত্যিক। উপেক্ষিত ও বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাওয়া বিরল কবি ও কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যচর্চা নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। তাঁর রচিত বইগুলো নতুন করে প্রকাশিত হোক। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশের উদ্যোগ নিক। কবির পাঠকেরা এখন চাইছেন এক মলাটে কবিকে পেতে। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করে। কিছু গ্রন্থের নাম তুলে ধরছি। আশা রাখছি, পাঠকদের মন ভরে যাবে। এই কবির লেখা গ্রন্থ পড়লে মনের প্রসারতা বাড়ে, অনন্ত ভালো লাগায় মেতে ওঠা যায়।

১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের রাধানগর গ্রামে। পিতা মুনশি উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেসা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। বাংলা সাহিত্যে বিরল প্রতিভা ও সব পল্লিকবির মধ্যে অন্যতম ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যকীর্তিতে তিনি যে উচ্চতায় উঠতে পেরেছিলেন, তার জন্য তিনি মনে করেন তাঁর মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। মায়ের মুখের অফুরন্ত গল্প ও রূপকথা শুনেই বড় হচ্ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। জীবনের শুরুতে প্রথাগত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। কয়েক বছর পর বন্দে আলী মিয়া বাংলাদেশের পাবনা শহরের মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি হন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়া শেষ হলে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে চিত্রবিদ্যায় ভর্তি হন কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে। চিত্রবিদ্যা নিয়েই ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বন্দে আলী মিয়া প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পড়াশোনার সময় তিনি ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ওই সময় থেকেই উজাড় করে দিতে লাগলেন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এটি একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলো ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে, ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ নামে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা পাঠককেই মুগ্ধ করেছিল। সাহিত্য আলোচকদের মনেও দাগ কাটে ওই কাব্যগ্রন্থ। ওই সময়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন তিনি। বন্দে আলী মিয়ার রচিত লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রতিষ্ঠিতদের পাশে প্রকাশিত হতে লাগল। ‘ময়নামতির চর’ কাব্যটি পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চ প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়াকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই চিঠির শেষে লিখেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’ বিশ্বকবির ওই মূল্যায়ন সার্থক হয়। তিনি লেখালেখির জীবনে একটা দারুণ উৎসাহ পেয়ে গেলেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে বন্দে আলী মিয়ার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘অনুরাগ’ প্রকাশিত হলো। তারপর কবিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে লাগল ‘স্বপ্নসাধে’, ‘মৃগপরী’, ‘বোকা জামাই’, ‘লীলাকমল’, ‘কামাল আতাতুর্ক’, ‘মধুমতির চর’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবি শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পকলাতেও সুনাম অর্জন করেন। তিনি ছবি আঁকতেন মনের বিশাল ক্যানভাসকে ছবিতে উদ্ভাসিত করতে। গ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্র চিত্রায়ণ থেকে পেশাদারি ছবিও এঁকেছেন তিনি অঢেল।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগ কবিকে ছিন্নমূল করে দিল। অবশেষে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যান নিজ গ্রামে। বাংলাদেশে ফিরে তিনি বেকার হয়ে পড়লেন। বই লিখে ও ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। দেশভাগ কবি বন্দে আলী মিয়া মেনে নিতে পারেননি। ওই সময় তিনি গভীর বেদনায় ভেঙে পড়েন। তিনি চেয়েছিলেন দুই বাংলাকে একসূত্রে বাঁধতে। দুই বাংলার মিলন প্রয়াসে তাঁর রচিত সাহিত্য পড়লে আমাদের চিবুক চোখের জলে ভিজে যায়। কবি ‘কিশোর পরাগ’, ‘জ্ঞানবার্তা’ নামে শিশু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও সাহিত্যের প্রায় সব বিষয়ে তিনি বলিষ্ঠ বিচরণ করেছেন। কিন্তু আমরা তাঁর সাহিত্যসেবার সুফল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি না কি! বাংলা সাহিত্যে এমন শক্তিশালী কবি ও সাহিত্যিক কম উঠে এসেছেন। তাঁর রচিত ‘পদ্মানদীর চর’, ‘দিবাস্বপ্ন’, ‘তাসের ঘর’, ‘মনের ময়ূর’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘ডাইনি বউ’, ‘রূপকথা’, ‘অরণ্য গোধূলি’ গ্রন্থ পাঠ করলে মনের আকাশ কার না সমৃদ্ধ হয়! তিনি যখন রেডিওতে চাকরি করতেন, তখন তিনি গল্পদাদু নামে শিশুদের মন জয় করে নেন। কারণ, বাচ্চাদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামে এক অনুষ্ঠান।

কবি শিশুদের মন ভরাতে ওই অনুষ্ঠানকে আরও আকর্ষণীয় করতে নিজেই শিশুদের উপযোগী গল্প শুনিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিতেন। যার ফলে বেতারে প্রচারিত ‘সবুজ মেলা’ অনুষ্ঠানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে চাকরি করার সময় বন্দে আলী মিয়া প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘দক্ষিণ দিগন্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। ‘কথিকা ও কাহিনি’ ও ‘ধরিত্রী’ নামে পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পায়। কবি নাটক রচনাতেও বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। ‘বৌদিদির রেস্টুরেন্ট’, ‘জোয়ার-ভাটা’, ‘গাধা হাকিম’, ‘উদয় প্রভাত’সহ আরও ১৪টি অতি উচ্চমানের নাটক পাঠকদের উপহার দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি হাস্যকৌতুক সৃষ্টিতেও দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত কয়েকটি শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এসব গ্রন্থ পাঠ করলে বাচ্চারা এবং সব পথভ্রষ্ট মানুষ আদর্শ মানুষ হওয়ার রসদ পাবে বলে আমার বিশ্বাস। উদাহরণস্বরূপ ‘হযরত আবু বক্কর’, ‘হযরত ওমর ফারুক’, ‘হাজী মহসিন’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘ছোটদের সিরাজদৌল্লা’, ‘বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’, ‘মীর মশাররফ হোসেন’, ‘ছোটদের কলম্বাস’, ‘ছোটদের আব্রাহাম লিংকন’, ‘ছোটদের সোহরাওয়ার্দী’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘বেগম রোকেয়া’, ‘হিটলার’, ‘রাবেয়া বসরী’, ‘শরৎচন্দ্র’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তাঁর রূপকথার গ্রন্থ পাঠ করে আমরা সমৃদ্ধ না হয়ে পারি না। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সংগীত রচনাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ।

বন্দে আলী মিয়া রচিত গানের বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কলগীতি’, ‘সুরলীলা’ প্রভৃতি। তাঁর গানের বইয়ে আমরা যেমন পাই পল্লিগীতি, তেমনি আছে দেশের গান, মরমি গান ও হাসির গান। বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁর গানে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন। গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, গল্পকথা, ছোটদের জন্য প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে যেমন, তেমনই সাহিত্যপথেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
তবু কবি অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে গেলেন আমাদের ভুল পদক্ষেপে। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর চর্চা হচ্ছে কই? পাঠ্যপুস্তকেও কবি ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কবি বন্দে আলী মিয়ার ব্যাপারে একটু সজাগ হলে ভালো হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সঠিক উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের নামে বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল তীর্থ ও কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। কবি বন্দে আলী মিয়ার মর্যাদা সন্ধানে বাঙালি সমাজকেই আরও এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃত অর্থে ঘরে ঘরে কবি বন্দে আলী মিয়ার চর্চা করা জরুরি বলে মনে করি। কবি বন্দে আলী মিয়া বিশাল সাহিত্য সাধনা করেছেন। এখানে তাঁর জীবনের অনন্ত সৃষ্টির অল্প দিক তুলে ধরার এক আন্তরিক চেষ্টা করলাম। যদি সঠিক পদক্ষেপে তাঁর মূল্যায়ন হয়, তাহলে এই প্রয়াস সার্থক হবে। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন রাজশাহীতে পরলোকগমন করেন। তাঁর মূল্যবান সাহিত্য নির্মাণ বাংলা সাহিত্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ইতিমধ্যেই। বিশ্বজুড়ে কবি বন্দে আলী মিয়া ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁর বলিষ্ঠ ও সাহিত্যরসে পূর্ণ লেখার গুণে।

তথ্যসূত্র: আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত বন্দে আলী মিয়া ১ম ও ২য় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

  • লেখক: সম্পাদক প্রকাশক উদার আকাশ। কলকাতা, ভারত।

 

#
জনপ্রিয়

কবি বন্দে আলী মিয়ার বিরল প্রতিভা

আপডেটের সময় : ০৭:৩২:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

ফারুক আহমেদ

বিশ্বসাহিত্যে অমর কথাসাহিত্যিক কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর মূল্যবান রচনা পড়লে মনের আকাশজুড়ে এক অনন্য নিদর্শন আকাশ তৈরি হয়। গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, ছোটদের জন্য অফুরন্ত রচনা, স্মৃতিকথাসহ একাধিক বিষয়ে বই লিখেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যসেবায় তাঁর অনন্য প্রয়াস সার্থক করেছে বাংলাকে। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে। তবু তিনি অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে গেলেন। কেন তিনি আজ বড় প্রাসঙ্গিক হয়েও আড়ালে রয়ে যাচ্ছেন? তার উত্তর আজও অধরা। মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন যে লেখক, সেই লেখক যদি উপেক্ষিত হন, তবে কার না দুঃখ হয়! ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে-নাহি কেহ পর’খ্যাত কবিকে আমরা ভুলে যাচ্ছি একটু একটু করে। এই বঙ্গে তাঁর চর্চা হচ্ছে কই?

পাঠ্যপুস্তকেও এই খ্যাতিমান কবি ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। শিশু ও বড়দের অনুপ্রেরণা দিতে ও নতুন সাহিত্য সাধনায় এগিয়ে আসতে সাহস জোগান এসব কবি–সাহিত্যিক। উপেক্ষিত ও বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাওয়া বিরল কবি ও কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যচর্চা নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। তাঁর রচিত বইগুলো নতুন করে প্রকাশিত হোক। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশের উদ্যোগ নিক। কবির পাঠকেরা এখন চাইছেন এক মলাটে কবিকে পেতে। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করে। কিছু গ্রন্থের নাম তুলে ধরছি। আশা রাখছি, পাঠকদের মন ভরে যাবে। এই কবির লেখা গ্রন্থ পড়লে মনের প্রসারতা বাড়ে, অনন্ত ভালো লাগায় মেতে ওঠা যায়।

১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের রাধানগর গ্রামে। পিতা মুনশি উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেসা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। বাংলা সাহিত্যে বিরল প্রতিভা ও সব পল্লিকবির মধ্যে অন্যতম ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যকীর্তিতে তিনি যে উচ্চতায় উঠতে পেরেছিলেন, তার জন্য তিনি মনে করেন তাঁর মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। মায়ের মুখের অফুরন্ত গল্প ও রূপকথা শুনেই বড় হচ্ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। জীবনের শুরুতে প্রথাগত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। কয়েক বছর পর বন্দে আলী মিয়া বাংলাদেশের পাবনা শহরের মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি হন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়া শেষ হলে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে চিত্রবিদ্যায় ভর্তি হন কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে। চিত্রবিদ্যা নিয়েই ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বন্দে আলী মিয়া প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পড়াশোনার সময় তিনি ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ওই সময় থেকেই উজাড় করে দিতে লাগলেন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এটি একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলো ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে, ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ নামে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা পাঠককেই মুগ্ধ করেছিল। সাহিত্য আলোচকদের মনেও দাগ কাটে ওই কাব্যগ্রন্থ। ওই সময়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন তিনি। বন্দে আলী মিয়ার রচিত লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রতিষ্ঠিতদের পাশে প্রকাশিত হতে লাগল। ‘ময়নামতির চর’ কাব্যটি পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চ প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়াকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই চিঠির শেষে লিখেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’ বিশ্বকবির ওই মূল্যায়ন সার্থক হয়। তিনি লেখালেখির জীবনে একটা দারুণ উৎসাহ পেয়ে গেলেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে বন্দে আলী মিয়ার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘অনুরাগ’ প্রকাশিত হলো। তারপর কবিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে লাগল ‘স্বপ্নসাধে’, ‘মৃগপরী’, ‘বোকা জামাই’, ‘লীলাকমল’, ‘কামাল আতাতুর্ক’, ‘মধুমতির চর’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবি শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পকলাতেও সুনাম অর্জন করেন। তিনি ছবি আঁকতেন মনের বিশাল ক্যানভাসকে ছবিতে উদ্ভাসিত করতে। গ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্র চিত্রায়ণ থেকে পেশাদারি ছবিও এঁকেছেন তিনি অঢেল।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগ কবিকে ছিন্নমূল করে দিল। অবশেষে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যান নিজ গ্রামে। বাংলাদেশে ফিরে তিনি বেকার হয়ে পড়লেন। বই লিখে ও ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। দেশভাগ কবি বন্দে আলী মিয়া মেনে নিতে পারেননি। ওই সময় তিনি গভীর বেদনায় ভেঙে পড়েন। তিনি চেয়েছিলেন দুই বাংলাকে একসূত্রে বাঁধতে। দুই বাংলার মিলন প্রয়াসে তাঁর রচিত সাহিত্য পড়লে আমাদের চিবুক চোখের জলে ভিজে যায়। কবি ‘কিশোর পরাগ’, ‘জ্ঞানবার্তা’ নামে শিশু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও সাহিত্যের প্রায় সব বিষয়ে তিনি বলিষ্ঠ বিচরণ করেছেন। কিন্তু আমরা তাঁর সাহিত্যসেবার সুফল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি না কি! বাংলা সাহিত্যে এমন শক্তিশালী কবি ও সাহিত্যিক কম উঠে এসেছেন। তাঁর রচিত ‘পদ্মানদীর চর’, ‘দিবাস্বপ্ন’, ‘তাসের ঘর’, ‘মনের ময়ূর’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘ডাইনি বউ’, ‘রূপকথা’, ‘অরণ্য গোধূলি’ গ্রন্থ পাঠ করলে মনের আকাশ কার না সমৃদ্ধ হয়! তিনি যখন রেডিওতে চাকরি করতেন, তখন তিনি গল্পদাদু নামে শিশুদের মন জয় করে নেন। কারণ, বাচ্চাদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামে এক অনুষ্ঠান।

কবি শিশুদের মন ভরাতে ওই অনুষ্ঠানকে আরও আকর্ষণীয় করতে নিজেই শিশুদের উপযোগী গল্প শুনিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিতেন। যার ফলে বেতারে প্রচারিত ‘সবুজ মেলা’ অনুষ্ঠানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে চাকরি করার সময় বন্দে আলী মিয়া প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘দক্ষিণ দিগন্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। ‘কথিকা ও কাহিনি’ ও ‘ধরিত্রী’ নামে পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পায়। কবি নাটক রচনাতেও বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। ‘বৌদিদির রেস্টুরেন্ট’, ‘জোয়ার-ভাটা’, ‘গাধা হাকিম’, ‘উদয় প্রভাত’সহ আরও ১৪টি অতি উচ্চমানের নাটক পাঠকদের উপহার দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি হাস্যকৌতুক সৃষ্টিতেও দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত কয়েকটি শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এসব গ্রন্থ পাঠ করলে বাচ্চারা এবং সব পথভ্রষ্ট মানুষ আদর্শ মানুষ হওয়ার রসদ পাবে বলে আমার বিশ্বাস। উদাহরণস্বরূপ ‘হযরত আবু বক্কর’, ‘হযরত ওমর ফারুক’, ‘হাজী মহসিন’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘ছোটদের সিরাজদৌল্লা’, ‘বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’, ‘মীর মশাররফ হোসেন’, ‘ছোটদের কলম্বাস’, ‘ছোটদের আব্রাহাম লিংকন’, ‘ছোটদের সোহরাওয়ার্দী’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘বেগম রোকেয়া’, ‘হিটলার’, ‘রাবেয়া বসরী’, ‘শরৎচন্দ্র’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তাঁর রূপকথার গ্রন্থ পাঠ করে আমরা সমৃদ্ধ না হয়ে পারি না। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সংগীত রচনাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ।

বন্দে আলী মিয়া রচিত গানের বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কলগীতি’, ‘সুরলীলা’ প্রভৃতি। তাঁর গানের বইয়ে আমরা যেমন পাই পল্লিগীতি, তেমনি আছে দেশের গান, মরমি গান ও হাসির গান। বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁর গানে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন। গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, গল্পকথা, ছোটদের জন্য প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে যেমন, তেমনই সাহিত্যপথেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
তবু কবি অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে গেলেন আমাদের ভুল পদক্ষেপে। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর চর্চা হচ্ছে কই? পাঠ্যপুস্তকেও কবি ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কবি বন্দে আলী মিয়ার ব্যাপারে একটু সজাগ হলে ভালো হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সঠিক উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের নামে বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল তীর্থ ও কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। কবি বন্দে আলী মিয়ার মর্যাদা সন্ধানে বাঙালি সমাজকেই আরও এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃত অর্থে ঘরে ঘরে কবি বন্দে আলী মিয়ার চর্চা করা জরুরি বলে মনে করি। কবি বন্দে আলী মিয়া বিশাল সাহিত্য সাধনা করেছেন। এখানে তাঁর জীবনের অনন্ত সৃষ্টির অল্প দিক তুলে ধরার এক আন্তরিক চেষ্টা করলাম। যদি সঠিক পদক্ষেপে তাঁর মূল্যায়ন হয়, তাহলে এই প্রয়াস সার্থক হবে। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন রাজশাহীতে পরলোকগমন করেন। তাঁর মূল্যবান সাহিত্য নির্মাণ বাংলা সাহিত্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ইতিমধ্যেই। বিশ্বজুড়ে কবি বন্দে আলী মিয়া ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁর বলিষ্ঠ ও সাহিত্যরসে পূর্ণ লেখার গুণে।

তথ্যসূত্র: আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত বন্দে আলী মিয়া ১ম ও ২য় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

  • লেখক: সম্পাদক প্রকাশক উদার আকাশ। কলকাতা, ভারত।