সেলিনা হোসেন
আমাদের সমাজে মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে- এ রকম একটি চেতনা মানুষের মনে নানাভাবে ধারণ করে। বিশেষ করে অর্থ, লোভ-লালসা আর ক্ষমতা। আর সেজন্য দেশের নানা স্থানে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নারী-শিশুরা দুর্বৃত্তের অস্ত্রের মুখে, প্রতারণা বা ফাঁদে পড়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রায় নিত্যদিনই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে নারী ও শিশু নির্যাতন-নিপীড়নের খবর। তবে এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না, সব খবরই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে না। অনেক খবর থেকে যায় খবরের আড়ালে। সমাজে নারী নির্যাতনের বহুমাত্রিক চিত্র সভ্যতা ও মানবতার কলঙ্ক- এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। শুধু নারীই নয়, সমান্তরালে চলছে শিশু নির্যাতনও, বিশেষ করে কন্যাশিশু নির্যাতন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) নামে একটি সংগঠন জানিয়েছে, নভেম্বর মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৫৮টি। এর মধ্যে ৪৩টি ধর্ষণের ঘটনা, ৮টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর দুই নারীকে হত্যা করা হয়েছে। আগের মাসের তুলনায় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা কিছুটা কমলেও তা উদ্বেগজনক রয়ে গেছে বলে মনে করছে এমএসএফ। এ ছাড়া এই প্রতিবেদনে কারাগারে মৃত্যু এবং গণপিটুনির তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। এমএসএফের মাসিক রিপোর্টে বলা হয়, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন রয়েছে, তার পরও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় না। রিপোর্টে বলা হয়, ধর্ষণের শিকার ৪৩ জনের মধ্যে ৯ শিশু ও ১৫ জন কিশোরী। এ ছাড়া আরও ২ কিশোরী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে অপর দুই কিশোরী। এদিকে গত মাসে ১৮টি ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। ১৭ জনকে যৌন হয়রানি এবং শারীরিক নির্যাতনের ৪৮টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ২৩ কিশোরী ও ৪৬ নারীসহ ৬৯ ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। নির্যাতন-নিপীড়নের অহরহ ঘটে চলা ঘটনাগুলো বলে দেয়, আমাদের সংস্কৃতি অপরাজনীতি ও একই সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার কাছে পরাজিত হচ্ছে। পিছু হটছে চিরকালীন মূল্যবোধ।
নারীর প্রতি একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে, যা কারও কাম্য নয়। নারী নির্যাতনের পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বৈষম্যের। সামাজিক বৈষম্যের ছায়া যত বিস্তৃত হচ্ছে, নারী নির্যাতন তত বাড়ছে। করোনা মহামারী, অর্থনৈতিক চাপসহ নানা কারণে নারীরা এখন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন আগের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে ছবির অপব্যবহারসহ নানাভাবে অনলাইনে বিদ্বেষের সম্মুখীন হন নারীরা। ফলে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছু হটে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কিছু ঘটনা সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা ক্রমে বাড়লেও সেভাবে দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। আমাদের মনে আছে রূপার কথা। চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার রূপা পৈশাচিকতা-বর্বরতার ছোবলাক্রন্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জের রূপা বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে বাসের মধ্যে চালক ও তার সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তার পরও গণপরিবহনে নারী নিপীড়নের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেন বন্ধ হচ্ছে না?
সরকার নারী শিক্ষা ও নারীদের স্বাবলম্বী করতে নীতিগতভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। অথচ এখনো গণপরিবহনে যাতায়াতে নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে উৎকট চিত্র। শুধু যে গণপরিবহনেই নারীকে হয়রানি-নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই মার্কেটে, কর্মস্থলে, পথেঘাটে এমন হয়রানির চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। নৈতিক অবক্ষয়ের এ কোন উৎকট রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি? দেশের সব এলাকায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা ঘটছেই। এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সমাজের ভঙ্গুর দৃশাই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সমাজে কীভাবে অবক্ষয়ের ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে, এর কুনজির যেন মেলে ক্ষণে ক্ষণে। নৈতিকতার বালাইহীন ও সামাজিক ভয়ভীতি এবং অনুশাসনহীন এমন সমাজ তো কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমি মনে করি, সরকার ও প্রশাসন তো বটেই, সুশীল সমাজকেও এসব বিষয়ে গভীর গুরুত্ব দিয়ে সোচ্চার হতে হবে। এই অবক্ষয়ের ধস ঠেকাতেই হবে।
আমাদের সমাজ বাস্তবতায় যেন প্রতীয়মান হয়, ক্ষয়ের ভাগ বেশি, নির্মাণের অংশ ধীর। আমরা দেখছি, ঢাকা মহানগরীর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নেই। আবার এখানে শিক্ষার্থীর জন্য নেই আলাদা গণপরিবহন ব্যবস্থাও। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি যেভাবে ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এর দায় কি সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা এড়াতে পারেন? কোনো সভ্য সমাজে এমনটি চলতে পারে না। গণপরিবহনের ঘটনাগুলো কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। মনে করি, দেশে গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের হয়রানি, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা সবকিছু যুক্ত করে বহুপক্ষীয় আলোচনাক্রমে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের দায় যে অনেক বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, গুরুতর অপরাধের মামলাগুলোর নিষ্পত্তির গতিও ধীর। আবার মামলা গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অনেকেরই রয়েছে নানা গাফিলতি কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা। আমরা জানি, বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারের প্রত্যাশার মূলে কুঠারাঘাত করে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। এই পরিস্থিতি থেকে আমরা কিছুটা বের হয়ে আসতে পারলেও এর নিরসন ঘটানো যাচ্ছে না বলেই অন্ধকার জিইয়ে আছে। স্বীকার করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অনেক মানবিক ও দায়িত্বশীল সদস্য রয়েছেন। সাম্প্রতিকের ঘটনায়ও এর সাক্ষ্য মিলেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও বলতে হয়, তাদেরই কারও কারও দুষ্কর্মের খতিয়ানও রয়েছে। এ-ও সত্য, আইন অপরাধীকে শাস্তি দিলেও মানবিক করতে পারছে না। এজন্য বিশেষ কর্মপরিকল্পনা নেওয়া জরুরি বলে মনে করি।
নারী-পুরুষের একসঙ্গে নিরাপদ অবস্থান সব ক্ষেত্রে মানবিক শ্রেয়বোধের আলোয় আলোকিত হবে- এই প্রত্যাশা কবে পূর্ণতা পাবে? সেই সময় তৈরি করতে হবে আমাদেরই। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে যূথবদ্ধভাবে। সবার যূথবদ্ধ প্রয়াসেই নিষ্কণ্টক করতে হবে মানুষের জীবনযাপনের সব পথ। তবেই জীবন মুক্ত হবে রাহুগ্রাসের থাবা থেকে। সামাজিক মূল্যবোধগুলোকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে এ ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করা যাবে না। অবশ্যই আশা করব, এ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে যা যা করণীয় সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করা হবে। বিশেষ করে আমরা যদি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারি তা হলেই ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব।
সূত্র : আমাদের সময় সম্পাদকীয়