8:09 pm, Sunday, 22 December 2024

হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে গুলতেকিনকে বিয়ে করেছিলেন!

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ ২০২৪
  • 120 ভিউ
শেয়ার করুন

বিপাশা ইসলাম :

গুলতেকিন এর সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, এই জীবনে বেশিরভাগ কাজই আমি করেছি ঝোঁকের মাথায়। ডিগ্রী শেষ করে দেশে ফিরলাম। সাত বছর আমেরিকায় কাটিয়ে যে সম্পদ নিয়ে ফিরলাম তা হলো, নগদ পঞ্চাশ ডলার, দুই স্যুটকেস ভর্তি বাচ্চাদের পুরানো খেলনা, এক স্যুটকেস বই এবং প্রচুর চকলেট।

কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায় আমি শুধু যে গোছানো তা না, অসম্ভব গোছানো। উদ্ভট একেকটা কাণ্ড করে বসি। কোনো সুস্থ মাথার মানুষ যা কখনো করবে না। গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ে হয় এমন ঝোঁকের মাথায়। তখন আমি হতদরিদ্র। লেকচারার হিসেবে ইউনিভার্সিটি থেকে সব মিলিয়ে সাত/আটশ টাকা পাই। দুই ভাইবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাবর রোডের এক বাসায় থাকি। সে বাসা সরকারী বাসা। এভিকেশন নোটিস হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট নিজে এসে বলে গেছেন, বাড়ি ছেড়ে দিতে। পনেরো দিনের নোটিস। বাড়ি না ছাড়লে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হবে। টাকা-পয়সার দিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব। মাসের শেষের দিকে বেশির ভাগ সময়ই বাসে করে ইউনিভার্সিটিতে আসার পয়সাও থাকে না। হেঁটে হেঁটে আমি ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি। নিতান্ত পাগল না হলে এমন অবস্থা কেউ বিয়ের চিন্তা করে না।

আমার মনে হলো, গুলতেকিন নামের এই বালিকাটিকে পাশে না পেলে আমার চলবে না। গুলতেকিনের মা-বাবা আমার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। বড় মেয়েরই বিয়ে হয়নি। ক্লাস টেনে পড়া মেয়ের বিয়ে হবে কী করে? কী করা যায় কিছুই ভেবে পাই না।

একদিন গুলতেকিন ডিপার্টমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি বললাম, চলো, এক কাজ করি– আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। সে চোখ বড় বড় করে বলল,

–কেন? কোর্টে গিয়ে বিয়ে করব কেন?

–খুব মজা হবে। নতুন ধরনের হবে। ব্যাপারটা খুব নাটকীয় না? তোমাকে ভাবার জন্য তিন মিনিট সময় দিলাম। তুমি ভেবে দেখ, তারপর বলো।

সে ভাবার জন্য তিন মিনিটের মতো দীর্ঘ সময় নিল না। এক মিনিট পরেই বলল,

–চলুন যাই। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরে আসিনি। সালোয়ার-কামিজ পরে কি বিয়ে করা যায়?

কোর্টে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না। কনের বয়স চৌদ্দ। এই বয়সে বিয়ে হয় না। আমি কোনো উপায় না দেখে তার ফুপু খালেদা হাবীবকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। আমার সাহিত্যপ্রতিভার পুরোটাই ঢেলে দিলাম চিঠিতে। চিঠি পড়ে তিনি বিস্মিত এবং খুব সম্ভব মুগ্ধ। কারণ তিনি গুলতেকিনের পরিবারের সবাইকে ডেকে দৃঢ় গলায় বললেন, এই ছেলের সঙ্গেই গুলতেকিনের বিয়ে দিতে হবে। অন্য কোথাও নয়। ভবিষ্যৎ-এ যা হবার হবে।

আমার চিঠির জবাবে তিনি লিখলেন – আপনার অদ্ভুত চিঠি পেয়েছি। এত বানান ভুল কেন?

তারা ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখে বিয়ে হবে। এই খবরে আমার এবং মা’র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হাতে একটা পয়সা নেই। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। এই অবস্থায় বিয়ে! কে জানে নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসে দেখা যাবে পুলিশ দিয়ে সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নতুন বউ নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে।

মা তাঁর সর্বশেষ সম্বল বাবার দেওয়া হাতের একজোড়া বালা, যা তিনি চরম দুঃসময়েও যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন, বিক্রি করে বিয়ের বাজার করলেন। জিনিসপত্রগুলি খুব সস্তা ধরনের কিন্তু তাতে মিশে গেল আমার বাবা এবং মা’র ভালোবাসা। আমি জানতাম, ভালোবাসার এই কল্যাণময় স্পর্শেই আমার অনিশ্চয়তা, হতাশা কেটে যাবে।

বউ নিয়ে বাসায় ফিরে বড় ধরনের চমক পেলাম। আমার শোবার ঘরটি অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমার ছোট বোন। আমাদের কোনো ফ্যান ছিল না। কিন্তু আজ মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বিছানায় কী সুন্দর ভেলভেটের চাদর। খাটের পাশে সুন্দর দুটি বেতের চেয়ার। বেতের চেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে একগাদা রক্ত গোলাপ। গোলাপের পাশে একটা চিঠিও পেলাম। মেজো বোন শিখুর লেখা চিঠি–

“দাদা ভাই,

তুমি যেসব গান পছন্দ করতে তার সব ক’টি টেপ করা আছে। কথা বলতে বলতে তোমরা যদি ক্লান্ত হয়ে পড় তাহলে ইচ্ছা করলে গান শুনতে পার। দরজার কাছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে দিয়েছি।”

ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করতেই সুচিত্রা মিত্রের কিন্নর কণ্ঠ ভেসে এলো– ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা?

গভীর আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি সেই জল গোপন করবার জন্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললাম,

–কেমন লাগছে গুলতেকিন?

সে নিচু গলায় বলল,

–বুঝতে পারছি না। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।

–ঘুম পাচ্ছে?

–না।

সারারাত আমরা গান শুনে কাটিয়ে দিলাম দু’জনের কেউই কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গান শোনা ছাড়া উপায় কী?

পরদিন ভোরবেলা খুব দুঃখজনক ব্যাপার ঘটল। যাদের বাসা থেকে সিলিং ফ্যান ধার করে আনা হয়েছিল তারা ফ্যান খুলে নিয়ে গেল। গুলতেকিন বিস্মিত হয়ে বলল,

–ওরা আমাদের ফ্যান খুলে নিচ্ছে কেন?

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বিছানার চমৎকার চাদর, বেতের চেয়ার, ক্যাসেট প্লেয়ার সবই তারা নিয়ে গেল। এমনকি টেবিলে রাখা সুন্দর ফুলদানিও অদৃশ্য। গুলতেকিন হতভম্ব। সে বলল,

–এসব কী হচ্ছে বলুন তো? ওরা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে কেন? আমরা বুঝি রাতে গান শুনব না?

গুলতেকিনের প্রশ্নের জবাব দেবার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমার নেই। আমার জন্য আরো বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে। বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এই কারণেই সবাই তড়িঘড়ি করে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

মা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে লজ্জায় কাঁপছি। আমার ছোটবোন এসে বলল,

–দাদাভাই, তুমি ভাবিকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে চলে যাও। এই নোংরা ব্যাপারটা ভাবির সামনে না হওয়াই ভালো।

আমি গুলতেকিনকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বৈশাখ মাসের ঘন নীল আকাশ, পেঁজাতুলার স্তূপীকৃত মেঘ, চনমনে রোদ। আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। হুড ফেলে দিয়েছি। আমার মনের গোপন ইচ্ছা – পৃথিবীর সবাই দেখুক, এই রূপবতী বালিকাটিকে আমি পাশে পেয়েছি। গভীর আনন্দে আমার হৃদয় পূর্ণ। বাসায় এখন কী হচ্ছে তা এখন আমার মাথায় নেই। ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়েও ভাবছি না। বর্তমানটাই সত্যি। অতীত কিছু না। ভবিষ্যৎ তো দূরের ব্যাপার। আমরা বাস করি বর্তমানে – অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না।

 

সূত্র : বিপাশা ফেসবুক থেকে

 

 

#
জনপ্রিয়

হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে গুলতেকিনকে বিয়ে করেছিলেন!

আপডেটের সময় : ০৭:০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ ২০২৪
শেয়ার করুন

বিপাশা ইসলাম :

গুলতেকিন এর সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, এই জীবনে বেশিরভাগ কাজই আমি করেছি ঝোঁকের মাথায়। ডিগ্রী শেষ করে দেশে ফিরলাম। সাত বছর আমেরিকায় কাটিয়ে যে সম্পদ নিয়ে ফিরলাম তা হলো, নগদ পঞ্চাশ ডলার, দুই স্যুটকেস ভর্তি বাচ্চাদের পুরানো খেলনা, এক স্যুটকেস বই এবং প্রচুর চকলেট।

কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায় আমি শুধু যে গোছানো তা না, অসম্ভব গোছানো। উদ্ভট একেকটা কাণ্ড করে বসি। কোনো সুস্থ মাথার মানুষ যা কখনো করবে না। গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ে হয় এমন ঝোঁকের মাথায়। তখন আমি হতদরিদ্র। লেকচারার হিসেবে ইউনিভার্সিটি থেকে সব মিলিয়ে সাত/আটশ টাকা পাই। দুই ভাইবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাবর রোডের এক বাসায় থাকি। সে বাসা সরকারী বাসা। এভিকেশন নোটিস হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট নিজে এসে বলে গেছেন, বাড়ি ছেড়ে দিতে। পনেরো দিনের নোটিস। বাড়ি না ছাড়লে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হবে। টাকা-পয়সার দিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব। মাসের শেষের দিকে বেশির ভাগ সময়ই বাসে করে ইউনিভার্সিটিতে আসার পয়সাও থাকে না। হেঁটে হেঁটে আমি ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি। নিতান্ত পাগল না হলে এমন অবস্থা কেউ বিয়ের চিন্তা করে না।

আমার মনে হলো, গুলতেকিন নামের এই বালিকাটিকে পাশে না পেলে আমার চলবে না। গুলতেকিনের মা-বাবা আমার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। বড় মেয়েরই বিয়ে হয়নি। ক্লাস টেনে পড়া মেয়ের বিয়ে হবে কী করে? কী করা যায় কিছুই ভেবে পাই না।

একদিন গুলতেকিন ডিপার্টমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি বললাম, চলো, এক কাজ করি– আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। সে চোখ বড় বড় করে বলল,

–কেন? কোর্টে গিয়ে বিয়ে করব কেন?

–খুব মজা হবে। নতুন ধরনের হবে। ব্যাপারটা খুব নাটকীয় না? তোমাকে ভাবার জন্য তিন মিনিট সময় দিলাম। তুমি ভেবে দেখ, তারপর বলো।

সে ভাবার জন্য তিন মিনিটের মতো দীর্ঘ সময় নিল না। এক মিনিট পরেই বলল,

–চলুন যাই। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরে আসিনি। সালোয়ার-কামিজ পরে কি বিয়ে করা যায়?

কোর্টে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না। কনের বয়স চৌদ্দ। এই বয়সে বিয়ে হয় না। আমি কোনো উপায় না দেখে তার ফুপু খালেদা হাবীবকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। আমার সাহিত্যপ্রতিভার পুরোটাই ঢেলে দিলাম চিঠিতে। চিঠি পড়ে তিনি বিস্মিত এবং খুব সম্ভব মুগ্ধ। কারণ তিনি গুলতেকিনের পরিবারের সবাইকে ডেকে দৃঢ় গলায় বললেন, এই ছেলের সঙ্গেই গুলতেকিনের বিয়ে দিতে হবে। অন্য কোথাও নয়। ভবিষ্যৎ-এ যা হবার হবে।

আমার চিঠির জবাবে তিনি লিখলেন – আপনার অদ্ভুত চিঠি পেয়েছি। এত বানান ভুল কেন?

তারা ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখে বিয়ে হবে। এই খবরে আমার এবং মা’র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হাতে একটা পয়সা নেই। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। এই অবস্থায় বিয়ে! কে জানে নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসে দেখা যাবে পুলিশ দিয়ে সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নতুন বউ নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে।

মা তাঁর সর্বশেষ সম্বল বাবার দেওয়া হাতের একজোড়া বালা, যা তিনি চরম দুঃসময়েও যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন, বিক্রি করে বিয়ের বাজার করলেন। জিনিসপত্রগুলি খুব সস্তা ধরনের কিন্তু তাতে মিশে গেল আমার বাবা এবং মা’র ভালোবাসা। আমি জানতাম, ভালোবাসার এই কল্যাণময় স্পর্শেই আমার অনিশ্চয়তা, হতাশা কেটে যাবে।

বউ নিয়ে বাসায় ফিরে বড় ধরনের চমক পেলাম। আমার শোবার ঘরটি অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমার ছোট বোন। আমাদের কোনো ফ্যান ছিল না। কিন্তু আজ মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বিছানায় কী সুন্দর ভেলভেটের চাদর। খাটের পাশে সুন্দর দুটি বেতের চেয়ার। বেতের চেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে একগাদা রক্ত গোলাপ। গোলাপের পাশে একটা চিঠিও পেলাম। মেজো বোন শিখুর লেখা চিঠি–

“দাদা ভাই,

তুমি যেসব গান পছন্দ করতে তার সব ক’টি টেপ করা আছে। কথা বলতে বলতে তোমরা যদি ক্লান্ত হয়ে পড় তাহলে ইচ্ছা করলে গান শুনতে পার। দরজার কাছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে দিয়েছি।”

ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করতেই সুচিত্রা মিত্রের কিন্নর কণ্ঠ ভেসে এলো– ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা?

গভীর আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি সেই জল গোপন করবার জন্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললাম,

–কেমন লাগছে গুলতেকিন?

সে নিচু গলায় বলল,

–বুঝতে পারছি না। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।

–ঘুম পাচ্ছে?

–না।

সারারাত আমরা গান শুনে কাটিয়ে দিলাম দু’জনের কেউই কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গান শোনা ছাড়া উপায় কী?

পরদিন ভোরবেলা খুব দুঃখজনক ব্যাপার ঘটল। যাদের বাসা থেকে সিলিং ফ্যান ধার করে আনা হয়েছিল তারা ফ্যান খুলে নিয়ে গেল। গুলতেকিন বিস্মিত হয়ে বলল,

–ওরা আমাদের ফ্যান খুলে নিচ্ছে কেন?

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বিছানার চমৎকার চাদর, বেতের চেয়ার, ক্যাসেট প্লেয়ার সবই তারা নিয়ে গেল। এমনকি টেবিলে রাখা সুন্দর ফুলদানিও অদৃশ্য। গুলতেকিন হতভম্ব। সে বলল,

–এসব কী হচ্ছে বলুন তো? ওরা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে কেন? আমরা বুঝি রাতে গান শুনব না?

গুলতেকিনের প্রশ্নের জবাব দেবার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমার নেই। আমার জন্য আরো বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে। বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এই কারণেই সবাই তড়িঘড়ি করে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

মা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে লজ্জায় কাঁপছি। আমার ছোটবোন এসে বলল,

–দাদাভাই, তুমি ভাবিকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে চলে যাও। এই নোংরা ব্যাপারটা ভাবির সামনে না হওয়াই ভালো।

আমি গুলতেকিনকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বৈশাখ মাসের ঘন নীল আকাশ, পেঁজাতুলার স্তূপীকৃত মেঘ, চনমনে রোদ। আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। হুড ফেলে দিয়েছি। আমার মনের গোপন ইচ্ছা – পৃথিবীর সবাই দেখুক, এই রূপবতী বালিকাটিকে আমি পাশে পেয়েছি। গভীর আনন্দে আমার হৃদয় পূর্ণ। বাসায় এখন কী হচ্ছে তা এখন আমার মাথায় নেই। ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়েও ভাবছি না। বর্তমানটাই সত্যি। অতীত কিছু না। ভবিষ্যৎ তো দূরের ব্যাপার। আমরা বাস করি বর্তমানে – অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না।

 

সূত্র : বিপাশা ফেসবুক থেকে