8:45 pm, Sunday, 22 December 2024

যেভাবে তাজমহল ধ্বংসের চেষ্টা ব্যর্থ হয় : সুমন পালিত

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৫:১৩:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ মার্চ ২০২৪
  • 167 ভিউ
শেয়ার করুন

তাজমহল বিশ্বের সপ্তাচার্যের একটি। ভারতে পর্যটনের উদ্দেশে যারা যান তাদের বড় অংশের উদ্দেশ্য থাকে তাজমহল পরিদর্শন। বছরে ৪০ থেকে ৮০ লাখ পর্যটক দেখতে আসেন এ অনন্য সমাধিসৌধ। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় বেগম মমতাজ মহলের কবরের ওপর নির্মিত এ সমাধিসৌধের ওপর দিয়ে গত ৪০০ বছর একের পর এক ঝড় বয়ে গেছে। তাজমহলের ওপর প্রথম বিপদ আসে এর নির্মাণের ১০০ বছর পর। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ঘণ্টা ততদিনে বেজে উঠেছে। জাঠ সৈন্যরা দখল করে নেয় আগ্রা। তারা তাজমহলকে তাদের আস্তানা বানায়। হাড়কাঁপানো প্রচন্ড শীতে এ সমাধিসৌধের ভিতরে খড় পুড়িয়ে জাঠরা আগুন পোহাত। এর ফলে কালো ধোঁয়ায় মর্মর পাথরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বর্বর জাঠরা তাজমহলের বিভিন্ন স্থান থেকে মহামূল্যবান মণি-মুক্তা এবং রুপার তৈরি অনেক তোরণ খুলে নিয়ে যায়।

ইংরেজ আমলে নির্দয় লুটপাটের শিকার হয় তাজমহল। এ সমাধিসৌধ ভেঙে মণি-মুক্তা ও মর্মর পাথর বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ইংরেজরা। স্বাধীন ভারতে সাড়ে পাঁচ যুগ ধরে তাজমহলকে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক হিসেবেই দেখা হতো। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর শিবমন্দির ভেঙে তাজমহল তৈরির কল্পকথা রটায় হিন্দুত্ববাদীরা। তারা এ নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত মতলববাজদের আবেদনে সাড়া দেয়নি।

তাজমহল তৈরির প্রায় ৪০০ বছর পরও দুনিয়াজুড়ে আলোচিত মুঘল সম্রাটের ভালোবাসার কেচ্ছা। যদিও মমতাজ মহল সম্রাট শাহজাহানের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। এমনকি সম্রাটের উপপত্নীর সংখ্যাও কম ছিল না। তবে সম্রাট তার স্ত্রীর কবরের ওপর যে সৌধ নির্মাণ করেন তা অপকট ভালোবাসারই সাক্ষ্য দেয়। মুঘল সাম্রাজ্য কালক্রমে ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়ালেও তাজমহল টিকে আছে আপন মহিমায়।

সম্রাট শাহজাহান আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে মমতাজ মহলের সমাধির ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। বর্তমান তাজমহল যেখানে সে জায়গাটি তার পছন্দ হয়। সেখানে ছিল একটি হাভেলি বা প্রাসাদোপম বাড়ি, যার মালিক ছিলেন স্থানীয় হিন্দু শাসক জয় সিং। সম্রাট শাহজাহান জয় সিংয়ের কাছ থেকে জায়গাটি কিনতে চান। জয় সিং সন্তুষ্টচিত্তে তাতে রাজি হন। এ বিষয়ে জারি করা হয় একটি শাহি ফরমান। ইংরেজ ইতিহাসবিদ ডব্লিউ ই বেগলি ও জেড এ ডেসাহাসের বইয়ে শাহি ফরমান ও জমি ক্রয়ের দলিলের বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেছেন, বইটি পড়লে বোঝা যায় মুঘলরা তাদের বিভিন্ন চুক্তি এবং ইতিহাস সংরক্ষণে বেশ যত্নবান ছিল।

তাজমহল তৈরি করতে গিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের কোষাগারে টান পড়ে। সম্রাট আওরঙ্গজেব তার মায়ের সমাধি তাজমহলের পেছনে বিশাল অর্থ ব্যয়কে ভালো চোখে দেখেননি। সম্রাট শাহজাহান তার জ্যেষ্ঠপুত্র শাহজাদা দারা শিকোকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। আর তাতেই বেঁকে বসেন সম্রাটের অন্য পুত্ররা। ঐতিহ্যগতভাবেই জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন মুঘলরা। ফলে সিংহাসন দখলে সম্রাটের জীবদ্দশায় শাহজাদারা একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হন। আওরঙ্গজেব ছিলেন কৌশলী। কীভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয় তা তিনি জানতেন। শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হন এবং উত্তরাধিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙিয়ে সিংহাসনে বসেন। বাবা সম্রাট শাহজাহানকে রাখেন নজরবন্দি করে। তারপর ভাগ্যহত সম্রাটের জীবনের বাদবাকি ২০ বছর কেটেছে বন্দি অবস্থায়। এ সময় বড় মেয়ে জাহানারা বাবার সঙ্গে স্বেচ্ছা বন্দিজীবন বেছে নেন।

মুঘল শাসনের ট্র্যাজেডি হলো তারা সুষ্ঠু উত্তরাধিকার ব্যবস্থা চালু করতে পারেননি। ফলে একাধিক মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে পুত্ররাও বিদ্রোহী হয়েছেন সিংহাসনের লোভে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে পুত্র শাহজাহানের বিদ্রোহ ইতিহাসের একটি আলোচ্য বিষয়। এমনকি সম্রাট আকবরের আমলে রাজকন্যারাও ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। ফলে মুঘল রাজকন্যাদের সাধারণত বিয়ে দেওয়া হতো না। তারা যাতে ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে না পড়েন সে জন্য ছিল এ বিধান। জাহানারা ছিলেন চিরকুমারী। একদিকে রাজকন্যা অন্যদিকে বিদুষী ছিলেন তিনি। তারপরও তিনি ঘর-সংসার করতে পারেননি। সিংহাসনের দাবিদার হয়ে উঠবেন এই ভয়ে বিয়ে না দেওয়ার জংলি বিধানের শিকার হন এই গুণী রাজকন্যা।

বলছিলাম তাজমহলের কথা। তাজমহল বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ সমাধিসৌধ। সম্রাট শাহজাহান ওই প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হন। তার সমাধির ওপর নির্মাণ করেন চোখজুড়ানো এক সমাধি। যা তৈরিতে লেগে যায় ২২ বছর। ২০ হাজার শ্রমিক ও কারিগর জড়িত ছিলেন তাজমহল নির্মাণে। সারা দুনিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল মার্বেল পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী। এ সমাধি নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। ১৬৫৩ সালে মূল ভবন তৈরির কাজ শেষ হয়। খুঁটিনাটি অন্যসব কাজ সম্পন্ন হতে সময় নেয় আরও দুই বছর। তাজমহল তৈরিতে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। বর্তমান সময়ে তা লাখ কোটি টাকার সমান। ১০০০ হাতির সাহায্যে বহন করা হয়েছে তাজমহল নির্মাণের মালামাল। অতুলনীয় এই ভবন নির্মাণের পর কারিগরদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল এমন কথাও বলা হয়েছে কোনো কোনো ইতিহাসে। যাতে কেউ তাজমহলের মতো কোনো ভবন নির্মাণের সুযোগ না পায়।

তাজমহল নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থ সংকট দেখা দেয় মুঘল রাজ কোষাগারে। সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পেছনে পুত্র আওরঙ্গজেবের অজুহাতগুলোর একটি ছিল অপচয় বন্ধ করা। এ কথা ঠিক, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন মিতব্যয়ী এবং সব ধরনের অপচয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু। ভাইদের হত্যা এবং পিতা সম্রাট শাহজাহানকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমৃত্যু বন্দি রাখেন আওরঙ্গজেব। পদচ্যুত সম্রাটের বিরুদ্ধে তিনি যে কুৎসা রটিয়েছেন তা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অঙ্কের হিসাবে আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তারপর থেকে এ শাসন ক্রমাগতভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকে। শেষ সম্রাট শাহ আলম জাফরের আমলে এর আয়তন ছিল দিল্লি নগরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি ছিলেন মূলত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাতাভোগী।

তাজমহল নির্মাণের কারণে সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসন কেড়ে নেন পুত্র আওরঙ্গজেব। এটা সত্যি না মিথ, তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে স্বীকার করতেই হবে তাজমহলের ওপর একের পর এক ফাঁড়া যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমাধিসৌধের ওপর সবচেয়ে বড় বিপদ নেমে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ইংরেজ আমলে। উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের পাশাপাশি তাজমহলেরও ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে ইংরেজ বেনিয়ারা। তারা এটিকে প্রমোদ কাননে রূপান্তর করে। সমাধিসৌধের পবিত্রতার লঙ্ঘন ঘটিয়ে মূল ভবন চত্বরে আয়োজন করা হতো বল নাচ। তাজমহলের দুই প্রান্তের দুই মসজিদ মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য ভাড়া দেওয়া হতো। মধুচন্দ্রিমা করতে আসা ইংরেজ তরুণ-তরুণীরা সমাধিসৌধের বিভিন্ন স্থান থেকে হাতুড়ি ও ছেনি ব্যবহার করে মণি-মুক্তা লুটে নিয়ে যায়। তাজ্জব ব্যাপার হলো- ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা এসব অপকর্ম প্রতিরোধ করার বদলে উৎসাহ জুগিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লর্ড কার্জনের কথা বলা যেতে পারে। যিনি ছিলেন ভাইসরয় বা গভর্নর জেনারেল। তিনি নিজেকে প্রত্নতত্ত্বের সমঝদার হিসেবেও দাবি করতেন। অথচ এ হেন ব্যক্তিটি বলেছিলেন আমোদ উল্লাসের উন্মাদনায় নন্দন বিলাসীরা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর সমাধির উপরিস্থলের চাঁদোয়া থেকে ছেনি ও হাতুড়ির সাহায্যে আকিক ও মণি-মুক্তার টুকরোগুলো খুলে নিয়ে গেলে এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা খোঁজা ঠিক হবে না। ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাজমহলসহ বিভিন্ন মুঘল স্থাপত্য ভেঙে সেগুলো থেকে মণি-মুক্তা ও মূল্যবান পাথর আহরণ করতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল বেন্টিংসকে তাজমহল ভেঙে ফেলার জন্য গঠিত এক কমিটির সভাপতি করা হয়। তার আমলে মুঘল স্থাপত্যগুলোর ওপর নেমে আসে অভিশাপ। দিল্লি ও আগ্রার নানা স্থাপনা থেকে দামি পাথর অপসারণের কাজ শুরু হয়। সেগুলো জাহাজে করে পাঠানো হয় ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ বরাবর। তাজমহল ভাঙার জন্যও নেওয়া হয় প্রস্তুতি। কিন্তু এ সমাধিসৌধ রক্ষা পায় ভাগ্যগুণে। তাজমহলের মূল্যবান রত্নরাজি বিক্রির জন্য লন্ডনে নিলাম ডাকা হয়। তাতে যে সর্বোচ্চ ডাক ওঠে, তা দিয়ে এ সমাধিসৌধ ভাঙার খরচও পোষাবে না বুঝতে পারে ইংরেজরা। তাই লন্ডন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় তাজমহল ভাঙার কাজ যেন স্থগিত রাখা হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। তাজমহলসহ ভারতে বিভিন্ন আমলে নির্মিত মহামূল্যবান স্থাপত্যগুলো বিদেশি দখলদারদের লুটপাটের বিপদ থেকে রক্ষা পায়। এরপর সাড়ে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে সেগুলো জাতীয় গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

২০১৪ সালে ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসে হিন্দুত্ববাদীরা। ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। বাবরি মসজিদের মতো তাজমহলকেও বিতর্কিত স্থাপনা বলে দাবি করে সাম্প্রদায়িকতার কীটরা। তাদের আবিষ্কার তাজমহল ছিল একটি হিন্দু মন্দির। ১৯৮৯ সালে বিকৃত মস্তিষ্ক এক ইতিহাসবিদ পি এন ওক ‘তাজমলে দ্য ট্রু স্টোরি’ বইতে দাবি করেন তাজমহলের আসল নাম তেজো মহল। এটি ছিল একটি হিন্দু মন্দির। একজন রাজপুত শাসক এ স্থাপনাটি তৈরি করেন। তবে ভারত সরকার এবং অন্য ইতিহাসবিদরা পি এন ওকের প্রলাপকে গুরুত্ব দেননি। ২০০৭ সালে বিজেপির একজন এমপি বিনয় কাটিয়ার হিন্দু মন্দির দাবি করে তাজমহলের নাম পরিবর্তনের দাবি জানান। এ ব্যাপারে তিনি আদালতেরও শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত তার দাবিতে সায় দেওয়ার গরজ অনুভব করেননি। ভারতের শাসন ক্ষমতায় মতলববাজদের আবির্ভাব ঘটলেও সে দেশের বিচারব্যবস্থা ধর্মান্ধদের কাছে নিজেদের বিবেককে এখনো যে বিকিয়ে দেয়নি আদালতের রায় তারই প্রমাণ।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

#
জনপ্রিয়

যেভাবে তাজমহল ধ্বংসের চেষ্টা ব্যর্থ হয় : সুমন পালিত

আপডেটের সময় : ০৫:১৩:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ মার্চ ২০২৪
শেয়ার করুন

তাজমহল বিশ্বের সপ্তাচার্যের একটি। ভারতে পর্যটনের উদ্দেশে যারা যান তাদের বড় অংশের উদ্দেশ্য থাকে তাজমহল পরিদর্শন। বছরে ৪০ থেকে ৮০ লাখ পর্যটক দেখতে আসেন এ অনন্য সমাধিসৌধ। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় বেগম মমতাজ মহলের কবরের ওপর নির্মিত এ সমাধিসৌধের ওপর দিয়ে গত ৪০০ বছর একের পর এক ঝড় বয়ে গেছে। তাজমহলের ওপর প্রথম বিপদ আসে এর নির্মাণের ১০০ বছর পর। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ঘণ্টা ততদিনে বেজে উঠেছে। জাঠ সৈন্যরা দখল করে নেয় আগ্রা। তারা তাজমহলকে তাদের আস্তানা বানায়। হাড়কাঁপানো প্রচন্ড শীতে এ সমাধিসৌধের ভিতরে খড় পুড়িয়ে জাঠরা আগুন পোহাত। এর ফলে কালো ধোঁয়ায় মর্মর পাথরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বর্বর জাঠরা তাজমহলের বিভিন্ন স্থান থেকে মহামূল্যবান মণি-মুক্তা এবং রুপার তৈরি অনেক তোরণ খুলে নিয়ে যায়।

ইংরেজ আমলে নির্দয় লুটপাটের শিকার হয় তাজমহল। এ সমাধিসৌধ ভেঙে মণি-মুক্তা ও মর্মর পাথর বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ইংরেজরা। স্বাধীন ভারতে সাড়ে পাঁচ যুগ ধরে তাজমহলকে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক হিসেবেই দেখা হতো। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর শিবমন্দির ভেঙে তাজমহল তৈরির কল্পকথা রটায় হিন্দুত্ববাদীরা। তারা এ নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত মতলববাজদের আবেদনে সাড়া দেয়নি।

তাজমহল তৈরির প্রায় ৪০০ বছর পরও দুনিয়াজুড়ে আলোচিত মুঘল সম্রাটের ভালোবাসার কেচ্ছা। যদিও মমতাজ মহল সম্রাট শাহজাহানের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। এমনকি সম্রাটের উপপত্নীর সংখ্যাও কম ছিল না। তবে সম্রাট তার স্ত্রীর কবরের ওপর যে সৌধ নির্মাণ করেন তা অপকট ভালোবাসারই সাক্ষ্য দেয়। মুঘল সাম্রাজ্য কালক্রমে ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়ালেও তাজমহল টিকে আছে আপন মহিমায়।

সম্রাট শাহজাহান আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে মমতাজ মহলের সমাধির ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। বর্তমান তাজমহল যেখানে সে জায়গাটি তার পছন্দ হয়। সেখানে ছিল একটি হাভেলি বা প্রাসাদোপম বাড়ি, যার মালিক ছিলেন স্থানীয় হিন্দু শাসক জয় সিং। সম্রাট শাহজাহান জয় সিংয়ের কাছ থেকে জায়গাটি কিনতে চান। জয় সিং সন্তুষ্টচিত্তে তাতে রাজি হন। এ বিষয়ে জারি করা হয় একটি শাহি ফরমান। ইংরেজ ইতিহাসবিদ ডব্লিউ ই বেগলি ও জেড এ ডেসাহাসের বইয়ে শাহি ফরমান ও জমি ক্রয়ের দলিলের বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেছেন, বইটি পড়লে বোঝা যায় মুঘলরা তাদের বিভিন্ন চুক্তি এবং ইতিহাস সংরক্ষণে বেশ যত্নবান ছিল।

তাজমহল তৈরি করতে গিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের কোষাগারে টান পড়ে। সম্রাট আওরঙ্গজেব তার মায়ের সমাধি তাজমহলের পেছনে বিশাল অর্থ ব্যয়কে ভালো চোখে দেখেননি। সম্রাট শাহজাহান তার জ্যেষ্ঠপুত্র শাহজাদা দারা শিকোকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। আর তাতেই বেঁকে বসেন সম্রাটের অন্য পুত্ররা। ঐতিহ্যগতভাবেই জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন মুঘলরা। ফলে সিংহাসন দখলে সম্রাটের জীবদ্দশায় শাহজাদারা একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হন। আওরঙ্গজেব ছিলেন কৌশলী। কীভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয় তা তিনি জানতেন। শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হন এবং উত্তরাধিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙিয়ে সিংহাসনে বসেন। বাবা সম্রাট শাহজাহানকে রাখেন নজরবন্দি করে। তারপর ভাগ্যহত সম্রাটের জীবনের বাদবাকি ২০ বছর কেটেছে বন্দি অবস্থায়। এ সময় বড় মেয়ে জাহানারা বাবার সঙ্গে স্বেচ্ছা বন্দিজীবন বেছে নেন।

মুঘল শাসনের ট্র্যাজেডি হলো তারা সুষ্ঠু উত্তরাধিকার ব্যবস্থা চালু করতে পারেননি। ফলে একাধিক মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে পুত্ররাও বিদ্রোহী হয়েছেন সিংহাসনের লোভে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে পুত্র শাহজাহানের বিদ্রোহ ইতিহাসের একটি আলোচ্য বিষয়। এমনকি সম্রাট আকবরের আমলে রাজকন্যারাও ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। ফলে মুঘল রাজকন্যাদের সাধারণত বিয়ে দেওয়া হতো না। তারা যাতে ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে না পড়েন সে জন্য ছিল এ বিধান। জাহানারা ছিলেন চিরকুমারী। একদিকে রাজকন্যা অন্যদিকে বিদুষী ছিলেন তিনি। তারপরও তিনি ঘর-সংসার করতে পারেননি। সিংহাসনের দাবিদার হয়ে উঠবেন এই ভয়ে বিয়ে না দেওয়ার জংলি বিধানের শিকার হন এই গুণী রাজকন্যা।

বলছিলাম তাজমহলের কথা। তাজমহল বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ সমাধিসৌধ। সম্রাট শাহজাহান ওই প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হন। তার সমাধির ওপর নির্মাণ করেন চোখজুড়ানো এক সমাধি। যা তৈরিতে লেগে যায় ২২ বছর। ২০ হাজার শ্রমিক ও কারিগর জড়িত ছিলেন তাজমহল নির্মাণে। সারা দুনিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল মার্বেল পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী। এ সমাধি নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। ১৬৫৩ সালে মূল ভবন তৈরির কাজ শেষ হয়। খুঁটিনাটি অন্যসব কাজ সম্পন্ন হতে সময় নেয় আরও দুই বছর। তাজমহল তৈরিতে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। বর্তমান সময়ে তা লাখ কোটি টাকার সমান। ১০০০ হাতির সাহায্যে বহন করা হয়েছে তাজমহল নির্মাণের মালামাল। অতুলনীয় এই ভবন নির্মাণের পর কারিগরদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল এমন কথাও বলা হয়েছে কোনো কোনো ইতিহাসে। যাতে কেউ তাজমহলের মতো কোনো ভবন নির্মাণের সুযোগ না পায়।

তাজমহল নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থ সংকট দেখা দেয় মুঘল রাজ কোষাগারে। সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পেছনে পুত্র আওরঙ্গজেবের অজুহাতগুলোর একটি ছিল অপচয় বন্ধ করা। এ কথা ঠিক, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন মিতব্যয়ী এবং সব ধরনের অপচয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু। ভাইদের হত্যা এবং পিতা সম্রাট শাহজাহানকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমৃত্যু বন্দি রাখেন আওরঙ্গজেব। পদচ্যুত সম্রাটের বিরুদ্ধে তিনি যে কুৎসা রটিয়েছেন তা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অঙ্কের হিসাবে আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তারপর থেকে এ শাসন ক্রমাগতভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকে। শেষ সম্রাট শাহ আলম জাফরের আমলে এর আয়তন ছিল দিল্লি নগরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি ছিলেন মূলত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাতাভোগী।

তাজমহল নির্মাণের কারণে সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসন কেড়ে নেন পুত্র আওরঙ্গজেব। এটা সত্যি না মিথ, তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে স্বীকার করতেই হবে তাজমহলের ওপর একের পর এক ফাঁড়া যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমাধিসৌধের ওপর সবচেয়ে বড় বিপদ নেমে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ইংরেজ আমলে। উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের পাশাপাশি তাজমহলেরও ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে ইংরেজ বেনিয়ারা। তারা এটিকে প্রমোদ কাননে রূপান্তর করে। সমাধিসৌধের পবিত্রতার লঙ্ঘন ঘটিয়ে মূল ভবন চত্বরে আয়োজন করা হতো বল নাচ। তাজমহলের দুই প্রান্তের দুই মসজিদ মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য ভাড়া দেওয়া হতো। মধুচন্দ্রিমা করতে আসা ইংরেজ তরুণ-তরুণীরা সমাধিসৌধের বিভিন্ন স্থান থেকে হাতুড়ি ও ছেনি ব্যবহার করে মণি-মুক্তা লুটে নিয়ে যায়। তাজ্জব ব্যাপার হলো- ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা এসব অপকর্ম প্রতিরোধ করার বদলে উৎসাহ জুগিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লর্ড কার্জনের কথা বলা যেতে পারে। যিনি ছিলেন ভাইসরয় বা গভর্নর জেনারেল। তিনি নিজেকে প্রত্নতত্ত্বের সমঝদার হিসেবেও দাবি করতেন। অথচ এ হেন ব্যক্তিটি বলেছিলেন আমোদ উল্লাসের উন্মাদনায় নন্দন বিলাসীরা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর সমাধির উপরিস্থলের চাঁদোয়া থেকে ছেনি ও হাতুড়ির সাহায্যে আকিক ও মণি-মুক্তার টুকরোগুলো খুলে নিয়ে গেলে এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা খোঁজা ঠিক হবে না। ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাজমহলসহ বিভিন্ন মুঘল স্থাপত্য ভেঙে সেগুলো থেকে মণি-মুক্তা ও মূল্যবান পাথর আহরণ করতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল বেন্টিংসকে তাজমহল ভেঙে ফেলার জন্য গঠিত এক কমিটির সভাপতি করা হয়। তার আমলে মুঘল স্থাপত্যগুলোর ওপর নেমে আসে অভিশাপ। দিল্লি ও আগ্রার নানা স্থাপনা থেকে দামি পাথর অপসারণের কাজ শুরু হয়। সেগুলো জাহাজে করে পাঠানো হয় ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ বরাবর। তাজমহল ভাঙার জন্যও নেওয়া হয় প্রস্তুতি। কিন্তু এ সমাধিসৌধ রক্ষা পায় ভাগ্যগুণে। তাজমহলের মূল্যবান রত্নরাজি বিক্রির জন্য লন্ডনে নিলাম ডাকা হয়। তাতে যে সর্বোচ্চ ডাক ওঠে, তা দিয়ে এ সমাধিসৌধ ভাঙার খরচও পোষাবে না বুঝতে পারে ইংরেজরা। তাই লন্ডন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় তাজমহল ভাঙার কাজ যেন স্থগিত রাখা হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। তাজমহলসহ ভারতে বিভিন্ন আমলে নির্মিত মহামূল্যবান স্থাপত্যগুলো বিদেশি দখলদারদের লুটপাটের বিপদ থেকে রক্ষা পায়। এরপর সাড়ে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে সেগুলো জাতীয় গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

২০১৪ সালে ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসে হিন্দুত্ববাদীরা। ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। বাবরি মসজিদের মতো তাজমহলকেও বিতর্কিত স্থাপনা বলে দাবি করে সাম্প্রদায়িকতার কীটরা। তাদের আবিষ্কার তাজমহল ছিল একটি হিন্দু মন্দির। ১৯৮৯ সালে বিকৃত মস্তিষ্ক এক ইতিহাসবিদ পি এন ওক ‘তাজমলে দ্য ট্রু স্টোরি’ বইতে দাবি করেন তাজমহলের আসল নাম তেজো মহল। এটি ছিল একটি হিন্দু মন্দির। একজন রাজপুত শাসক এ স্থাপনাটি তৈরি করেন। তবে ভারত সরকার এবং অন্য ইতিহাসবিদরা পি এন ওকের প্রলাপকে গুরুত্ব দেননি। ২০০৭ সালে বিজেপির একজন এমপি বিনয় কাটিয়ার হিন্দু মন্দির দাবি করে তাজমহলের নাম পরিবর্তনের দাবি জানান। এ ব্যাপারে তিনি আদালতেরও শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত তার দাবিতে সায় দেওয়ার গরজ অনুভব করেননি। ভারতের শাসন ক্ষমতায় মতলববাজদের আবির্ভাব ঘটলেও সে দেশের বিচারব্যবস্থা ধর্মান্ধদের কাছে নিজেদের বিবেককে এখনো যে বিকিয়ে দেয়নি আদালতের রায় তারই প্রমাণ।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন