12:39 am, Monday, 23 December 2024

শূন্য থেকে মহাবিশ্বের জন্ম যেভাবে

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ১১:১৩:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৪
  • 151 ভিউ
শেয়ার করুন

 তানভীর হোসেন : 

দৃশ্যমান এই বিশাল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে লক্ষকোটি গ্যালাক্সি। আর এসব গ্যালাক্সির মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষকোটি নক্ষত্র। কিন্তু তার পরও বলতে হয়, মহাবিশ্ব মূলত ফাঁকা। মহাবিশ্বের বেশির ভাগ এলাকাজুড়েই রয়েছে শূন্যতা।

যাকে আমরা সহজ ভাষায় বলি মহাশূন্য। এর মানে হলো, যেখানে কিছুই নেই। কিন্তু আসলেই কি মহাশূন্য একেবারেই শূন্য? নাকি এই অসীম শূন্যতার মাঝে অন্য কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে, যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়?

বিশাল মহাবিশ্বে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে চলুন আমরা পরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের অভ্যন্তরীণ অবস্থাটি দেখে আসি। হাইড্রোজেন পরমাণুর কথাই ধরুন।

এর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে রয়েছে একটি প্রোটন কণা। একে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরছে একটি ইলেকট্রন কণা। কিন্তু হাইড্রোজেন পরমাণুর অত্যন্ত সামান্য একটু অংশ জুড়ে থাকে ইলেকট্রন এবং প্রোটন। হাইড্রোজেন পরমাণুর ভেতরের শতকরা ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৬ ভাগ অংশই হলো ফাঁকা।

অর্থাৎ পরমাণুর ভেতরটিও মহাশূন্যের মতোই শূন্য। এই শূন্যতাটি কতটা ব্যাপক, সেটি একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করছি। আমাদের পৃথিবীতে যত পরমাণু আছে, তার ভেতর থেকে যদি সব ফাঁকা অংশ সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের পুরো পৃথিবীর আয়তন চুপসে গিয়ে হবে একটি টেনিস বলের সমান। কিন্তু এর ভরের কোনো পরিবর্তন হবে না। তাহলে ভেবে দেখুন, পরমাণুর ভেতরে শূন্যস্থানটি না থাকলে বস্তুর অবস্থাটি কী হতো।

এই বিশাল মহাবিশ্ব এবং বস্তুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ সব জায়গায়ই শূন্যতার ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। অথচ আমরা মনে করি, শূন্যতা মানে কিছুই না। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, মহাবিশ্বে শূন্যতার গুরুত্ব অপরিসীম। শূন্যতা না থাকলে পরমাণু গঠিত হতে পারত না। পরমাণু না থাকলে বস্তুও গঠিত হতো না। আর বস্তু না থাকলে মহাবিশ্বেরও সৃষ্টি হতো না। সে জন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, শূন্যতা থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে।

ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হলেও, এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। শূন্যতা থেকে কিভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে, সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিকসের শরণাপন্ন হতে হবে। বস্তুর অভ্যন্তরে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ তার নিয়ামক হলো কোয়ান্টাম মেকানিকস। পরমাণুর ভেতর যে শূন্যতা রয়েছে তাকে বলা হয় কোয়ান্টাম শূন্যতা। এটি আসলে পুরোপুরি শূন্য নয়। এই শূন্যতার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক ধরনের শক্তি। যার ফলে এই কোয়ান্টাম শূন্যতার ভেতরে সব সময় এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। একে বলা হয় কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এর ফলে কোয়ান্টাম শূন্যতার মাঝে সর্বদাই ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতি-কণার উদ্ভব হয়, আবার মুহূর্তের মধ্যেই তারা শূন্যে মিলিয়ে যায়। ব্যাপারটা আশ্চর্য মনে হলেও, কোয়ান্টাম জগতে এই ফ্ল্যাকচুয়েশন সবসময়ই ঘটছে। এর স্বপক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণও রয়েছে।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের আলোকে এর একটু ব্যাখ্যা দিচ্ছি। ১৯২৭ জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন কোন বস্তুকণার অবস্থান এবং ভরবেগ একই সাথে নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একে বলা হয় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তায় সূত্র। আসলে বস্তুকণাদের শুধুমাত্র কণা বললে ভুল হবে। কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়ম অনুসারে বস্তুকণা একইসাথে কণা এবং তরঙ্গ দুই অবস্থানেই থাকতে পারে। বস্তুকণার একই সাথে তরঙ্গ ও কণা দুটি সত্ত্বাই রয়েছে। সেজন্য বস্তুকণার গতি প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে হলে ওয়েভ ফাংশানের সাহায্য নিতে হয়।

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক তাঁর বিখ্যাত সমীকরণের মাধ্যমে ইলেকট্রনের গতি-প্রকৃতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমীকরণের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, ইলেকট্রন কণার বিপরীতে প্রতি-ইলেকট্রন কণার অস্তিত্বও থাকা সম্ভব।

১৯৩২ সালে, কার্ল অ্যান্ডারসন নামে একজন বিজ্ঞানী সত্যি সত্যিই প্রতি-ইলেকট্রন কণার সন্ধান পেলেন। এর নাম হলো পজিট্রন। এর ভর ইলেকট্রনের সমান হলেও চার্জ হলো বিপরীত, অর্থাৎ পজিটিভ। পজিট্রন হলো পজেটিভ ইলেকট্রন। এভাবে প্রোটনের বিপরীতে প্রতি-প্রোটন, নিউট্রনের বিপরীতে প্রতি-নিউট্রন কণার সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব প্রতি-কণা দিয়ে তৈরি হয় প্রতি-পদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটার। কিন্তু প্রকৃতিতে আমরা অ্যান্টিম্যাটার দেখতে পাই না। তার কারণ হলো, প্রতি-পদার্থ কণা যখনই সাধারণ পদার্থ কণার সংস্পর্শে আসে তখন বিপুল শক্তির উদ্ভব হয় এবং উভয় কণাগুলো শুন্যে বিলীন হয়ে যায়। সে জন্য প্রকৃতিতে আমরা পদার্থের পাশাপাশি প্রতি-পদার্থ দেখতে পাই না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বস্তুজগতের কোয়ান্টাম শূন্যতার মধ্য থেকে ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতি-কণার উদ্ভব প্রতিনিয়তই হচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই তারা শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। এটাই হলো কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মোদ্দা কথা।

কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের উৎপত্তির একটি ধারণা দিয়েছেন। আমরা জানি, এখন থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হলো, এর আগে কিছুই ছিল না। বিগ ব্যাংয়ের ফলেই স্থান এবং কালের সৃষ্টি হয়েছে।

বিগ ব্যাংয়ের আগে যেহেতু সময়ের অস্তিত্ব ছিল না, সেহেতু এর আগে কী ছিল সে প্রশ্নটি অবান্তর। কিন্তু বিগ ব্যাং কেন হয়েছিল, সে ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, সৃষ্টির সূচনায় মহাবিশ্বের সব শক্তি একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই বিন্দুটির ভেতর কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে হঠাৎ করেই একটি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। এটাই হলো বিগ ব্যাং। এর পরপরই মহাবিশ্ব ব্যাপক হারে স্ফীত (inflation) হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানীদের হিসাবে, জ্যামিতিক হারে এই ব্যাপক স্ফীতিটি হয়েছিল বিগ ব্যাং ঘটার ১০-৩৭ থেকে ১০-৩৫ সেকেন্ডের মধ্যে। এই অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই মহাবিশ্বের আয়তন জ্যামিতিক হারে বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। এরপর মহাবিশ্বে যাবতীয় বস্তুকণার উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী সময়ে বস্তুকণার পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণুর সৃষ্টি হয়। তারপর ধীরে ধীরে এসব পরমাণু পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির জন্ম হয়, যা এখন দৃশ্যমান মহাবিশ্বের অংশ। বিগ ব্যাংয়ের ফলে সৃষ্ট আমাদের চেনা মহাবিশ্বটি এখনো ক্রমাগত প্রসারিত হয়েই চলেছে।

এবার ফিরে আসি, মহাবিশ্বের অসীম শূন্যতার প্রশ্নে। বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে এক গুপ্তশক্তির সন্ধান পেয়েছেন, যার নাম তারা দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি। এই ডার্ক এনার্জির প্রভাবে প্রসারমাণ গ্যালাক্সিগুলোর ছুটে চলার গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোনো এক গুপ্ত শক্তি গ্যালাক্সিগুলোকে ক্রমাগত দূর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মোদ্দাকথা হলো, মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করছে এই ডার্ক এনার্জি। মহাশূন্য আসলে শূন্য নয়। এর সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জি।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাবিশ্বের শতকরা ৬৯ ভাগই হলো এই ডার্ক এনার্জি। কিন্তু এর উৎস সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। তবে কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, এটি মহাশূন্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাদের মতে, অসীম শূন্যতার মাঝে প্রতিনিয়ত কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলেই ডার্ক এনার্জির সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এই ধারণার পেছনে এখনো কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। তবে শূন্যতার মাঝে যে অদৃশ্য শক্তি লুকিয়ে আছে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীমহল নিশ্চিত। এটি পারমাণবিক ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি মহাশূন্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেখেশুনে মনে হয়, অসীম এই শূন্যতার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির সব রহস্য।

সূত্র : নিউ সায়েন্টিস্ট

 

#
জনপ্রিয়

শূন্য থেকে মহাবিশ্বের জন্ম যেভাবে

আপডেটের সময় : ১১:১৩:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৪
শেয়ার করুন

 তানভীর হোসেন : 

দৃশ্যমান এই বিশাল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে লক্ষকোটি গ্যালাক্সি। আর এসব গ্যালাক্সির মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষকোটি নক্ষত্র। কিন্তু তার পরও বলতে হয়, মহাবিশ্ব মূলত ফাঁকা। মহাবিশ্বের বেশির ভাগ এলাকাজুড়েই রয়েছে শূন্যতা।

যাকে আমরা সহজ ভাষায় বলি মহাশূন্য। এর মানে হলো, যেখানে কিছুই নেই। কিন্তু আসলেই কি মহাশূন্য একেবারেই শূন্য? নাকি এই অসীম শূন্যতার মাঝে অন্য কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে, যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়?

বিশাল মহাবিশ্বে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে চলুন আমরা পরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের অভ্যন্তরীণ অবস্থাটি দেখে আসি। হাইড্রোজেন পরমাণুর কথাই ধরুন।

এর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে রয়েছে একটি প্রোটন কণা। একে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরছে একটি ইলেকট্রন কণা। কিন্তু হাইড্রোজেন পরমাণুর অত্যন্ত সামান্য একটু অংশ জুড়ে থাকে ইলেকট্রন এবং প্রোটন। হাইড্রোজেন পরমাণুর ভেতরের শতকরা ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৬ ভাগ অংশই হলো ফাঁকা।

অর্থাৎ পরমাণুর ভেতরটিও মহাশূন্যের মতোই শূন্য। এই শূন্যতাটি কতটা ব্যাপক, সেটি একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করছি। আমাদের পৃথিবীতে যত পরমাণু আছে, তার ভেতর থেকে যদি সব ফাঁকা অংশ সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের পুরো পৃথিবীর আয়তন চুপসে গিয়ে হবে একটি টেনিস বলের সমান। কিন্তু এর ভরের কোনো পরিবর্তন হবে না। তাহলে ভেবে দেখুন, পরমাণুর ভেতরে শূন্যস্থানটি না থাকলে বস্তুর অবস্থাটি কী হতো।

এই বিশাল মহাবিশ্ব এবং বস্তুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ সব জায়গায়ই শূন্যতার ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। অথচ আমরা মনে করি, শূন্যতা মানে কিছুই না। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, মহাবিশ্বে শূন্যতার গুরুত্ব অপরিসীম। শূন্যতা না থাকলে পরমাণু গঠিত হতে পারত না। পরমাণু না থাকলে বস্তুও গঠিত হতো না। আর বস্তু না থাকলে মহাবিশ্বেরও সৃষ্টি হতো না। সে জন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, শূন্যতা থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে।

ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হলেও, এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। শূন্যতা থেকে কিভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে, সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিকসের শরণাপন্ন হতে হবে। বস্তুর অভ্যন্তরে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ তার নিয়ামক হলো কোয়ান্টাম মেকানিকস। পরমাণুর ভেতর যে শূন্যতা রয়েছে তাকে বলা হয় কোয়ান্টাম শূন্যতা। এটি আসলে পুরোপুরি শূন্য নয়। এই শূন্যতার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক ধরনের শক্তি। যার ফলে এই কোয়ান্টাম শূন্যতার ভেতরে সব সময় এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। একে বলা হয় কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এর ফলে কোয়ান্টাম শূন্যতার মাঝে সর্বদাই ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতি-কণার উদ্ভব হয়, আবার মুহূর্তের মধ্যেই তারা শূন্যে মিলিয়ে যায়। ব্যাপারটা আশ্চর্য মনে হলেও, কোয়ান্টাম জগতে এই ফ্ল্যাকচুয়েশন সবসময়ই ঘটছে। এর স্বপক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণও রয়েছে।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের আলোকে এর একটু ব্যাখ্যা দিচ্ছি। ১৯২৭ জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন কোন বস্তুকণার অবস্থান এবং ভরবেগ একই সাথে নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একে বলা হয় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তায় সূত্র। আসলে বস্তুকণাদের শুধুমাত্র কণা বললে ভুল হবে। কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়ম অনুসারে বস্তুকণা একইসাথে কণা এবং তরঙ্গ দুই অবস্থানেই থাকতে পারে। বস্তুকণার একই সাথে তরঙ্গ ও কণা দুটি সত্ত্বাই রয়েছে। সেজন্য বস্তুকণার গতি প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে হলে ওয়েভ ফাংশানের সাহায্য নিতে হয়।

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক তাঁর বিখ্যাত সমীকরণের মাধ্যমে ইলেকট্রনের গতি-প্রকৃতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমীকরণের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, ইলেকট্রন কণার বিপরীতে প্রতি-ইলেকট্রন কণার অস্তিত্বও থাকা সম্ভব।

১৯৩২ সালে, কার্ল অ্যান্ডারসন নামে একজন বিজ্ঞানী সত্যি সত্যিই প্রতি-ইলেকট্রন কণার সন্ধান পেলেন। এর নাম হলো পজিট্রন। এর ভর ইলেকট্রনের সমান হলেও চার্জ হলো বিপরীত, অর্থাৎ পজিটিভ। পজিট্রন হলো পজেটিভ ইলেকট্রন। এভাবে প্রোটনের বিপরীতে প্রতি-প্রোটন, নিউট্রনের বিপরীতে প্রতি-নিউট্রন কণার সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব প্রতি-কণা দিয়ে তৈরি হয় প্রতি-পদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটার। কিন্তু প্রকৃতিতে আমরা অ্যান্টিম্যাটার দেখতে পাই না। তার কারণ হলো, প্রতি-পদার্থ কণা যখনই সাধারণ পদার্থ কণার সংস্পর্শে আসে তখন বিপুল শক্তির উদ্ভব হয় এবং উভয় কণাগুলো শুন্যে বিলীন হয়ে যায়। সে জন্য প্রকৃতিতে আমরা পদার্থের পাশাপাশি প্রতি-পদার্থ দেখতে পাই না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বস্তুজগতের কোয়ান্টাম শূন্যতার মধ্য থেকে ভার্চুয়াল কণা এবং প্রতি-কণার উদ্ভব প্রতিনিয়তই হচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই তারা শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। এটাই হলো কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মোদ্দা কথা।

কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের উৎপত্তির একটি ধারণা দিয়েছেন। আমরা জানি, এখন থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হলো, এর আগে কিছুই ছিল না। বিগ ব্যাংয়ের ফলেই স্থান এবং কালের সৃষ্টি হয়েছে।

বিগ ব্যাংয়ের আগে যেহেতু সময়ের অস্তিত্ব ছিল না, সেহেতু এর আগে কী ছিল সে প্রশ্নটি অবান্তর। কিন্তু বিগ ব্যাং কেন হয়েছিল, সে ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, সৃষ্টির সূচনায় মহাবিশ্বের সব শক্তি একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই বিন্দুটির ভেতর কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে হঠাৎ করেই একটি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। এটাই হলো বিগ ব্যাং। এর পরপরই মহাবিশ্ব ব্যাপক হারে স্ফীত (inflation) হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানীদের হিসাবে, জ্যামিতিক হারে এই ব্যাপক স্ফীতিটি হয়েছিল বিগ ব্যাং ঘটার ১০-৩৭ থেকে ১০-৩৫ সেকেন্ডের মধ্যে। এই অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই মহাবিশ্বের আয়তন জ্যামিতিক হারে বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। এরপর মহাবিশ্বে যাবতীয় বস্তুকণার উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী সময়ে বস্তুকণার পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণুর সৃষ্টি হয়। তারপর ধীরে ধীরে এসব পরমাণু পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির জন্ম হয়, যা এখন দৃশ্যমান মহাবিশ্বের অংশ। বিগ ব্যাংয়ের ফলে সৃষ্ট আমাদের চেনা মহাবিশ্বটি এখনো ক্রমাগত প্রসারিত হয়েই চলেছে।

এবার ফিরে আসি, মহাবিশ্বের অসীম শূন্যতার প্রশ্নে। বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে এক গুপ্তশক্তির সন্ধান পেয়েছেন, যার নাম তারা দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি। এই ডার্ক এনার্জির প্রভাবে প্রসারমাণ গ্যালাক্সিগুলোর ছুটে চলার গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোনো এক গুপ্ত শক্তি গ্যালাক্সিগুলোকে ক্রমাগত দূর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মোদ্দাকথা হলো, মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করছে এই ডার্ক এনার্জি। মহাশূন্য আসলে শূন্য নয়। এর সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জি।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাবিশ্বের শতকরা ৬৯ ভাগই হলো এই ডার্ক এনার্জি। কিন্তু এর উৎস সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। তবে কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, এটি মহাশূন্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাদের মতে, অসীম শূন্যতার মাঝে প্রতিনিয়ত কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলেই ডার্ক এনার্জির সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এই ধারণার পেছনে এখনো কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। তবে শূন্যতার মাঝে যে অদৃশ্য শক্তি লুকিয়ে আছে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীমহল নিশ্চিত। এটি পারমাণবিক ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি মহাশূন্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেখেশুনে মনে হয়, অসীম এই শূন্যতার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির সব রহস্য।

সূত্র : নিউ সায়েন্টিস্ট