8:38 pm, Sunday, 22 December 2024

কবিতা এবং তার পাঠক

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৮:০৬:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 219 ভিউ
শেয়ার করুন

ড. আনোয়ারুল করীম :

সকলেই কবিতার পাঠক ননÑ কেউ কেউ পাঠক। যেমন ‘সকলেই কবি ননÑ কেউ কেউ কবি।’ কবিতা পড়তে জানলেই যেমন পাঠক হওয়া যায় না, কবিতা লেখার ধরণ অথবা টেকনিক জানা থাকলেই তেমনি কবি হওয়া যায় না। কবিতার পাঠক তাই কবিতা লিখতে না জানলেও কবি হয়ে উঠতে পারেন অবশ্য এ কথা রচনায় সিদ্ধ না হলেও মর্মস্পর্শিতায় সত্য।

কবি তার রচনায় মর্মের ভাবনাকে উদ্ঘাটিত করেন বিচিত্র ব্যঞ্জনার স্বাদেÑ কবিতার পাঠক তা আস্বাদন করেন অনুভূতির জারক রসে। কবিতার রচয়িতা বুঝি এক নিপুণ রাঁধুনি যিনি অপূর্ব দক্ষতায় সাধারণ দ্রব্যাদিকে অসাধারণে পরিণত করে রসিকের কৃতার্থভাজন হন। কবিতার ক্ষেত্রে কবি ও পাঠকের সম্পর্ক অনেকটা এই রাঁধুনি এবং রসিকের মতোই। কবিতার পাঠক যেন সেই রসিক বাউল তিনি সেই হংসী যিনি পঙ্কিল জীবনের মধ্য থেকে বেছে নিতে জানেন মহৎ জীবনের উপাদান। কবিতার ক্ষেত্রে তাই কবিতার পাঠকের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সৎ এবং মহৎ কবি নির্ধারণেও তার অবদান অনস্বীকার্য।

কবিতার পাঠক পেশাদার সমালোচক নন। তাঁর আলোচনায় পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায় না। বলা যেতে পারে মহৎ কবির মতো তিনি জ্ঞানে বিশ্বাসী। এই জ্ঞান ফুলের পরিচয় চিহ্ন জানবার জ্ঞানÑ জহুরীর মতো নিকষে ঘষে ফুলকে খণ্ডিত অথবা লজ্জা দেবার জ্ঞান নয়। কবিতার পাঠক কবিতার সৌন্দর্য উদ্ঘাটন করেনÑ উপলব্ধি করেন এই সৌন্দর্য সংগতিপূর্ণ না ‘অসংস্থিত পীড়াদায়ক’। কবিতার সাথে কবিতার পাঠকের সম্পর্কে জীবনানন্দের ভাষায় বলতে গেলে যেন ‘আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের সাদা রৌদ্রের মতো।’

কবিতার পাঠকের সংখ্যা কোন কালেই বেশি ছিল নাÑ বর্তমানেও নেই। ভবিষ্যতে বেশি হবার সম্ভাবনা তেমন না হওয়াই বোধকরি সমীচীন। কবিতার পাঠক যেন এক বিম্বিত কাঁচের টুকরো, আলোকের প্রতিফলনে কবিতার সৌন্দর্যের বিস্তারই তার একমাত্র লক্ষ্য।

প্রসংগত উল্লেখ করা যেতে পারে, কবিতা ভালো লাগা এবং কবিতার পাঠক হওয়া এক কথা নয়। ভালোলাগারও রকমফের আছে। আধুনিক জীবনে কবিতা বিলাসের সামগ্রী। ড্রইং রুমের শেলফে নাম করা কবির বই না থাকলে মানায় না। অথবা দু’একটি আসরে বিশেষ করে নাগরিক আড্ডায় কিছু কিছু কবির রচনা বিশেষ ঢঙে আবৃত্তি করতে জানলে কদর বাড়ে। এঁরা কবিতার চেয়ে নিজেকেই ভালবাসেনÑ অপরের সামনে নিজেকে উপস্থাপনাই যার লক্ষ্য।

শুধু এরাই নন আজকাল অনেকে পোষাকী কবি হয়ে কবিতাকে ফ্যাসানের উপকরণ করে তুলেছেনÑ এরা সর্বক্ষণ একটি কৃত্রিম ধোঁয়াটে জীবনের সাধনায় নিমগ্ন থাকেন। এঁরা কবিতাকে ঝবী ংঢ়ড়ৎঃ-এর মাধ্যম বানিয়ে এক ধরণের আত্মরতির শিকার হয়ে পড়েন। এ এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা।

কবিতার পাঠক কবিতাকে ভালবাসেন সুন্দর করে বাঁচবার জন্য। এ ভালোলাগা যেমন নিটোল তেমনি আন্তরিক। গোটা বাংলাদেশে এ ধরনের পাঠকের সংখ্যা একান্তই সীমিত, যেমন সীমিত কবিতা ও কবির সংখ্যা। তাই বলেছিলাম সকলেই কবিতার পাঠক ননÑ কেউ কেউ পাঠক। যেমন ‘সকলেই কবি ননÑ কেউ কেউ কবি।’

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে কবিতার অনুশীলনকারী নেহাৎ কম নয়Ñ কিন্তু এঁদের সকলেই কবি নন, যেমন বর্তমানে কবিতার প্রচুর পাঠক থাকা সত্ত্বেও সকলেই কবিতার পাঠক নন। পরিসংখ্যান নিলে বর্তমান বাংলাদেশে কবিতার অনুশীলনকারীদের এমন প্রাবল্য কোন কালেই বোধকরি ছিল না।

কবিতার পাঠকের সংখ্যা কোন কালেই বেশি ছিল নাÑ বর্তমানেও নেই। ভবিষ্যতে বেশি হবার সম্ভাবনা তেমন না হওয়াই বোধকরি সমীচীন। কবিতার পাঠক যেন এক বিশেষ করে এই অনুশীলনকারীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই অধিক। তরুণেরা কবিতা লিখবেন না, এমন কথা আমি বলছি নাÑ কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁরা তরুণ বয়সেই লেখেন। কেউ আরো আগে। কিন্তু পীড়াদায়ক হয় যখন দেখি, দু-একটি ছত্র লিখে এঁরা কবি নাম কিনতে চান। কবিতার বই প্রকাশ পেলে তো কথাই নেই। এঁরা অধিকাংশই প্রোপাগ্যাণ্ডাতে বিশ্বাসী এবং প্রোপাগ্যাণ্ডাতে আমাদের দেশের কিছু পত্র-পত্রিকা সবিশেষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। এরা এমন অনেক অ-কবির রচনা পত্রস্থ করে থাকেন যা কোন অর্থেই কবিতাপদবাচ্য হয় না। ব্যক্তিগত পরিচয়, গোষ্ঠীনির্ভরতা এইসব রচনা পত্রস্থ হতে বিশেষ সহায়ক। অবশ্য এমন প্রোপাগ্যাণ্ডার ফলে অনেক অ-কবিই আমাদের সমানে ‘হঠাৎ-কবি’র আখ্যায় চিহ্নিত হতে পারেন এবং তখন কবিতাকে এক দারুণ ‘হস্তী জননী’র মতো মনে হয় যে কেবল অজ্ঞান, অর্বাচীন দাঁতাল সন্তানদের প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাত ময়দান ভরে ফেলেছে’Ñ পথ চলার সাধ্যি যেন আর নেই। প্রতি যুগেই এমনটি বোধকরি হয় এবং এই নিরালম্ব সংগতিহীন জনতার স্রোত থেকে কেউ হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে আসেনÑ এঁরা সকলের জন্য অথবা অনেকের জন্য নয়Ñ কারো কারো জন্য এবং তারাই যথার্থ কবি। কবিতার পাঠকের হাত ধরে বৈশাখী মেঘের মতো এঁরা কবিতার নীলাকাশে প্রকৃতির সান্ত্বনার অঞ্চলে ভেসে ফেরেন ‘নির্জন রৌদ্রে নিস্তব্ধ কোন অদিতির কাছে।’এঁরা চিরকাল বোধির কাছে বিশ্বস্ত। এঁরা জনতার জন্যে ননÑ মুষ্টিমেয়  দীক্ষিতের জন্যÑযাঁরা কবিতার পাঠক।

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার জগতে বোধিদীপ্ত কবির সংখ্যা দুর্লভ নয়। কিন্তু সামগ্রিক অবক্ষয়ের টানাপোড়েনে বোধিচেতন কবিসত্তার যে অস্বাভাবিক বিচ্যুতি ঘটেছে। কবিতার পাঠক মাত্র তা স্বীকার করবেন। সাম্প্রতিককালের প্রায় সমগ্র বাংলা কবিতাই বলতে গেলে আজ এক নিদারুণ নৈরাজ্যিক মনোভঙ্গির উৎকট উদ্ঘাটন। কবিরা ইদানিং কালে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিকÑ যা আত্মতুষ্টিরই নামান্তর অথবা আত্মরমণের। বোদির কাছে বিশ্বস্ত হলেও কবিরা কবিতার পাঠকের কাছে তেমন বিশ্বস্ত হতে পারছেন কই। তবে কি উভয়েই বৃন্তচ্যুত? হয়তো অনেকটা তাই। কবি ও কবিতার পাঠক একদিন যে দায়বোধের আবশ্যিকরূপে অধিষ্ট ছিলেন অবক্ষয়ের সংক্রমণ তাদের উভয়কে আজ পীড়িত করে তুলেছে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? অবক্ষয়ের এই সর্বগ্রাসীরূপ রুখবার দায়িত্ব তবে কার স্কন্ধে আরোপিত? আলোকের ঝর্ণাধারায় আমাদের সকল গ্লানি ধুইয়ে দিতে আজ কার আবাহন হবে? নিশ্চিতভাবে কোন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক অথবা সমাজ সংস্কারক এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার স্পর্ধা অথবা যোগ্যতা রাখেন না।

এ দায়ভাগ কোন অনুপ্রেরিত কবির। যিনি স্বয়ং শিক্ষিত এবং যাঁর হৃদয়ই কবিতা। অনুপ্রেরণাই কবিতার মোহিনী শক্তি। এই অনুপ্রেরণার উৎসমূল তো মানব। তবে কি মানবে আর মানুষে পার্থক্য রয়েছে? আছে বৈকি। যিনি মানবÑ তিনি সর্বকালের মানব। মানুষ তারই খণ্ডিত চিত্রকল্প। কবিতায় উত্তরণ ঘটে মানবে। তিনি বাউলের সাঁই।

পৃথিবীর তাবৎ মহৎ কবিদের রচনায় এই মহত্তম ভাবনার প্রকাশ ঘটে থাকেÑ তবে চেতনার প্রেক্ষিতে নিশ্চিত অর্থেই ভিন্নতর। তাহলে কি বলা যেতে পারে কবিতা বেদনার পদাবলী হয়েও তা আনন্দের, বিরহের হয়েও তা মিলনের অর্থাৎ এর ভিতর একটা কল্যাণকামিতার ইংগিত যেন বেশ প্রচ্ছন্ন। কিন্তু কার জন্যে এই কল্যাণকামিতা? কবি নিজেই তো নিজের কল্যাণকামী। আমার দুঃখ যেন আমারই আনন্দ। বিরহ যেন আমার বহু কাংখিত, কারণ ত মিলনের ইচ্ছাটিকেই মনের ভিতর সর্বক্ষণ উজ্জীবিত রাখে।

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাবলীতে যে এমন কোন ইংগিত নেই তা বলা যায় নাÑ  তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে এই ধারণা অনেকটা অস্পষ্ট, স্বচ্ছতা বিলোপিত। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পরে বাংলা কাব্য জগতে অনুপ্রেরিত কবি হিসেবে জীবনানন্দের নাম উচ্চারণ করা হলে বোধকরি কারো আপত্তি হবে না। অনুপ্রেরিত বলেই বুঝি আঁধারের আবির্ভাবে তিনি হতাশাগ্রস্ত নন বরং ঘোষণা করেন, ‘এমনতর আঁধার ভালো আজকে কঠিন রুক্ষ শতাব্দীতে।’ কারণ তাঁর কাছে এই আঁধারই তো আলোক অথবা আলোকই আঁধার। তাই তাঁর কাব্যে ব্যর্থতা, দ্বিধা, হতাশা সব যেন একটি অখণ্ডের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। জীবনানন্দ সময়কে অবলোকন করেছেন অনন্ত সময়ের প্রেক্ষিতে যেমন জীবনের সাথে  যোগ রয়েছে মহাজীবনের। এই দু’য়ের মধ্যে কোন মৌলিক ভিন্নতা নেই বরং বলা যেতে পারে আছে আবহমানের টান। মানুষকে অতিমাত্রায় মানুষী ভাবার মধ্যে কোন পূর্ণতার ইংগিত লক্ষ্য করা যায় না এবং তা কেবল শূন্যতারই নামান্তর হয়তো হতে পারে। বিন্দু থেকে বৃত্তে উপনীত হতে প্রয়োজন একের। অনুপ্রেরিত কবি একের সাধনা করেন। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় সেই একের যেন বড় অভাব।

কবিতার একজন পাঠক হিসেবে এ প্রতিক্রিয়া কি নিতান্তই অসমীচীন? কবিরা কি বলেন!

#
জনপ্রিয়

কবিতা এবং তার পাঠক

আপডেটের সময় : ০৮:০৬:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

ড. আনোয়ারুল করীম :

সকলেই কবিতার পাঠক ননÑ কেউ কেউ পাঠক। যেমন ‘সকলেই কবি ননÑ কেউ কেউ কবি।’ কবিতা পড়তে জানলেই যেমন পাঠক হওয়া যায় না, কবিতা লেখার ধরণ অথবা টেকনিক জানা থাকলেই তেমনি কবি হওয়া যায় না। কবিতার পাঠক তাই কবিতা লিখতে না জানলেও কবি হয়ে উঠতে পারেন অবশ্য এ কথা রচনায় সিদ্ধ না হলেও মর্মস্পর্শিতায় সত্য।

কবি তার রচনায় মর্মের ভাবনাকে উদ্ঘাটিত করেন বিচিত্র ব্যঞ্জনার স্বাদেÑ কবিতার পাঠক তা আস্বাদন করেন অনুভূতির জারক রসে। কবিতার রচয়িতা বুঝি এক নিপুণ রাঁধুনি যিনি অপূর্ব দক্ষতায় সাধারণ দ্রব্যাদিকে অসাধারণে পরিণত করে রসিকের কৃতার্থভাজন হন। কবিতার ক্ষেত্রে কবি ও পাঠকের সম্পর্ক অনেকটা এই রাঁধুনি এবং রসিকের মতোই। কবিতার পাঠক যেন সেই রসিক বাউল তিনি সেই হংসী যিনি পঙ্কিল জীবনের মধ্য থেকে বেছে নিতে জানেন মহৎ জীবনের উপাদান। কবিতার ক্ষেত্রে তাই কবিতার পাঠকের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সৎ এবং মহৎ কবি নির্ধারণেও তার অবদান অনস্বীকার্য।

কবিতার পাঠক পেশাদার সমালোচক নন। তাঁর আলোচনায় পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায় না। বলা যেতে পারে মহৎ কবির মতো তিনি জ্ঞানে বিশ্বাসী। এই জ্ঞান ফুলের পরিচয় চিহ্ন জানবার জ্ঞানÑ জহুরীর মতো নিকষে ঘষে ফুলকে খণ্ডিত অথবা লজ্জা দেবার জ্ঞান নয়। কবিতার পাঠক কবিতার সৌন্দর্য উদ্ঘাটন করেনÑ উপলব্ধি করেন এই সৌন্দর্য সংগতিপূর্ণ না ‘অসংস্থিত পীড়াদায়ক’। কবিতার সাথে কবিতার পাঠকের সম্পর্কে জীবনানন্দের ভাষায় বলতে গেলে যেন ‘আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের সাদা রৌদ্রের মতো।’

কবিতার পাঠকের সংখ্যা কোন কালেই বেশি ছিল নাÑ বর্তমানেও নেই। ভবিষ্যতে বেশি হবার সম্ভাবনা তেমন না হওয়াই বোধকরি সমীচীন। কবিতার পাঠক যেন এক বিম্বিত কাঁচের টুকরো, আলোকের প্রতিফলনে কবিতার সৌন্দর্যের বিস্তারই তার একমাত্র লক্ষ্য।

প্রসংগত উল্লেখ করা যেতে পারে, কবিতা ভালো লাগা এবং কবিতার পাঠক হওয়া এক কথা নয়। ভালোলাগারও রকমফের আছে। আধুনিক জীবনে কবিতা বিলাসের সামগ্রী। ড্রইং রুমের শেলফে নাম করা কবির বই না থাকলে মানায় না। অথবা দু’একটি আসরে বিশেষ করে নাগরিক আড্ডায় কিছু কিছু কবির রচনা বিশেষ ঢঙে আবৃত্তি করতে জানলে কদর বাড়ে। এঁরা কবিতার চেয়ে নিজেকেই ভালবাসেনÑ অপরের সামনে নিজেকে উপস্থাপনাই যার লক্ষ্য।

শুধু এরাই নন আজকাল অনেকে পোষাকী কবি হয়ে কবিতাকে ফ্যাসানের উপকরণ করে তুলেছেনÑ এরা সর্বক্ষণ একটি কৃত্রিম ধোঁয়াটে জীবনের সাধনায় নিমগ্ন থাকেন। এঁরা কবিতাকে ঝবী ংঢ়ড়ৎঃ-এর মাধ্যম বানিয়ে এক ধরণের আত্মরতির শিকার হয়ে পড়েন। এ এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা।

কবিতার পাঠক কবিতাকে ভালবাসেন সুন্দর করে বাঁচবার জন্য। এ ভালোলাগা যেমন নিটোল তেমনি আন্তরিক। গোটা বাংলাদেশে এ ধরনের পাঠকের সংখ্যা একান্তই সীমিত, যেমন সীমিত কবিতা ও কবির সংখ্যা। তাই বলেছিলাম সকলেই কবিতার পাঠক ননÑ কেউ কেউ পাঠক। যেমন ‘সকলেই কবি ননÑ কেউ কেউ কবি।’

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে কবিতার অনুশীলনকারী নেহাৎ কম নয়Ñ কিন্তু এঁদের সকলেই কবি নন, যেমন বর্তমানে কবিতার প্রচুর পাঠক থাকা সত্ত্বেও সকলেই কবিতার পাঠক নন। পরিসংখ্যান নিলে বর্তমান বাংলাদেশে কবিতার অনুশীলনকারীদের এমন প্রাবল্য কোন কালেই বোধকরি ছিল না।

কবিতার পাঠকের সংখ্যা কোন কালেই বেশি ছিল নাÑ বর্তমানেও নেই। ভবিষ্যতে বেশি হবার সম্ভাবনা তেমন না হওয়াই বোধকরি সমীচীন। কবিতার পাঠক যেন এক বিশেষ করে এই অনুশীলনকারীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই অধিক। তরুণেরা কবিতা লিখবেন না, এমন কথা আমি বলছি নাÑ কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁরা তরুণ বয়সেই লেখেন। কেউ আরো আগে। কিন্তু পীড়াদায়ক হয় যখন দেখি, দু-একটি ছত্র লিখে এঁরা কবি নাম কিনতে চান। কবিতার বই প্রকাশ পেলে তো কথাই নেই। এঁরা অধিকাংশই প্রোপাগ্যাণ্ডাতে বিশ্বাসী এবং প্রোপাগ্যাণ্ডাতে আমাদের দেশের কিছু পত্র-পত্রিকা সবিশেষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। এরা এমন অনেক অ-কবির রচনা পত্রস্থ করে থাকেন যা কোন অর্থেই কবিতাপদবাচ্য হয় না। ব্যক্তিগত পরিচয়, গোষ্ঠীনির্ভরতা এইসব রচনা পত্রস্থ হতে বিশেষ সহায়ক। অবশ্য এমন প্রোপাগ্যাণ্ডার ফলে অনেক অ-কবিই আমাদের সমানে ‘হঠাৎ-কবি’র আখ্যায় চিহ্নিত হতে পারেন এবং তখন কবিতাকে এক দারুণ ‘হস্তী জননী’র মতো মনে হয় যে কেবল অজ্ঞান, অর্বাচীন দাঁতাল সন্তানদের প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাত ময়দান ভরে ফেলেছে’Ñ পথ চলার সাধ্যি যেন আর নেই। প্রতি যুগেই এমনটি বোধকরি হয় এবং এই নিরালম্ব সংগতিহীন জনতার স্রোত থেকে কেউ হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে আসেনÑ এঁরা সকলের জন্য অথবা অনেকের জন্য নয়Ñ কারো কারো জন্য এবং তারাই যথার্থ কবি। কবিতার পাঠকের হাত ধরে বৈশাখী মেঘের মতো এঁরা কবিতার নীলাকাশে প্রকৃতির সান্ত্বনার অঞ্চলে ভেসে ফেরেন ‘নির্জন রৌদ্রে নিস্তব্ধ কোন অদিতির কাছে।’এঁরা চিরকাল বোধির কাছে বিশ্বস্ত। এঁরা জনতার জন্যে ননÑ মুষ্টিমেয়  দীক্ষিতের জন্যÑযাঁরা কবিতার পাঠক।

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার জগতে বোধিদীপ্ত কবির সংখ্যা দুর্লভ নয়। কিন্তু সামগ্রিক অবক্ষয়ের টানাপোড়েনে বোধিচেতন কবিসত্তার যে অস্বাভাবিক বিচ্যুতি ঘটেছে। কবিতার পাঠক মাত্র তা স্বীকার করবেন। সাম্প্রতিককালের প্রায় সমগ্র বাংলা কবিতাই বলতে গেলে আজ এক নিদারুণ নৈরাজ্যিক মনোভঙ্গির উৎকট উদ্ঘাটন। কবিরা ইদানিং কালে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিকÑ যা আত্মতুষ্টিরই নামান্তর অথবা আত্মরমণের। বোদির কাছে বিশ্বস্ত হলেও কবিরা কবিতার পাঠকের কাছে তেমন বিশ্বস্ত হতে পারছেন কই। তবে কি উভয়েই বৃন্তচ্যুত? হয়তো অনেকটা তাই। কবি ও কবিতার পাঠক একদিন যে দায়বোধের আবশ্যিকরূপে অধিষ্ট ছিলেন অবক্ষয়ের সংক্রমণ তাদের উভয়কে আজ পীড়িত করে তুলেছে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? অবক্ষয়ের এই সর্বগ্রাসীরূপ রুখবার দায়িত্ব তবে কার স্কন্ধে আরোপিত? আলোকের ঝর্ণাধারায় আমাদের সকল গ্লানি ধুইয়ে দিতে আজ কার আবাহন হবে? নিশ্চিতভাবে কোন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক অথবা সমাজ সংস্কারক এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার স্পর্ধা অথবা যোগ্যতা রাখেন না।

এ দায়ভাগ কোন অনুপ্রেরিত কবির। যিনি স্বয়ং শিক্ষিত এবং যাঁর হৃদয়ই কবিতা। অনুপ্রেরণাই কবিতার মোহিনী শক্তি। এই অনুপ্রেরণার উৎসমূল তো মানব। তবে কি মানবে আর মানুষে পার্থক্য রয়েছে? আছে বৈকি। যিনি মানবÑ তিনি সর্বকালের মানব। মানুষ তারই খণ্ডিত চিত্রকল্প। কবিতায় উত্তরণ ঘটে মানবে। তিনি বাউলের সাঁই।

পৃথিবীর তাবৎ মহৎ কবিদের রচনায় এই মহত্তম ভাবনার প্রকাশ ঘটে থাকেÑ তবে চেতনার প্রেক্ষিতে নিশ্চিত অর্থেই ভিন্নতর। তাহলে কি বলা যেতে পারে কবিতা বেদনার পদাবলী হয়েও তা আনন্দের, বিরহের হয়েও তা মিলনের অর্থাৎ এর ভিতর একটা কল্যাণকামিতার ইংগিত যেন বেশ প্রচ্ছন্ন। কিন্তু কার জন্যে এই কল্যাণকামিতা? কবি নিজেই তো নিজের কল্যাণকামী। আমার দুঃখ যেন আমারই আনন্দ। বিরহ যেন আমার বহু কাংখিত, কারণ ত মিলনের ইচ্ছাটিকেই মনের ভিতর সর্বক্ষণ উজ্জীবিত রাখে।

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাবলীতে যে এমন কোন ইংগিত নেই তা বলা যায় নাÑ  তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে এই ধারণা অনেকটা অস্পষ্ট, স্বচ্ছতা বিলোপিত। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পরে বাংলা কাব্য জগতে অনুপ্রেরিত কবি হিসেবে জীবনানন্দের নাম উচ্চারণ করা হলে বোধকরি কারো আপত্তি হবে না। অনুপ্রেরিত বলেই বুঝি আঁধারের আবির্ভাবে তিনি হতাশাগ্রস্ত নন বরং ঘোষণা করেন, ‘এমনতর আঁধার ভালো আজকে কঠিন রুক্ষ শতাব্দীতে।’ কারণ তাঁর কাছে এই আঁধারই তো আলোক অথবা আলোকই আঁধার। তাই তাঁর কাব্যে ব্যর্থতা, দ্বিধা, হতাশা সব যেন একটি অখণ্ডের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। জীবনানন্দ সময়কে অবলোকন করেছেন অনন্ত সময়ের প্রেক্ষিতে যেমন জীবনের সাথে  যোগ রয়েছে মহাজীবনের। এই দু’য়ের মধ্যে কোন মৌলিক ভিন্নতা নেই বরং বলা যেতে পারে আছে আবহমানের টান। মানুষকে অতিমাত্রায় মানুষী ভাবার মধ্যে কোন পূর্ণতার ইংগিত লক্ষ্য করা যায় না এবং তা কেবল শূন্যতারই নামান্তর হয়তো হতে পারে। বিন্দু থেকে বৃত্তে উপনীত হতে প্রয়োজন একের। অনুপ্রেরিত কবি একের সাধনা করেন। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় সেই একের যেন বড় অভাব।

কবিতার একজন পাঠক হিসেবে এ প্রতিক্রিয়া কি নিতান্তই অসমীচীন? কবিরা কি বলেন!