12:06 am, Monday, 23 December 2024

কালো গোলাপ : শাওন আসগর

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ১১:১৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 184 ভিউ
শেয়ার করুন

স্কুটার নিয়ে যেতে হবে। ফার্মগেট ইন্দিরা রোড হতে বাংলামোটর। ডাকাত চালকের খপ্পরে পড়েছি, ভাড়া দিতে হবে দুশো টাকা। হতে পারতো আশি বা একশো টাকা কিন্তু চালকের যুক্তি হলো অনেক যানজট, কম হলে পোষায় না। অগত্যা রওনা হলাম দু‘জনে। সাথে আছেন শক্তিমান একজন লেখক যার সান্নিধ্য পেতেই মূলত এই ছোট্ট যাতায়াতের পরিকল্পনা। স্কুটারে বসেই নিজেদের হাতে থাকা দু‘টো হালকা খাবারের টিফিন বক্স পাশে রাখি।

যানজট কম নয় আসলে। স্কুটারটি খামারবাড়ির দিকে ইউটার্ণ নিতেই সিগন্যালে পড়লাম। দুজনের মুখেই বিরক্তি। শক্তিমান লেখকের মুড ভালো করার জন্য প্রসঙ্গ জুড়িয়ে দিই, বলি–কবি আপনি অতো ভালো লিখেন কী করে ? আপনি কি জানেন এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে আপনি অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন আমাদের জন্য।

তিনি মুখ ঘুরিয়ে আমাকে বলেন–অনেক পড়তে হয়, জানতে হয় বিশ^সাহিত্য। মনে রাখবেন ভেতরে জ্ঞান না থাকলে আপনার লেখাও আসবে না।

আমি বলি–আমিতো পড়ি। বেশ সময় নিয়ে পড়ি প্রতিদিন, তবুও আমি যে পারি না আপনার মতো।

তিনি জবাব করেন–কেউ কারো মতো হতে পারে না। সবারই ধরণ আলাদা হয়। আপনিও সম্প্রতি ভালো লিখছেন। আজকে ‘অন্যধারায়’ যে কবিতাটি পড়েছেন তা খুবই সময় উপযোগি ও ভালো হয়েছে। শুনলেনতো আমি আজ আপনার কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলেছি। আসলে কী জানেন কবিতায় শুধু শব্দ আর ভালো বাক্য হলেই হয় না। ওখানে থাকতে হয় কালের প্রয়োজন, সময়ের আবেদনই কবিতাকে সমৃদ্ধ করে।

স্কুটার যাচ্ছে। বাংলামোটরের কাছে পৌছে গেছি। কিন্তু আবারো সিগন্যাল এখানে। স্কুটারের দু‘পাশেই ভিক্ষুক দাঁড়ালো। তাদের মিনতিভরা কণ্ঠ। কায়ক্লেশের মধ্যে থাকা দেহের ভেতর থেকে মিনতির সুর বের হচ্ছে। আজকাল শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পথে গলিতেই লক্ষ্য করা যায় দারিদ্র লোকদের চিত্র। ভ্যান গাড়িতে করে কেউ কেউ বিক্রি করছেন শাক সবজি, জুতো, কাপড়, রকমারি খেলা, বাদাম চাল ভাজা বুট ইত্যাদি। তাদের এই চিত্র মূলত দেশের দারিদ্রতার সাম্প্রতিক সময়কে ইঙ্গিত করে। গ্রামের মানুষগুলো আরো দৈন্য দশায় জর্জড়িত। একেতো অভাব চারদিকে, তারওপর অবরোধ হরতালে জীবনের সকল নিত্য প্রয়োজনের দাবী মুখ থুবড়ে পড়ছে প্রতিদিন।

তার ওপর কিছু কিছু মানুষ তাদের জন্মদিনের উৎসব নিয়ে ব্যস্ত। এসব একেবারেই মেনে নিতে পারি না। যেই দেশের মানুষ তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না সেই দেশে অতো হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে জন্মদিন পালন করবে আর তা প্রচার করবে, না আমি মনে প্রাণে তা কখনো চাই না। এসবের বিপরিতে আমার যুক্তি খুব প্রাসঙ্গিক হয়। করতে হলে তা নিজ নিজ বাড়িতে করা যেতে পারে অল্প পরিসরে। এর চেয়ে ভালো অন্তত জন্মদিনে কিছু গরীব পথশিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। লোকেরা কেনো যে এগুলো করছে না তা বোধগম্য নয় আমার।

কিন্তু শক্তিমান কবি আমার এই যুক্তি মেনে নিতে পারেন না। তিনি বলেন–দেখুন বাংলাদেশের কবিরা খুব অবহেলিত। সরকার মন্ত্রীবর্গ বা আমলারা কেউ কবিকে সম্মান দিতে চায় না। সেকারণে কবিদের নিজস্ব পরিচয় প্রতিদিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাদের জগত সংক্ষিপ্ত, তাদের পরিচয় প্রচার শুধুমাত্র কয়েকটি পত্রিকায় সীমাবদ্ধ। অথচ রাষ্ট্র বিনির্মাণে, সমাজ পরিবর্তনে কবির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবিকে অসম্মান করে কোনো জাতি সুশৃঙ্খল হতে পারে না। তাই কবির জন্মদিনই উৎসবমুখরভাবে সবাইকে জানিয়ে পালন করা উচিত। শক্তিমান কবির এই যুক্তি শুনে আমি নীরব থাকি আর ভাবি আমার আগামী জন্মদিনটি বড় করেই পালন করতে হবে।

সাথে থাকা টিফিন বক্স থেকে দু‘টো কলা আর ড্রাই কেক বের করে দিলাম ওদের। স্কুটার টানতে দেরি হলো আরো প্রায় মিনিট তিনেক হবে। কথা বলি আবার–আমাদের লেখকরাতো ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। আজ একটা লেখায় পড়লাম জন মিলটন তার ‘প্যারাডাইস লস্ট’ লেখার পূর্বে পাঁচ বছরই সংসার থেকে আলাদা ছিলেন। শক্তিমান কবি বললেন–হা তাই করা জরুরী। দেখেন লোরকা পাবলো নেরুদার জীবনী দেখেন, তারা কতো কষ্ট করতেন কবিতার জন্য।

আমি সাথে সাথে আমাদের নজরুল হুমায়ুন আজাদের নামও যোগ করলাম। তাদের কারাগারে অন্তরিণ থাকা আর রক্ত ঝরানোর প্রসঙ্গ তুললাম।

কবি তাঁর নির্দিষ্ট গন্তব্যে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন। এটাও কবিতার এক আসর। এখানে কবিকে বিলম্বিত জন্মদিকের কেক খাওয়াবেন সবাই। টেবিলে রয়েছে ফুলের তোড়া, কেকের প্যাকেট, রয়েছে কিছু বই আর উপিস্থিতি খাতা।

আমাকে পরিচয় করে দেয়া হলো এবং কিছু কথা ও কবিতা পাঠের আহবান করা হলো।

কিছু কথা বলতে গিয়ে আটকে গেলাম। খেই হারিয়ে ফেললাম সামনে বসা কালো মেয়েটির দিকে চোখ পড়ায়। সেও কবি, বয়স খুব বেশি হবে না। আন্দাজ করছি চল্লিশের কাছাকাছি, বয়স যা-ই হউক, হতে পারে তার পরিধানকৃত পোষাক-আশাক ও সাজগোছের কারণে বয়স কম মনে হচ্ছে। তবে আমি তার পরিহিত শাড়ি পড়ার স্টাইলটি খুব করে নজরে আটকিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ। শালিনতার কোনো কমতি নেই তার মধ্যে। চুলের এবং মুখের উপরও উজ্জলতার ছোঁয়া। আর কিছুক্ষণ আগে সে যেই কবিতাটি পড়েছে তখনই ওই কবিতার শব্দ তার মুখ থেকে আমার কানে বুকে আছড়ে পড়েছে। অসাধারণ কন্ঠ গলে গলে পড়েছে সারা কক্ষে। উপরের ফ্যানের বাতাসে মিশে গিয়ে তার পঠিত কবিতার বাক্যগুলো সবাইকে মোহিত করেছে আর মোহাবিষ্ট করেছে আমার মনকেও।

আমি আজ কথা বলতে পারিনি স্বাভাবিকভাবে। কথা জড়িয়ে যায় এলোমেলো হয়ে যায়। তবু বোকার মতো করেই বলতে থাকি–আসলে কবিতার যে ছন্দ প্রকরণ বা শিল্পকলা থাকে তাতে প্রকৃতি, চারপাশের হাজার কথা, সমস্যাতো থাকেই, তারপরও কবিতার মূল উপজীব্য হতে পারে নারী। একজন নারীও কবিতার শরীরে প্রসাধনী যোগ করতে সহায়তা করেন। এই যে ধরুন আমাদের এখানে বসে থাকা কবি (আমি আঙ্গুল উঁচিয়ে তাকে দেখালাম)তাকে এখন দুর্লভ কালো গোলাপের সাথে তুলনা করা যায়। তাকে নিয়ে কবিতার ঋদ্ধ বাক্য গঠন করা যায়।

একথা বলার সাথে সাথে কালো গোলাপ দু‘হাতে তার মুখ ঢাকেন এবং উচ্ছল ভঙ্গিতে হেসে ওঠেন। তার হাসির ঝনঝন শব্দ, মালা থেকে হিরের দানা খসে পড়ার মতোই শব্দ করে পড়তে থাকে। তার দাঁত যেনো দন্ত চিকিৎসকের চেম্বারে থাকা কোনো অপরূপ সুন্দরী মেয়ের দাঁতের বিজ্ঞাপণের মতোই হৃদয়ে কাঁপন তোলার মতো।

আজ আমার সব অগোছালো হয়ে পড়ে। আমার পঠিত কবিতাও ভালো হয়নি।

একটু পরই শক্তিমান কবির জন্য কেক কাটা হলো। সবাই হাতে করে কেকের টুকরো নিচ্ছি আর কেউ কেউ চেয়ারে বসে দাঁড়িয়ে তা মুখে নিচ্ছি। গুঞ্জন কক্ষের ভেতর, নানান কথা নানান রকমের হাসির বাণ বইছে। সবাই শক্তিমান কবিকে নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। আমি লক্ষ্য করলাম কালো গোলাপের ঠোঁটের আরো একটু উপরে চিবুকের একটি অংশে কেকের ক্রিমের এক ক্ষুদ্র কণা চুপচাপ বসে তাকে চুম্বন করছে। কাছে ডেকে নিলাম তাকে, বললাম সেই কণাটির কথা। সে বললো–সমস্যা নেই। কেউ আর তা খাবে না। কেউ ধরে এখান থেকে সরাবেও না। থাকুক ওটি।

খেয়াল করলাম কক্ষটির দরোজা দিয়ে পাশের কোনো পুষ্পবাগান হতে সে যেনো অনেক সুগন্ধ লুটে এনেছে এখন। আমার সারা শরীরে সুগন্ধ মেখে দিচ্ছে হেমন্তের বাতাস। বলার আর কিছু পেলাম না। তবে তার কথার অর্থ দাঁড়ায় অনেক। সবই বুঝতে পারি কিন্তু নিজের হাত দিয়ে ওই বেয়ারা টুকরো সরাবার সাহস আমার হলো না। বিদায়ের সময় শুধু আরেকবার হাত ঈশারা করে জানালাম।

পথে নেমে হাঁটতে থাকি। মনে হলো সে পেছনে আসতে পারে। কিন্ত ভয়ও হলো মনে, যদি পেছনে তাকিয়ে তাকে না দেখি তবে সেই কষ্ট নিয়ে সঠিক সময়ে ঘরে ফিরতে পারবো না। আমারও যে ঘর আছে, তা ওই কালো গোলাপের কারণে ভুলেই গিয়েছিলাম।

হাঁটি। অনেকক্ষণ হাঁটি পথে পথে।

২৪.১১.২০২৩
রাত ১১.৫৫.মি.

শাওন আসগর # প্রযত্নে: আশিকুল কাদির। সীমানা গ্রীণ হাউস-৩য় তলা। ২০৯/ক লালবাগ রোড, ঢাকা-১২১১।

 

#
জনপ্রিয়

কালো গোলাপ : শাওন আসগর

আপডেটের সময় : ১১:১৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

স্কুটার নিয়ে যেতে হবে। ফার্মগেট ইন্দিরা রোড হতে বাংলামোটর। ডাকাত চালকের খপ্পরে পড়েছি, ভাড়া দিতে হবে দুশো টাকা। হতে পারতো আশি বা একশো টাকা কিন্তু চালকের যুক্তি হলো অনেক যানজট, কম হলে পোষায় না। অগত্যা রওনা হলাম দু‘জনে। সাথে আছেন শক্তিমান একজন লেখক যার সান্নিধ্য পেতেই মূলত এই ছোট্ট যাতায়াতের পরিকল্পনা। স্কুটারে বসেই নিজেদের হাতে থাকা দু‘টো হালকা খাবারের টিফিন বক্স পাশে রাখি।

যানজট কম নয় আসলে। স্কুটারটি খামারবাড়ির দিকে ইউটার্ণ নিতেই সিগন্যালে পড়লাম। দুজনের মুখেই বিরক্তি। শক্তিমান লেখকের মুড ভালো করার জন্য প্রসঙ্গ জুড়িয়ে দিই, বলি–কবি আপনি অতো ভালো লিখেন কী করে ? আপনি কি জানেন এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে আপনি অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন আমাদের জন্য।

তিনি মুখ ঘুরিয়ে আমাকে বলেন–অনেক পড়তে হয়, জানতে হয় বিশ^সাহিত্য। মনে রাখবেন ভেতরে জ্ঞান না থাকলে আপনার লেখাও আসবে না।

আমি বলি–আমিতো পড়ি। বেশ সময় নিয়ে পড়ি প্রতিদিন, তবুও আমি যে পারি না আপনার মতো।

তিনি জবাব করেন–কেউ কারো মতো হতে পারে না। সবারই ধরণ আলাদা হয়। আপনিও সম্প্রতি ভালো লিখছেন। আজকে ‘অন্যধারায়’ যে কবিতাটি পড়েছেন তা খুবই সময় উপযোগি ও ভালো হয়েছে। শুনলেনতো আমি আজ আপনার কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলেছি। আসলে কী জানেন কবিতায় শুধু শব্দ আর ভালো বাক্য হলেই হয় না। ওখানে থাকতে হয় কালের প্রয়োজন, সময়ের আবেদনই কবিতাকে সমৃদ্ধ করে।

স্কুটার যাচ্ছে। বাংলামোটরের কাছে পৌছে গেছি। কিন্তু আবারো সিগন্যাল এখানে। স্কুটারের দু‘পাশেই ভিক্ষুক দাঁড়ালো। তাদের মিনতিভরা কণ্ঠ। কায়ক্লেশের মধ্যে থাকা দেহের ভেতর থেকে মিনতির সুর বের হচ্ছে। আজকাল শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পথে গলিতেই লক্ষ্য করা যায় দারিদ্র লোকদের চিত্র। ভ্যান গাড়িতে করে কেউ কেউ বিক্রি করছেন শাক সবজি, জুতো, কাপড়, রকমারি খেলা, বাদাম চাল ভাজা বুট ইত্যাদি। তাদের এই চিত্র মূলত দেশের দারিদ্রতার সাম্প্রতিক সময়কে ইঙ্গিত করে। গ্রামের মানুষগুলো আরো দৈন্য দশায় জর্জড়িত। একেতো অভাব চারদিকে, তারওপর অবরোধ হরতালে জীবনের সকল নিত্য প্রয়োজনের দাবী মুখ থুবড়ে পড়ছে প্রতিদিন।

তার ওপর কিছু কিছু মানুষ তাদের জন্মদিনের উৎসব নিয়ে ব্যস্ত। এসব একেবারেই মেনে নিতে পারি না। যেই দেশের মানুষ তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না সেই দেশে অতো হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে জন্মদিন পালন করবে আর তা প্রচার করবে, না আমি মনে প্রাণে তা কখনো চাই না। এসবের বিপরিতে আমার যুক্তি খুব প্রাসঙ্গিক হয়। করতে হলে তা নিজ নিজ বাড়িতে করা যেতে পারে অল্প পরিসরে। এর চেয়ে ভালো অন্তত জন্মদিনে কিছু গরীব পথশিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। লোকেরা কেনো যে এগুলো করছে না তা বোধগম্য নয় আমার।

কিন্তু শক্তিমান কবি আমার এই যুক্তি মেনে নিতে পারেন না। তিনি বলেন–দেখুন বাংলাদেশের কবিরা খুব অবহেলিত। সরকার মন্ত্রীবর্গ বা আমলারা কেউ কবিকে সম্মান দিতে চায় না। সেকারণে কবিদের নিজস্ব পরিচয় প্রতিদিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাদের জগত সংক্ষিপ্ত, তাদের পরিচয় প্রচার শুধুমাত্র কয়েকটি পত্রিকায় সীমাবদ্ধ। অথচ রাষ্ট্র বিনির্মাণে, সমাজ পরিবর্তনে কবির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবিকে অসম্মান করে কোনো জাতি সুশৃঙ্খল হতে পারে না। তাই কবির জন্মদিনই উৎসবমুখরভাবে সবাইকে জানিয়ে পালন করা উচিত। শক্তিমান কবির এই যুক্তি শুনে আমি নীরব থাকি আর ভাবি আমার আগামী জন্মদিনটি বড় করেই পালন করতে হবে।

সাথে থাকা টিফিন বক্স থেকে দু‘টো কলা আর ড্রাই কেক বের করে দিলাম ওদের। স্কুটার টানতে দেরি হলো আরো প্রায় মিনিট তিনেক হবে। কথা বলি আবার–আমাদের লেখকরাতো ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। আজ একটা লেখায় পড়লাম জন মিলটন তার ‘প্যারাডাইস লস্ট’ লেখার পূর্বে পাঁচ বছরই সংসার থেকে আলাদা ছিলেন। শক্তিমান কবি বললেন–হা তাই করা জরুরী। দেখেন লোরকা পাবলো নেরুদার জীবনী দেখেন, তারা কতো কষ্ট করতেন কবিতার জন্য।

আমি সাথে সাথে আমাদের নজরুল হুমায়ুন আজাদের নামও যোগ করলাম। তাদের কারাগারে অন্তরিণ থাকা আর রক্ত ঝরানোর প্রসঙ্গ তুললাম।

কবি তাঁর নির্দিষ্ট গন্তব্যে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন। এটাও কবিতার এক আসর। এখানে কবিকে বিলম্বিত জন্মদিকের কেক খাওয়াবেন সবাই। টেবিলে রয়েছে ফুলের তোড়া, কেকের প্যাকেট, রয়েছে কিছু বই আর উপিস্থিতি খাতা।

আমাকে পরিচয় করে দেয়া হলো এবং কিছু কথা ও কবিতা পাঠের আহবান করা হলো।

কিছু কথা বলতে গিয়ে আটকে গেলাম। খেই হারিয়ে ফেললাম সামনে বসা কালো মেয়েটির দিকে চোখ পড়ায়। সেও কবি, বয়স খুব বেশি হবে না। আন্দাজ করছি চল্লিশের কাছাকাছি, বয়স যা-ই হউক, হতে পারে তার পরিধানকৃত পোষাক-আশাক ও সাজগোছের কারণে বয়স কম মনে হচ্ছে। তবে আমি তার পরিহিত শাড়ি পড়ার স্টাইলটি খুব করে নজরে আটকিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ। শালিনতার কোনো কমতি নেই তার মধ্যে। চুলের এবং মুখের উপরও উজ্জলতার ছোঁয়া। আর কিছুক্ষণ আগে সে যেই কবিতাটি পড়েছে তখনই ওই কবিতার শব্দ তার মুখ থেকে আমার কানে বুকে আছড়ে পড়েছে। অসাধারণ কন্ঠ গলে গলে পড়েছে সারা কক্ষে। উপরের ফ্যানের বাতাসে মিশে গিয়ে তার পঠিত কবিতার বাক্যগুলো সবাইকে মোহিত করেছে আর মোহাবিষ্ট করেছে আমার মনকেও।

আমি আজ কথা বলতে পারিনি স্বাভাবিকভাবে। কথা জড়িয়ে যায় এলোমেলো হয়ে যায়। তবু বোকার মতো করেই বলতে থাকি–আসলে কবিতার যে ছন্দ প্রকরণ বা শিল্পকলা থাকে তাতে প্রকৃতি, চারপাশের হাজার কথা, সমস্যাতো থাকেই, তারপরও কবিতার মূল উপজীব্য হতে পারে নারী। একজন নারীও কবিতার শরীরে প্রসাধনী যোগ করতে সহায়তা করেন। এই যে ধরুন আমাদের এখানে বসে থাকা কবি (আমি আঙ্গুল উঁচিয়ে তাকে দেখালাম)তাকে এখন দুর্লভ কালো গোলাপের সাথে তুলনা করা যায়। তাকে নিয়ে কবিতার ঋদ্ধ বাক্য গঠন করা যায়।

একথা বলার সাথে সাথে কালো গোলাপ দু‘হাতে তার মুখ ঢাকেন এবং উচ্ছল ভঙ্গিতে হেসে ওঠেন। তার হাসির ঝনঝন শব্দ, মালা থেকে হিরের দানা খসে পড়ার মতোই শব্দ করে পড়তে থাকে। তার দাঁত যেনো দন্ত চিকিৎসকের চেম্বারে থাকা কোনো অপরূপ সুন্দরী মেয়ের দাঁতের বিজ্ঞাপণের মতোই হৃদয়ে কাঁপন তোলার মতো।

আজ আমার সব অগোছালো হয়ে পড়ে। আমার পঠিত কবিতাও ভালো হয়নি।

একটু পরই শক্তিমান কবির জন্য কেক কাটা হলো। সবাই হাতে করে কেকের টুকরো নিচ্ছি আর কেউ কেউ চেয়ারে বসে দাঁড়িয়ে তা মুখে নিচ্ছি। গুঞ্জন কক্ষের ভেতর, নানান কথা নানান রকমের হাসির বাণ বইছে। সবাই শক্তিমান কবিকে নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। আমি লক্ষ্য করলাম কালো গোলাপের ঠোঁটের আরো একটু উপরে চিবুকের একটি অংশে কেকের ক্রিমের এক ক্ষুদ্র কণা চুপচাপ বসে তাকে চুম্বন করছে। কাছে ডেকে নিলাম তাকে, বললাম সেই কণাটির কথা। সে বললো–সমস্যা নেই। কেউ আর তা খাবে না। কেউ ধরে এখান থেকে সরাবেও না। থাকুক ওটি।

খেয়াল করলাম কক্ষটির দরোজা দিয়ে পাশের কোনো পুষ্পবাগান হতে সে যেনো অনেক সুগন্ধ লুটে এনেছে এখন। আমার সারা শরীরে সুগন্ধ মেখে দিচ্ছে হেমন্তের বাতাস। বলার আর কিছু পেলাম না। তবে তার কথার অর্থ দাঁড়ায় অনেক। সবই বুঝতে পারি কিন্তু নিজের হাত দিয়ে ওই বেয়ারা টুকরো সরাবার সাহস আমার হলো না। বিদায়ের সময় শুধু আরেকবার হাত ঈশারা করে জানালাম।

পথে নেমে হাঁটতে থাকি। মনে হলো সে পেছনে আসতে পারে। কিন্ত ভয়ও হলো মনে, যদি পেছনে তাকিয়ে তাকে না দেখি তবে সেই কষ্ট নিয়ে সঠিক সময়ে ঘরে ফিরতে পারবো না। আমারও যে ঘর আছে, তা ওই কালো গোলাপের কারণে ভুলেই গিয়েছিলাম।

হাঁটি। অনেকক্ষণ হাঁটি পথে পথে।

২৪.১১.২০২৩
রাত ১১.৫৫.মি.

শাওন আসগর # প্রযত্নে: আশিকুল কাদির। সীমানা গ্রীণ হাউস-৩য় তলা। ২০৯/ক লালবাগ রোড, ঢাকা-১২১১।