1:43 am, Monday, 23 December 2024

ইসলাম ধর্মে যিশু ও মেরিকে যেভাবে দেখা হয়

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:১২:০৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 67 ভিউ
শেয়ার করুন
কারুবাক ডেস্ক :

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তার মহিমা প্রচারের মাধ্যমে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতেই প্রভু যিশুর পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল।

তবে খ্রিস্টধর্মের প্রভু যিশুকে নিয়ে ইসলাম ধর্মেও রয়েছে আলোচনা। শুধু যিশু নন; তার মা মেরিকে নিয়েও রয়েছে আলোচনা। মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফে একাধিকবার উল্লেখ রয়েছে এই দুজনের কথা।

যখন বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ যিশুর জন্ম উদযাপন করছে, তখন অনেকের মধ্যেই আগ্রহ যে মুসলমানরা ভার্জিন মেরি অর্থাৎ কুমারী মরিয়ম এবং তার পুত্র জেসাস বা যিশু বা নবী ঈসাকে কীভাবে দেখে?

বিশ্বব্যাপী যিশুর অনুসারীর সংখ্যা সর্বাধিক। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানেই রয়েছে মুসলমানরা।

ইসলাম ধর্মে নবী ঈসার মা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কোরআনের একটি সূরার নাম “মরিয়ম” রাখা হয়েছে। তিনিই একমাত্র নারী, যাকে মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থে নাম ধরে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ১৯ নম্বর সুরাটি তার নামে নামকরণ করা হয়।

জন ইউনিভার্সিটির থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক জেকি সারিটোপ্রাক যুক্তরাষ্ট্রের, অক্সফোর্ড বিবলিওগ্রাফিজ ওয়েবসাইটে “মেরি ইন ইসলাম” লেখায় বলেন, “মরিয়মের নাম ক্যানোনিকাল গসপেলগুলোয় যতবার বলা হয়েছে তার চাইতে বেশি বলা হয়েছে কোরআনে। কোরআনে কমপক্ষে ৭০টি আয়াতে মরিয়মের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।”

মরিয়ম মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত একজন নারী এবং যারা তাকে সম্মান করে না তাদেরকে মুসলমান বলে গণ্য করা হয় না।

মুসলমানদের মতে, নবী ঈসার জন্মের ছয় শতাব্দী পরে কোরআন নাজিল হয়। সে সময় ফেরেশতা জিবরাইলের (খ্রিস্টান ধর্মমতে দেবদূত গ্যাব্রিয়েল) মাধ্যমে, ইসলামের নবী মুহাম্মদের কাছে কোরআন নাজিল হয়।

খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্ম অনুসারে, গ্যাব্রিয়েল বা জিবরাইল প্রথমবারের মতো মেরি বা মরিয়মকে জানান যে তিনি গর্ভবতী।

খ্রিস্টধর্মের মতো ইসলামও বিশ্বাস করে যে, মরিয়মের গর্ভধারণ ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।

সূরা আল ইমরানে এই ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; যেখানে মরিয়মকে “সুসংবাদ” জানানো হয় এই বলে যে, তিনি এমন একজনের মা হবেন যিনি মেসাইয়াহ বা আল্লাহর রসুল হবেন। এ নিয়ে মরিয়মের প্রতিক্রিয়া কোরআনের ৪৭ নম্বর আয়াতে উঠে এসেছে।

“হে ঈশ্বর! আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ না করা সত্ত্বেও আমার সন্তান হবে কিভাবে?”

পরবর্তীতে সুরায় মরিয়মের সতীত্বের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, “এবং মরিয়ম এমন একজন যিনি তার কুমারীত্ব রক্ষা করেছিলেন, তারপর আমি তার ভেতর আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে সমগ্র জগতবাসীর জন্য এক নিদর্শন বানিয়েছিলাম।”

একা নারীর শক্তি যদিও উভয় ধর্মই মরিয়মের প্রশংসা করেছে, তবে যিশুর মা-কে নিয়ে গল্পগুলোয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা রয়েছে।

ইসলাম ধর্মে নবী ইউসুফের (খ্রিস্টান ধর্মমতে জোসেফ) কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, যেখানে কিনা খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনুসারে মেরি ছিলেন জোসেফের বাগদত্তা।

অন্যদিকে ইসলাম ধর্মমতে, নবী ঈসার মা যখন গর্ভবতী হয়েছিলেন তখন তিনি বিবাহিত ছিলেন না অর্থাৎ কুমারী ছিলেন।

ইসলাম ধর্মমতে, মরিয়ম তার পরিবার এবং তার সম্প্রদায় থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন; যাতে তিনি একটি খেজুর গাছের ছায়ায় একা একা বাচ্চা প্রসব করতে পারেন।

সুরা মরিয়মের ২২ থেকে ২৫ আয়াতে নবী ঈসার জন্মের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

“অতঃপর তিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করলেন এবং একটি নির্জন স্থানে চলে গেলেন। প্রসব বেদনায় তিনি এক খেজুর গাছের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সন্তান প্রসবের বেদনায় তিনি বলেছিলেন: ‘এর আগেই যদি আমি মরে যেতাম আর মানুষের স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে যেতাম!’”

“অতঃপর ফেরেশতা তাকে নীচ থেকে আওয়াজ দিলেন যে, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পায়ের তলায় এক নহর বইয়ে দিয়েছেন।”

“তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কাণ্ড নাড়া দাও, সেটি তোমার সামনে তাজা, পাকা খেজুর ফেলতে থাকবে।”

এক নারীর সাহসিকতা ইসলামে মরিয়মের গুরুত্বের আরেকটি দিক হল যে কোরানের কিছু আয়াতে নবী ঈসাকে “মরিয়মের পুত্র” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যদিও ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক নারী আছেন যাদের মুসলিমরা প্রশংসা করেন। যেমন নবী মুহাম্মদের স্ত্রী এবং কন্যা।

নবী ঈসার মা মুসলমানদের জন্য ধৈর্য ও সাহসের উদাহরণও বটে। কারণ, তিনি যখন তার সম্প্রদায়ে ফিরে আসেন, তখন মরিয়মকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যেমনটি সুরা মরিয়মের আয়াতগুলোয় বর্ণনা করা হয়েছে।

“অতঃপর তিনি তার সন্তানকে কোলে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের সামনে হাজির হলেন। তারা বলল: হে মরিয়ম, তুমি তো এক অঘটন ঘটিয়ে বসেছ।”

“হে হারুনের বোন! তোমার পিতা কোনো অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মা ব্যভিচারিণী ছিলেন না।”

কোরআন অনুসারে, নবী ঈসা নবজাতক হওয়া সত্ত্বেও কথা বলে ওঠেন, “আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে একজন নবী করেছেন।”

নবী ঈসা ইসলামিক ঐতিহ্যে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং প্রায়শই নবী মুহাম্মদের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নবী হিসাবে তাকে বিবেচনা করা হয়। মুসলমানরা নবী মুহাম্মাদের নাম উচ্চারণ করার পরে সাল্লাল্লাহু ওলায়হি ওয়াসসাল্লাম বা “তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” বলে থাকে। যখন নবী ঈসা সম্পর্কে কথা বলেন তখনও তারা একই কাজ করেন।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় যিশু এবং মেরি দুটি খুব জনপ্রিয় নাম, তেমনি মুসলিম বিশ্বে ছেলেদের ঈসা এবং মেয়েদের মরিয়ম নামটিও খুব প্রচলিত।

উপাসনা ইসলাম এবং ক্যাথলিক ধর্মে মরিয়ম এবং তার ছেলেকে ঘিরে যেসব ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে অন্যতম প্রধান অসঙ্গতির বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।

ক্যাথলিকদের জন্য, ভার্জিন মেরি হলেন ঈশ্বরের মা এবং ঈশ্বর জেসাস বা যিশুর মধ্যে মানুষ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

অন্যদিকে মুসলমানদের জন্য, নবী ঈসা ঈশ্বর নন। তাই, মরিয়ম ঈশ্বরের মা নন। ইসলামে মরিয়ম বা নবী ঈসা কাউকে স্রষ্টার সামনে সুপারিশকারী হিসাবে দেখা হয়নি। তারা মানুষ ছিলেন; যাদের কাছে কিছুই প্রার্থনা করা বা চাওয়া যায় না বা চাওয়া হয় না।

নবী ঈসার নাম কোরআনে ২৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে আল্লাজ প্রদত্ত এক অলৌকিক বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, শান্তির নবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনে নবী ঈসার অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

প্রতিকৃতি ক্যাথলিক গির্জা এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, যানবাহন এবং পোশাকে মেরির বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখা যায়। ক্যাথলিক গির্জা একটি বিষয় খেয়াল রাখে তা হলো, তারা যখন মেরির প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করে তখন সেটা যিশুর মায়ের প্রতিকৃতিকে উপাসনা করা হয় না।

ইসলামে আল্লাহর কোনো নবীকে কোন ছবি বা প্রতিকৃতির মাধ্যমে তুলে ধরা নিষেধ। এ কারণে মসজিদে মানুষের কোনো ছবি থাকে না। মসজিদের দেয়ালে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে কোরআনের আয়াত লেখা থাকে।

ইসলামের সুন্নি ধারাও মরিয়মকে প্রতিকৃতি রূপে প্রকাশ করাকে আপত্তিকর বলে মনে করে। যদিও অনেক শিয়া (ইসলাম ধর্মের আরেকটি শাখা) ইসলামি ব্যক্তিত্বের ছবি প্রকাশের ব্যাপারে বেশ নমনীয়।

আরেকটি অসঙ্গতি ক্যাথলিক ধর্ম এবং ইসলামের মধ্যে জেসাস/যিশু বা নবী ঈসাকে নিয়ে মূল পার্থক্য হল ইসলামে তাকে একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার হয় এবং তাকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র বলা হয় না। তিনি যেভাবে মারা গেছেন সেটা নিয়েও দুটি ধর্মে ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে।

ইসলাম ধর্মানুসারীদের মতে, যিশু বা নবী ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি। কোরআনের ১৫৭ ও ১৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

”যদিও তারা বলেছে: আমরা মরিয়মের পুত্র আরেকজন আল্লাহর নবী ইসাকে হত্যা করেছি, তারা সেটা বিশ্বাস করলেও আসলে তারা হত্যা করতে পারেনি বা ক্রুশবিদ্ধ করতে পারেনি। এবং যারা তার সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছে, বস্তুত: তারা এ সম্বন্ধে সন্দিহান ছিল, আসলে কী ঘটেছে, সেই সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি”

“কিন্তু আল্লাহ তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”

এ ধরনের মতভেদ থাকা সত্ত্বেও নবী ঈসা ইসলামের প্রিয় একজন নবী। তবে মুসলমানরা তার জন্মদিন বা বড়দিন উদযাপন করে না।

অন্যদিকে ক্যাথলিক ধর্মের নেতারা শুরু থেকেই মেরি এবং জেসাস/যিশুর প্রতি ইসলামের গভীর শ্রদ্ধাকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। অনেকের মতে, এটি উভয় বিশ্বের মধ্যে সংলাপ স্থাপনের সেরা সেতুবন্ধনগুলোর একটি।

 

#
জনপ্রিয়

ইসলাম ধর্মে যিশু ও মেরিকে যেভাবে দেখা হয়

আপডেটের সময় : ০৭:১২:০৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন
কারুবাক ডেস্ক :

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তার মহিমা প্রচারের মাধ্যমে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতেই প্রভু যিশুর পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল।

তবে খ্রিস্টধর্মের প্রভু যিশুকে নিয়ে ইসলাম ধর্মেও রয়েছে আলোচনা। শুধু যিশু নন; তার মা মেরিকে নিয়েও রয়েছে আলোচনা। মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফে একাধিকবার উল্লেখ রয়েছে এই দুজনের কথা।

যখন বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ যিশুর জন্ম উদযাপন করছে, তখন অনেকের মধ্যেই আগ্রহ যে মুসলমানরা ভার্জিন মেরি অর্থাৎ কুমারী মরিয়ম এবং তার পুত্র জেসাস বা যিশু বা নবী ঈসাকে কীভাবে দেখে?

বিশ্বব্যাপী যিশুর অনুসারীর সংখ্যা সর্বাধিক। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানেই রয়েছে মুসলমানরা।

ইসলাম ধর্মে নবী ঈসার মা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কোরআনের একটি সূরার নাম “মরিয়ম” রাখা হয়েছে। তিনিই একমাত্র নারী, যাকে মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থে নাম ধরে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ১৯ নম্বর সুরাটি তার নামে নামকরণ করা হয়।

জন ইউনিভার্সিটির থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক জেকি সারিটোপ্রাক যুক্তরাষ্ট্রের, অক্সফোর্ড বিবলিওগ্রাফিজ ওয়েবসাইটে “মেরি ইন ইসলাম” লেখায় বলেন, “মরিয়মের নাম ক্যানোনিকাল গসপেলগুলোয় যতবার বলা হয়েছে তার চাইতে বেশি বলা হয়েছে কোরআনে। কোরআনে কমপক্ষে ৭০টি আয়াতে মরিয়মের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।”

মরিয়ম মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত একজন নারী এবং যারা তাকে সম্মান করে না তাদেরকে মুসলমান বলে গণ্য করা হয় না।

মুসলমানদের মতে, নবী ঈসার জন্মের ছয় শতাব্দী পরে কোরআন নাজিল হয়। সে সময় ফেরেশতা জিবরাইলের (খ্রিস্টান ধর্মমতে দেবদূত গ্যাব্রিয়েল) মাধ্যমে, ইসলামের নবী মুহাম্মদের কাছে কোরআন নাজিল হয়।

খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্ম অনুসারে, গ্যাব্রিয়েল বা জিবরাইল প্রথমবারের মতো মেরি বা মরিয়মকে জানান যে তিনি গর্ভবতী।

খ্রিস্টধর্মের মতো ইসলামও বিশ্বাস করে যে, মরিয়মের গর্ভধারণ ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।

সূরা আল ইমরানে এই ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; যেখানে মরিয়মকে “সুসংবাদ” জানানো হয় এই বলে যে, তিনি এমন একজনের মা হবেন যিনি মেসাইয়াহ বা আল্লাহর রসুল হবেন। এ নিয়ে মরিয়মের প্রতিক্রিয়া কোরআনের ৪৭ নম্বর আয়াতে উঠে এসেছে।

“হে ঈশ্বর! আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ না করা সত্ত্বেও আমার সন্তান হবে কিভাবে?”

পরবর্তীতে সুরায় মরিয়মের সতীত্বের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, “এবং মরিয়ম এমন একজন যিনি তার কুমারীত্ব রক্ষা করেছিলেন, তারপর আমি তার ভেতর আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে সমগ্র জগতবাসীর জন্য এক নিদর্শন বানিয়েছিলাম।”

একা নারীর শক্তি যদিও উভয় ধর্মই মরিয়মের প্রশংসা করেছে, তবে যিশুর মা-কে নিয়ে গল্পগুলোয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা রয়েছে।

ইসলাম ধর্মে নবী ইউসুফের (খ্রিস্টান ধর্মমতে জোসেফ) কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, যেখানে কিনা খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনুসারে মেরি ছিলেন জোসেফের বাগদত্তা।

অন্যদিকে ইসলাম ধর্মমতে, নবী ঈসার মা যখন গর্ভবতী হয়েছিলেন তখন তিনি বিবাহিত ছিলেন না অর্থাৎ কুমারী ছিলেন।

ইসলাম ধর্মমতে, মরিয়ম তার পরিবার এবং তার সম্প্রদায় থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন; যাতে তিনি একটি খেজুর গাছের ছায়ায় একা একা বাচ্চা প্রসব করতে পারেন।

সুরা মরিয়মের ২২ থেকে ২৫ আয়াতে নবী ঈসার জন্মের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

“অতঃপর তিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করলেন এবং একটি নির্জন স্থানে চলে গেলেন। প্রসব বেদনায় তিনি এক খেজুর গাছের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সন্তান প্রসবের বেদনায় তিনি বলেছিলেন: ‘এর আগেই যদি আমি মরে যেতাম আর মানুষের স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে যেতাম!’”

“অতঃপর ফেরেশতা তাকে নীচ থেকে আওয়াজ দিলেন যে, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পায়ের তলায় এক নহর বইয়ে দিয়েছেন।”

“তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কাণ্ড নাড়া দাও, সেটি তোমার সামনে তাজা, পাকা খেজুর ফেলতে থাকবে।”

এক নারীর সাহসিকতা ইসলামে মরিয়মের গুরুত্বের আরেকটি দিক হল যে কোরানের কিছু আয়াতে নবী ঈসাকে “মরিয়মের পুত্র” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যদিও ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক নারী আছেন যাদের মুসলিমরা প্রশংসা করেন। যেমন নবী মুহাম্মদের স্ত্রী এবং কন্যা।

নবী ঈসার মা মুসলমানদের জন্য ধৈর্য ও সাহসের উদাহরণও বটে। কারণ, তিনি যখন তার সম্প্রদায়ে ফিরে আসেন, তখন মরিয়মকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যেমনটি সুরা মরিয়মের আয়াতগুলোয় বর্ণনা করা হয়েছে।

“অতঃপর তিনি তার সন্তানকে কোলে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের সামনে হাজির হলেন। তারা বলল: হে মরিয়ম, তুমি তো এক অঘটন ঘটিয়ে বসেছ।”

“হে হারুনের বোন! তোমার পিতা কোনো অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মা ব্যভিচারিণী ছিলেন না।”

কোরআন অনুসারে, নবী ঈসা নবজাতক হওয়া সত্ত্বেও কথা বলে ওঠেন, “আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে একজন নবী করেছেন।”

নবী ঈসা ইসলামিক ঐতিহ্যে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং প্রায়শই নবী মুহাম্মদের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নবী হিসাবে তাকে বিবেচনা করা হয়। মুসলমানরা নবী মুহাম্মাদের নাম উচ্চারণ করার পরে সাল্লাল্লাহু ওলায়হি ওয়াসসাল্লাম বা “তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” বলে থাকে। যখন নবী ঈসা সম্পর্কে কথা বলেন তখনও তারা একই কাজ করেন।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় যিশু এবং মেরি দুটি খুব জনপ্রিয় নাম, তেমনি মুসলিম বিশ্বে ছেলেদের ঈসা এবং মেয়েদের মরিয়ম নামটিও খুব প্রচলিত।

উপাসনা ইসলাম এবং ক্যাথলিক ধর্মে মরিয়ম এবং তার ছেলেকে ঘিরে যেসব ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে অন্যতম প্রধান অসঙ্গতির বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।

ক্যাথলিকদের জন্য, ভার্জিন মেরি হলেন ঈশ্বরের মা এবং ঈশ্বর জেসাস বা যিশুর মধ্যে মানুষ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

অন্যদিকে মুসলমানদের জন্য, নবী ঈসা ঈশ্বর নন। তাই, মরিয়ম ঈশ্বরের মা নন। ইসলামে মরিয়ম বা নবী ঈসা কাউকে স্রষ্টার সামনে সুপারিশকারী হিসাবে দেখা হয়নি। তারা মানুষ ছিলেন; যাদের কাছে কিছুই প্রার্থনা করা বা চাওয়া যায় না বা চাওয়া হয় না।

নবী ঈসার নাম কোরআনে ২৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে আল্লাজ প্রদত্ত এক অলৌকিক বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, শান্তির নবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনে নবী ঈসার অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

প্রতিকৃতি ক্যাথলিক গির্জা এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, যানবাহন এবং পোশাকে মেরির বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখা যায়। ক্যাথলিক গির্জা একটি বিষয় খেয়াল রাখে তা হলো, তারা যখন মেরির প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করে তখন সেটা যিশুর মায়ের প্রতিকৃতিকে উপাসনা করা হয় না।

ইসলামে আল্লাহর কোনো নবীকে কোন ছবি বা প্রতিকৃতির মাধ্যমে তুলে ধরা নিষেধ। এ কারণে মসজিদে মানুষের কোনো ছবি থাকে না। মসজিদের দেয়ালে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে কোরআনের আয়াত লেখা থাকে।

ইসলামের সুন্নি ধারাও মরিয়মকে প্রতিকৃতি রূপে প্রকাশ করাকে আপত্তিকর বলে মনে করে। যদিও অনেক শিয়া (ইসলাম ধর্মের আরেকটি শাখা) ইসলামি ব্যক্তিত্বের ছবি প্রকাশের ব্যাপারে বেশ নমনীয়।

আরেকটি অসঙ্গতি ক্যাথলিক ধর্ম এবং ইসলামের মধ্যে জেসাস/যিশু বা নবী ঈসাকে নিয়ে মূল পার্থক্য হল ইসলামে তাকে একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার হয় এবং তাকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র বলা হয় না। তিনি যেভাবে মারা গেছেন সেটা নিয়েও দুটি ধর্মে ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে।

ইসলাম ধর্মানুসারীদের মতে, যিশু বা নবী ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি। কোরআনের ১৫৭ ও ১৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

”যদিও তারা বলেছে: আমরা মরিয়মের পুত্র আরেকজন আল্লাহর নবী ইসাকে হত্যা করেছি, তারা সেটা বিশ্বাস করলেও আসলে তারা হত্যা করতে পারেনি বা ক্রুশবিদ্ধ করতে পারেনি। এবং যারা তার সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছে, বস্তুত: তারা এ সম্বন্ধে সন্দিহান ছিল, আসলে কী ঘটেছে, সেই সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি”

“কিন্তু আল্লাহ তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”

এ ধরনের মতভেদ থাকা সত্ত্বেও নবী ঈসা ইসলামের প্রিয় একজন নবী। তবে মুসলমানরা তার জন্মদিন বা বড়দিন উদযাপন করে না।

অন্যদিকে ক্যাথলিক ধর্মের নেতারা শুরু থেকেই মেরি এবং জেসাস/যিশুর প্রতি ইসলামের গভীর শ্রদ্ধাকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। অনেকের মতে, এটি উভয় বিশ্বের মধ্যে সংলাপ স্থাপনের সেরা সেতুবন্ধনগুলোর একটি।