কারুবাক ডেস্ক :
আজ ২৭শে ডিসেম্বর। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, প্রখ্যাত চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্মদিন। ১৯৪১ সালের এই দিনে তিনি চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সেখানে অধ্যায়নকালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এফআরসিএস-এর চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে ভারতে ফিরে আসেন। ফিরেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। পরে তিনি ডা. এম এ মবিনের সঙ্গে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। যুদ্ধকালীন স্বল্প সময়ে তিনি অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দেন, যার মাধ্যমে তারা রোগীদের সেবা করতেন। তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট-এ প্রকাশিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর তিনি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসাপাতাল।
পড়ালেখা ও জীবনযাত্রা
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন ১৯৬৪ সালে। এরপর সাধারণ সার্জারি ও ভাস্কুলার সার্জারিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ (এফআরসিএস) নিতে চলে যান যুক্তরাজ্য।
ওই সময় তার জীবনযাত্রা ছিল অগ্রগতিমূলক। তিনি সেখানে প্লেন চালাতেন। তার প্রাইভেট প্লেনের লাইসেন্স ছিল। প্রিন্স ফিলিপসহ অন্যান্য অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা যে দোকানে স্যুট বানাতো, সেখান থেকেই নিজের স্যুট বানাতেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসে এফআরসিএস পড়াকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। এর পরে ডা. এম এ মবিনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। সে সময় তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রশিক্ষণ দেন। তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টারটি হামলার শিকার হয়েছিল, সেই যাত্রীদের মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন।
ওষুধ নীতিতে অবদান
তিনি মূলতঃ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। ১৯৮২ সালে প্রণীত ওষুধ নীতির যথার্থ প্রয়োগ দেশকে আজ ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। বিদেশও রপ্তানী হচ্ছে অনেক। ওষুধ নীতি প্রণয়নের অন্যতম নায়ক ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তার পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল ঢাকার ইস্কাটন সড়কে পুনঃস্থাপিত করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু রূপে গড়ে তোলার জন্য চল গ্রামে যাই স্লোগান ও উদ্দেশ্য নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তর করেন। তখন এটির নামকরণ করা হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণকে কম মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কাজ করে গেছেন।
নির্ভীক স্পষ্টবাদী
তিনি ছিলেন সদা নির্ভীক। জাতীয় দুর্যোগ ও রাজনৈতিক সংকটে সত্য ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
কর্মমূখর জীবনে নানা অর্জন তাঁর। স্বীকৃতিও পেয়েছেন অনেক। এরমধ্যে- জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এরপর, ফিলিপাইনের রামন ম্যাগসাইসাই পদক লাভ করেন ১৯৮৫-তে। সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসেবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড পদক পান ১৯৯২ এ। ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ সম্মাননা পান। এছাড়াও মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার লাভ পান।
মৃত্যু
১১ এপ্রিল, ২০২৩ মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা যান। মৃত্যুকালে স্ত্রী শিরিন পি হক, কন্যা বৃষ্টি আন্না চৌধুরী, ছেলে বারিশ হাসান চৌধুরীসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য অনুরাগী-ভক্ত রেখে গেছেন তিনি।