9:32 pm, Thursday, 26 December 2024

বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৬:০৫:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 136 ভিউ
শেয়ার করুন

বিশ্বজিৎ ঘোষ

বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিক বা সব্যসাচী লেখকদের একটা তালিকা তৈরি করতে বসলে নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে স্থান দিতে হবে সৈয়দ শামসুল হককে। প্রকৃত অর্থেই আমাদের প্রধান সব্যসাচী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কি না লিখেছেন তিনি—কত বিচিত্র বিষয় কত না আঙ্গিকে রূপান্বিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কলমের আঁচড়ে, তুলির টানে। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিতেও আছে বহুমাত্রিকতার পরিচয়।

তবে এ ধারায় নিঃসন্দেহে আরেক দীপ্র নাম বুদ্ধদেব বসু। নানা বিষয়ে তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপ দিয়েছেন তাঁর জগৎভাবনা ও জীবনবীক্ষা। আমরা যদি বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে চোখ ফেরাই, তাহলে এ ধারায় প্রথমেই মনে আসবে সৈয়দ শামসুল হকের নাম।
সৈয়দ হককে কী পরিচয়ে তুলে ধরব—কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কিশোর সাহিত্যিক, অনুবাদক, চলচ্চিত্রকার; নানা অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করা যাবে।

চিত্রশিল্পী কিংবা প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও তাঁর অবদানটা অনুলেখ্য নয়। এত সব পরিচয়ের মাঝেও রবীন্দ্রনাথ কি বুদ্ধদেব বসুর মতো তিনিও বোধকরি কবি অভিধায় প্রথমে চিহ্নিত হবেন। পঞ্চাশের দশকে কবি হিসেবেই আমাদের সাহিত্য ভুবনে তাঁর উজ্জ্বল আবির্ভাব—অতঃপর অতিক্রান্ত হয়েছে অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময়। ছয় দশকের নিরন্তর সাধনায় বাংলা কাব্যধারায় সৈয়দ হক নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব এক ভুবন।

সৈয়দ হকের কবিমানসের বিকাশরেখাকে স্পষ্টভাবে দুটো ভাগে বিভাজন করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তীকালে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন ও শরীরচেতনা তাঁর কবিতায় প্রবলভাবে ছাপ ফেলেছে। এ পর্বে তিনি একান্তই ব্যক্তিকচেতনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সমষ্টিচেতনার পরিবর্তে ব্যক্তিক প্রেম আর কাম আর প্রতিহিংসা নিয়েই প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ পর্বে সৈয়দ হকের সাহিত্যভুবন।
পঞ্চাশের দশকেই প্রেম আর নারীকে নিয়ে তিনি যে কবিতাভুবন নির্মাণ করেছেন, আমাদের কবিতার ধারায় তা উন্মোচন করে আধুনিকতার নতুন এক বাতাবরণ।

ষাটের কবিদের হাতে তা পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়। আধুনিক মানুষের একাকিত্ববোধ ও অনন্বয়চেতনাও এ পর্বে সৈয়দ হকের কবিতায় বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। প্রেমের বহুমুখী প্রকাশ, মনোবিকলন, নারী আর প্রকৃতিকে অভিন্ন সত্তায় কল্পনা—এসব বৈশিষ্ট্য মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সৈয়দ হকের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘একদা এক রাজ্যে’ (১৯৬১), ‘বিরতিহীন উৎসব’ (১৯৬৯), ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ (১৯৭০) এসব কাব্যগ্রন্থে সৈয়দ হকের কবিমানসের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি লক্ষ করা যাবে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কালখণ্ডে সৈয়দ হকের কবিমানসে মৌলিক এবং গুণগত রূপান্তর ঘটে। এ পর্বে দেখা যায়, ব্যক্তিক আত্ম-কুণ্ডয়ন অতিক্রম করে সৈয়দ হক ক্রমেই জাগ্রত হয়েছেন সমষ্টিচেতনায়। কখনো বৃহত্তর দেশমাতৃকার সঙ্গে সংযোগ, কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, কখনো বা প্রাকৃতজীবনের অঙ্গীকার সৈয়দ হকের চেতনায় সৃষ্টি করেছে ইতিবাচক সদর্থক এক চেতনা। যার ফলে এ সময়ে সৈয়দ হকের কবিতায় দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এ পর্যায়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে ‘পরাণের গহীন ভিতর’ (১৯৮০), ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’ (১৯৮৯), ‘তোরাপের ভাই’ (১৯৯০), ‘রাজনৈতিক কবিতা’ (১৯৯১) ইত্যাদি। প্রথম পর্ব থেকে ভাষা ব্যবহার এবং আঙ্গিক প্রসাধনেও দ্বিতীয় পর্বে নতুন মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৈয়দ হকের কবিতায় লোকজীবনকে অঙ্গীকারের জন্য লোকভাষার নিপুণ ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। অলংকার নির্মাণ ও চিত্রকল্প সৃজনেও এ পর্বে সৈয়দ হক দুরূহ পরীক্ষার প্রান্তর ছেড়ে সহজতার পথে বিচরণ করেছেন, বিচরণ করেছেন বাঙালির সংগ্রামী জীবনের আঙিনায়।
বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ হকের প্রাতিস্বিকতার সবচেয়ে বড় জায়গা নাটক—সুনির্দিষ্টভাবে বললে কাব্যনাটক। বুদ্ধদেব বসুর পরে কাব্যনাট্যকার হিসেবে সৈয়দ হক রেখেছেন অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। কাব্যনাটকে সৈয়দ হক কখনো ধারণ করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, কখনো বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্য, কখনো বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক ঘটনা। কাব্যনাটকে বিষয়ের পাশাপাশি প্রকরণ পরিচর্যায়ও তাঁর নিপুণ শিল্পিতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির সমুত্থিত জাগরণকে অসামান্য ব্যঞ্জনায় শিল্পরূপ দিয়েছেন তিনি। ভাষার গীতময়তা, আঞ্চলিক শব্দের কুশলী প্রয়োগ এবং যুদ্ধকালীন জীবন-বাস্তবতার কাব্যিক উচ্চারণে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে একটি পালাবদলকারী নাটক হিসেবে বিবেচিত। নাটকের সমাপ্তিতে পাইকের সংলাপে যে প্রতিশোধের বাণী উচ্চারিত, তা বুঝি বাংলাদেশের জন্য এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।
এদিকে, এদিকে সব আসেন এখন
দেখাইয়া দেই সব কোথায় কখন
কি গজব কি আজাবে ছিল লোকজন
জালেমের হাতে ছিল যখন শাসন
শত শত মারা গেছে আত্মীয়স্বজন।
বাংলা কাব্যনাটকের ধারায় সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ (১৯৮২) এক স্মরণীয় এবং অনতিক্রান্ত নির্মাণ। ১৭৮৩ সালে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক নেতা নূরলদীনের সংগ্রাম আর সাহস আর সংক্ষোভ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কাব্যনাটক। নূরলদীনের ব্রিটিশবিরোধিতার সঙ্গে সৈয়দ হক অসামান্য নৈপুণ্যে এখানে মিলিয়ে দিয়েছেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের উপনিবেশবাদবিরোধী মুক্তিসংগ্রামকে এবং এখানেই ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ নাটকের কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি। সৈয়দ হক মনে করেন, ১৭৮৩ কিংবা ১৯৭১ সালে বাঙালির জাগরণ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বাঙালি জাতিসত্তার এই সংগ্রামী চেতনা উপস্থাপনের জন্যই তাঁর নূরলদীন স্মরণ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত পয়ার ছন্দে বিন্যস্ত ব্যতিক্রমী এই কাব্যনাট্য বাংলা নাটকের ইতিহাসে সঞ্চার করেছে নতুন এক মাত্রা। বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রামী চেতনা ও প্রতিরোধ বাসনা, জীবন বাজি রেখে আপন মৃত্তিকায় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সাহস নূরলদীনের শেষ সংলাপে উদ্ভাসিত :
পুন্নিমার চান বড় হয় রে ধরল।
জননীর দুগ্ধের মতন তার দ্যাখোঁ রোশনাই।
… … … …
এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়
উয়ার মতন খাড়া হয় য্যান মানুষেরা হয়।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বঙ্গপসাগর,
উয়ার মতন গর্জি ওঠে য্যান মানুষের স্বর।

এ দ্যাশে হামার বাড়ি পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র আছে,
উয়ার মতন ফির মানুষের রক্ত য্যান নাচে।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি পশ্চিমেতে পাহাড়িয়া মাটি,
উয়ার মতন শক্ত হয় য্যান মানুষের ঘাঁটি
হয় হয় হয় হয়।
‘গণনায়ক’ (১৯৭৬), ‘এখানে এখন’ (১৯৮৮), ‘ঈর্ষা’ (১৯৯৩)—এসব কাব্যনাটকেও সৈয়দ হককে একজন অসামান্য নাট্যকার হিসেবে সহজেই আবিষ্কার করা যায়। বাংলা নাটকের মঞ্চসফলতাকেও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন সৈয়দ হক। উপর্যুক্ত কাব্যনাট্যগুলোও মঞ্চসফলতার প্রশ্নে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
ছোটগাল্পিক হিসেবে সৈয়দ হকের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকে। তিনি প্রধানত নগরজীবনের গল্প-ভাষ্যকার। উৎকট আত্মকেন্দ্রিকতা ও মনোবিকলন তাঁর গল্পসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ছোটগল্পে প্রেমের পটভূমিতে সৈয়দ হক নির্মাণ করেন আধুনিক নগরজীবনের বহুভুজ যন্ত্রণার কথা, নাগরিক মধ্যবিত্তের হতাশা-ব্যর্থতা আর আত্মদহনের কথা। ‘শীত বিকেল’ (১৯৫৯), ‘রক্তগোলাপ’ (১৯৬৪), ‘আনন্দের মৃত্যু’ (১৯৬৭), ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’ (১৯৮২)—এসব গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সৈয়দ হকের উপর্যুক্ত ছোটগাল্পিক প্রতিভার ছাপ সুস্পষ্ট। আশি-উত্তর কালখণ্ডে ছোটগল্পে সৈয়দ হক আত্মদহনের প্রান্তর পেরিয়ে সমষ্টি-উজ্জীবনের পথে যাত্রা করেছেন। এ সময় জনসমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর গল্পে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’ (১৯৯০) গ্রন্থে সংকলিত গল্পগুলোতে তাঁর এই নবযাত্রার ছাপ সুস্পষ্ট। এ গ্রন্থে সৈয়দ হককে একজন দায়বদ্ধ শিল্পী হিসেবে আবিষ্কার করা যায়, তাঁকে অনায়াসেই স্থান দেওয়া যায় শ্রেষ্ঠ গল্পকারের আসনে। পঞ্চাশের দশকে উপন্যাসে তিনি প্রধানত ধরতে চেয়েছেন অবচেতন-আকাঙ্ক্ষাপীড়িত বিকৃত বিপন্ন নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী কালখণ্ডে প্রকাশিত ‘এক মহিলার ছবি’ (১৯৫৯), ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৯), ‘অনুপম দিন’ (১৯৬২), ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ (১৯৬৪)—এসব উপন্যাসে সৈয়দ হকের আত্মমগ্ন ঔপন্যাসিক প্রতিভার প্রতিফলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে সৈয়দ হক লিখেছেন ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ (১৯৮৯), ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ (১৯৯০) ইত্যাদি। এসব উপন্যাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রাপ্তি উন্মোচিত হয়েছে, শিল্পিত হয়েছে যুদ্ধকালীন নানামাত্রিক বাস্তবতা।
প্রবন্ধ, সমালোচনা, স্মৃতিকথা ইত্যাদি ধারায়ও সৈয়দ হক তাঁর স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ ধারায় তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ (১৯৯৫), ‘গল্পের কলকব্জা’ (১৯৯৬) ইত্যাদি গ্রন্থের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। অনুবাদক হিসেবেও তাঁর সফলতা স্মরণযোগ্য। ‘ম্যাকবেথ ও টেম্পেস্ট’ নাটক তাঁর অনুবাদক-সফলতার পরিচয় বহন করছে। এক অনুপম গদ্যরীতির স্রষ্টা সৈয়দ হক। তাঁর গদ্য সুখদ, মনোরম এবং আকর্ষণী শক্তিসম্পন্ন। সৈয়দ হক দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন, তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ভবন। দৈশিকতার সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর সৃষ্টি গোটা বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছেই ছড়িয়ে পড়েছে, হয়ে উঠেছেন তিনি বাংলা সাহিত্যের মূলধারার লেখক। এখানেই সৈয়দ হকের কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি, স্মরণীয় সাফল্য।

সূত্র : শিলালিপি

 

#
জনপ্রিয়

বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক

আপডেটের সময় : ০৬:০৫:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

বিশ্বজিৎ ঘোষ

বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিক বা সব্যসাচী লেখকদের একটা তালিকা তৈরি করতে বসলে নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে স্থান দিতে হবে সৈয়দ শামসুল হককে। প্রকৃত অর্থেই আমাদের প্রধান সব্যসাচী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কি না লিখেছেন তিনি—কত বিচিত্র বিষয় কত না আঙ্গিকে রূপান্বিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কলমের আঁচড়ে, তুলির টানে। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিতেও আছে বহুমাত্রিকতার পরিচয়।

তবে এ ধারায় নিঃসন্দেহে আরেক দীপ্র নাম বুদ্ধদেব বসু। নানা বিষয়ে তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপ দিয়েছেন তাঁর জগৎভাবনা ও জীবনবীক্ষা। আমরা যদি বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে চোখ ফেরাই, তাহলে এ ধারায় প্রথমেই মনে আসবে সৈয়দ শামসুল হকের নাম।
সৈয়দ হককে কী পরিচয়ে তুলে ধরব—কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কিশোর সাহিত্যিক, অনুবাদক, চলচ্চিত্রকার; নানা অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করা যাবে।

চিত্রশিল্পী কিংবা প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও তাঁর অবদানটা অনুলেখ্য নয়। এত সব পরিচয়ের মাঝেও রবীন্দ্রনাথ কি বুদ্ধদেব বসুর মতো তিনিও বোধকরি কবি অভিধায় প্রথমে চিহ্নিত হবেন। পঞ্চাশের দশকে কবি হিসেবেই আমাদের সাহিত্য ভুবনে তাঁর উজ্জ্বল আবির্ভাব—অতঃপর অতিক্রান্ত হয়েছে অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময়। ছয় দশকের নিরন্তর সাধনায় বাংলা কাব্যধারায় সৈয়দ হক নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব এক ভুবন।

সৈয়দ হকের কবিমানসের বিকাশরেখাকে স্পষ্টভাবে দুটো ভাগে বিভাজন করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তীকালে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন ও শরীরচেতনা তাঁর কবিতায় প্রবলভাবে ছাপ ফেলেছে। এ পর্বে তিনি একান্তই ব্যক্তিকচেতনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সমষ্টিচেতনার পরিবর্তে ব্যক্তিক প্রেম আর কাম আর প্রতিহিংসা নিয়েই প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ পর্বে সৈয়দ হকের সাহিত্যভুবন।
পঞ্চাশের দশকেই প্রেম আর নারীকে নিয়ে তিনি যে কবিতাভুবন নির্মাণ করেছেন, আমাদের কবিতার ধারায় তা উন্মোচন করে আধুনিকতার নতুন এক বাতাবরণ।

ষাটের কবিদের হাতে তা পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়। আধুনিক মানুষের একাকিত্ববোধ ও অনন্বয়চেতনাও এ পর্বে সৈয়দ হকের কবিতায় বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। প্রেমের বহুমুখী প্রকাশ, মনোবিকলন, নারী আর প্রকৃতিকে অভিন্ন সত্তায় কল্পনা—এসব বৈশিষ্ট্য মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সৈয়দ হকের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘একদা এক রাজ্যে’ (১৯৬১), ‘বিরতিহীন উৎসব’ (১৯৬৯), ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ (১৯৭০) এসব কাব্যগ্রন্থে সৈয়দ হকের কবিমানসের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি লক্ষ করা যাবে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কালখণ্ডে সৈয়দ হকের কবিমানসে মৌলিক এবং গুণগত রূপান্তর ঘটে। এ পর্বে দেখা যায়, ব্যক্তিক আত্ম-কুণ্ডয়ন অতিক্রম করে সৈয়দ হক ক্রমেই জাগ্রত হয়েছেন সমষ্টিচেতনায়। কখনো বৃহত্তর দেশমাতৃকার সঙ্গে সংযোগ, কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, কখনো বা প্রাকৃতজীবনের অঙ্গীকার সৈয়দ হকের চেতনায় সৃষ্টি করেছে ইতিবাচক সদর্থক এক চেতনা। যার ফলে এ সময়ে সৈয়দ হকের কবিতায় দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এ পর্যায়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে ‘পরাণের গহীন ভিতর’ (১৯৮০), ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’ (১৯৮৯), ‘তোরাপের ভাই’ (১৯৯০), ‘রাজনৈতিক কবিতা’ (১৯৯১) ইত্যাদি। প্রথম পর্ব থেকে ভাষা ব্যবহার এবং আঙ্গিক প্রসাধনেও দ্বিতীয় পর্বে নতুন মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৈয়দ হকের কবিতায় লোকজীবনকে অঙ্গীকারের জন্য লোকভাষার নিপুণ ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। অলংকার নির্মাণ ও চিত্রকল্প সৃজনেও এ পর্বে সৈয়দ হক দুরূহ পরীক্ষার প্রান্তর ছেড়ে সহজতার পথে বিচরণ করেছেন, বিচরণ করেছেন বাঙালির সংগ্রামী জীবনের আঙিনায়।
বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ হকের প্রাতিস্বিকতার সবচেয়ে বড় জায়গা নাটক—সুনির্দিষ্টভাবে বললে কাব্যনাটক। বুদ্ধদেব বসুর পরে কাব্যনাট্যকার হিসেবে সৈয়দ হক রেখেছেন অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। কাব্যনাটকে সৈয়দ হক কখনো ধারণ করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, কখনো বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্য, কখনো বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক ঘটনা। কাব্যনাটকে বিষয়ের পাশাপাশি প্রকরণ পরিচর্যায়ও তাঁর নিপুণ শিল্পিতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির সমুত্থিত জাগরণকে অসামান্য ব্যঞ্জনায় শিল্পরূপ দিয়েছেন তিনি। ভাষার গীতময়তা, আঞ্চলিক শব্দের কুশলী প্রয়োগ এবং যুদ্ধকালীন জীবন-বাস্তবতার কাব্যিক উচ্চারণে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে একটি পালাবদলকারী নাটক হিসেবে বিবেচিত। নাটকের সমাপ্তিতে পাইকের সংলাপে যে প্রতিশোধের বাণী উচ্চারিত, তা বুঝি বাংলাদেশের জন্য এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।
এদিকে, এদিকে সব আসেন এখন
দেখাইয়া দেই সব কোথায় কখন
কি গজব কি আজাবে ছিল লোকজন
জালেমের হাতে ছিল যখন শাসন
শত শত মারা গেছে আত্মীয়স্বজন।
বাংলা কাব্যনাটকের ধারায় সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ (১৯৮২) এক স্মরণীয় এবং অনতিক্রান্ত নির্মাণ। ১৭৮৩ সালে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক নেতা নূরলদীনের সংগ্রাম আর সাহস আর সংক্ষোভ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কাব্যনাটক। নূরলদীনের ব্রিটিশবিরোধিতার সঙ্গে সৈয়দ হক অসামান্য নৈপুণ্যে এখানে মিলিয়ে দিয়েছেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের উপনিবেশবাদবিরোধী মুক্তিসংগ্রামকে এবং এখানেই ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ নাটকের কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি। সৈয়দ হক মনে করেন, ১৭৮৩ কিংবা ১৯৭১ সালে বাঙালির জাগরণ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বাঙালি জাতিসত্তার এই সংগ্রামী চেতনা উপস্থাপনের জন্যই তাঁর নূরলদীন স্মরণ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত পয়ার ছন্দে বিন্যস্ত ব্যতিক্রমী এই কাব্যনাট্য বাংলা নাটকের ইতিহাসে সঞ্চার করেছে নতুন এক মাত্রা। বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রামী চেতনা ও প্রতিরোধ বাসনা, জীবন বাজি রেখে আপন মৃত্তিকায় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সাহস নূরলদীনের শেষ সংলাপে উদ্ভাসিত :
পুন্নিমার চান বড় হয় রে ধরল।
জননীর দুগ্ধের মতন তার দ্যাখোঁ রোশনাই।
… … … …
এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়
উয়ার মতন খাড়া হয় য্যান মানুষেরা হয়।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বঙ্গপসাগর,
উয়ার মতন গর্জি ওঠে য্যান মানুষের স্বর।

এ দ্যাশে হামার বাড়ি পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র আছে,
উয়ার মতন ফির মানুষের রক্ত য্যান নাচে।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি পশ্চিমেতে পাহাড়িয়া মাটি,
উয়ার মতন শক্ত হয় য্যান মানুষের ঘাঁটি
হয় হয় হয় হয়।
‘গণনায়ক’ (১৯৭৬), ‘এখানে এখন’ (১৯৮৮), ‘ঈর্ষা’ (১৯৯৩)—এসব কাব্যনাটকেও সৈয়দ হককে একজন অসামান্য নাট্যকার হিসেবে সহজেই আবিষ্কার করা যায়। বাংলা নাটকের মঞ্চসফলতাকেও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন সৈয়দ হক। উপর্যুক্ত কাব্যনাট্যগুলোও মঞ্চসফলতার প্রশ্নে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
ছোটগাল্পিক হিসেবে সৈয়দ হকের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকে। তিনি প্রধানত নগরজীবনের গল্প-ভাষ্যকার। উৎকট আত্মকেন্দ্রিকতা ও মনোবিকলন তাঁর গল্পসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ছোটগল্পে প্রেমের পটভূমিতে সৈয়দ হক নির্মাণ করেন আধুনিক নগরজীবনের বহুভুজ যন্ত্রণার কথা, নাগরিক মধ্যবিত্তের হতাশা-ব্যর্থতা আর আত্মদহনের কথা। ‘শীত বিকেল’ (১৯৫৯), ‘রক্তগোলাপ’ (১৯৬৪), ‘আনন্দের মৃত্যু’ (১৯৬৭), ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’ (১৯৮২)—এসব গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সৈয়দ হকের উপর্যুক্ত ছোটগাল্পিক প্রতিভার ছাপ সুস্পষ্ট। আশি-উত্তর কালখণ্ডে ছোটগল্পে সৈয়দ হক আত্মদহনের প্রান্তর পেরিয়ে সমষ্টি-উজ্জীবনের পথে যাত্রা করেছেন। এ সময় জনসমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর গল্পে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’ (১৯৯০) গ্রন্থে সংকলিত গল্পগুলোতে তাঁর এই নবযাত্রার ছাপ সুস্পষ্ট। এ গ্রন্থে সৈয়দ হককে একজন দায়বদ্ধ শিল্পী হিসেবে আবিষ্কার করা যায়, তাঁকে অনায়াসেই স্থান দেওয়া যায় শ্রেষ্ঠ গল্পকারের আসনে। পঞ্চাশের দশকে উপন্যাসে তিনি প্রধানত ধরতে চেয়েছেন অবচেতন-আকাঙ্ক্ষাপীড়িত বিকৃত বিপন্ন নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী কালখণ্ডে প্রকাশিত ‘এক মহিলার ছবি’ (১৯৫৯), ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৯), ‘অনুপম দিন’ (১৯৬২), ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ (১৯৬৪)—এসব উপন্যাসে সৈয়দ হকের আত্মমগ্ন ঔপন্যাসিক প্রতিভার প্রতিফলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে সৈয়দ হক লিখেছেন ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ (১৯৮৯), ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ (১৯৯০) ইত্যাদি। এসব উপন্যাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রাপ্তি উন্মোচিত হয়েছে, শিল্পিত হয়েছে যুদ্ধকালীন নানামাত্রিক বাস্তবতা।
প্রবন্ধ, সমালোচনা, স্মৃতিকথা ইত্যাদি ধারায়ও সৈয়দ হক তাঁর স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ ধারায় তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ (১৯৯৫), ‘গল্পের কলকব্জা’ (১৯৯৬) ইত্যাদি গ্রন্থের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। অনুবাদক হিসেবেও তাঁর সফলতা স্মরণযোগ্য। ‘ম্যাকবেথ ও টেম্পেস্ট’ নাটক তাঁর অনুবাদক-সফলতার পরিচয় বহন করছে। এক অনুপম গদ্যরীতির স্রষ্টা সৈয়দ হক। তাঁর গদ্য সুখদ, মনোরম এবং আকর্ষণী শক্তিসম্পন্ন। সৈয়দ হক দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন, তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ভবন। দৈশিকতার সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর সৃষ্টি গোটা বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছেই ছড়িয়ে পড়েছে, হয়ে উঠেছেন তিনি বাংলা সাহিত্যের মূলধারার লেখক। এখানেই সৈয়দ হকের কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি, স্মরণীয় সাফল্য।

সূত্র : শিলালিপি