মসলেম উদ্দীন মুখে হাত দিয়ে বসে আছে আকাশের পানে তাকিয়ে। জীবনের অঙ্ক মেলে না ওর। বুকের ভেতর কাল বৈশাখির মেঘ, যেন থেমে থেমে বিদুৎ চমকায়। কখন ঝড় শুরু হয় তার বুঝি হিসাব নেই।
ফুলবানু ওর স্ত্রী, পাশে এসে মাটিতেই বসে পড়ে। আস্তে করে ডেকে বলল, ওগো শুনছ? কী এত ভাবছ বল তো? আমরা তো আমাদের সোনামানিকদের কাছেই থাকব। হয়তো দুজন এক জায়গা থাকব না, তবু কত ভালোথাকব। তোমার চিকিৎসা হবে, আমরা ভালো ভালো খাব, কত সুখ আমাদের।
ধমক দিতে গিয়েও থেমে যায় মসলেম উদ্দীন। কাঁপা কাঁপা হাতে স্ত্রীর মাথাটা টেনে নেয় বুকের মধ্যে। চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ফুলবানু তুই কী মন থেকে বলছিস, তোর যে চোখ কান্দে।
ফুলবানু এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় মসলেম উদ্দীন। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই চোখের পানিতে যেন ফুলবানুর মাথা ঠান্ডা করতে চায়। মনে পড়ে অভাবের সংসারে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে বরণ করতে করতে চার ছেলে দুই মেয়ে ওদের সংসারে আসে। মানুষের বাড়ি স্বামী-স্ত্রী মিলে কাজ করে ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে। আজ ওরা সবাই চাকরি করে, কেউই বাড়ি থাকে না। দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে, জামাইয়েরা চাকরি করে। সবাই নিজ নিজ আবাসস্থলে থাকে।
ওরা বুড়াবুড়ি দুজন সেই গ্রামে কোনোরকম মাথাগুঁজে থাকে। সংসারে আয় বলতে কিছুই নেই মোসলেম উদ্দীনের। অসুস্থ, ফুলবানুই মাঝে মাঝে মানুষের বাড়ি কাজ করে, আর দুই মেয়ে মাঝে মাঝে পাঁচশ, এক হাজার টাকা পাঠায়। বছরে দুই ঈদে কাপড়চোপড় দেয়। ছেলেরা কোনো টাকাপয়সা দিতে পারে না, তাদের ইনকামে নাকি তাদেরই চলে না।
হঠাৎ করেই মসলেম উদ্দীনের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার চিকৎসা হয়। গ্রামের লোকেরা চাঁদা তুলে চিকিৎসা করিয়ে এনেছে। এরপর গ্রামের মাতব্বর ছেলেমেয়েদের ফোন করে ডেকে এনেছিল। তারা এসে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছে, তারা আলাদা কোনো খরচ দিতে পারবে না। প্রতি ছেলেমেয়ের কাছে একেকজন দুই মাস করে থাকবে। দুজনকে কোনো ছেলেই একসঙ্গে রাখতে পারবে না। শুধু দুই মেয়ের যখন সময় আসবে তখন তারা মা-বাবাকে একসঙ্গে রাখবে। মসলেম উদ্দীন ভাবতে কয়েকদিন সময় নিয়েছে। আজ ভাবনার তৃতীয়দিন। অস্থিরতায় মসলেম উদ্দীনের বুকটা কাঁপছে।
যদি এ সিদ্ধান্তই মানতে হয় তাহলে ফুলবানুর সঙ্গে ওর আবার দেখা হবে তো? আর ভাবতে পারে না। চোখের কোনায় শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ আবার ভিজে ওঠে। ভাবতে পারে না কে ওকে পানি গরম করে গোসল করাবে? কে ওকে রাতে ধরে নিয়ে প্রস্রাব করাবে? কে ওকে কাশি উঠলে মালসাটা এগিয়ে দেবে? যদি ঘুম না আসে তাহলে কে মাথায় হাত বোলাবে? কাকে বলবে পায়ে একটু তেল দাও তো, দেখি কাশিটা কমে কিনা? চারদিকে শূন্যতা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।
ফুলবানু এবার স্বামীর মুখের দিকে তাকায়, বুঝতে চায় কী ভাবছে? কিন্তু এ ভাবনার কোনো কূলকিনারা নাই। আগামীকাল ছেলেদের খবর পাঠানোর দিন। ছেলেদের কী বলবে ভেবে পায় না। স্বামীকে কাছে রাখার ব্যাকুলতায় ওর প্রাণটা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চায়। আবার স্বামীকেও বলতে পারেনা। তাহলে সে কিছুতেই রাজি হবে না, ফুলবানুকে ছেড়ে যাবার। ফুলবানু চায় ওর স্বামী বেঁচে থাক হাজার বছর। এভাবেই দিন গড়িয়ে রাত আসে।
শুয়ে আছে দুজন, কোনো কথা নেই। যেন মৃত্যুপুরীতে দুজন হিমশীতল মানুষ। হঠাৎ করেই কাশি উঠে মসলেম উদ্দীনের। আর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। ফুলবানু দিশেহারা হয়ে ওই মধ্যরাতে পাশের বাড়ির একজনকে ডাকে। সে এসে ভ্যান ডেকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ফুলবানু তাড়াতাড়ি স্বামীকে গুছিয়ে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয়।
আজ যেন মসলেম উদ্দীনের শ্বাসকষ্ট মাত্রায় বেশি। হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই পরনের কাপড় ভিজে যায়, রক্তাক্ত চোখে শুধু ফুলবানুর হাতটা ধরে বলে, ফুলি তোকে কোথাও যেতে হবে না, আমার ভিটায়, আমার কবরের পাশে তুই থাকিস। না হলে যে আমি একা থাকতে পারব না। তারপর সব শেষ।
একটু আগেই মসলেম উদ্দীনের লাশ দাফন করা হয়েছে। ছেলেরা ফিরে গেছে তাদের আবাসস্থলে। মেয়ে দুটো আছে। ফুলবানু অনড় হয়ে বসে আছে। হায়রে ভাত, কত মূল্য তোর। তুই যে আমার বন্ধনকে আলগা করে দিলি। তুই যে আমার ভালোবাসাকে মাটির নিচে দিয়ে দিলি। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। পাখিরা বাসায় ফিরছে, নিঃসঙ্গ ফুলবানু কবরের দিকে তাকিয়ে সুরা ইয়াসিন মুখস্থ পাঠ করছে।