মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি সমৃদ্ধ ভাষা। ইসলামী সভ্যতার উজ্জ্বল সোনালি সৌধ আরবি ভাষাতেই নির্মিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের ভাষা হওয়ায় আরবি মুসলমানদের অন্তরে সম্মান ও গাম্ভীর্যের অধিকারী। যে ব্যক্তি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাসাগরে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা সংগ্রহ করতে চায় তাকে আরবি ভাষায় পারদর্শী হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা উপলব্ধি করতে পারো।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ২)
পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলছেন, পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ও প্রথম ভাষা আরবি। আদম (আ.)-কে সর্বপ্রথম জান্নাতে যে ভাষাজ্ঞান দান করা হয়েছিল সেটি ছিল আরবি। কেননা আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষাও তিনি সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পরম করুনাময়। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিখিয়েছেন (ভাব প্রকাশ করতে) ভাষা।
’ (সুরা : আর রহমান, আয়াত: ১-৪)
বোঝা গেল, আল্লাহ জগৎ সৃষ্টির আগেই ভাষা সৃষ্টি করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, জান্নাতে আদম (আ.)-এর ভাষা ছিল আরবি। তিনি নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর আরবি ভাষা ভুলে যান। অতঃপর সুরিয়ানি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। দুনিয়াতে এসে তার তাওবা কবুল হওয়ার পরে আবার আরবি ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হন।
(আল মুজহির : ১/৩০)
অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা
আরবি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও গভীর সাহিত্যরস সমৃদ্ধ একটি ভাষা। আরবি ভাষার শব্দসংখ্যা এক কোটি ২৩ লাখেরও বেশি। এ ভাষায় এত বেশি সমার্থবোধক শব্দাবলি রয়েছে, যা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় দেখা যায় না। যেমন আরবিতে সিংহ বোঝাতে ৩৫০টি শব্দ, ‘উট’ বোঝাতে ২৫৫টি, ‘পানি’ বোঝাতে ১৭০টি শব্দ আছে। আল্লামা রাফেয়ি (রহ.) বলেন, কোরআন আরবি ভাষায় এমন রীতিতে অবতীর্ণ হয়েছে, যা অল্প ও বিস্তর উভয় পরিমাণ সমালোচকদের অক্ষম করে দেয়। কেবল আলোর সঙ্গে কোরআনের তুলনা করা যেতে পারে। কেননা আলো খণ্ডিত হলেও তার প্রকৃতিতে যেমন কোনো পরিবর্তন আসে না, পবিত্র কোরআনও তেমনি। (তারিখু আদাবিল আরবি : ২/৭৪)
আরবি ভাষার ধর্মীয় গুরুত্ব
ন্যূনতম আরবি জানা না থাকলে ব্যক্তির পক্ষে ধর্মীয় জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। কেননা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হলো নামাজ। বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ছাড়া নামাজ শুদ্ধ হয় না। সঙ্গে সঙ্গে নামাজে বিভিন্ন দোয়া-দরুদ, তসবিহ-তাহলিল আরবিতেই আদায় করতে হয়। পৃথিবীর লাখ লাখ মসজিদে প্রতিদিন পাঁচবার আরবিতে আজান দেওয়া হয়। জুমার নামাজের খুতবা, দুই ঈদের জামাতে খুতবা আরবিতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া হাদিসের ভাষাও আরবি। এ জন্য ধর্মীয় জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চাইলে আরবি ভাষা অপরিহার্য।
অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আরবি ভাষার ভূমিকা
পৃথিবীতে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় দেড় শ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ। এদের বেশির ভাগের ভাষা আরবি। আরব দেশগুলো বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ও খনিজ সম্পদের দেশ। উক্ত দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের সন্ধান, ব্যাবসায়িক যোগাযোগ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আরবি ভাষা শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো বৈদেশিক রেমিট্যান্স। এর ৬৩ শতাংশ আসে আরবি ভাষাভাষী দেশগুলো থেকে।
আরব ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রমসহ সব ক্ষেত্রে আরবি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এটি তাঁদের বাণিজ্যিক ভাষা। সুতরাং যাঁরা আরব দেশগুলোতে নিজেদের শ্রম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন তাঁদের জন্য আরবি ভাষা শেখা খুবই জরুরি।
আরবি ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বর্তমানে বিশ্বের ২৮টি দেশে আরবি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। আর পৃথিবীতে এই ভাষাভাষী লোকের সঙ্গে প্রায় ২৮ কোটির ওপরে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘকাল পর্যন্ত আরবরা নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করে সেখানে কথা বলার সুযোগ পেত না। কারণ তখন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। এগুলো হলো ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, চীনা ও রাশিয়ান। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় আলোচনাসভা, বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৬৬ সালে ইউনেসকোর সাধারণ অধিবেশনগুলোতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য ভাষার সঙ্গে আরবি ভাষায়ও অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভার ২৮তম অধিবেশনে ৩১৯০ নস্বর সিদ্ধান্তের আলোকে আরবিকে ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ১৯০তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সাংস্কৃতিক জীবনে আরবির গুরুত্ব
মুমিন মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনের ভিত্তি হলো ইসলামী সংস্কৃতি, যা আরবি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে। মুসলিম জাতি গঠন ও ঈমানি শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরবি ভাষা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে আরবি ভাষার ব্যাবহারিক ক্ষেত্রকে আরো সহজতর পন্থায় মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। আরবি লেখা, বলা ও বোঝার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম।