7:45 pm, Sunday, 22 December 2024

জানোয়ার এঞ্জিনিয়ার 

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৬:৪২:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 68 ভিউ
শেয়ার করুন

 সুকুমার রায় :

পাখির মধ্যে কাক, আর পশুর মধ্যে শিয়াল—বুদ্ধির জন্য মানুষ ইহাদের প্রশংসা করে। কিন্তু এখন যে জন্তুটির কথা বলিব, তাহার বুদ্ধি শিয়ালের চাইতে বেশি কি না, সেটা তোমরা বিচার করিয়া দেখো। এই জন্তুর বাড়ি উত্তরের শীতের দেশে—বিশেষত উত্তর আমেরিকায়। ল্যাজসুদ্ধ দুহাত লম্বা জন্তুটি, দেখিতে কতকটা ইঁদুর বা গিনিপিগের মতো; তাহার চেহারায় বিশেষ কোনো বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় না।

কিন্তু তাহার কাজ যদি দেখো, তবে বুঝিবে সে কত বড় কারিকর। জানোয়ারের মধ্যে এত বড় ‘এঞ্জিনিয়ার’ আর দ্বিতীয় নাই। ইহার নাম বীভার।

মৌমাছির চাক, মাকড়সার জাল, পিঁপড়ার বাসা প্রভৃতি অনেক ব্যাপারের মধ্যে আমরা খুব কৌশলের পরিচয় পাই—কিন্তু বীভারের বুদ্ধি-কৌশল আরো অদ্ভুত।

ইহারা বড় বড় বাঁধ বাঁধিয়া নদীর স্রোত আটকাইয়া রাখে, জঙ্গলের বড় বড় গাছ কাটিয়া ফেলে এবং সেই গাছের ‘লাড়ি’ বানাইয়া নানা রকম কাজে লাগায়। খাল কাটিয়া এক জায়গার জল আরেক জায়গায় নিতেও ইহারা কম ওস্তাদ নয়। এই সমস্ত কাজে ইহাদের প্রধান অস্ত্র বাটালির মতো ধারালো চারটি দাঁত। বড় বড় গাছ, যাহা কোপাইয়া কাটিতে মানুষের রীতিমতো পরিশ্রম লাগে, বীভার তাহার ঐ দাঁত দুটি দিয়া সেই গাছকে কুরিয়া মাটিতে ফেলে।

যেখানে বীভারেরা পল্লী বাঁধিয়া দলেবলে বসতি করে, তাহার আশপাশেই দেখা যায় যে অনেকগুলি গাছের গোড়ার দিকে, জমি হইতে হাতখানেক উপরে, খানিকটা কাঠ যেন খাবলাইয়া ফেলা হইয়াছে। একেকটা গাছ প্রায় পড়ো পড়ো অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছে; আরেকটু কাটিলেই পড়িয়া যাইবে। এ সমস্তই বীভারের কাণ্ড। গাছটি যখন কাটা হইল তখন তাহাকে ছোট-বড় নানা রকম টুকরায় কাটিবার জন্য বীভারের দল ভারি ব্যস্ত হইয়া ওঠে। শীতকালে যখন বরফ জমিয়া যায়, যখন চলাফেরা করিয়া খাবার সংগ্রহ করা কঠিন হইয়া পড়ে, তখন বীভারের প্রধান খাদ্য হয় গাছের ছাল।

সেই জন্য শীত আসিবার পূর্বেই তাহাদের গাছ কাটিবার ধুম পড়িয়া যায়, এবং তাহারা গাছের নরম বাকল কাটিয়া বাসার মধ্যে জমাইতে থাকে।

বীভারের প্রধান আশ্চর্য কীর্তি নদীর বাঁধ; কিন্তু তাহার কথা বলিবার আগে ইহাদের বাসা সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। জলের ধারে কাঠকুটা ও মাটির ঢিপি বানাইয়া তাহার মধ্যে বীভারেরা স্ত্রী-পুত্র পরিবার লইয়া বাস করে। এই অদ্ভুত বাসায় ঢুকিবার দরজাটি থাকে জলের নিচে, একটা লম্বা প্যাঁচালো সুড়ঙ্গের মুখে। জলে ডুব মারিয়া ঐ সুড়ঙ্গের মুখটি বাহির করিতে না পারিলে বাসায় ঢুকিবার আর কোনো উপায় নাই। বাসার উপরে যে ঢিপির মতো ছাদ থাকে তাহাও দুই-তিন হাত বা তাহার চাইতে বেশি পুরু এবং খুবই মজবুত। একেকটা ঢিপি প্রায় পাঁচ, সাত বা দশ হাত উঁচু হয়।

শীত পড়িবার কিছু আগেই তাহারা বাসায় ঢুকিবার একটা নূতন সুড়ঙ্গপথ কাটিতে আরম্ভ করে। এই পথটা একেবারে সোজা আর খুব মোটা হয়—কারণ এইখান দিয়াই তাহারা গাছের ডালপালা আনিয়া শীতকালের জন্য সঞ্চয় করিতে থাকে। এই সুড়ঙ্গেরও মুখটি থাকে জলের নিচে। প্রত্যেক পরিবারের লোকেরা আপন আপন বাসায় ঢুকিবার পথ জানে এবং প্রত্যেক পরিবার নিজের নিজের খাবার সংগ্রহ করে। কেবল বড় বড় বাঁধ বাঁধিবার সময়ে দুটি-চারটি বা আট-দশটি পরিবার একত্র হইয়া কাজ করে। মেজের উপর পাতিবার জন্য প্রত্যেক বাসায় কিছু কিছু নরম ঘাসও রাখা হয়। কোনো কোনো জায়গায় আবার বাসার মধ্যে দেয়াল তুলিয়া ছোটদের ঘর, বড়দের ঘর ইত্যাদি নানা রকম আলগা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়। আবার কোথাও কোথাও দোতলা-তিনতলা করিয়াও ঘরের বন্দোবস্ত করা হয়। খাবার সংগ্রহ হইয়া গেলে অনেক সময়ে বড় সুড়ঙ্গটার মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। শীতকালে যখন জলের উপরে বরফ জমিয়া যায়, সেই সময়ে বাহির হইবার জন্যও একটা আলগা সুড়ঙ্গের দরকার হয়। এই সুড়ঙ্গটা থাকে বাসার বাহিরে—ইহার এক মুখ জলের নিচে, আরেক মুখ উঁচু ডাঙার উপরে। জলের নিচে বাসার দরজা দিয়া বাহির হইয়া তারপর এই সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকিয়া তবে বীভারেরা বাহিরে আসে।

বীভারের শরীরের গঠন দেখিলেই বোঝা যায় যে জলে থাকা অভ্যাস তাহার আছে। হাঁসের পায়ের মতো চ্যাটালো পা, নৌকার বৈঠার মতো চওড়া চ্যাপ্টা ল্যাজ, গায়ের নরম লোমের উপরে আবার লম্বা তেলতেলা লোমের ঢাকনি — এ সমস্তই জলজন্তুর উপযোগী ব্যবস্থা। বাসার কাছে জল না হইলে তাহাদের চলে না, সুতরাং সেখানে যাহাতে বারো মাস যথেষ্ট জল থাকে তাহার জন্য সে নদীতে বাঁধ বাঁধিয়া জল আটকাইয়া বড় বড় বিল জমাইয়া ফেলে। আর সেই বিলের ধারে বাসা বাঁধিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকে। কোথাও বসতি করিবার আগে বীভারেরা দল বাঁধিয়া জায়গা দেখিতে বাহির হয়।

যেখানে নদী আছে অথচ স্রোত বেশি নাই, অথবা জল খুব গভীর নয়, সেই রকম জায়গা তাহাদের খুব পছন্দ। জলের ধারে গাছ থাকা চাই আর জায়গাটা বেশ নির্জন চাই, তবেই তাহা ষোলো আনা মনের মতো হয়। দলের মধ্যে যাহারা বয়সে প্রবীণ তাহারা প্রথমত চারিদিক দেখিয়া শুনিয়া জায়গা ঠিক করে; তারপর সকলে মিলিয়া নদীর ধারের আঠালো মাটি আর ছোট-বড় লাকড়ি ফেলিয়া জলের মধ্যে বাঁধ বাঁধিতে থাকে। এক পরত মাটি দিয়া তাহার উপর এক সার লাকড়ি চাপায়; তাহার উপরে আবার মাটি ফেলিয়া, তাহার উপর ডালপালা শিকড় জড়াইয়া মজবুত করিয়া গাঁথিয়া তোলে। বাঁধ যতই উঁচু হইতে থাকে, নদীর স্রোত বাধা পাইয়া ততই দুই দিকে ছড়াইয়া পড়ে — আর বীভারেরাও সেই বুঝিয়া বাঁধটাকে ক্রমাগতই লম্বা করিতে থাকে। এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে নদীর মধ্যে প্রকাণ্ড বিল জমিয়া যায়। অনেক সময়ে জলের বেগ কমাইবার জন্য কাছে কাছে আরো দুই-একটা ছোটখাটো বাঁধ দেওয়ার দরকার হয়। এ কাজটিও বীভারেরা খুব হিসাবমতো বুদ্ধি খাটাইয়া করে।

এ সমস্ত কাজ করিতে হইলে জলের স্রোত কোন দিকে, কোথায় কতখানি জল ইত্যাদি অনেক বিষয় জানা দরকার। কানাডার এক এঞ্জিনিয়ার সাহেব একটা নদীতে তিন-চারটি বীভারের বাঁধ পরীক্ষা করিয়া দেখেন। তিনি বলেন যে, তাঁহার উপর ও কাজের ভার থাকিলে তিনি যেখানে যেখানে যে রকমভাবে বাঁধ রাখা উচিত বোধ করিতেন বীভারেরাও ঠিক সেইসব জায়গায় তেমনিভাবে বাঁধ বসাইয়াছে। এই রকম একেকটি বাঁধ একেক সময়ে এক শ বা দুই শ হাত লম্বা এবং পাঁচ হাত বা দশ হাত উঁচু হইতে দেখা যায়। একবার এক সাহেব তামাসা দেখিবার জন্য রাত্রে একটা বাঁধের খানিকটা কোদাল দিয়া ভাঙিয়া লুকাইয়া থাকেন। ভাঙা বাঁধের ফাঁক দিয়া হুড় হুড় করিয়া জল বাহির হইতে লাগিল— তাহার শব্দে কোথা হইতে একটা বীভার বাহির হইয়া আসিল— তারপর দেখিতে দেখিতে ৮/১০টি বীভার অতি সাবধানে এদিক-ওদিক কান পাতিয়া আস্তে আস্তে বাঁধের কাছে আসিল। তারপর সবাই মিলিয়া খানিকক্ষণ কী যেন পরামর্শ করিয়া ইঠাৎ সকলে ব্যস্ত হইয়া চারিদিকে ছুটিয়া গেল এবং দুই ঘণ্টার মধ্যেই কাঠ ও মাটি দিয়া বাঁধটাকে মেরামত করিয়া তুলিল। তারপর একটা বীভার তাহার লেজ দিয়া জলের উপর চটাৎ করিয়া বাড়ি মারিতেই সকলে যে যার মতো কোথায় সরিয়া পড়িল আর সারা রাত তাহাদের দেখাই গেল না।

হঠাৎ ভয় পাইলে বা সকলকে সতর্ক করিতে হইলে বীভারেরা এইরূপ জলের উপর লেজের বাড়ি মারিয়া শব্দ করে। নিস্তব্ধ রাত্রে এই শব্দ পিস্তলের আওয়াজের মতো শুনায় এবং অনেক সময় একটা আওয়াজের পর সকলের জলে ঝাঁপ দিবার চটাপট্ শব্দ অনেক দূর হইতে পরিষ্কার শুনিতে পাওয়া যায়। বাঁধ বাঁধিবার জন্য গাছের দরকার হয়। এই গাছ কাটিয়া বড় বড় লাকড়ি বানাইয়া তাহা বহিয়া লওয়া খুবই পরিশ্রমের কাজ। সেই জন্য বীভারেরা এমন জাগায় বাসা খোঁজে, যাহার কাছে যথেষ্ট গাছ আছে। সেই গাছগুলিকে তাহারা দাঁত দিয়া এমনভাবে কাটে যে গাছগুলি পড়িবার সময় ঠিক নদীমুখো হইয়া পড়ে। তখন তাহাকে কাটিয়া-কুটিয়া অল্প পরিশ্রমেই জলে ভাসাইয়া লওয়া যায়, কিন্তু গাছগুলি যদি জল হইতে দূরে থাকে অথবা কাছের গাছগুলি যদি সব ফুরাইয়া যায়, তাহা হইলে উপায় কী? তাহা হইলে বীভারেরা দস্তুরমতো খাল কাটিয়া সেই গাছ আনিবার সুবিধা করিয়া লয়। তাহারা নদীর কিনারা হইতে গাছের গোড়া পর্যন্ত দুই হাত চওড়া ও দুই হাত গভীর একটি খাল কাটিয়া যায়। তারপর সেই খালে যখন নদীর জল আসিয়া পড়ে, তখন গাছের টুকরাগুলি তাহাতে ভাসাইয়া ঠেলিয়া লইতে আর কোনোই মুশকিল হয় না।

এমন যে বুদ্ধিমান নিরীহ জন্তু, মানুষে তাহার উপরেও অত্যাচার করিতে ছাড়ে নাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, বীভারের গায়ের চামড়াটি বড়ই সুন্দর ও মোলায়েম— শৌখিন লোকের লোভ হইবার মতো জিনিস। সুতরাং এই জন্তুকে মারিয়া তাহার চামড়া বিক্রয় করিলে বেশ দু পয়সা লাভ করা যায়। এই চামড়ার লোভে বিস্তর শিকারি আজ প্রায় দেড় শ বৎসর ধরিয়া নানা দেশে ইহাদের মারিয়া উজাড় করিয়া ফিরিতেছে। মানুষের শখের জন্য কত লক্ষ লক্ষ বীভার যে প্রাণ দিয়াছে তাহার আর সংখ্যা হয় না। এখনো যে ইহারা পৃথিবী হইতে লোপ পায় নাই, ইহাই আশ্চর্য।

লেখক : কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক

 

#
জনপ্রিয়

জানোয়ার এঞ্জিনিয়ার 

আপডেটের সময় : ০৬:৪২:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

 সুকুমার রায় :

পাখির মধ্যে কাক, আর পশুর মধ্যে শিয়াল—বুদ্ধির জন্য মানুষ ইহাদের প্রশংসা করে। কিন্তু এখন যে জন্তুটির কথা বলিব, তাহার বুদ্ধি শিয়ালের চাইতে বেশি কি না, সেটা তোমরা বিচার করিয়া দেখো। এই জন্তুর বাড়ি উত্তরের শীতের দেশে—বিশেষত উত্তর আমেরিকায়। ল্যাজসুদ্ধ দুহাত লম্বা জন্তুটি, দেখিতে কতকটা ইঁদুর বা গিনিপিগের মতো; তাহার চেহারায় বিশেষ কোনো বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় না।

কিন্তু তাহার কাজ যদি দেখো, তবে বুঝিবে সে কত বড় কারিকর। জানোয়ারের মধ্যে এত বড় ‘এঞ্জিনিয়ার’ আর দ্বিতীয় নাই। ইহার নাম বীভার।

মৌমাছির চাক, মাকড়সার জাল, পিঁপড়ার বাসা প্রভৃতি অনেক ব্যাপারের মধ্যে আমরা খুব কৌশলের পরিচয় পাই—কিন্তু বীভারের বুদ্ধি-কৌশল আরো অদ্ভুত।

ইহারা বড় বড় বাঁধ বাঁধিয়া নদীর স্রোত আটকাইয়া রাখে, জঙ্গলের বড় বড় গাছ কাটিয়া ফেলে এবং সেই গাছের ‘লাড়ি’ বানাইয়া নানা রকম কাজে লাগায়। খাল কাটিয়া এক জায়গার জল আরেক জায়গায় নিতেও ইহারা কম ওস্তাদ নয়। এই সমস্ত কাজে ইহাদের প্রধান অস্ত্র বাটালির মতো ধারালো চারটি দাঁত। বড় বড় গাছ, যাহা কোপাইয়া কাটিতে মানুষের রীতিমতো পরিশ্রম লাগে, বীভার তাহার ঐ দাঁত দুটি দিয়া সেই গাছকে কুরিয়া মাটিতে ফেলে।

যেখানে বীভারেরা পল্লী বাঁধিয়া দলেবলে বসতি করে, তাহার আশপাশেই দেখা যায় যে অনেকগুলি গাছের গোড়ার দিকে, জমি হইতে হাতখানেক উপরে, খানিকটা কাঠ যেন খাবলাইয়া ফেলা হইয়াছে। একেকটা গাছ প্রায় পড়ো পড়ো অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছে; আরেকটু কাটিলেই পড়িয়া যাইবে। এ সমস্তই বীভারের কাণ্ড। গাছটি যখন কাটা হইল তখন তাহাকে ছোট-বড় নানা রকম টুকরায় কাটিবার জন্য বীভারের দল ভারি ব্যস্ত হইয়া ওঠে। শীতকালে যখন বরফ জমিয়া যায়, যখন চলাফেরা করিয়া খাবার সংগ্রহ করা কঠিন হইয়া পড়ে, তখন বীভারের প্রধান খাদ্য হয় গাছের ছাল।

সেই জন্য শীত আসিবার পূর্বেই তাহাদের গাছ কাটিবার ধুম পড়িয়া যায়, এবং তাহারা গাছের নরম বাকল কাটিয়া বাসার মধ্যে জমাইতে থাকে।

বীভারের প্রধান আশ্চর্য কীর্তি নদীর বাঁধ; কিন্তু তাহার কথা বলিবার আগে ইহাদের বাসা সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। জলের ধারে কাঠকুটা ও মাটির ঢিপি বানাইয়া তাহার মধ্যে বীভারেরা স্ত্রী-পুত্র পরিবার লইয়া বাস করে। এই অদ্ভুত বাসায় ঢুকিবার দরজাটি থাকে জলের নিচে, একটা লম্বা প্যাঁচালো সুড়ঙ্গের মুখে। জলে ডুব মারিয়া ঐ সুড়ঙ্গের মুখটি বাহির করিতে না পারিলে বাসায় ঢুকিবার আর কোনো উপায় নাই। বাসার উপরে যে ঢিপির মতো ছাদ থাকে তাহাও দুই-তিন হাত বা তাহার চাইতে বেশি পুরু এবং খুবই মজবুত। একেকটা ঢিপি প্রায় পাঁচ, সাত বা দশ হাত উঁচু হয়।

শীত পড়িবার কিছু আগেই তাহারা বাসায় ঢুকিবার একটা নূতন সুড়ঙ্গপথ কাটিতে আরম্ভ করে। এই পথটা একেবারে সোজা আর খুব মোটা হয়—কারণ এইখান দিয়াই তাহারা গাছের ডালপালা আনিয়া শীতকালের জন্য সঞ্চয় করিতে থাকে। এই সুড়ঙ্গেরও মুখটি থাকে জলের নিচে। প্রত্যেক পরিবারের লোকেরা আপন আপন বাসায় ঢুকিবার পথ জানে এবং প্রত্যেক পরিবার নিজের নিজের খাবার সংগ্রহ করে। কেবল বড় বড় বাঁধ বাঁধিবার সময়ে দুটি-চারটি বা আট-দশটি পরিবার একত্র হইয়া কাজ করে। মেজের উপর পাতিবার জন্য প্রত্যেক বাসায় কিছু কিছু নরম ঘাসও রাখা হয়। কোনো কোনো জায়গায় আবার বাসার মধ্যে দেয়াল তুলিয়া ছোটদের ঘর, বড়দের ঘর ইত্যাদি নানা রকম আলগা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়। আবার কোথাও কোথাও দোতলা-তিনতলা করিয়াও ঘরের বন্দোবস্ত করা হয়। খাবার সংগ্রহ হইয়া গেলে অনেক সময়ে বড় সুড়ঙ্গটার মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। শীতকালে যখন জলের উপরে বরফ জমিয়া যায়, সেই সময়ে বাহির হইবার জন্যও একটা আলগা সুড়ঙ্গের দরকার হয়। এই সুড়ঙ্গটা থাকে বাসার বাহিরে—ইহার এক মুখ জলের নিচে, আরেক মুখ উঁচু ডাঙার উপরে। জলের নিচে বাসার দরজা দিয়া বাহির হইয়া তারপর এই সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকিয়া তবে বীভারেরা বাহিরে আসে।

বীভারের শরীরের গঠন দেখিলেই বোঝা যায় যে জলে থাকা অভ্যাস তাহার আছে। হাঁসের পায়ের মতো চ্যাটালো পা, নৌকার বৈঠার মতো চওড়া চ্যাপ্টা ল্যাজ, গায়ের নরম লোমের উপরে আবার লম্বা তেলতেলা লোমের ঢাকনি — এ সমস্তই জলজন্তুর উপযোগী ব্যবস্থা। বাসার কাছে জল না হইলে তাহাদের চলে না, সুতরাং সেখানে যাহাতে বারো মাস যথেষ্ট জল থাকে তাহার জন্য সে নদীতে বাঁধ বাঁধিয়া জল আটকাইয়া বড় বড় বিল জমাইয়া ফেলে। আর সেই বিলের ধারে বাসা বাঁধিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকে। কোথাও বসতি করিবার আগে বীভারেরা দল বাঁধিয়া জায়গা দেখিতে বাহির হয়।

যেখানে নদী আছে অথচ স্রোত বেশি নাই, অথবা জল খুব গভীর নয়, সেই রকম জায়গা তাহাদের খুব পছন্দ। জলের ধারে গাছ থাকা চাই আর জায়গাটা বেশ নির্জন চাই, তবেই তাহা ষোলো আনা মনের মতো হয়। দলের মধ্যে যাহারা বয়সে প্রবীণ তাহারা প্রথমত চারিদিক দেখিয়া শুনিয়া জায়গা ঠিক করে; তারপর সকলে মিলিয়া নদীর ধারের আঠালো মাটি আর ছোট-বড় লাকড়ি ফেলিয়া জলের মধ্যে বাঁধ বাঁধিতে থাকে। এক পরত মাটি দিয়া তাহার উপর এক সার লাকড়ি চাপায়; তাহার উপরে আবার মাটি ফেলিয়া, তাহার উপর ডালপালা শিকড় জড়াইয়া মজবুত করিয়া গাঁথিয়া তোলে। বাঁধ যতই উঁচু হইতে থাকে, নদীর স্রোত বাধা পাইয়া ততই দুই দিকে ছড়াইয়া পড়ে — আর বীভারেরাও সেই বুঝিয়া বাঁধটাকে ক্রমাগতই লম্বা করিতে থাকে। এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে নদীর মধ্যে প্রকাণ্ড বিল জমিয়া যায়। অনেক সময়ে জলের বেগ কমাইবার জন্য কাছে কাছে আরো দুই-একটা ছোটখাটো বাঁধ দেওয়ার দরকার হয়। এ কাজটিও বীভারেরা খুব হিসাবমতো বুদ্ধি খাটাইয়া করে।

এ সমস্ত কাজ করিতে হইলে জলের স্রোত কোন দিকে, কোথায় কতখানি জল ইত্যাদি অনেক বিষয় জানা দরকার। কানাডার এক এঞ্জিনিয়ার সাহেব একটা নদীতে তিন-চারটি বীভারের বাঁধ পরীক্ষা করিয়া দেখেন। তিনি বলেন যে, তাঁহার উপর ও কাজের ভার থাকিলে তিনি যেখানে যেখানে যে রকমভাবে বাঁধ রাখা উচিত বোধ করিতেন বীভারেরাও ঠিক সেইসব জায়গায় তেমনিভাবে বাঁধ বসাইয়াছে। এই রকম একেকটি বাঁধ একেক সময়ে এক শ বা দুই শ হাত লম্বা এবং পাঁচ হাত বা দশ হাত উঁচু হইতে দেখা যায়। একবার এক সাহেব তামাসা দেখিবার জন্য রাত্রে একটা বাঁধের খানিকটা কোদাল দিয়া ভাঙিয়া লুকাইয়া থাকেন। ভাঙা বাঁধের ফাঁক দিয়া হুড় হুড় করিয়া জল বাহির হইতে লাগিল— তাহার শব্দে কোথা হইতে একটা বীভার বাহির হইয়া আসিল— তারপর দেখিতে দেখিতে ৮/১০টি বীভার অতি সাবধানে এদিক-ওদিক কান পাতিয়া আস্তে আস্তে বাঁধের কাছে আসিল। তারপর সবাই মিলিয়া খানিকক্ষণ কী যেন পরামর্শ করিয়া ইঠাৎ সকলে ব্যস্ত হইয়া চারিদিকে ছুটিয়া গেল এবং দুই ঘণ্টার মধ্যেই কাঠ ও মাটি দিয়া বাঁধটাকে মেরামত করিয়া তুলিল। তারপর একটা বীভার তাহার লেজ দিয়া জলের উপর চটাৎ করিয়া বাড়ি মারিতেই সকলে যে যার মতো কোথায় সরিয়া পড়িল আর সারা রাত তাহাদের দেখাই গেল না।

হঠাৎ ভয় পাইলে বা সকলকে সতর্ক করিতে হইলে বীভারেরা এইরূপ জলের উপর লেজের বাড়ি মারিয়া শব্দ করে। নিস্তব্ধ রাত্রে এই শব্দ পিস্তলের আওয়াজের মতো শুনায় এবং অনেক সময় একটা আওয়াজের পর সকলের জলে ঝাঁপ দিবার চটাপট্ শব্দ অনেক দূর হইতে পরিষ্কার শুনিতে পাওয়া যায়। বাঁধ বাঁধিবার জন্য গাছের দরকার হয়। এই গাছ কাটিয়া বড় বড় লাকড়ি বানাইয়া তাহা বহিয়া লওয়া খুবই পরিশ্রমের কাজ। সেই জন্য বীভারেরা এমন জাগায় বাসা খোঁজে, যাহার কাছে যথেষ্ট গাছ আছে। সেই গাছগুলিকে তাহারা দাঁত দিয়া এমনভাবে কাটে যে গাছগুলি পড়িবার সময় ঠিক নদীমুখো হইয়া পড়ে। তখন তাহাকে কাটিয়া-কুটিয়া অল্প পরিশ্রমেই জলে ভাসাইয়া লওয়া যায়, কিন্তু গাছগুলি যদি জল হইতে দূরে থাকে অথবা কাছের গাছগুলি যদি সব ফুরাইয়া যায়, তাহা হইলে উপায় কী? তাহা হইলে বীভারেরা দস্তুরমতো খাল কাটিয়া সেই গাছ আনিবার সুবিধা করিয়া লয়। তাহারা নদীর কিনারা হইতে গাছের গোড়া পর্যন্ত দুই হাত চওড়া ও দুই হাত গভীর একটি খাল কাটিয়া যায়। তারপর সেই খালে যখন নদীর জল আসিয়া পড়ে, তখন গাছের টুকরাগুলি তাহাতে ভাসাইয়া ঠেলিয়া লইতে আর কোনোই মুশকিল হয় না।

এমন যে বুদ্ধিমান নিরীহ জন্তু, মানুষে তাহার উপরেও অত্যাচার করিতে ছাড়ে নাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, বীভারের গায়ের চামড়াটি বড়ই সুন্দর ও মোলায়েম— শৌখিন লোকের লোভ হইবার মতো জিনিস। সুতরাং এই জন্তুকে মারিয়া তাহার চামড়া বিক্রয় করিলে বেশ দু পয়সা লাভ করা যায়। এই চামড়ার লোভে বিস্তর শিকারি আজ প্রায় দেড় শ বৎসর ধরিয়া নানা দেশে ইহাদের মারিয়া উজাড় করিয়া ফিরিতেছে। মানুষের শখের জন্য কত লক্ষ লক্ষ বীভার যে প্রাণ দিয়াছে তাহার আর সংখ্যা হয় না। এখনো যে ইহারা পৃথিবী হইতে লোপ পায় নাই, ইহাই আশ্চর্য।

লেখক : কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক