অসাধারণ এবং বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিস্ময়করভাবেই কাঁপিয়ে রেখেছিলেন ইংরেজ আধিপত্যকালে গোটা ভারতবর্ষকে, দুই বাংলাতে তো বটেই। বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদের ঝড় নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন শোষিত এবং নির্যাতিত মানুষদের সঙ্গে নিয়ে। তৎকালীন অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি ছিলেন নজরুল ইসলাম। ’ধূমকেতু’তে বজ্রের ভাষায় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ভারত মুক্তির–দু’শো বছরের পরাধীনতা এবং গোলামি থেকে ব্রিটিশদের হটাবার মন্ত্রে। কাব্যে, সাহিত্যে–সংগীতে এবং সাংবাদিকতায় এক অবিস্মরণীয় দ্রোহের প্রতীক হয়ে দুই বাংলায় তিনি ছিলেন রাজাধিরাজ। রবীন্দ্রসাম্রাজ্যে জন্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেই তাঁর দুর্বার অগ্রযাত্রা থেমে থাকে নি তাঁর নিশ্চুপ-নিশ্চল এবং বাকহীন অসুস্থতা পূর্ব-পর্যন্ত। হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই সম্মান করেছেন মানুষ হিসেবে। ইসলাম কোনো সম্প্রদায়ের নাম নয়। মুসলমানও তাই কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক নয়। ইসলাম অর্থ শান্তি। হিন্দুদের ধর্মেও শান্তির কথা বলা হয়েছে। হোম শান্তি, তাদের ধর্মের মুখ্য কথা। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। মুসলমান কোনো দেবতায় বিশ্বাসী নয়। এখানেই পার্থক্য হিন্দু এবং মুসলমানদের। আল কোরআনে আল্লাহ সর্ব ক্ষেত্রেই মানুষ এবং মানবকেই বুঝেছেন। নজরুল সাহিত্য ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্ম নিয়ে কবিতা ও গান লিখেছেন। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন ইসলামের অনুসারী একজন যথার্থ মুসলমান। একারণেই মসজিদের পাশেই কবিকে কবর দেবার দেবার জন্য তিনি বিনীত অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁর কবিতায়।
আমরা ভুলিনি যে নজরুল ইসলামের প্রতিভাকে সম্মান জানিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি তাঁর সমকালে ইন্টামিডিয়েট বাংলা টেকস্ট বই-এ অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কৃতজ্ঞ এ কারণে যে তিনি নজরুল ইসলামকে অসুস্থ অবস্থায় বাংলাদেশে এনে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মামনা দিয়েছিলেন এবং আমৃত্যু তাঁকে বাংলাদেশে রেখে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় শোক পালন এবং কবির ইচ্ছানুযায়ী মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি ব্রিটিশের হাত থেকে বাংলার মুক্তির জন্য বাংলার জয় শব্দটি গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মনে হয় কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিকেই বেছে নিয়েছিলেন।
সাহিত্য সংস্কৃতি তথা জীবনের সর্বস্তরে বাংলার মুসলমানদের দৈন্য বিশ্লেষণ করে এবং তাদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁ নজরুলকে এক পত্রে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। নজরুল যথাসময়ে পত্রখানার উত্তর দেননি। দীর্ঘকাল পরে-১৩৩৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসে, নজরুল ওইপত্রখানা সওগাতের সাহিত্য মজলিসে সবাইকে পড়ে শোনান। সমবেত সাহিত্যিক বন্ধুরা প্রিন্সিপাল সাহেবের এই পত্রকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন। তাঁরা নজরুলকে অনুরোধ করলেন এর একটা উত্তর দেবার জন্য। সবারই ইচ্ছা, প্রিন্সিপাল সাহেবের পত্র এবং নজরুলের উত্তর দুটোই একসঙ্গে সওগাতে প্রকাশ করা হোক। এর সপ্তাহখানেক পরই নজরুল উক্ত চিঠির সুদীর্ঘ জবাব দেন। ১৩৩৪ সালের পৌষ সংখ্যা সওগাতে উভয় পত্র প্রকাশিত হয়। সে যুগে লিখিত এই চিঠি দুখানার ঐতিহাসিক মূল্য আছে সন্দেহ নেই। নিম্নে উভয় চিঠি উদ্ধৃত করা হলো।
প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর পত্র
ভাই নজরুল ইসলাম,
তোমায় কখনো দেখিনি। অনেকবার দেখা করার সুযোগ খুঁজেছি, সে সুযোগ ঘটে উঠে নাই, দূর হ’তে শুধু তোমার লেখা পড়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, অন্তরের অন্তস্থল হ’তে ঐ প্রতিভার কাছে বার বার মস্তক নত করেছি আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, ‘প্রভো, এ কাঙ্গাল বাঙ্গালী মুসলিম সমাজকে যদি একটি রত্ন দিয়েছ, ওকে রক্ষা ক’রো- সমাজকে দিয়ে ওর কদর করে নিও। তোমায় এত আপন ভাবি, এত কদর করি বলেই আজ অকুণ্ঠিত চিত্তে তোমায় তুমি বলে সম্বোধন করছি। তোমার গুনমুগ্ধ. তোমার প্রীতি-আকাঙ্খী, তোমার ভক্ত ভাই-এর এ আবদার তুমি রক্ষা করবে, তাও জানি।
আজ তোমায় কয়টি কথা বলব,Ñগুরুরূপে নয়, ভাইরূপে, ভক্তরূপে। এ কথাগুলি বলব বলে অনেকবার তোমার সাক্ষাৎ খুঁজেছি, পাই নাই, কিন্তু কথাগুলিও বুকের তলে অনুদিন তোলপাড় করছে; তাই পত্র মারফৎই বলতে চেষ্টা করছি।
আমি আগেই বলেছি, বাঙ্গলার মুসলিম সমাজ কাঙ্গালÑÑশুধু ধনে নয়, মনেও। তাই বাঙ্গলার অ-মুসলিমরা তোমার যে কদর করেছেন, মুসলিমরা তা করেন নাই, করতে শেখেন নাই। এ কথা ভেবে অনেক সময় লজ্জায় মাথা নত করেছি, সমাজকে নিন্দা করেছি, বন্ধু মহলে রোষ-প্রকাশ করেছি। কিন্তু সে শুধু নিন্দায় ফায়দা কি, শুধু-আস্ফালনে ফল কি? সমাজ যে পতিত, দয়ার পাত্র; তাই সেই ভেবে তাকে কখনও স্নেহের হাত বুলিয়ে, কখনও জোরে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে হবে, পথে আনতে হবে। আর সমাজের কাছে ত আমার সে আবদারের অধিকার নাই, যে-আবদার তোমার কাছে আমি করতে পারি। তাই এবার সমাজকে ছেড়ে তোমার দিকে ফিরছি। সমাজ মরতে বসেছে; তাকে বাঁচাতে হলে চাই সজ্জীবনী-সুধা, কে সেই সুধার পাত্র হাতে এনে এই মরনোম্মুখ সমাজের সামনে দাঁড়াবে, কোন সুসন্তান আপন তপোবলে গগঙ্গা আনয়ন করে, এ অগণ্য সাগর-গোষ্ঠীকে পুনর্জ্জীবন দান করবে, কাঙ্গাল সমাজ উৎকন্ঠিত চিত্তে করুণ নয়নে সেই প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে। কে জানি না; কিন্তু মনে হয়, তোমায় বুঝি খোদা সে সুধা-ভারে কিঞ্চিৎ দান করেছেন, তোমার অন্তরের অন্তরালে বুঝি সে-সাধনার বীজ জমা আছে। হাত বাড়াবে কি? একবার সাহসে বুক বেঁধে সে তপশ্চারণে মনোনিবেশ করবে কি?
সুদূর অতীত ইতিহাসের প্রান্তসীমার ওপার হ’তে যে অস্পষ্ট, অর্দ্ধশ্রুত মায়াধ্বনি ভেসে আসে, সে কবির কন্ঠস্বর!ÑÑকবি যে যুগে যুগে সত্যের গীতি, কল্যাণের গীতি, বিরাট অনন্ত মহা-জীবনের নিগূঢ় ভিত্তি কর্ম্মের উদ্বোধন-গীতি গেয়ে এসেছে। স্নেহ-বাৎসল্য-ভরপুর মাতৃক্রোড়ে, আধনিমীলিত-আঁখি শিশুর শয্যাপার্শ্বে, নবীন-নবীনার মিলন-তীর্থ বিবাহ-বাসরে, ধর্ম্মযাজকের উন্নত বেদীতে, কর্ম্মবীরের উলঙ্গ অসি-বর্শার রঙ্গ-ভূমি যুদ্ধক্ষেত্রে সমর-শেষে বিজয়ের উল্লাস-নিনাদে, শহীদের শোকে, নিহতদের কল্যাণ-কামনায়, মহাযাত্রীর সমাধিধারে কবির লীলায়িত বাণী-ধ্বনি যুগে যুগে ঝঙ্কৃত হয়েছে; মহামানবের মনোজ্ঞ ক’রে যখনই যিনি যে-বাণী প্রচার করতে চেয়েছেন, তিনি যত বড় মহাসত্যই প্রচার করুন না কেন, তিনি কবির লালিত্বে মধুর ক’রে তা বলতে চেয়েছেনÑÑবলেছেন। কারণ বিশিষ্ট শক্তিস্ফুরিত স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞ রস-শূন্য নির্যাস বাণীর মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন, কিন্তু বিশ্বমানবের চিত্ত স্পর্শ করতে হলে সেই ভাব-উদ্বেল চঞ্চল তরঙ্গায়িত বচন-প্রবাহেই করতে হবে, যাকে ধরবার জন্য খোদাতা’লার স্থাপিত রাজধানীর দুই পার্শ্বের বেতার স্টেশন দুইটি অনুদিন এত উদগ্রীব এবং যার মৃদু আঘাতে প্রাণের বীণার নীরব তারে সহসা আকুল রাগিনীঝঙ্কার জেগে উঠে মানবদেহের স্নায়ুর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে উন্মাদনার তড়িৎ প্রবাহ ছুটিয়ে দেয়। তুমি সেই কবিদের একজন, তোমার কন্ঠে সেই সঞ্জীবনী সুধার উন্মাদনা আছে।
কিন্তু ভাই, তোমায় জিজ্ঞাসা করছি, কোন ব্রতে তোমার সে কন্ঠস্বর তুমি নিয়োজিত করেছ? তোমার প্রতিভা অদ্ভুত, কিন্তু তারো চেয়ে গুরুতর তোমার দায়িত্ব! কড়ির মালিক যে, তার নিকাশ না দিলেও বড় আসে যায় না; কিন্তু মাণিকের মালিকের নিকাশ দিতেই হবে; তোমার প্রতিভাকে ত তোমার সার্থক করতেই হবে!
কোন পথে সে সার্থকতার অন্বেষণ করবে? বিদ্রোহে? উত্তম;ÑÑকিন্তু বিদ্রোহকেও সুনিশ্চিত উদ্দেশ্যযুক্ত করতে হবেÑÑশুধু তোমার যখন চাহে এ মন যা ‘উন্মাদ’ ‘ঝঞ্ঝা’র মত চললে তোমার জীবনের সার্থকতার নৈকট্য কোথায়? তৈমুরের বিরাট দুর্বার অভিযানের দিকে আমরা বিস্ময়ে চেয়ে থাকি, তারপর ক্লান্ত চোখ ফিরিয়ে নিই, তারপর তার কথা ভুলে যাই; কিন্তু বাবরের ক্ষুদ্রতর অভিযানের কথা ভুলতে পারি নাইÑÑতাঁর অভিযান আমাদিগকে দিয়েছেÑÑদিল্লী, আগ্রা, ময়ুরাসন, সর্ব্বোপরি দিয়েছে তাজমহল। তোমার কাছে আমরা চাই বাবরের অভিযান, যে-অভিযানের দক্ষিণে-বামে,, অগ্রে-পশ্চাতে নব নব সৃষ্টির সৌধ গড়ে ওঠে।
বাঙলার মুসলিমরা তোমার সম্যক কদর করে নাই, কিন্তু তাই বলে কি তাদের তুমি ছেড়ে যাবে? তোমার ক্ষেত্র মুসলিম সাহিত্যে, বাঙালী মুসলিম চেয়ে আছে তোমার কন্ঠ দিয়ে ইসলামের প্রাণবাণী পুনঃ প্রতিধ্বনিত হবে; ইসরাফীলের শিঙ্গার মত সেই প্রতিধ্বনি এই নিদ্রিত সমাজকে মহা-আহ্বানে জাগ্রত করবে। বাঙ্গলার আর দশ জন কবির মত যদি তুমি কবিতা লেখ, তবে তোমার প্রতিভা আছে, স্থায়ী আসন তুমি পাবে; কিন্তু সে-আসন মাত্র, সিংহাসন নয়, আর বাঙ্গলার মুসলমান সাহিত্যরাজ্যে সিংহাসন খালি পড়ে রয়েছে, তুমি শুধু দখল করলেই হয়। মধুসুদন যদি শুধু ইংরাজী কাব্যই লিখতেন, তবে হয় ত একজন বাইরন হতে পারতেন, কিন্তু মধুচক্র-রচয়িতা হ’তে পারতেন না। কিন্তু আমি শুধু যশের, শুধু প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে এ প্রশ্নের বিচার করছি না। আমার বক্তব্য এই, যেখানে দশটা অভাব আছে, সেখানে যদি সব অভাবগুলি একসঙ্গে দূর না করা যায়, তবে যেটি সবচেয়ে বড় অভাব, সেইটি আগে দূর করার চেষ্টা করতে হয়।
এখন বিচার করতে হয়, তুমি বাঙালী, তুমি কবি, তুমি মুসলিম, বাঙলার কোন কল্যাণ সাধনে তোমার আগে অগ্রসর হওয়া দরকার।
বাঙালীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দরিদ্র, সব চেয়ে বেশী অজ্ঞ, সব চেয়ে বেশী আত্মভোলা তোমারই ভাই এই মুসলিমগণ। আর বাংলা সাহিত্যে সব চেয়ে অবহেলিত, সব চেয়ে কলঙ্কিত, সব চেয়ে নিন্দিত, কুলিখিত বিষয় ইসলাম। ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য, সভ্যতা, ইতিহাস বাঙলার সাহিত্যে হয় নাই, না হয় বিকৃতরূপে আছে। যিনি বাঙলার সাহিত্যে ইসলামের সত্যসনাতন নিষ্কলঙ্ক চিত্র দান করবেন, যিনি ‘এই সব মূক ম্লান মুখে’ ভাষা দিবেন, এই সব ভগ্ন শুষ্ক শ্রান্ত বুকে’ আশা ধ্বনিয়ে তুলবেন, যিনি ইসলামের সত্যস্বরূপ দেশের সম্মুখে ধরে মুসলিমের বুকে বল দেবেন, অ-মুসলিমের বুক হতে ইসলাম-অশ্রদ্ধা দুর করতঃ হিন্দু মুসলমান মিলনের সত্য ভিত্তির পত্তন করবেন, তিনিই হবেন বর্তমানের শ্রেষ্ঠতম দেশ-হিতৈষী, তিনিই হবেন বাঙ্গালী মুসলিমের মুক্তির অগ্রদূত। তুমি চেষ্টা করলে তাই হতে পার; তুমি সেই মহা গৌরবের আসন দখল করতে পার, তুমি এইরূপে তোমার কবি প্রতিভাকে, তোমার জীবনকে, তোমার মানবতাকে সহজতম রূপে সার্থক করতে পার।
আরো এক কথা। এই বাঙ্গালী মুসলিমের মুক্তির অগ্রদূত রূপে যে তুমি আসবে, সে কোন পথে? বিদ্রোহের পথে? আমার মনে হয়, তা নয়। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, খরহব ড়ভ ষবধংঃ ৎবংরংঃধহপব বা লঘুতম বাধার পথে অগ্রসর হওয়া সমীচীন। ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কিছু নাই; ইসলাম আধুনিকতম উন্নততম ধর্ম্ম; তবে যে বাঙলার মুসলিমরা অনেক কুসংস্কার পড়েছে, সে ইসলামের দোষ নয়; এই হতভাগ্যরা ইসলামের সাথে ঐ কুসংস্কারগুলি পোষণ করছে। এখন এই কুংস্কারগুলি দূর করতেই হবে; কিন্তু সেগুলি যে ইসলামের অনুশাসন নয়, বরং ইসলামের বিরুদ্ধ মত, এই বলে সে-গুলির নিন্দা করতে হবেÑÑইসলামকে, ইসলামের কোন অনুষ্ঠানকে নিন্দা করে নয়। কারণ যারা কুসংস্কারে ডুবে ইসলামের পবিত্র নামে হয়ত অজ্ঞাতে কলঙ্ক-কালিমা লেপন করছে, তারাই ইসলামের নিন্দা সইতে পারে না; সুতরাং ইসলামের নিন্দার নামে খুব ভাল কথা বলে¬ও তারা শুনবে না; যাদের শুনাবার জন্য বলা তারাই যদি না শুনে, তবে সে বলায় লাভ কি? কিন্তু মুসলিমদের একটা গুণ আছে, যা আর কোন জাতির নেই; সে ধর্ম্মের নামে পাগল হয়; তাই সে হাফিজ-রুমীকে সত্য-সাধক বলে বরণ করে নিয়েছে; তাই সে শেখ সাদীকে দৈনন্দিন জীবনের বহু কাজে আদর্শ করেছে। তোমার বিদ্রোহী পড়ে যারা বিদ্রোহী হয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন তোমার ‘সুবেহ্ উন্মিদ’ পড়ে আনন্দে, গর্ব্বে লাফিয়ে উঠেছিলেনÑÑআর নাচতে নাচতে এসে আমায় বলেছিলেন, নজরুল যদি এমনই ধারা লিখত, তবে বাঙলার আলিমরা যে তাকে মাথায় করে রাখত (যিনি বলছিলেন, তিনি একজন আলেম)। এ কথা কয়টি তোমায় ভেবে দেখতে বলি। বাঙলার মৌলানা রুমীর আসন খালি পড়ে রয়েছে, তুমি তাই দখল করে ধন্য হও, বাঙলার মুসলিমকে বাঙলার সাহিত্যকে ধন্য কর।
তাই আজ বড় আশায়, বড় ভরসায়, বড় সাহসে, বড় মিনতির স্বরে তোমায় বলছি, ভাই, কাঙাল মুসলিমের বড় আদরের ধন তুমি, তুমি এই দিকে, পতিত মুসলিম সমাজের দিকে, এই অবহেলিত ইসলামের দিকে একবার চাও, তাদের ব্যথিত চিত্তের করুণরাগিনী তোমার কন্ঠে ভাষা লাভ করে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলুক, তাদের সুপ্ত প্রাণের জড়তা তেমার আকুল আহ্বানের উন্মাদনায় চেতনাময়ী হউক, ইসলামের মহান উদার উচ্চ আদর্শ তোমার কবিতায় মূর্ত্তি লাভ করুক, তোমার কাব্যসাধনা ইসলামের মহাগীতিতে চরম সার্থকতায় ধন্য হোক। আমীন।
অনেক কথা বলে ফেললাম, ভাই, মাফ করো। ভাইয়ের কাছে ভাই যদি এমন প্রাণ খুলে কথা না বলবে, তবে বলবে কোথায়?
নজরুলের উত্তর
শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান সাহেব!
আমাদের আশি বছরে নাকি স্রষ্টা ব্রহ্মার একদিন। আমি অত বড় স্রষ্টা না হ’লেও স্রষ্টা ত বটে, তা আমার সে-সৃষ্টির পরিসর যত ক্ষুদ্র পরিধিই হোক! কাজেই আমারও একটা দিন অন্ততঃ তিনটে বছরের কম যে নয়, তা অন্য কেউ বিশ্বাস করুক চাই না করুক, আপনি নিশ্চয় করবেন।
আপনার ১৯২৫ সালের লেখা চিঠির উত্তর দিচ্ছি ১৯২৭ সালের আয়ু যখন ফুরিয়ে এসেছে তখন!
এমনও হ’তে পারে, ১৯২৭-এর সাথে সাথে হয়ত বা আমরাও আয়ু ফুরিয়ে এসেছে- তাই আমি আমারও অজ্ঞাতে কোনো অনির্দ্দেশের ইঙ্গিতে আমার শেষ বলা বলে যাচ্ছি আপনার চিঠির উত্তর দেওয়ার সুযোগে! কেননা, আমি এই তিন বছরের মধ্যে কারুর চিঠির উত্তর দিয়েছি, এত বড় বদনাম আমার শত্রুতেও দিতে পারবেনাÑÑবন্ধুরা ত নয়ই। অবশ্য, আয়ু আমার ফুরিয়ে এসেছেÑÑএ সুসংবাদটা উপভোগ করার মত সৎসাহস আমার নেই, বিশ্বাসও হয়ত করিনে; কিন্তু আমারই স্বজাতি অর্থাৎ কবি জাতীয় অনেকেই এ-বিশ্বাস করেন এবং আমিও যাতে বিশ্বাস করি- তার জন্যে অর্থ ও সামর্থ্য ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণেই করছেন। কিন্তু, আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে তাঁরা যে নিঃশ্বাস মোচন করেন, তা হ্রস্ব নয় এবং সে-নিঃশ্বাস বিশ্বাসীরও নয়! হতভাগা আমি, তাঁদের এই আমার প্রতি অতি মনোযোগ নাকি প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতে পারিনেÑÑমন্দ লোকে এমন অভিযোগও করেছে তাঁদের দরবারে।
লোকে বললেও আমি মনে করতে ব্যথা পাই যে, তাঁরা আমার শত্রু। কারণ, একদিন তাঁরাই আমার শ্রেষ্ঠবন্ধু ছিলেন। আজ যদি তাঁরা সত্যি সত্যিই আমার মৃত্যুকামনা করেন, তবে তা আমার মঙ্গলের জন্যই, এ আমি আমার সকল হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাই নি- তাদের হাতের আঘাত যত বড় এবং যত বেশীই পাই। মানুষের মুখ উল্টে গেলে ভূত হয়, বা ভূত হ’লে তার মুখ উল্টে যায়; কিন্তু মানুষের হৃদয় উল্টে গেলে সে যে ভূতের চেয়েও কত ভীষণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র হয়ে উঠে-তাও আমি ভাল ক’রেই জানি। তবু আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে, চির-রহস্যের অবগুন্ঠন মোচন করবে, এই ধুলোর নীচে স্বর্গ টেনে আনবেÑÑএ আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সকল ব্যথিতের ব্যথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি, এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনে। এই ব্যথিতের অশ্রুজলের মুকুরে যেন আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কিছু করতে যদি না-ই পারি ওদের সাথে প্রাণ ভরে যেন কাঁদতে পাই।
কিন্তু এ আপনার চিঠির উত্তর হচ্ছে না।
দেখুন, চিঠি না লিখতে লিখতে চিঠি লেখার কায়দাটা গেছি ভুলে। তাতে করে কিন্তু লাভ হয়েছে অনেক। যদিও চোখ-কান বুঁজে উত্তর দিয়ে ফেলি কারুর চিঠির, সে-উত্তর পড়ে তাঁর প্রত্যুত্তর দেবার মত উৎসাহ বা প্রবৃত্তির ইতি ঐখানেই হয়ে যায়। কেননা, সেটা তাঁর চিঠির উত্তর ছাড়া আর সব কিছুই হয়। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নিতে পারেন। সুতরাং, এটাও যদি আপনার চিঠির উত্তর না হয়ে আর কিছুই হয়, তবে সেটা আপনার অদৃষ্টের দোষ নয়, আমার হাতের অখ্যাতি।
আমাদের দেখা না হ’লেও শোনার ত্রুটি কোনো পক্ষ থেকেই ঘটেনি দেখছি। আপনাকে চিনি, আপনি আমায় যতটুকু চেনেন তার চেয়েও বেশী ক’রে ; কিন্তু জানতে যে আজও পারলাম না, তার জন্য অভিযোগ আমার অদৃষ্টকে ছাড়া আর কাকে করব বলুন। এতদিন ধরে বাঙলার এত জায়গা ঘুরেও যখন আপনার সঙ্গে দেখা হ’ল না, তখন আর যে হবে, সে আশা রাখিনে। বিশেষ করে আজ যখন ক্রমেই নিজেকে জানাশোনার আড়ালে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ ভালই হয়েছেÑÑঅন্ততঃ আপনার দিক থেকে। আমার দিকের ক্ষতিটাকে আমি সইতে পারব এই আনন্দে যে, আপনার এত শ্রদ্ধা অপাত্রে অর্পিত হয়েছে ব’লে দুঃখ করবার সুযোগ আপনায় দিলাম না। এ আমার বিনয় নয়, আমি নিজে অনুভব করেছি যে, আমায় শুনে যাঁরা শ্রদ্ধা করেছেন, দেখে তাঁরা তাঁদের সে-শ্রদ্ধা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাই আমি আজ অন্তরে অন্তরে প্রার্থনা করছি, কাছে থেকে যাঁদের কেবল ব্যথাই দিলাম দূরে গিয়ে অন্ততঃ তাঁদের সে-দুঃখ ভুলবার অবসর যদি না দিই, তবে মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা সত্য নয়।
তা ছাড়া, নৈকট্যের একটা নিষ্ঠুরতা আছে। চাঁদের জ্যোৎস্নায় কলঙ্ক নেই, কিন্তু চাঁদে কলঙ্ক আছে। দূরে থেকে চাঁদ চক্ষু জুড়ায়, কিন্তু মৃত চন্দ্রলোকে গিয়ে কেউ খুশী হয়ে উঠবেন বলে মনে হয় না। বাতায়ন দিয়ে যে সূর্য্যালোক ঘরে আসে, তা আলো দেয়, কিন্তু চোখে দেখার সূর্য্য দগ্ধ করে। চন্দ্র-সূর্য্যকে আমি নমস্কার করি, কিন্তু তাঁদের পৃথিবী দর্শনের কথা শুনলে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। ভালোই হয়েছে ভাই, কাছে গেলে হয়ত আমার কলঙ্কটাই বড় হয়ে দেখা দিত।
তারপর, শ্রদ্ধার কথা। ওদিক দিয়ে আপনার জিতে যাবার কোনো আশা নেই বন্ধু। শ্রদ্ধা যদি ওজন করা যেত, তা হ’লে আমাদের দেশের একজন প্রবীন সম্পাদকÑযিনি মানুষের দোষগুণ বানিয়ার মত ক’রে কড়ায় গণ্ডায় ওজন করতে সিদ্ধহস্ত, তাঁর কাছে গিয়েই এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যেত! গ্রহের ফেরে তাঁর কাঁচিপাকি ওজনের ফের আমার পক্ষে কোনো দিনই অনুকুল নয়; তা সত্ত্বেও আপনিই হারতেন, এ আমি জোর ক’রে বলতে পারি।
হঠাৎ মুদির প্রসঙ্গটা এসে পড়বার কারণ আছে, বন্ধু। জানেনই ত, আমরা কানাকড়ির খরিদ্দার। কাজেই ওজনে এতটুকু কম হ’তে দেখলে প্রাণটা ছাঁৎ ক’রে ওঠে। মুদিওয়ালার ওতে লাভ কতটুকু হয় জানিনে, কিন্তু আমাদের ক্ষতির পরিমাণ আমরা ছাড়া কেউ বুঝবে না, মুদিওয়ালা ত নয়ই। তবু মুদিওয়ালাকে তুল দাঁড়ি ধরতে দেখলে একটু ভরসা হয় যে, চোখের সামনে অতটা ঠকাতে তার বাধবে; কিন্তু তার পাঁচ সিকে মাইনের নোংরা চাকরগুলো যখন দাঁড়িপাল্লার মালিক হয়ে বসে, তখন আর কোনো আশা থাকে না। আগেই বলেছি, আমরা দরিদ্র খরিদ্দার। থাকত বড় বড় মিঞাদের মত সহায়-সম্বল, ত’ হ’লে এ অভিযোগ করতাম না।
পায়া-ভারী লোকের ভারী সুবিধে। তা সে পায়া-ভারী পায়ে ফাইলেরিয়াÑÑগোদ হয়েই হোক, বা ভার গুণেই হোক! এঁদের তুলতে হয় কাঁধে ক’রে, আর কাছে যেতে হয় মাথাটা ভূঁইসমান নীচু ক’রে। ব্যবসা যারা বোঝে, তারা অন্য দোকানীর বড় খদ্দেরকে হিংসা ও তজ্জনিত ঘৃণা যতই করুক, তাঁকে নিজের দোকানে ভিড়োতে তারÑÑদোকানের সবটুকু তেল তার ভারী পায়ে খরচ করতে তার এতটুকু বাধে না। দরকার হ’লে তার পুত্র ছোটে তেলের টিন ঘাড়ে করে, সাঁতরে পার হয় রূপনারায়ণ নদ, তাঁর ভারী পায়ে ঢালে তৈল, তা সে পা যতই কেন ঘানি-গাছের মত অবিচলিত থাক। সাথে সে ভাড়াটে ভাঁড়ও স্তুতি-গাইয়ে নিয়ে যেতেও ভুলে না।
থাক এখন এসব বাজে কথা। অনেক কথার উত্তর দিতে হবে।
আমি আপনার মত অসঙ্কোচে তুমি বলতে পারলাম না বলে ক্ষুন্ন হবেন না যেন। আমি একে পাড়াগাঁয়ে স্কুল-পলানো ছেলে, তার ওপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে না (পেটে বোমা মারার উপমাটা দিলাম না স্পেশাল ট্রিবিউনালের ভয়ে)। যদি বা খাজা বা ইবরাহিম খানকে তুমি বলতে পারতাম, কিন্তু কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবের নাম শুনেই আমার হাত-পা একেবারেই পেটের ভিতর সেঁদিয়ে গেছে! আরে বাপ! স্কুলের হেডমাষ্টারের চেহারা মনে করতেই আমার আজও জলতেষ্টা পেয়ে যায়, আর কলেজের প্রিন্সিপালÑÑসে না জানি আরো কত ভীষণ! আমার স্কুল-জীবনে আমি কখনো ক্লাসে বসে পড়েছি, এত বড় অপবাদ আমার চেয়ে এক নম্বর কম পেয়ে যে লাষ্টবয়’ হয়ে যেত-সেও দিতে পারবে না। হাইবেঞ্চের উচ্চাসন হ’তে আমার চরণ কোনদিনই টলেনি, ওর সাথে আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেছিল। তাই হয়ত আজো বক্তৃতামঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিলে মনে হয়, মাষ্টার মশাই হাইবেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন!
যার রক্তে রক্তে এত শিক্ষক-ভীতি, আপনি সাধ্য সাধনা করেও তুমি বলাতে পারবেন না, এ স্থিরনিশ্চিত। এইবার পালা শুরু।
বাঙলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কি না জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতিমাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হ’তে। আমার মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবে যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনদিন অভিযোগ করেছি বলে ত মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হবার মত বড় ত আমি হইনি! অথচ হাফেজ খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সাথে কাফেরের পংক্তিতে উঠে গেলাম!
হিন্দুরা লেখক-অলেখক জন-সাধারণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি ভালোবাসা দিয়ে আমায় এত বড় করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তা হ’লে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য, কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দুসভা’ওয়ালা আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদেরে আঙ্গুল দিয়ে গোণা যায়। এঁদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত। এঁদের অবিচারের জন্য সমস্ত হিন্দুসমাজকে দোষ দিই নাই এবং দিবও না। তাছাড়া, আজকাল সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে আমি যে মুসলমানÑÑএইটেই হয়ে পড়েছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধ, আমি যত বেশী অসাম্প্রদায়িক হই না কেন।
প্রথম গালাগালির ঝড়টা আমার ঘরের দিক অর্থাৎ মুসলমানের দিক থেকেই এসেছিলÑÑএটা অস্বীকার করিনে; কিন্তু তাই বলে মুসলমানেরা যে আমায় কদর করেন নি, এটাও ঠিক নয়। যারা দেশের সত্যিকার প্রাণ সেই তরুণ মুসলিম বন্ধুরা আমায় যে-ভালোবাসা, যে প্রীতি দিয়ে অভিনন্দিত করেছেন, তাতে নিন্দার কাঁটা বহু নীচে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রবীণদের আশীর্বাদ মাথার মণি হয়ত পাইনি, কিন্তু তরুণদের ভালোবাসাÑÑবুকের মালা আমি পেয়েছি। আমার ক্ষতির ক্ষেতে ফুলের ফসল ফলেছে।
এই তরুণদেরই ত নেতা ইবরাহিম খান, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মনসুর, ওয়াজেদ আলী, আবুল হোসেন। আর এই বন্ধুরাই ত আমায় বড় করেছেন, এই তরুণদের বুকে আমার জন্য আসন পেতে দিয়েছেনÑÑপ্রীতির আসন! ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফরিদপুরে যারা তাদের গলার মালা দিয়ে আমায় বরণ করল, তারা এই তরুণেরই দল। অবশ্য, এ তরুণের জাত ছিল না। এরা ছিল সকল জাতির।
সকলকে জাগাবার কাজে আমায় আহ্বান করেছেন। আমার মনে হয়, আপনাদের আহ্বানের আগেই আমার ক্ষুদ্র শক্তির সবটুকু দিয়ে এদের জাগাবার চেষ্টা করেছিÑÑশুধু যে লিখে, তা নয়ÑÑআমার জীবনী ও কর্মশক্তি দিয়েও।
আমার শক্তি স্বল্প, তবু এই আট বছর ধরে আমি, দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক-শ্রমিক তরুণদের সঙ্গবদ্ধ করবার চেষ্টা করেছি- লিখেছি, বলেছি, চারণের মত পথে পথে গান গেয়ে ফিরেছি। অর্থ আমার নাই, কিন্তু সামর্থ্য যেটুকু আছে, তা ব্যয় করতে কুন্ঠিত কোনদিন হয়েছি, এ-বদনাম আর যেই দিক, আপনি দেবেন না বোধ হয়। আমার এই দেশ-সেবার, সমাজ-সেবার অপরাধের জন্য শ্রীমৎ সরকার বাবাজির আমার উপর দৃষ্টি অতিমাত্রায় তীক্ষè হয়ে উঠেছে। আমার সবচেয়ে চলতি বইগুলোই গেল বাজেয়াফত হয়ে। এই সে-দিনো পুলিশ আবার আমায় জানিয়ে দিয়েছে, আমার নব-প্রকাশিত ‘রুদ্র-মঙ্গল’ আর বিক্রি করলে আমাকে রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত করা হবে। আমি যদি পাশ্চাত্য ঋষি হুইটম্যানের সুরে সুর মিলিয়ে বলি,ÑÑ
“ইবযড়ষফ, ও ফড় হড়ঃ মরাব ধ ষরঃঃষব পযধৎরঃু,
ডযবহ ও মরাব, ও মরাব সুংবষভ.”
তা’হলে সেটাকে অহঙ্কার ব’লে ভুল করবেন না…………..।
[চলবে]
কবি নজরুল এবয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা গ্রন্থ থেকে নেয়া