7:02 pm, Monday, 16 September 2024

ঘরে ফেরা : আরিফুর রহমান আকন্দ

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:৩৫:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 129 ভিউ
শেয়ার করুন

এখানে আছি ওখানে যাই
হয়না কোথাও ঠাঁই।
বনে বনে উড়ে বেড়াই
আপন তো কোথাও নেই।
দিবস রজনী উপোস থাকি
দেয়না খেতে কেউ,
পারতো যদি ধাক্কা দিত,
তাড়িয়ে দিত এসে, তেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই,
পা টা করেছি নাই, আগেই।

মুখ থেকে অস্থির বাক্য বের করে ফিরোজ। শুধু শুধু নয়। রাগ করে। স্ত্রীর মর্জিনাকে গালি দেয়। প্রতিবারের রান্নাতে অতিরিক্ত তৈল মসলা অপচয় করে সে। অভিযোগ ফিরোজের। খুব হিসেবি হয়ে সংসার চালায় স্ত্রী মর্জিনা। যদিও। তাকে আরও হিসেবি হওয়ার তাগাদা তারপরও। ফিরোজ তাগাদা দেয় অপচয় কমাতে। ঝাল একটু বেশি হলে সমস্যা নেই কোন তাকে। সিদ্ধ হতে হবে ভাল করে। খাওয়া যাবে। খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই হল। কোন মতে। স্বাধের কোন প্রয়োজন নেই। কুপি বাতি আর চালা ঘরে শুয়ে স্বাধের কথা ভাবা মানায় না।

কেননা, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, ফিরোজের। প্রতিনিয়ত। কোন মতে খেয়ে না খেয়ে দিন কেটে যায় তাদের।

ঘরে চাঁদের আলো আসে। প্রতি রাতে। জোছনা দেখতে বাইরে যেতে হয় না কখনও। এমন রোমাঞ্চকর সুন্দর রাত সুখকর হয়না ফিরোজদের। কখনও। প্রতিরাতে চাঁদের ডুবে যাওয়া দেখে মেঘের আড়ালে লুকোতে দেখে। ফিরোজের উত্থান পতনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ডুবে যাওয়া চাঁদ। কষ্ট হয় তার, কান্না আসেনা। এখন আর আগের মতো। মেঘের আড়াল থেকে, চাঁদের মতো বেরোতে পারে না সে। এমন আশা ছেড়ে দিছে অনেক আগে। রাত কাটে তার ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে। সারা বছর।

বর্তমান অবস্থা বাংলা পুরোনো প্রবাদের মতো হয়ে আছে ফিরোজের। ‘নূন’ আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা এখন। এটা আনতে গেলে ওটার অভাব। টাকা যোগার করে ওটা নিয়ে এসে দেখে আগেরটা শেষ হয়ে গেছে। অনেক আগেই।

ফিরোজের অবস্থা আগে এমন ছিলনা। পদ্মার পাড়ে বাড়ি ছিল তার। বিশাল বড় বাড়ি, ধানের জমি। পুকুর, পুকুর ভরা মাছ। গোয়াল ভরা গরু-ছাগল। বাড়ির চারপাশে ছিল, বিশাল বাগান। গাছ-পালা। বাড়ির সামনে ছিল, সুপারি আর নারিকেলের বাগান। পিছনে ছিল বাঁশ বাগান। তার একটা পরিচয় ছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন, নিয়ে সাজানো পরিবার ছিল, তাদের। এগুলো খুব বেশী পুরোনো কথা নয়। বছর পনের আগের কথা।

একরাতে, পদ্মার নির্দয় চাহুনিতে। সবকিছু স্বপ্ন হয়ে স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে আজ।

ভাগ্য দেবতা সে রাতে, তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল। হয়তো।

প্রাণে বাঁচিয়ে রেখে গেছে তাকে। ভাগ্য দেবতার চাহুনি ফিরোজের দিকে ছিল। সে রাতে। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একা বেঁচে আছে সে। আজও।

মাঝে মাঝে রাগ হয় ফিরোজের। ভীষণ রকমের রাগ। ভাগ্য দেবতার প্রতি। মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল সে। যেহেতু। আর একটু ভাল করে তাকালে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত তার। তার তো কোন কিছুর অভাব থাকার কথা না।

মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ঘুরতে হতো না। অন্তত পক্ষে। ছদ্মবেশে ভালো পা টা লুকিয়ে রেখে। খুড়া হয়ে।

এক ঝড়ের রাতে পদ্মার ভাংগর শুরু হয়, আচমকা। কোনো পূর্বাভাস ছাড়া।

কিছু বুঝে উঠার আগে অর্ধেক গ্রাম তার গর্ভে গ্রাস করে ফেলে। সর্বনাশা পদ্মা।
যখন বুঝতে পারে, দেড়ি হয়ে গেছে। অনেক। গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু এবং বসত ভিটার মায়া ছেড়ে পালিয়েছে সবাই। যে যেদিকে সুযোগ পায়, ছুটে যায় সে দিকে। কারও দিকে তাকানোর সুযোগ নেই, কারও। কারও জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই কারও কাছে। আপন প্রাণ নিয়ে নিজ নিজ মতো করে ছুটেছে নিরাপত আশ্রয়ের দিকে।

শুধুমাত্র নদী ভাংগন আসলে এতো তাড়াতাড়ি গ্রাম ছেড়ে পালাতে হতো না। কারও। নদী ভাংগন বাদ মেরামত করার মতো উদ্যোগ নেওয়া যেতো। সবাই মিলে। আসতে আসতে প্রয়োজনীয় আসবাব নিয়ে গ্রাম ছাড়া যেতো। ব্যর্থ হলে।

সাথে ছিল ঝড় প্রবল বৃষ্টি। বিপত্তি বাঁধিয়ে ছিল। সাথে ছিল অন্ধকার রাত। সবথেকে বেশি বিপত্তির কারণ।

সাহস ধরেনি কারও মনে। বাঁধের কাছে যেতে।

এক হাতে পুটলি অন্য হাতে ফিরোজের এক ভাই। ছুটেছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ফিরোজের বাবা। বোনকে নিয়েছে তার মা, কোলে। আর কিছু নেওয়ার সুযোগ হয়নি তার। পিছু পিছু ছুটেছে, ফিরোজের বাবার।

দশ বছর বয়সী ফিরোজ খালি হাতে বের হয়নি ঘর থেকে। সামনে যা পেয়েছে সাধ্য মতো নিয়েছে। হাতে। তার মন কিছুতেই যাচ্ছিল না। বাড়ি ছেড়ে। কাপুরুষের মতো পালাতে চায়নি। বিবেকের কাছে বাঁধা পরে যায় সে।

মাঝ পথ থেকে ফিরে আসে। বাধ্য হয়ে। রান্না ঘর থেকে তরকারি কাটার বটি বের করে আনে। এতো সহজে পায়নি। খুজতে হয় অনেক। অনেক সময়ের অপচয় সেখানে। দৌড়ে যায় সে গোয়াল ঘরে। বটি হাতে। গরু ছাগল গুলোকে বাঁধন ছাড়া করতে হবে। দড়ির বাঁধন খুলা অসম্ভব। একেবারেই। গোয়াল ঘরের চটার বেড়া কেটে ঢুকে, একপাশ দিয়ে।

আল্লাহর সৃষ্টি অবুজ প্রাণীগুলো মুক্তি পায়। ফিরোজের একটু খানি মায়ায়। অনেক খানি ত্যাগে। নিজের জীবন বাজি রাখার কারণে।

গায়ের লোক সবাই গাঁ ছেড়ে চলে গেছে। অনেক আগেই। নিরাপদ আশ্রয়ের খুজে। ফাঁকা হয়ে আছে গ্রাম। জনমানবহীন ভুতুরে পরিবেশ বিরাজমান।

ফিরোজ যাচ্ছে একা একা। দৌড়ে। লক্ষ্যহীন গন্তব্য। চার পাশের থমথমে পরিবেশ যেন, ফিরোজকে সামনে এগুতে দিচ্ছে না। ভয় কাবু করে ফেলেছে তাকে। যতই দৌড়াচ্ছে, ততই যেন মনে হচ্ছে। আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে আছে সে। চার পাশ অন্ধকার। দেখা যায়না কিছু। ভাল করে। অনুমান করছে সে।

বাঁচার কোনে সুযোগ নেই। নিশ্চিত। হার মেনে নিয়েছে। নিয়তির কাছে সপে দিয়েছে নিজেকে।

দাড়িয়ে যায় ফিরোজ। চলার শক্তি নেই শরীরে। নিজের কথা ভাবছে না এখন আর। অবুজ প্রাণীগুলোর কথা ভাবছে সে বার বার।
তারা বাঁচবে না মরবে কেউ জানেনা। বাঁধা অবস্থায় থেকে মরতে হবে না। অন্তত পক্ষে। বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করতে পারবে। এ অবস্থাতেই বেঁচে যাবে হয়তো।

তাদের মতো ভাগ্যবান আশা করে। নিজেকে। আল্লাহর রহমতে বেঁচে যায় সে। শুধুমাত্র।
নিজেকে আবিষ্কার করে এক মাছ শিকারি জেলের ঘরে। ফিরোজ।

সারারাত মাছ ধরে বাড়ি ফিরছিল সে। সকালে সুর্য উঠার ঠিক আগ মুহুর্তে। ফিরোজকে পরে থাকতে দেখে সে, নিথর হয়ে। নদীর ঘাটে। ফিরোজের শরীরের অর্ধেক অংশ ছিল পানিতে। পেট থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই পানির উপরে। শুকনো কাদায়। সারা শরীর সরীসৃপের মতো দেখাচ্ছিল। পা দুটো পানিতে। কোমর থেকে বাকি সবটা। নদীর পানির শান্ত ঢেউয়ের সাথে যেন খেলা করছে।

যে কারো চোখ গোলক ধাঁধায় পরে যাবে। আচমকা চোখে পড়া মাত্রই। নদীর পানিতে ভেসে আসা ফিরোজকে দেখে বিশ্বাস করবে না কেউ। মানুষ হতে পারে সে। নিজেকে বোকা প্রমাণ করতে চাইবে না যে কেউ। মানুষ ভেবে।

কোন জলজ প্রাণী ডাঙায় এসে বিপদে পড়েছে। নিঃসন্দেহে ধরে নিবে সবাই। বেঁচে ফেরার জন্য চেষ্টা করছে। আপ্রাণ। পা গুলো নড়তে দেখে মনে হবে অনেকের। কাছে এসে নিজের ভুল বুজতে দেড়ি হবে না। কাছে থেকে দেখে। কিন্তু জীবিত নাকি মৃত বোঝার সুযোগ নেই কোন। অল্প একটু সময় লাগবে পুরোপুরিভাবে বুঝতে।

ফিরোজের প্রাণ বাঁচানো জেলে এমন দিধায় পড়েছিল প্রথম থেকে।
বুকে মাথা রেখে হৃদ স্পন্দন বুঝতে চেষ্টা করে। জীবিত নাকি মৃত নিশ্চিত হতে। সফল হয় জেলে। হৃদ স্পন্দন সচল। কিছুটা কম। পেটে চাপ দিয়ে। ফুসফুসের পানি বের করে জেলে। হৃদ স্পন্দন আগের থেকে স্বাভাবিক হয়। কিছুটা। জ্ঞান ফিরেনি এখনও। তবে বেঁচে আছে।

কয়েকজন জেলেকে ডেকে আনে। সে। বাড়ী নিয়ে আসে তাদের সহযোগিতায়। ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে, শুকনো কাপড় পড়িয়ে দেয়। অন্য দুজন জেলে। গরম বিছানা পেতে দেয়। গরম বিছানা পেতে জেলে ঘরে শুতে দেয় ফিরোজকে। তখনও জ্ঞান ফিরেনি তার।

রসুনের সাথে সরিষার তৈল মিশিয়ে গরম করে আনে, জেলে বৌ। ভাতের ফেনের মতো ফেন আসা গরম রসুন তৈল। দ্রুত শরীর গরম কররা মহৌষধ। গ্রামাঞ্চলে আজও প্রচলিত এ পদ্ধতি।

সারা শরীরে মালিশ করে দেয় জেলে এবং তার ছেলে। ফিরোজের শরীরে। আন্তরিক চেষ্টায়, যত্নে বেঁচে যায় ফিরোজ। সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে জেলে পরিবারের প্রতি,ফিরোজ।

কিন্তু তাকে ধুকে ধুকে মরতে হচ্ছে, প্রতিনিয়ত। আজবদি। পিছনে ফেলে আসা দিনগুলো কুরে কুরে খাচ্ছ তাকে। সারাক্ষণ।

এই ভেবে ঘুমায় সে প্রতিরাতে- “সকাল বেলায় ঘুম থেকে জেগে দেখবে, সবকিছু আগের মতো আছে। আগের রাতের ভাবনা গুলো সব দুঃস্বপ্ন ছিল। একটা মস্তবড় ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।

জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে বেঁচে থাকতে, তাকে বীরের মতো লড়তে হচ্ছে। আজ পর্যন্ত। তার অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। সবকিছুতে। সে একজন লড়াকু সৈনিক এখন।

হাত পেতে ভিক্ষা নিতে লজ্জা হয়না, এখন তার। অভ্যাস হয়ে গেছে। লজ্জা পেত সে শুরুর দিকে। কেউ কিছু দিয়ে গেলে মুখ লুকাতে হতো। কোন রিড়ম্বনা মনে হয়না এখন তার কাছে। ফিরোজের ইচ্ছা ছিল কাজ করে পরিশ্রম করে রোজগার করবে। প্রথম দিকে। সকল প্রকার কাজ জানা ছিল তার। পরিশ্রম করার মন মানসিকতা ছিল সব ক্ষেত্রে।

কাজের খুঁেজ মানুষের দারে দারে ঘুরেছে সে। পায়নি। কেউ তাকে কাজ দেয়নি কোন প্রকারের। অবিশ্বাস করেছে সবাই। অনেক সময় অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে।

অপরিচিতদেরকেউ বিশ্বাস করেনা এসমাজে। মুখ থুবরে পরে থাকলে পাশে এসে দাড়াবেনা কেউ। কখনও। পিছে ভয় হয় বলে। অনেক কিছু নিয়ে। এটা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত একটি ধারা। বহুকাল ধরে চলে আসছে।

অপরিচিত ফিরোজকে কাজ দিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার মতো কেউ নেই। এসমাজে হয়তো। একজনও নেই খুঁজে পাবেনা কেউ শত চেষ্টায়। এমন নির্বোধ মহৎ লোক। শারীরিকভাবে খেটে খাওয়ার মতো কোন কাজ লিখা নেই ফিরোজের ভাগ্যে। হয়তো। নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচার মতো সামনে পরেনি তার। সে সময়ে।

ঢাকাগামী ট্রেনের ছাদে করে ময়মনসিংহ আসে ফিরোজ। বিনা টিকিটে। টিটির চোখে ফাঁকি দিয়ে আসতে হয়। এশহর তাকে ছাড়তে চায়নি। এলোমেলো শহর আরও এলোমেলো হয়ে যায়। এশহরের ছোঁয়ায়। ফিরোজের। এখানে কোন কোন কাজ পেয়ে যাবে। ভেবেছিল ফিরোজ। ভুল ছিল ধারনা। সম্পূর্ণ। শহরের মানুষেরা কাজ করে প্রতিযোগিতা করে। এশহরে কাজের বড় অভাব। গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। কিছ একটা যদিও জুটে যায়, শত চেষ্টায়। সবার জন্য হয়না প্রজোয্য। কখনও। ফিরোজ হয়তো সেই অভাগাদের কেউ একজন। অপরিচিত নতুন এলাকায় কিছু করা সহজ নয়। এতোটা। এটা হয়তো আগে থেকে ভেবে দেখেনি সে। এতোটা সহজ করে। টাকা দুইদিন দুইরাত না খেয়ে আছে সে। ক্লান্ত শরীর। অনেক বেশি। ঘুম আসেনি চোখে অভুক্ত পেটে। এ কদিন।

শুয়ে বিশ্রাম নেয়ার মতো কোন জায়গা পায়নি। ঘুরে বেড়িয়েছে সারাক্ষণ। এদিক ওদিক। অভুক্ত পেট, নির্ঘুম চোখ, শরীরটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি ছিলনা। পা দুটোতে। অবশিষ্ট শক্তিটুকো ছিলনা।

ট্রেন থেকে পা বাড়িয়ে সাহস করে নেমে যায়। কোন মতে। ফুট ওভার ব্রীজের শিড়ির পাশে বসে পরে। আর হয়তো সামনে যাওয়া সম্ভব নয় । তার পক্ষে।

নিজের বাহুকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পরে। বসে থাকতে পারছিলনা, হয়তো। কষ্ট হচ্ছিল অনেক বেশি। গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে। শীত নিবারনের চেষ্টা করছিল। ব্যর্থ সে চেষ্টা। খালি শরীরে।

প্রকৃতিতে এখন শীত আসেনি। আসার সময় খুব একটা দুরে নয়। চারপাশ থেকে আসা, শরীরে বয়ে যাওয়া হীমেল হাওয়া জানান দিচ্ছিল। এই বুঝি শীত আসছে। আর অল্প ক‘টা দিন অপেক্ষা।

কোন প্রকার কাঁতা কম্বল ছাড়া নিজের শরীরের ময়লা জামাগুলো সম্বল করে শুয়ে থাকে। ফিরোজ। যে কারও দেখে মনে হবে যবুথবু হয়ে শুয়ে আছে এক রোগ্ন ভিখারী। তার কেউ নেই। বাড়ী নেই। ঘর নেই। এবারের শীত বুঝি তাকে আর রেখে যাবে না।

নভেম্বর মাস শেষ হতে চলেছে তখন। প্রায়। নিজের এবং পরিবারের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে সবাই। শীতের কেনাকাটা। গরম কাপড় কেনাকাটার ধুম। কেউ ব্যস্ত হয়ে আছে, নিজেকে নিয়ে নয়। গরীব দুখিদের মতো অসহায়দের নিয়ে। তাদের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ করতে হবে। শীত আসার আগেই। এই রেল ষ্টেশনে পা রাখে যে সন্ধ্যায়, ফিরোজ। প্রথম। সে রাতে একদল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী শীত বস্ত্র বিতরণ করতে আছে ষ্টেশনে। এদের সবাই এশহরে বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করে। কোথাও না কোথাও মেচ ভাড়া করে থাকে। শহরের মধ্যে। বাড়ী থেকে টাকা এনে নিজের খরচ চালাতে হয়। সে টাকা থেকে অল্প পরিমাণ টাকা বাঁচিয়ে রাখে তারা। আর্ত মানবতার কল্যাণে খরচ করবে বলে। এমন মহৎ ছেলে মেয়েদের তুলনা কারও সাথে হয়না। সৃষ্টি কর্তার দয়ার সাগরের বিন্দু পরিমাণ এদের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়েছেন। দুনিয়াতে। তাই এমন ছেলে মেয়েরা সবসময় মানব কল্যাণের কথা চিন্তা করে। দুখিদের মুখে হাসি ফুটাতে চায়। এদের সবাই নিরিহ বাবা মার সহজ সরল ছেলে মেয়ে। নিজের স্বার্থ বলতে নেই এদের কাছে।

মাহদি নামের এক তরুনের চোখ পরে ফিরোজের দিকে। আতকে পরে তার মায়ায়। চোখ দুটো মাহদির। জলে ভরে ছলছল করছিল দুটো চোখ তার। ফিরোজের যবুথবু হয়ে শুয়ে থাকা দেখে। শীত নেই তবুও শীতে কাঁপছে। টক টক করে। এ যেন মাঘের শীতের সবটা শীত মাঘের আগেই চলে আসছে ফিরোজের শরীরে।

একটা কম্বল বাড়িয়ে দেয় ফিরোজের দিকে। সে। হাত বাড়িয়ে নেওয়ার শক্তিটুকুও ছিলনা তার। মাহদি নিজ হাতে গায়ে জড়িয়ে দেয়। কম্বলটা। অনুভব করে প্রচন্ড জ্বর শরীরে। এখনি যেন তার গা জ্বরের ত্যাজে পুড়ে যাবে, ছাই হয়ে যাবে সারা শরীর। এমন অবস্থা ফিরোজের।

ফিরোজের গায়ে হাত রেখে জ্বরের তীব্রতা অনুভব করতে চেষ্টা করে মাহদি সহ আরও কয়েকজন। থমকে উঠে সে। এমন জ্বরের তীব্রতা নিজ হাতে অনুভব করেনি কখনও। হয়তো। নিঃশ্চুপ হয়ে আছে ছেলে গুলো। কি করতে হবে ভেবে পাচ্ছে না এই মুহুর্তে। শিহাব, নিশাত, হিমেল, ইরা সবাইকে ডেকে আনে কাছে। পরামর্শ করতে চেষ্টা করে । কি করবে এখন। সিদ্ধান্ত হয়। চিকিৎসা করাবে তারা। তাই করা উচিত। মতামত দেয় সবাই। আজ রাতেই করতে হবে যা করার।

শিহাবের ভিন্ন মত। সে আপত্তি করে- ওর গায়ে শুধুমাত্র জ্বর আসছে। যদিও একটু বেশি। আমরা বরং জ্বর সর্দ্দির কয়েকটা ট্যাবলেট এনে দেই। খাবার কিনে দিয়ে যাই। ইনশাল্লাহ জ্বর নেমে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই। কিছু পরিমাণ টাকা দিয়ে যেতে পারলে মন্দ হতো না। সেটা পরে দেখব আমাদের সামর্থ অনুযায়ী। কাল একবার এসে দেখে যাব। এ দায়িত্ব আমার উপর থাকুক। জ্বর না কমলে বিকল্প কিছু করতে পারি তখন। তার চিকিৎসা করব আমরা অবশ্যই।

সবার থেকে টাকা তোলা হয়। এখানে যারা আসছে। সবাই দেয় কম বেশি টাকা নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী। অনেক টাকা উঠে। হিমেল ঔষধ আনতে যায়। মাসুদ খাবার নিয়ে আসে। আপন চাঁদার টাকা তাদের হাতে দিয়ে পাঠায়। ইরা নিজ হাতে মুখে তুলে খাওয়ায় ফিরোজকে। ঔষধ খেতে দেয়। তিন দিনের অভুক্ত ফিরোজ পাগলের মতো খাওয়া শেষ করে। অবাক হয় সবাই। বাকী টাকাগুলো ফিরোজের হাতে দিয়ে যায়। আপন। শুয়ে থাকে ফিরোজ। এখন হয়তো ঘুমটা ভাল হবে তার। ঘুমাবে এখন সে। ছাত্রদের উদারতা দেখে মুগ্ধ হয়েছে ষ্টেশনে আসা অনেক যাত্রী। সকল ভ্যান যাত্রীরা উৎসাহের সাথে ফিরোজকে টাকা দিচ্ছে। অল্প কিছু খাবার কিনে দিয়েছে। অনেকেই। তার চার পাশে বিশাল দোকানের মতো খাবার জমে গেছে। অল্প সময়েই।

ফিরোজের চার পাশে ভিক্ষুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরও অনেক। বাচ্চা ভিক্ষুক, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ভিক্ষুক। ঘুরে বেড়ায় ফিরোজের চার পাশে। তামাশা দেখছে তারা। যাকে দেখছে হাত পাতছে। হাত জোর করে ভিক্ষা চাইছে। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই কারও সেই দিকে। ফিরোজকে নিয়ে পরে আছে সবাই। ঘন্টা দুইয়ের ব্যবধানে ফিরোজ এখন সকল কিছুর শিরোনাম।
ফিরোজের মুখে দ্বিতীয় বারের মতো খাবার তুলে দেয়। মধ্য বয়সী এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। ফিরোজ হয়তো ঘুমিয়ে গেছিল। এই সময়ে। ডেকে তোলে ভদ্রলোকের সাথে থাকা এক লোক। পাতি নেতা টাইপের কিছু একটা হবে। সে।

রাজ্যের বিরক্তি মুখে এনে হা করে খাবার তুলে নেয়। ফিরোজ। আবার শুয়ে পরে সে। পাতি নেতা টাইপের লোকটার প্রতি ভিষন রকমের রাগ হয় মধ্য বয়সী ভদ্রলোক। কেন সে আরেকটু সময়, ধরে রাখতে পারেনি। মুখে যা আসছে তা বলেই ধমকাচ্ছে। ভদ্রলোকের ব্যবহার যে এতো খারাপ হতে পারে এখানে কারও ধারনা ছিলনা। পাতিনেতা টাইপের লোকটা সবকিছু নীরব হয়ে শুনছে।

তার এই ভাল মানসী আচরণের আড়ালে লোকিয়ে আছে, মস্ত বড় একটা শয়তান জানুয়ার। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না সে কথা।

এক বয়স্ক বৃদ্ধ ভিক্ষুক মহিলা ভদ্রলোক বেচারার হাতে চুমু খেতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল“ বাবা তুমি মানুষ নও ফেরেশতা। পুরোটা বলে শেষ সুযোগ হয়নি তার। সে শুধু বলেছিল বাবা তুমি মানুষ নও” এটুকু বলাতে ভদ্রলোক বুড়ি বেচারার গালে একখানা ভদ্র থাপ্পর বসিয়ে দেয়। বুড়ির কথায় কি বুঝেছে সে, জানানেই বুড়ির। সে সাথে ভদ্রলোকদের একটা জনপ্রিয় গালি সালা ছোটলোকের বাচ্চা।ভদ্রলোক মহোদয় এখান থেকে কেটে পরে।

এতো তাড়াতাড়ি একজন ভাল মানুষের বদলে যাওয়া রূপ দেখে খুব একটা অবাক হয়নি সে। তার চোখে মুখে অবাক হওয়ার চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। আগের মতোই স্বাভাবিক সে। এমন মুখোসধারী ভদ্র আচরণের সাথে আগে থেকেই পরিচিত ভিক্ষুক বুড়ি। হয়তো। সে শুধু তার গালে হাতটুকু চেপে ধরে রাখে। অল্প সময়। পরক্ষণেই চোখ মুছে ফেলে অন্যদিকে ভিক্ষা করতে ভিরের মাঝে হারিয়ে যায়।

বাঙ্গালী প্রসারে নয় প্রচারে বিশ্বাসী। যে করেই হোক নিজের প্রচারনা করা চাই। কেউ করতে না আসলে সমস্যা নাই। নিজেকে নিজেই প্রচার কাজে নিয়োজিত করতে হবে। প্রচারের যুগে প্রচারনার কাজে টিকে থাকতে হবে। প্রচার করে।

ফিরোজের আজ এতো কদর। তার প্রতি মানুষের এতো ভালবাসা! এমনকিছু সে জীবনেও হয়তো কল্পনা করেনি।

দান দিতে আসা ছেলেদের হাতে ক্যামেরা ছিল। তাই আজ ফিরোজের প্রতি এতো ভালবাসা। এতো অচেনা মানুষের। ফিরোজের আজ অভাব নেই। অন্যের ভালবাসার। ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আছে সে।

একেকজন বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাড়িয়েছে, ক্যামেরার সামনে। খুব আগ্রহ সহকারে ফিরোজের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যেকে। ছবি তোলা হচ্ছে। ছবি তুলবে বলে। নিজের টাকায় খাবার কিনে দিয়েছে ফিরোজকে। অনেকেই। দেওয়ার সময় ঠিকঠাক মতো ছবি তুলতে হবে। গুরুত্বের সাথে। একটু এদিক সেটিক হলে চলবে না। আগে থেকেই বলে রেখেছে উৎসাহিত কয়েকজন। ফটোগ্রাফার মিমলা কে। ছবি গুলো নেওয়ার মতো কোন আগ্রহ দেখা গেল না কারও মাঝে। ছবি গুলো কোথায় যাচ্ছে। কোথায় যাবে। এমন প্রশ্ন কারও মধ্যে নেই। উত্তর জানার কোন আগ্রহ নেই কারও মাঝে। বিন্দু পরিমাণটুকু ছবি তুলতে কোন অলসতা নেই, মিমলার। যে যেভাবে বলছে সেভাবেই ক্লিক করে যাচ্ছে। একের পর এক। ক্যামেরার বাটনে।

অনেক টাকা হয়েছে ফিরোজের। একরাতে। গতরাতে শরীরে আসা, জ্বরটা নেমে গেছে এখন। সকালের মিষ্টি রোদে বসে আছে সে। শরীরে রোদের তাপ নিচ্ছে, তার। আজ তাকে অনেক সতেজ ও ফুরফুরা দেখাচ্ছে।

বোঝার অপেক্ষা রাখেনা, টাকায় সব মিলে। মনের শান্তি পর্যন্ত। শরীরের সতেজতা।

সকালের নাস্তাটা সেরে নিয়েছে, এই সময়ে। গরম ধোয়া উঠা দুধ চা, সাথে বন রুটি। তুলনাহীন নাস্তা। অন্যকিছুর সাথে। রুটি শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দেয় এখন। চুও-ওপ-চু-ওপ করে লম্বা শব্দে টান দেয় চায়ের কাপে।

মন যখন ভাল থাকে শব্দ করে চা খেতে ভাল লাগে খুব। আরও বেশি লম্বা এবং আরও বেশি শব্দ করে শেষ চুমুক দেয়, ফিরোজ। চায়ের কাপে। চা শেষ। কাপটা ফেরত পাঠিয়ে দেয় দোকানের ছেলেটাকে ডাক দিয়ে। ফিরোজের ডাক শুনে দৌড়ে আসে দোকানের ছেলেটা। ফিরোজের অনেক কদর এখানে আজ। ফিরোজ অনেক টাকা ওয়ালা আজ। সব দোকানিরা জেনে গেছে সে কথা। তার ডাকের আগে আগে থাকতে চায় সবাই। চাওয়া মাত্রই যে কোন কিছু নিয়ে আসে। কাপ ফেরত নিয়ে যায় সে। সাথে সাথে বিল পরিশোধ করে দেয়। ফিরোজ। হাসি মুখে বিদায় হয়। যাওয়ার আগে ফিরোজকে বলে যায়- যে কোন দরকারে এই কেরামতকে ডাক দিবেন মামা। আমি হইছি নেত্রকোণার পুলা। সবকিছু আমার জানা। থাকব আমি আপনার হুকুম আসার অপেক্ষায়। চোখে মুখে ক্লান্তির কোন লেশ নেই তার। বিন্দু মাত্র। রাতের টাকা গুলো আরও একবার গুণে দেখা দরকার। মনে মনে বলে ফিরোজ। এর আগে তিনবার গুণেছে। এখন নিয়ে হবে চারবার। বার হাজার পাঁচশত ত্রিশ টাকা ছিল। এখন আছে বার হাজার পাঁচশত বিশ টাকা। দশ টাকা খরচ। চা রুটি খেয়ে। পরিষ্কার হিসাব। টাকা গুলো কোমড়ে গুজে রাখে গুণার পর। মনে মনে একটু হেসে নেয় সে।

একজায়গায় বসে থাকতে ভাল লাগছে না তার। আর একটু হাটা চলা দরকার। রাত থেকে এক জায়গায় শুয়ে আছে এখানে। এক ঘুমেই রাত পার। সকালে উঠে বসেছে শুধুমাত্র। জায়গা থেকে নড়েনি এখনও।

ষ্টেশনটা দেখতে হবে একটু ঘুরে ফিরে। একটু খুজ খবর নিলে মন্দ হয়না। চেনা জানা থাকা ভাল।

গতরাতের একমাত্র সম্বল, কম্বলটার এখন আর দরকার নেই কোন। ফেলে দিলে মন্দ হয়না। হাতগুলো বিশ্রাম পাবে একটু। আগামী রাতের কথা ভেবে, ভাজ করে বগলের নিচে গুজে নিয়েছে সে। কম্বলটা। হাত একটু কষ্ট পাবে। পাক। কোন সমস্যা নেই এতে। শরীরটা তো আরাম পাবে সারারাত ভরে। শরীরের আরাম অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের আরামের জন্য অনেকেই অনেক কিছু করতে রাজি। করছেও তাই।

যেখানেই রাত আসুক শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে। কম্বলটা কষ্ট করে সাথে রাখলে। একটা আরামে ঘুম হবে। সারারাত ধরে। শীত ধারে কাছে ঘেষার কোন দুঃসাহস করবে না। এক ঘুমেই রাত পার। সকালে ঘুম ভেঙ্গে সুন্দর সকাল দেখা যাবে। সুন্দর সকাল উপভোগ করতে হলে, রাতে ভাল ঘুমের বিকল্প নেই। কিছু। ষ্টেশনের পুরোনো ভিক্ষুকগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফেলফেল করে হাসছে। দাঁত খেলিয়ে। ফিরোজের মুঠেও ভাল লাগছে না। সকাল সকাল এমন উপহাস দেখতে।
এখানে বসে, শরীর চুলকানো মতো কোন কিছু দেখার ইচ্ছা নেই তার।

কলেজ পড়ুয়া ছেলেগুলোকে ধন্যবাদ দিয়েছে বেশ কয়েকবার। মনে মনে। সামনাসামনি ধন্যবাদ দিবে আরেকবার। মনে মনে ঠিক করে রাখে সে।

কলেজ পড়ুয়া সেচ্চাসেবী ছেলেগুলো, সে রাতে উপকার করেছে। সত্যিই। অনেক উপকার। পাশে দাঁড়িয়ে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফিরোজের দিকে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের সে চেষ্টাকে বিফলে দেননি। ছেলেগুলোর উছিলায় সুস্থ হয়েছে আজ। কর্মক্ষমতা ফিরে পেয়েছে এখন। এটাই যেন ফিরোজে জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছু করে অর্থ উপার্জন করার থেকে কিছু না করে অর্থ উপার্জনের পথে পরিচিত হয়ে গেছে সে। এক রাতে। টাকা গুলো শেষ হওয়ার পরে হাত পেতে দিতে শুরু করে। এক সময় অভ্যাস হয়ে যায়। এটা পেশা হয়ে গেছে এখন তার। ফিরোজ এখন ভিক্ষা করে সে একজন ভিক্ষুক।

শুধু নিরবে একা বসলে, ভাবনার জগতে তার পুরোনো স্মৃতিগুলো এসে ভীড় করে। এখন। ভাবনার জগতে প্রবেশ করে স্মৃতিচারণ করে মনের অজান্তে।
মর্জিনার রান্না শেষ হয়েছে। এতক্ষণে। ফিরোজকে ডেকে বলে সে, খেতে আসতে। অতীতের কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে সে। স্ত্রীর ডাকে। ফিরোজ শুধু স্ত্রীর দিকে তাকায় কোন কথা বলে না। চোখ দুটো পানিতে ছল ছল করছে। ঘর অন্ধকার থাকায় মর্জিনা বুঝেনি কিছু।

মুখে অশ্লিল গালিটা নেই এখন আর। সে শুধু নিচু গলায় বলে- আইতাছি। হাত মুখ ধুয়ে আইতাছি।

#
জনপ্রিয়

ঘরে ফেরা : আরিফুর রহমান আকন্দ

আপডেটের সময় : ০৭:৩৫:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

এখানে আছি ওখানে যাই
হয়না কোথাও ঠাঁই।
বনে বনে উড়ে বেড়াই
আপন তো কোথাও নেই।
দিবস রজনী উপোস থাকি
দেয়না খেতে কেউ,
পারতো যদি ধাক্কা দিত,
তাড়িয়ে দিত এসে, তেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই,
পা টা করেছি নাই, আগেই।

মুখ থেকে অস্থির বাক্য বের করে ফিরোজ। শুধু শুধু নয়। রাগ করে। স্ত্রীর মর্জিনাকে গালি দেয়। প্রতিবারের রান্নাতে অতিরিক্ত তৈল মসলা অপচয় করে সে। অভিযোগ ফিরোজের। খুব হিসেবি হয়ে সংসার চালায় স্ত্রী মর্জিনা। যদিও। তাকে আরও হিসেবি হওয়ার তাগাদা তারপরও। ফিরোজ তাগাদা দেয় অপচয় কমাতে। ঝাল একটু বেশি হলে সমস্যা নেই কোন তাকে। সিদ্ধ হতে হবে ভাল করে। খাওয়া যাবে। খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই হল। কোন মতে। স্বাধের কোন প্রয়োজন নেই। কুপি বাতি আর চালা ঘরে শুয়ে স্বাধের কথা ভাবা মানায় না।

কেননা, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, ফিরোজের। প্রতিনিয়ত। কোন মতে খেয়ে না খেয়ে দিন কেটে যায় তাদের।

ঘরে চাঁদের আলো আসে। প্রতি রাতে। জোছনা দেখতে বাইরে যেতে হয় না কখনও। এমন রোমাঞ্চকর সুন্দর রাত সুখকর হয়না ফিরোজদের। কখনও। প্রতিরাতে চাঁদের ডুবে যাওয়া দেখে মেঘের আড়ালে লুকোতে দেখে। ফিরোজের উত্থান পতনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ডুবে যাওয়া চাঁদ। কষ্ট হয় তার, কান্না আসেনা। এখন আর আগের মতো। মেঘের আড়াল থেকে, চাঁদের মতো বেরোতে পারে না সে। এমন আশা ছেড়ে দিছে অনেক আগে। রাত কাটে তার ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে। সারা বছর।

বর্তমান অবস্থা বাংলা পুরোনো প্রবাদের মতো হয়ে আছে ফিরোজের। ‘নূন’ আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা এখন। এটা আনতে গেলে ওটার অভাব। টাকা যোগার করে ওটা নিয়ে এসে দেখে আগেরটা শেষ হয়ে গেছে। অনেক আগেই।

ফিরোজের অবস্থা আগে এমন ছিলনা। পদ্মার পাড়ে বাড়ি ছিল তার। বিশাল বড় বাড়ি, ধানের জমি। পুকুর, পুকুর ভরা মাছ। গোয়াল ভরা গরু-ছাগল। বাড়ির চারপাশে ছিল, বিশাল বাগান। গাছ-পালা। বাড়ির সামনে ছিল, সুপারি আর নারিকেলের বাগান। পিছনে ছিল বাঁশ বাগান। তার একটা পরিচয় ছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন, নিয়ে সাজানো পরিবার ছিল, তাদের। এগুলো খুব বেশী পুরোনো কথা নয়। বছর পনের আগের কথা।

একরাতে, পদ্মার নির্দয় চাহুনিতে। সবকিছু স্বপ্ন হয়ে স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে আজ।

ভাগ্য দেবতা সে রাতে, তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল। হয়তো।

প্রাণে বাঁচিয়ে রেখে গেছে তাকে। ভাগ্য দেবতার চাহুনি ফিরোজের দিকে ছিল। সে রাতে। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একা বেঁচে আছে সে। আজও।

মাঝে মাঝে রাগ হয় ফিরোজের। ভীষণ রকমের রাগ। ভাগ্য দেবতার প্রতি। মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল সে। যেহেতু। আর একটু ভাল করে তাকালে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত তার। তার তো কোন কিছুর অভাব থাকার কথা না।

মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ঘুরতে হতো না। অন্তত পক্ষে। ছদ্মবেশে ভালো পা টা লুকিয়ে রেখে। খুড়া হয়ে।

এক ঝড়ের রাতে পদ্মার ভাংগর শুরু হয়, আচমকা। কোনো পূর্বাভাস ছাড়া।

কিছু বুঝে উঠার আগে অর্ধেক গ্রাম তার গর্ভে গ্রাস করে ফেলে। সর্বনাশা পদ্মা।
যখন বুঝতে পারে, দেড়ি হয়ে গেছে। অনেক। গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু এবং বসত ভিটার মায়া ছেড়ে পালিয়েছে সবাই। যে যেদিকে সুযোগ পায়, ছুটে যায় সে দিকে। কারও দিকে তাকানোর সুযোগ নেই, কারও। কারও জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই কারও কাছে। আপন প্রাণ নিয়ে নিজ নিজ মতো করে ছুটেছে নিরাপত আশ্রয়ের দিকে।

শুধুমাত্র নদী ভাংগন আসলে এতো তাড়াতাড়ি গ্রাম ছেড়ে পালাতে হতো না। কারও। নদী ভাংগন বাদ মেরামত করার মতো উদ্যোগ নেওয়া যেতো। সবাই মিলে। আসতে আসতে প্রয়োজনীয় আসবাব নিয়ে গ্রাম ছাড়া যেতো। ব্যর্থ হলে।

সাথে ছিল ঝড় প্রবল বৃষ্টি। বিপত্তি বাঁধিয়ে ছিল। সাথে ছিল অন্ধকার রাত। সবথেকে বেশি বিপত্তির কারণ।

সাহস ধরেনি কারও মনে। বাঁধের কাছে যেতে।

এক হাতে পুটলি অন্য হাতে ফিরোজের এক ভাই। ছুটেছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ফিরোজের বাবা। বোনকে নিয়েছে তার মা, কোলে। আর কিছু নেওয়ার সুযোগ হয়নি তার। পিছু পিছু ছুটেছে, ফিরোজের বাবার।

দশ বছর বয়সী ফিরোজ খালি হাতে বের হয়নি ঘর থেকে। সামনে যা পেয়েছে সাধ্য মতো নিয়েছে। হাতে। তার মন কিছুতেই যাচ্ছিল না। বাড়ি ছেড়ে। কাপুরুষের মতো পালাতে চায়নি। বিবেকের কাছে বাঁধা পরে যায় সে।

মাঝ পথ থেকে ফিরে আসে। বাধ্য হয়ে। রান্না ঘর থেকে তরকারি কাটার বটি বের করে আনে। এতো সহজে পায়নি। খুজতে হয় অনেক। অনেক সময়ের অপচয় সেখানে। দৌড়ে যায় সে গোয়াল ঘরে। বটি হাতে। গরু ছাগল গুলোকে বাঁধন ছাড়া করতে হবে। দড়ির বাঁধন খুলা অসম্ভব। একেবারেই। গোয়াল ঘরের চটার বেড়া কেটে ঢুকে, একপাশ দিয়ে।

আল্লাহর সৃষ্টি অবুজ প্রাণীগুলো মুক্তি পায়। ফিরোজের একটু খানি মায়ায়। অনেক খানি ত্যাগে। নিজের জীবন বাজি রাখার কারণে।

গায়ের লোক সবাই গাঁ ছেড়ে চলে গেছে। অনেক আগেই। নিরাপদ আশ্রয়ের খুজে। ফাঁকা হয়ে আছে গ্রাম। জনমানবহীন ভুতুরে পরিবেশ বিরাজমান।

ফিরোজ যাচ্ছে একা একা। দৌড়ে। লক্ষ্যহীন গন্তব্য। চার পাশের থমথমে পরিবেশ যেন, ফিরোজকে সামনে এগুতে দিচ্ছে না। ভয় কাবু করে ফেলেছে তাকে। যতই দৌড়াচ্ছে, ততই যেন মনে হচ্ছে। আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে আছে সে। চার পাশ অন্ধকার। দেখা যায়না কিছু। ভাল করে। অনুমান করছে সে।

বাঁচার কোনে সুযোগ নেই। নিশ্চিত। হার মেনে নিয়েছে। নিয়তির কাছে সপে দিয়েছে নিজেকে।

দাড়িয়ে যায় ফিরোজ। চলার শক্তি নেই শরীরে। নিজের কথা ভাবছে না এখন আর। অবুজ প্রাণীগুলোর কথা ভাবছে সে বার বার।
তারা বাঁচবে না মরবে কেউ জানেনা। বাঁধা অবস্থায় থেকে মরতে হবে না। অন্তত পক্ষে। বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করতে পারবে। এ অবস্থাতেই বেঁচে যাবে হয়তো।

তাদের মতো ভাগ্যবান আশা করে। নিজেকে। আল্লাহর রহমতে বেঁচে যায় সে। শুধুমাত্র।
নিজেকে আবিষ্কার করে এক মাছ শিকারি জেলের ঘরে। ফিরোজ।

সারারাত মাছ ধরে বাড়ি ফিরছিল সে। সকালে সুর্য উঠার ঠিক আগ মুহুর্তে। ফিরোজকে পরে থাকতে দেখে সে, নিথর হয়ে। নদীর ঘাটে। ফিরোজের শরীরের অর্ধেক অংশ ছিল পানিতে। পেট থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই পানির উপরে। শুকনো কাদায়। সারা শরীর সরীসৃপের মতো দেখাচ্ছিল। পা দুটো পানিতে। কোমর থেকে বাকি সবটা। নদীর পানির শান্ত ঢেউয়ের সাথে যেন খেলা করছে।

যে কারো চোখ গোলক ধাঁধায় পরে যাবে। আচমকা চোখে পড়া মাত্রই। নদীর পানিতে ভেসে আসা ফিরোজকে দেখে বিশ্বাস করবে না কেউ। মানুষ হতে পারে সে। নিজেকে বোকা প্রমাণ করতে চাইবে না যে কেউ। মানুষ ভেবে।

কোন জলজ প্রাণী ডাঙায় এসে বিপদে পড়েছে। নিঃসন্দেহে ধরে নিবে সবাই। বেঁচে ফেরার জন্য চেষ্টা করছে। আপ্রাণ। পা গুলো নড়তে দেখে মনে হবে অনেকের। কাছে এসে নিজের ভুল বুজতে দেড়ি হবে না। কাছে থেকে দেখে। কিন্তু জীবিত নাকি মৃত বোঝার সুযোগ নেই কোন। অল্প একটু সময় লাগবে পুরোপুরিভাবে বুঝতে।

ফিরোজের প্রাণ বাঁচানো জেলে এমন দিধায় পড়েছিল প্রথম থেকে।
বুকে মাথা রেখে হৃদ স্পন্দন বুঝতে চেষ্টা করে। জীবিত নাকি মৃত নিশ্চিত হতে। সফল হয় জেলে। হৃদ স্পন্দন সচল। কিছুটা কম। পেটে চাপ দিয়ে। ফুসফুসের পানি বের করে জেলে। হৃদ স্পন্দন আগের থেকে স্বাভাবিক হয়। কিছুটা। জ্ঞান ফিরেনি এখনও। তবে বেঁচে আছে।

কয়েকজন জেলেকে ডেকে আনে। সে। বাড়ী নিয়ে আসে তাদের সহযোগিতায়। ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে, শুকনো কাপড় পড়িয়ে দেয়। অন্য দুজন জেলে। গরম বিছানা পেতে দেয়। গরম বিছানা পেতে জেলে ঘরে শুতে দেয় ফিরোজকে। তখনও জ্ঞান ফিরেনি তার।

রসুনের সাথে সরিষার তৈল মিশিয়ে গরম করে আনে, জেলে বৌ। ভাতের ফেনের মতো ফেন আসা গরম রসুন তৈল। দ্রুত শরীর গরম কররা মহৌষধ। গ্রামাঞ্চলে আজও প্রচলিত এ পদ্ধতি।

সারা শরীরে মালিশ করে দেয় জেলে এবং তার ছেলে। ফিরোজের শরীরে। আন্তরিক চেষ্টায়, যত্নে বেঁচে যায় ফিরোজ। সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে জেলে পরিবারের প্রতি,ফিরোজ।

কিন্তু তাকে ধুকে ধুকে মরতে হচ্ছে, প্রতিনিয়ত। আজবদি। পিছনে ফেলে আসা দিনগুলো কুরে কুরে খাচ্ছ তাকে। সারাক্ষণ।

এই ভেবে ঘুমায় সে প্রতিরাতে- “সকাল বেলায় ঘুম থেকে জেগে দেখবে, সবকিছু আগের মতো আছে। আগের রাতের ভাবনা গুলো সব দুঃস্বপ্ন ছিল। একটা মস্তবড় ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।

জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে বেঁচে থাকতে, তাকে বীরের মতো লড়তে হচ্ছে। আজ পর্যন্ত। তার অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। সবকিছুতে। সে একজন লড়াকু সৈনিক এখন।

হাত পেতে ভিক্ষা নিতে লজ্জা হয়না, এখন তার। অভ্যাস হয়ে গেছে। লজ্জা পেত সে শুরুর দিকে। কেউ কিছু দিয়ে গেলে মুখ লুকাতে হতো। কোন রিড়ম্বনা মনে হয়না এখন তার কাছে। ফিরোজের ইচ্ছা ছিল কাজ করে পরিশ্রম করে রোজগার করবে। প্রথম দিকে। সকল প্রকার কাজ জানা ছিল তার। পরিশ্রম করার মন মানসিকতা ছিল সব ক্ষেত্রে।

কাজের খুঁেজ মানুষের দারে দারে ঘুরেছে সে। পায়নি। কেউ তাকে কাজ দেয়নি কোন প্রকারের। অবিশ্বাস করেছে সবাই। অনেক সময় অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে।

অপরিচিতদেরকেউ বিশ্বাস করেনা এসমাজে। মুখ থুবরে পরে থাকলে পাশে এসে দাড়াবেনা কেউ। কখনও। পিছে ভয় হয় বলে। অনেক কিছু নিয়ে। এটা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত একটি ধারা। বহুকাল ধরে চলে আসছে।

অপরিচিত ফিরোজকে কাজ দিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার মতো কেউ নেই। এসমাজে হয়তো। একজনও নেই খুঁজে পাবেনা কেউ শত চেষ্টায়। এমন নির্বোধ মহৎ লোক। শারীরিকভাবে খেটে খাওয়ার মতো কোন কাজ লিখা নেই ফিরোজের ভাগ্যে। হয়তো। নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচার মতো সামনে পরেনি তার। সে সময়ে।

ঢাকাগামী ট্রেনের ছাদে করে ময়মনসিংহ আসে ফিরোজ। বিনা টিকিটে। টিটির চোখে ফাঁকি দিয়ে আসতে হয়। এশহর তাকে ছাড়তে চায়নি। এলোমেলো শহর আরও এলোমেলো হয়ে যায়। এশহরের ছোঁয়ায়। ফিরোজের। এখানে কোন কোন কাজ পেয়ে যাবে। ভেবেছিল ফিরোজ। ভুল ছিল ধারনা। সম্পূর্ণ। শহরের মানুষেরা কাজ করে প্রতিযোগিতা করে। এশহরে কাজের বড় অভাব। গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। কিছ একটা যদিও জুটে যায়, শত চেষ্টায়। সবার জন্য হয়না প্রজোয্য। কখনও। ফিরোজ হয়তো সেই অভাগাদের কেউ একজন। অপরিচিত নতুন এলাকায় কিছু করা সহজ নয়। এতোটা। এটা হয়তো আগে থেকে ভেবে দেখেনি সে। এতোটা সহজ করে। টাকা দুইদিন দুইরাত না খেয়ে আছে সে। ক্লান্ত শরীর। অনেক বেশি। ঘুম আসেনি চোখে অভুক্ত পেটে। এ কদিন।

শুয়ে বিশ্রাম নেয়ার মতো কোন জায়গা পায়নি। ঘুরে বেড়িয়েছে সারাক্ষণ। এদিক ওদিক। অভুক্ত পেট, নির্ঘুম চোখ, শরীরটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি ছিলনা। পা দুটোতে। অবশিষ্ট শক্তিটুকো ছিলনা।

ট্রেন থেকে পা বাড়িয়ে সাহস করে নেমে যায়। কোন মতে। ফুট ওভার ব্রীজের শিড়ির পাশে বসে পরে। আর হয়তো সামনে যাওয়া সম্ভব নয় । তার পক্ষে।

নিজের বাহুকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পরে। বসে থাকতে পারছিলনা, হয়তো। কষ্ট হচ্ছিল অনেক বেশি। গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে। শীত নিবারনের চেষ্টা করছিল। ব্যর্থ সে চেষ্টা। খালি শরীরে।

প্রকৃতিতে এখন শীত আসেনি। আসার সময় খুব একটা দুরে নয়। চারপাশ থেকে আসা, শরীরে বয়ে যাওয়া হীমেল হাওয়া জানান দিচ্ছিল। এই বুঝি শীত আসছে। আর অল্প ক‘টা দিন অপেক্ষা।

কোন প্রকার কাঁতা কম্বল ছাড়া নিজের শরীরের ময়লা জামাগুলো সম্বল করে শুয়ে থাকে। ফিরোজ। যে কারও দেখে মনে হবে যবুথবু হয়ে শুয়ে আছে এক রোগ্ন ভিখারী। তার কেউ নেই। বাড়ী নেই। ঘর নেই। এবারের শীত বুঝি তাকে আর রেখে যাবে না।

নভেম্বর মাস শেষ হতে চলেছে তখন। প্রায়। নিজের এবং পরিবারের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে সবাই। শীতের কেনাকাটা। গরম কাপড় কেনাকাটার ধুম। কেউ ব্যস্ত হয়ে আছে, নিজেকে নিয়ে নয়। গরীব দুখিদের মতো অসহায়দের নিয়ে। তাদের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ করতে হবে। শীত আসার আগেই। এই রেল ষ্টেশনে পা রাখে যে সন্ধ্যায়, ফিরোজ। প্রথম। সে রাতে একদল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী শীত বস্ত্র বিতরণ করতে আছে ষ্টেশনে। এদের সবাই এশহরে বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করে। কোথাও না কোথাও মেচ ভাড়া করে থাকে। শহরের মধ্যে। বাড়ী থেকে টাকা এনে নিজের খরচ চালাতে হয়। সে টাকা থেকে অল্প পরিমাণ টাকা বাঁচিয়ে রাখে তারা। আর্ত মানবতার কল্যাণে খরচ করবে বলে। এমন মহৎ ছেলে মেয়েদের তুলনা কারও সাথে হয়না। সৃষ্টি কর্তার দয়ার সাগরের বিন্দু পরিমাণ এদের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়েছেন। দুনিয়াতে। তাই এমন ছেলে মেয়েরা সবসময় মানব কল্যাণের কথা চিন্তা করে। দুখিদের মুখে হাসি ফুটাতে চায়। এদের সবাই নিরিহ বাবা মার সহজ সরল ছেলে মেয়ে। নিজের স্বার্থ বলতে নেই এদের কাছে।

মাহদি নামের এক তরুনের চোখ পরে ফিরোজের দিকে। আতকে পরে তার মায়ায়। চোখ দুটো মাহদির। জলে ভরে ছলছল করছিল দুটো চোখ তার। ফিরোজের যবুথবু হয়ে শুয়ে থাকা দেখে। শীত নেই তবুও শীতে কাঁপছে। টক টক করে। এ যেন মাঘের শীতের সবটা শীত মাঘের আগেই চলে আসছে ফিরোজের শরীরে।

একটা কম্বল বাড়িয়ে দেয় ফিরোজের দিকে। সে। হাত বাড়িয়ে নেওয়ার শক্তিটুকুও ছিলনা তার। মাহদি নিজ হাতে গায়ে জড়িয়ে দেয়। কম্বলটা। অনুভব করে প্রচন্ড জ্বর শরীরে। এখনি যেন তার গা জ্বরের ত্যাজে পুড়ে যাবে, ছাই হয়ে যাবে সারা শরীর। এমন অবস্থা ফিরোজের।

ফিরোজের গায়ে হাত রেখে জ্বরের তীব্রতা অনুভব করতে চেষ্টা করে মাহদি সহ আরও কয়েকজন। থমকে উঠে সে। এমন জ্বরের তীব্রতা নিজ হাতে অনুভব করেনি কখনও। হয়তো। নিঃশ্চুপ হয়ে আছে ছেলে গুলো। কি করতে হবে ভেবে পাচ্ছে না এই মুহুর্তে। শিহাব, নিশাত, হিমেল, ইরা সবাইকে ডেকে আনে কাছে। পরামর্শ করতে চেষ্টা করে । কি করবে এখন। সিদ্ধান্ত হয়। চিকিৎসা করাবে তারা। তাই করা উচিত। মতামত দেয় সবাই। আজ রাতেই করতে হবে যা করার।

শিহাবের ভিন্ন মত। সে আপত্তি করে- ওর গায়ে শুধুমাত্র জ্বর আসছে। যদিও একটু বেশি। আমরা বরং জ্বর সর্দ্দির কয়েকটা ট্যাবলেট এনে দেই। খাবার কিনে দিয়ে যাই। ইনশাল্লাহ জ্বর নেমে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই। কিছু পরিমাণ টাকা দিয়ে যেতে পারলে মন্দ হতো না। সেটা পরে দেখব আমাদের সামর্থ অনুযায়ী। কাল একবার এসে দেখে যাব। এ দায়িত্ব আমার উপর থাকুক। জ্বর না কমলে বিকল্প কিছু করতে পারি তখন। তার চিকিৎসা করব আমরা অবশ্যই।

সবার থেকে টাকা তোলা হয়। এখানে যারা আসছে। সবাই দেয় কম বেশি টাকা নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী। অনেক টাকা উঠে। হিমেল ঔষধ আনতে যায়। মাসুদ খাবার নিয়ে আসে। আপন চাঁদার টাকা তাদের হাতে দিয়ে পাঠায়। ইরা নিজ হাতে মুখে তুলে খাওয়ায় ফিরোজকে। ঔষধ খেতে দেয়। তিন দিনের অভুক্ত ফিরোজ পাগলের মতো খাওয়া শেষ করে। অবাক হয় সবাই। বাকী টাকাগুলো ফিরোজের হাতে দিয়ে যায়। আপন। শুয়ে থাকে ফিরোজ। এখন হয়তো ঘুমটা ভাল হবে তার। ঘুমাবে এখন সে। ছাত্রদের উদারতা দেখে মুগ্ধ হয়েছে ষ্টেশনে আসা অনেক যাত্রী। সকল ভ্যান যাত্রীরা উৎসাহের সাথে ফিরোজকে টাকা দিচ্ছে। অল্প কিছু খাবার কিনে দিয়েছে। অনেকেই। তার চার পাশে বিশাল দোকানের মতো খাবার জমে গেছে। অল্প সময়েই।

ফিরোজের চার পাশে ভিক্ষুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরও অনেক। বাচ্চা ভিক্ষুক, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ভিক্ষুক। ঘুরে বেড়ায় ফিরোজের চার পাশে। তামাশা দেখছে তারা। যাকে দেখছে হাত পাতছে। হাত জোর করে ভিক্ষা চাইছে। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই কারও সেই দিকে। ফিরোজকে নিয়ে পরে আছে সবাই। ঘন্টা দুইয়ের ব্যবধানে ফিরোজ এখন সকল কিছুর শিরোনাম।
ফিরোজের মুখে দ্বিতীয় বারের মতো খাবার তুলে দেয়। মধ্য বয়সী এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। ফিরোজ হয়তো ঘুমিয়ে গেছিল। এই সময়ে। ডেকে তোলে ভদ্রলোকের সাথে থাকা এক লোক। পাতি নেতা টাইপের কিছু একটা হবে। সে।

রাজ্যের বিরক্তি মুখে এনে হা করে খাবার তুলে নেয়। ফিরোজ। আবার শুয়ে পরে সে। পাতি নেতা টাইপের লোকটার প্রতি ভিষন রকমের রাগ হয় মধ্য বয়সী ভদ্রলোক। কেন সে আরেকটু সময়, ধরে রাখতে পারেনি। মুখে যা আসছে তা বলেই ধমকাচ্ছে। ভদ্রলোকের ব্যবহার যে এতো খারাপ হতে পারে এখানে কারও ধারনা ছিলনা। পাতিনেতা টাইপের লোকটা সবকিছু নীরব হয়ে শুনছে।

তার এই ভাল মানসী আচরণের আড়ালে লোকিয়ে আছে, মস্ত বড় একটা শয়তান জানুয়ার। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না সে কথা।

এক বয়স্ক বৃদ্ধ ভিক্ষুক মহিলা ভদ্রলোক বেচারার হাতে চুমু খেতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল“ বাবা তুমি মানুষ নও ফেরেশতা। পুরোটা বলে শেষ সুযোগ হয়নি তার। সে শুধু বলেছিল বাবা তুমি মানুষ নও” এটুকু বলাতে ভদ্রলোক বুড়ি বেচারার গালে একখানা ভদ্র থাপ্পর বসিয়ে দেয়। বুড়ির কথায় কি বুঝেছে সে, জানানেই বুড়ির। সে সাথে ভদ্রলোকদের একটা জনপ্রিয় গালি সালা ছোটলোকের বাচ্চা।ভদ্রলোক মহোদয় এখান থেকে কেটে পরে।

এতো তাড়াতাড়ি একজন ভাল মানুষের বদলে যাওয়া রূপ দেখে খুব একটা অবাক হয়নি সে। তার চোখে মুখে অবাক হওয়ার চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। আগের মতোই স্বাভাবিক সে। এমন মুখোসধারী ভদ্র আচরণের সাথে আগে থেকেই পরিচিত ভিক্ষুক বুড়ি। হয়তো। সে শুধু তার গালে হাতটুকু চেপে ধরে রাখে। অল্প সময়। পরক্ষণেই চোখ মুছে ফেলে অন্যদিকে ভিক্ষা করতে ভিরের মাঝে হারিয়ে যায়।

বাঙ্গালী প্রসারে নয় প্রচারে বিশ্বাসী। যে করেই হোক নিজের প্রচারনা করা চাই। কেউ করতে না আসলে সমস্যা নাই। নিজেকে নিজেই প্রচার কাজে নিয়োজিত করতে হবে। প্রচারের যুগে প্রচারনার কাজে টিকে থাকতে হবে। প্রচার করে।

ফিরোজের আজ এতো কদর। তার প্রতি মানুষের এতো ভালবাসা! এমনকিছু সে জীবনেও হয়তো কল্পনা করেনি।

দান দিতে আসা ছেলেদের হাতে ক্যামেরা ছিল। তাই আজ ফিরোজের প্রতি এতো ভালবাসা। এতো অচেনা মানুষের। ফিরোজের আজ অভাব নেই। অন্যের ভালবাসার। ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আছে সে।

একেকজন বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাড়িয়েছে, ক্যামেরার সামনে। খুব আগ্রহ সহকারে ফিরোজের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যেকে। ছবি তোলা হচ্ছে। ছবি তুলবে বলে। নিজের টাকায় খাবার কিনে দিয়েছে ফিরোজকে। অনেকেই। দেওয়ার সময় ঠিকঠাক মতো ছবি তুলতে হবে। গুরুত্বের সাথে। একটু এদিক সেটিক হলে চলবে না। আগে থেকেই বলে রেখেছে উৎসাহিত কয়েকজন। ফটোগ্রাফার মিমলা কে। ছবি গুলো নেওয়ার মতো কোন আগ্রহ দেখা গেল না কারও মাঝে। ছবি গুলো কোথায় যাচ্ছে। কোথায় যাবে। এমন প্রশ্ন কারও মধ্যে নেই। উত্তর জানার কোন আগ্রহ নেই কারও মাঝে। বিন্দু পরিমাণটুকু ছবি তুলতে কোন অলসতা নেই, মিমলার। যে যেভাবে বলছে সেভাবেই ক্লিক করে যাচ্ছে। একের পর এক। ক্যামেরার বাটনে।

অনেক টাকা হয়েছে ফিরোজের। একরাতে। গতরাতে শরীরে আসা, জ্বরটা নেমে গেছে এখন। সকালের মিষ্টি রোদে বসে আছে সে। শরীরে রোদের তাপ নিচ্ছে, তার। আজ তাকে অনেক সতেজ ও ফুরফুরা দেখাচ্ছে।

বোঝার অপেক্ষা রাখেনা, টাকায় সব মিলে। মনের শান্তি পর্যন্ত। শরীরের সতেজতা।

সকালের নাস্তাটা সেরে নিয়েছে, এই সময়ে। গরম ধোয়া উঠা দুধ চা, সাথে বন রুটি। তুলনাহীন নাস্তা। অন্যকিছুর সাথে। রুটি শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দেয় এখন। চুও-ওপ-চু-ওপ করে লম্বা শব্দে টান দেয় চায়ের কাপে।

মন যখন ভাল থাকে শব্দ করে চা খেতে ভাল লাগে খুব। আরও বেশি লম্বা এবং আরও বেশি শব্দ করে শেষ চুমুক দেয়, ফিরোজ। চায়ের কাপে। চা শেষ। কাপটা ফেরত পাঠিয়ে দেয় দোকানের ছেলেটাকে ডাক দিয়ে। ফিরোজের ডাক শুনে দৌড়ে আসে দোকানের ছেলেটা। ফিরোজের অনেক কদর এখানে আজ। ফিরোজ অনেক টাকা ওয়ালা আজ। সব দোকানিরা জেনে গেছে সে কথা। তার ডাকের আগে আগে থাকতে চায় সবাই। চাওয়া মাত্রই যে কোন কিছু নিয়ে আসে। কাপ ফেরত নিয়ে যায় সে। সাথে সাথে বিল পরিশোধ করে দেয়। ফিরোজ। হাসি মুখে বিদায় হয়। যাওয়ার আগে ফিরোজকে বলে যায়- যে কোন দরকারে এই কেরামতকে ডাক দিবেন মামা। আমি হইছি নেত্রকোণার পুলা। সবকিছু আমার জানা। থাকব আমি আপনার হুকুম আসার অপেক্ষায়। চোখে মুখে ক্লান্তির কোন লেশ নেই তার। বিন্দু মাত্র। রাতের টাকা গুলো আরও একবার গুণে দেখা দরকার। মনে মনে বলে ফিরোজ। এর আগে তিনবার গুণেছে। এখন নিয়ে হবে চারবার। বার হাজার পাঁচশত ত্রিশ টাকা ছিল। এখন আছে বার হাজার পাঁচশত বিশ টাকা। দশ টাকা খরচ। চা রুটি খেয়ে। পরিষ্কার হিসাব। টাকা গুলো কোমড়ে গুজে রাখে গুণার পর। মনে মনে একটু হেসে নেয় সে।

একজায়গায় বসে থাকতে ভাল লাগছে না তার। আর একটু হাটা চলা দরকার। রাত থেকে এক জায়গায় শুয়ে আছে এখানে। এক ঘুমেই রাত পার। সকালে উঠে বসেছে শুধুমাত্র। জায়গা থেকে নড়েনি এখনও।

ষ্টেশনটা দেখতে হবে একটু ঘুরে ফিরে। একটু খুজ খবর নিলে মন্দ হয়না। চেনা জানা থাকা ভাল।

গতরাতের একমাত্র সম্বল, কম্বলটার এখন আর দরকার নেই কোন। ফেলে দিলে মন্দ হয়না। হাতগুলো বিশ্রাম পাবে একটু। আগামী রাতের কথা ভেবে, ভাজ করে বগলের নিচে গুজে নিয়েছে সে। কম্বলটা। হাত একটু কষ্ট পাবে। পাক। কোন সমস্যা নেই এতে। শরীরটা তো আরাম পাবে সারারাত ভরে। শরীরের আরাম অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের আরামের জন্য অনেকেই অনেক কিছু করতে রাজি। করছেও তাই।

যেখানেই রাত আসুক শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে। কম্বলটা কষ্ট করে সাথে রাখলে। একটা আরামে ঘুম হবে। সারারাত ধরে। শীত ধারে কাছে ঘেষার কোন দুঃসাহস করবে না। এক ঘুমেই রাত পার। সকালে ঘুম ভেঙ্গে সুন্দর সকাল দেখা যাবে। সুন্দর সকাল উপভোগ করতে হলে, রাতে ভাল ঘুমের বিকল্প নেই। কিছু। ষ্টেশনের পুরোনো ভিক্ষুকগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফেলফেল করে হাসছে। দাঁত খেলিয়ে। ফিরোজের মুঠেও ভাল লাগছে না। সকাল সকাল এমন উপহাস দেখতে।
এখানে বসে, শরীর চুলকানো মতো কোন কিছু দেখার ইচ্ছা নেই তার।

কলেজ পড়ুয়া ছেলেগুলোকে ধন্যবাদ দিয়েছে বেশ কয়েকবার। মনে মনে। সামনাসামনি ধন্যবাদ দিবে আরেকবার। মনে মনে ঠিক করে রাখে সে।

কলেজ পড়ুয়া সেচ্চাসেবী ছেলেগুলো, সে রাতে উপকার করেছে। সত্যিই। অনেক উপকার। পাশে দাঁড়িয়ে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফিরোজের দিকে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের সে চেষ্টাকে বিফলে দেননি। ছেলেগুলোর উছিলায় সুস্থ হয়েছে আজ। কর্মক্ষমতা ফিরে পেয়েছে এখন। এটাই যেন ফিরোজে জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছু করে অর্থ উপার্জন করার থেকে কিছু না করে অর্থ উপার্জনের পথে পরিচিত হয়ে গেছে সে। এক রাতে। টাকা গুলো শেষ হওয়ার পরে হাত পেতে দিতে শুরু করে। এক সময় অভ্যাস হয়ে যায়। এটা পেশা হয়ে গেছে এখন তার। ফিরোজ এখন ভিক্ষা করে সে একজন ভিক্ষুক।

শুধু নিরবে একা বসলে, ভাবনার জগতে তার পুরোনো স্মৃতিগুলো এসে ভীড় করে। এখন। ভাবনার জগতে প্রবেশ করে স্মৃতিচারণ করে মনের অজান্তে।
মর্জিনার রান্না শেষ হয়েছে। এতক্ষণে। ফিরোজকে ডেকে বলে সে, খেতে আসতে। অতীতের কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে সে। স্ত্রীর ডাকে। ফিরোজ শুধু স্ত্রীর দিকে তাকায় কোন কথা বলে না। চোখ দুটো পানিতে ছল ছল করছে। ঘর অন্ধকার থাকায় মর্জিনা বুঝেনি কিছু।

মুখে অশ্লিল গালিটা নেই এখন আর। সে শুধু নিচু গলায় বলে- আইতাছি। হাত মুখ ধুয়ে আইতাছি।