8:53 pm, Sunday, 22 December 2024

সময়ের অগ্রবর্তী ও অদম্য সাহসী বেগম রোকেয়া

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:৫০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 78 ভিউ
শেয়ার করুন

কোনো নারী যখন পিতৃতন্ত্রের পাহারাদারি করে, তখন সমাজ কথিত অবলা নারীও কী যে প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে তার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ঔপন্যাসিক আশাপূর্ণা দেবীর ‘ট্রিলজি’ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুবর্ণলতার শাশুড়ি মুক্তকেশী বামুনী। মুক্তকেশী এক সাধারণ বিধবা নারী। উপন্যাসের কাহিনি যে সময়ের, সেই সময়ে বিধবা নারী হচ্ছে পরিবার, সমাজ—সর্বত্র অপাঙক্তেয়। (অবশ্য এখনো যে সর্বত্র এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, তা-ও নয়!) কোনো শুভ কাজের পাশে বিধবার স্থান নেই, যা ওই উপন্যাসের মাঝেই আছে; যেমন—মুক্তকেশীর বালবিধবা নাতনিকে দরজা আটকে রাখা হয়, যাতে সে তার অপর নাতনির বিয়ের অনুষ্ঠানের সামনে চলে না আসে।

আর শুধু তা-ই নয়, এমনকি শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত ওই বিধবা নাতনিকে যখন তার হাড়বজ্জাত কাকা ঘর থেকে বের করে দেয়, তখনো এক সুবর্ণলতা ছাড়া কেউ প্রতিবাদ করেনি। অথচ মুক্তকেশী নিজে বিধবা নারী হলেও সংসারের মাথায় থেকে সবার ওপর ছড়ি ঘোরায়। সংসারে তার কথাই শেষ কথা। তার বিচক্ষণ বড় ছেলে সব বুঝেও মায়ের কথার প্রতিবাদ করতে পারে না।

আসলে সংসারে মুক্তকেশীর এই প্রবল প্রতাপের মূলে ছিল পিতৃতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম আনুগত্য। সে ছিল এর প্রবল ধারক, যা তার ক্ষমতার উৎসও বটে। সে সব সময় তার পুত্রবধূ সুবর্ণলতা ও তার মা সত্যবতীকে ব্যভিচারী বলে গালাগাল করে। কারণ তারা নারীর প্রতি পিতৃতন্ত্রের অন্যায় নির্দেশ অমান্য করে।

পিতৃতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে একজন নারী যেরূপ ক্ষমতাধর হয়ে যায়, তেমনটি ঘটে ধর্মের বেলায়ও। আমাদের আশপাশেই দেখতে পাই একেবারে চরম অশিক্ষিত, হতদরিদ্র, এমনিতে সমাজে যাকে কেউ পোছে না, তেমন কেউও যদি ধর্ম রক্ষার স্বঘোষিত পাহারাদার বা পাইক-বরকন্দাজ হিসেবে আওয়াজ তোলে, তখন তার আহ্বানে সাড়া দিয়েই রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যায়। এমনকি তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় সমাজ ও রাষ্ট্র। হাল আমলে তো কেবল ধর্ম রক্ষার স্বঘোষিত পাহারাদার অনেক ভ্রষ্ট দুরাচারের মুখের কথায়ই ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বহু নির্দোষ মানুষের দিন কাটছে কারান্তরালে। কিন্তু এসব অনাচারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারে সে রকম এখন আর কেউ নেই।

শতাব্দীকাল আগেও একজন নারী কী দুরন্ত সাহস দেখিয়েছিলেন নারীর প্রতি সংঘটিত সব অনাচার আর বিরাজমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন পিতৃতন্ত্র কিভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে পিছিয়ে রেখেছে, শোষণ করেছে। তিনি তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন নারীকে পিছিয়ে রাখা মানে কেবল নারীকে পিছিয়ে রাখা নয়। এটা প্রকারান্তরে গোটা মানবসমাজকে, মানবসভ্যতাকে পিছিয়ে রাখা। বলেছেন, সমাজদেহের দুটি চাকার একটি নারী। তাই নারীকে পিছিয়ে রেখে আরেকটি চাকা এগিয়ে যেতে পারে না। তিনি রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। তাঁকে বলা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত। কিন্তু তাঁকে শুধু নারী জাগরণের অগ্রদূত বললে যেন একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা হয়। মূলত তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। নারী জাগরণ বললে মনে হয় যেন এটা শুধুই ঘুমন্ত নারীদের জাগিয়ে দেওয়ার একটা কাজ। কিন্তু কেবল জাগিয়ে দিলেই কি কেউ জেগে ওঠে বা জেগে থাকে? আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কথা আমরা অনেকেই জানি। পিতৃতন্ত্রও ধর্মের আফিম খাইয়ে নারীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। এরূপ ঘুমন্তদের জাগিয়ে দিলে কী হবে? তাদের আবার আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে, যেমন এখনো রাখা হচ্ছে।

নারী জাগরণের ডাক রোকেয়ার আগে অনেকেই দিয়েছিলেন, অনেক নারী জেগেও উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁদের জেগে থাকতে দেওয়া হয়নি। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের ভয় তাঁকে বিষণ্ন করে। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া সাখাওয়াতের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তোলন করিতে চাহিয়াছেন, তখনই শাস্ত্র ও ধর্মের বচনরূপ হাতুড়ি দিয়া তার মস্তক চূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।’ সমাজ সংস্কারক রোকেয়া তাই মানুষের মনের জঞ্জাল পরিষ্কারের কাজে হাত দিয়েছিলেন। যে আফিম খাইয়ে নারীকে ঘুম পাড়ানো হয়, সেই আফিমগাছের মূল উৎপাটনের জন্য বারবার নারীর শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন একমাত্র সুশিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের মন থেকে সব কুসংস্কার, সব ক্ষুদ্রতা ও নীচু ভাবনা দূর করা সম্ভব।

রোকেয়া আরো বলেছেন, ‘কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও, উহারা নিজেরাই অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করিতে পারিবে।’ কেননা কেবল দুমুঠো ভাতের জন্যও নারীকে যে কত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়, সেটা তিনি দেখেছিলেন। অথচ এই ভাত-কাপড়ও নারীকে কেউ মাগনা দেয় না। দিনরাত খেটে পাওয়া সামান্য ভাত-কাপড়ের জন্য তাকে উঠতে-বসতে খোঁটা শুনতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর গৃহশ্রমের যে কোনো মূল্য নেই, তা দূরদর্শী রোকেয়া বুঝেছিলেন বলেই কন্যাদের সুশিক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বী করার পরামর্শ দিয়েছেন। নারীশিক্ষা, নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার কথাও রোকেয়ার আগে অনেকে বলেছেন, কিন্তু রোকেয়াই একমাত্র সমতার কথা বলেছেন। আজ আমরা জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে অনেক কথা বলি, কিন্তু তিনি সে কথা বলে গেছেন ১০০ বছর সময়েরও আগে। তাঁর রচিত ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস, ‘মতিচূর’, ‘অবরোধবাসিনী’ প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি অনুচ্ছেদ ও প্রতিটি ছত্রে তিনি সমতার কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘যাহা যাহা  পুরুষ করিতে পারিবে, নারীও তাহাই পারিবে। সে জন্য তাহারা আশা প্রকাশ করিয়াছেন, একদিন আমরা লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি বৈমানিক, লেডি ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, মোক্তার সব হইব।’ মহীয়সী রোকেয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে আজ আমরা সব হয়েছি। আর যে আকাঙ্ক্ষার কথা; যেমন—রাষ্ট্র পরিচালনার কথা তিনি উচ্চারণ করেননি, তা-ও হয়েছে। কিন্তু সমতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। বৈষম্য কিছুটা কমেছে, তবে বিলোপ করা যায়নি। কারণ তাঁর আরব্ধ সমাজ সংস্কারের কাজ থমকে গেছে। ধর্মের কথা বলে নারীকে মোড়কজাত করা হয়েছে বা নারী নিজেই মোড়কের ভেতর ঢুকতে পছন্দ করে। ভোগবাদী ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে যখন ব্যক্তিত্বের বিকাশের পরিবর্তে মাতৃত্বের আবেগে তাড়িত কিংবা জ্ঞানের চর্চার থেকে দেহসজ্জার প্রতি বেশি অনুরাগ, যা সাধারণত অন্যের মনোযোগ আকর্ষণে বা অন্যের মনোরঞ্জনে ধাবিত করে, তখন সমতার আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়। সে জন্য সময়ের থেকে অনেক বেশি অগ্রসর রোকেয়া আজ থেকে ১০০ বছরের বেশি সময় আগে যা ভেবেছিলেন, আমরা এখনো তা ভাবতে পারি না।

কিন্তু আমাদের তা ভাবতে হবে। ১২০ বছর আগে রাতের নির্জনতায় পিতৃতন্ত্রের রক্তচক্ষুর অন্তরালে মোমবাতির আলোয় অধীত বিদ্যা শিক্ষার আলোকে যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন, যে জ্ঞানের আলোয় তিনি সমাজের অন্ধকার দূর করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, অনেক পথনির্দেশনা দিয়ে গেছেন অথচ আজ যখন চারদিকে এত আলোর বন্যা তার মাঝেও আমাদের ভেতরে পুঞ্জীভূত হয়েছে গাঢ় অন্ধকার। সে অন্ধকার ঘোচাতে হলে অনুসরণ করতে হবে রোকেয়া সাখাওয়াতের নির্দেশিত পথ।

স্বাতী চৌধুরী  : কথাসাহিত্যিক ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ,ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা

 

#
জনপ্রিয়

সময়ের অগ্রবর্তী ও অদম্য সাহসী বেগম রোকেয়া

আপডেটের সময় : ০৭:৫০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

কোনো নারী যখন পিতৃতন্ত্রের পাহারাদারি করে, তখন সমাজ কথিত অবলা নারীও কী যে প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে তার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ঔপন্যাসিক আশাপূর্ণা দেবীর ‘ট্রিলজি’ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুবর্ণলতার শাশুড়ি মুক্তকেশী বামুনী। মুক্তকেশী এক সাধারণ বিধবা নারী। উপন্যাসের কাহিনি যে সময়ের, সেই সময়ে বিধবা নারী হচ্ছে পরিবার, সমাজ—সর্বত্র অপাঙক্তেয়। (অবশ্য এখনো যে সর্বত্র এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, তা-ও নয়!) কোনো শুভ কাজের পাশে বিধবার স্থান নেই, যা ওই উপন্যাসের মাঝেই আছে; যেমন—মুক্তকেশীর বালবিধবা নাতনিকে দরজা আটকে রাখা হয়, যাতে সে তার অপর নাতনির বিয়ের অনুষ্ঠানের সামনে চলে না আসে।

আর শুধু তা-ই নয়, এমনকি শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত ওই বিধবা নাতনিকে যখন তার হাড়বজ্জাত কাকা ঘর থেকে বের করে দেয়, তখনো এক সুবর্ণলতা ছাড়া কেউ প্রতিবাদ করেনি। অথচ মুক্তকেশী নিজে বিধবা নারী হলেও সংসারের মাথায় থেকে সবার ওপর ছড়ি ঘোরায়। সংসারে তার কথাই শেষ কথা। তার বিচক্ষণ বড় ছেলে সব বুঝেও মায়ের কথার প্রতিবাদ করতে পারে না।

আসলে সংসারে মুক্তকেশীর এই প্রবল প্রতাপের মূলে ছিল পিতৃতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম আনুগত্য। সে ছিল এর প্রবল ধারক, যা তার ক্ষমতার উৎসও বটে। সে সব সময় তার পুত্রবধূ সুবর্ণলতা ও তার মা সত্যবতীকে ব্যভিচারী বলে গালাগাল করে। কারণ তারা নারীর প্রতি পিতৃতন্ত্রের অন্যায় নির্দেশ অমান্য করে।

পিতৃতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে একজন নারী যেরূপ ক্ষমতাধর হয়ে যায়, তেমনটি ঘটে ধর্মের বেলায়ও। আমাদের আশপাশেই দেখতে পাই একেবারে চরম অশিক্ষিত, হতদরিদ্র, এমনিতে সমাজে যাকে কেউ পোছে না, তেমন কেউও যদি ধর্ম রক্ষার স্বঘোষিত পাহারাদার বা পাইক-বরকন্দাজ হিসেবে আওয়াজ তোলে, তখন তার আহ্বানে সাড়া দিয়েই রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যায়। এমনকি তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় সমাজ ও রাষ্ট্র। হাল আমলে তো কেবল ধর্ম রক্ষার স্বঘোষিত পাহারাদার অনেক ভ্রষ্ট দুরাচারের মুখের কথায়ই ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বহু নির্দোষ মানুষের দিন কাটছে কারান্তরালে। কিন্তু এসব অনাচারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারে সে রকম এখন আর কেউ নেই।

শতাব্দীকাল আগেও একজন নারী কী দুরন্ত সাহস দেখিয়েছিলেন নারীর প্রতি সংঘটিত সব অনাচার আর বিরাজমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন পিতৃতন্ত্র কিভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে পিছিয়ে রেখেছে, শোষণ করেছে। তিনি তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন নারীকে পিছিয়ে রাখা মানে কেবল নারীকে পিছিয়ে রাখা নয়। এটা প্রকারান্তরে গোটা মানবসমাজকে, মানবসভ্যতাকে পিছিয়ে রাখা। বলেছেন, সমাজদেহের দুটি চাকার একটি নারী। তাই নারীকে পিছিয়ে রেখে আরেকটি চাকা এগিয়ে যেতে পারে না। তিনি রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। তাঁকে বলা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত। কিন্তু তাঁকে শুধু নারী জাগরণের অগ্রদূত বললে যেন একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা হয়। মূলত তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। নারী জাগরণ বললে মনে হয় যেন এটা শুধুই ঘুমন্ত নারীদের জাগিয়ে দেওয়ার একটা কাজ। কিন্তু কেবল জাগিয়ে দিলেই কি কেউ জেগে ওঠে বা জেগে থাকে? আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কথা আমরা অনেকেই জানি। পিতৃতন্ত্রও ধর্মের আফিম খাইয়ে নারীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। এরূপ ঘুমন্তদের জাগিয়ে দিলে কী হবে? তাদের আবার আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে, যেমন এখনো রাখা হচ্ছে।

নারী জাগরণের ডাক রোকেয়ার আগে অনেকেই দিয়েছিলেন, অনেক নারী জেগেও উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁদের জেগে থাকতে দেওয়া হয়নি। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের ভয় তাঁকে বিষণ্ন করে। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া সাখাওয়াতের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তোলন করিতে চাহিয়াছেন, তখনই শাস্ত্র ও ধর্মের বচনরূপ হাতুড়ি দিয়া তার মস্তক চূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।’ সমাজ সংস্কারক রোকেয়া তাই মানুষের মনের জঞ্জাল পরিষ্কারের কাজে হাত দিয়েছিলেন। যে আফিম খাইয়ে নারীকে ঘুম পাড়ানো হয়, সেই আফিমগাছের মূল উৎপাটনের জন্য বারবার নারীর শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন একমাত্র সুশিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের মন থেকে সব কুসংস্কার, সব ক্ষুদ্রতা ও নীচু ভাবনা দূর করা সম্ভব।

রোকেয়া আরো বলেছেন, ‘কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও, উহারা নিজেরাই অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করিতে পারিবে।’ কেননা কেবল দুমুঠো ভাতের জন্যও নারীকে যে কত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়, সেটা তিনি দেখেছিলেন। অথচ এই ভাত-কাপড়ও নারীকে কেউ মাগনা দেয় না। দিনরাত খেটে পাওয়া সামান্য ভাত-কাপড়ের জন্য তাকে উঠতে-বসতে খোঁটা শুনতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর গৃহশ্রমের যে কোনো মূল্য নেই, তা দূরদর্শী রোকেয়া বুঝেছিলেন বলেই কন্যাদের সুশিক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বী করার পরামর্শ দিয়েছেন। নারীশিক্ষা, নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার কথাও রোকেয়ার আগে অনেকে বলেছেন, কিন্তু রোকেয়াই একমাত্র সমতার কথা বলেছেন। আজ আমরা জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে অনেক কথা বলি, কিন্তু তিনি সে কথা বলে গেছেন ১০০ বছর সময়েরও আগে। তাঁর রচিত ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস, ‘মতিচূর’, ‘অবরোধবাসিনী’ প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি অনুচ্ছেদ ও প্রতিটি ছত্রে তিনি সমতার কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘যাহা যাহা  পুরুষ করিতে পারিবে, নারীও তাহাই পারিবে। সে জন্য তাহারা আশা প্রকাশ করিয়াছেন, একদিন আমরা লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি বৈমানিক, লেডি ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, মোক্তার সব হইব।’ মহীয়সী রোকেয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে আজ আমরা সব হয়েছি। আর যে আকাঙ্ক্ষার কথা; যেমন—রাষ্ট্র পরিচালনার কথা তিনি উচ্চারণ করেননি, তা-ও হয়েছে। কিন্তু সমতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। বৈষম্য কিছুটা কমেছে, তবে বিলোপ করা যায়নি। কারণ তাঁর আরব্ধ সমাজ সংস্কারের কাজ থমকে গেছে। ধর্মের কথা বলে নারীকে মোড়কজাত করা হয়েছে বা নারী নিজেই মোড়কের ভেতর ঢুকতে পছন্দ করে। ভোগবাদী ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে যখন ব্যক্তিত্বের বিকাশের পরিবর্তে মাতৃত্বের আবেগে তাড়িত কিংবা জ্ঞানের চর্চার থেকে দেহসজ্জার প্রতি বেশি অনুরাগ, যা সাধারণত অন্যের মনোযোগ আকর্ষণে বা অন্যের মনোরঞ্জনে ধাবিত করে, তখন সমতার আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়। সে জন্য সময়ের থেকে অনেক বেশি অগ্রসর রোকেয়া আজ থেকে ১০০ বছরের বেশি সময় আগে যা ভেবেছিলেন, আমরা এখনো তা ভাবতে পারি না।

কিন্তু আমাদের তা ভাবতে হবে। ১২০ বছর আগে রাতের নির্জনতায় পিতৃতন্ত্রের রক্তচক্ষুর অন্তরালে মোমবাতির আলোয় অধীত বিদ্যা শিক্ষার আলোকে যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন, যে জ্ঞানের আলোয় তিনি সমাজের অন্ধকার দূর করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, অনেক পথনির্দেশনা দিয়ে গেছেন অথচ আজ যখন চারদিকে এত আলোর বন্যা তার মাঝেও আমাদের ভেতরে পুঞ্জীভূত হয়েছে গাঢ় অন্ধকার। সে অন্ধকার ঘোচাতে হলে অনুসরণ করতে হবে রোকেয়া সাখাওয়াতের নির্দেশিত পথ।

স্বাতী চৌধুরী  : কথাসাহিত্যিক ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ,ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা