3:24 am, Thursday, 19 September 2024

শৈশবের কথা : জয়নুল আবেদিন

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ০৭:০৮:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 72 ভিউ
শেয়ার করুন

যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ছবি আঁকতে শিখলাম কী করে? বা কার কাছ থেকে? তবে উত্তর দিতে পারব না। বলব, আমার দেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ আমাকে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এ দেশের আকাশ, বাতাস, নদী, মাঠ, বন– এখানকার মানুষের চলাফেরা, ওঠা-বসা, হাসি-কান্না আমাকে ছবি আঁকতে বলেছে।
ছেলেবেলাটা আমার কেটেছে ময়মনসিংহের বিভিন্ন ছোট ছোট শহরে। আমার আব্বা পুলিশে চাকুরি করতেন। সেই উপলক্ষে এ থানা থেকে সে থানা, এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম আমাদের ঘুরতে হতো। তাই দেখার সুযোগ পেয়েছি আমি অনেক।
ব্রহ্মপুত্রের ধারে ধারে ছেলেবেলায় খেলে বেড়াতাম। শীতের নদী কুলুকুলু করে বয়ে যেত। জেলেরা মাছ ধরত, মেয়েরা কাপড় কাচতো, কলসি ভরে পানি নিয়ে যেতো বাড়ি, যাত্রী এপার-ওপার করতো খেয়া নৌকার মাঝি। আমি তন্ময় হয়ে দেখতাম মানুষের এই আসা-যাওয়া। নদীর ওপারে ছিল ঘন বন, তাকালে দেখা যেতো দূরে নীল আকাশের কোল ঘেঁষে ধূসর গারো পাহাড়। সব কিছু মিলে মায়ার মতো লাগতো আমার কাছে। একদিন সকালে উঠে বুঝতাম কেমন যেন মিষ্টি বাতাস বয়, দূরে বকুল ডালে কোকিল ডাকে। বুঝতাম বসন্ত এসেছে। বসন্তকালে গাছে গাছে কত ফুল ফুটতো। সমস্ত প্রকৃতিতে রঙের হাট বসে যেত।
হঠাৎ একদিন আকাশ অন্ধকার করে ঈশান কোণ থেকে ছুটে আসতো কালো মেঘ, সঙ্গে সঙ্গে আসতো ঝড়– কালবৈশাখী। ছুটে বেরিয়ে আসতাম আম কুড়োবার জন্যে। ঝড় আমার খুব ভালো লাগতো।
রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম, সকালে উঠে দেখি গাছের পাতা, মাঠ, রাস্তা সব ভেজা। মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা এত পানি কোথা থেকে এলো? মা বলতেন, কাল রাত্রে যে বৃষ্টি হয়েছিল। ওহ্, তাহলে বর্ষাকাল এসে গেছে! ব্রহ্মপুত্রের পানি ফুলে ফুলে দুলে দুলে উঠতো, দূরে দেখা যেতো কালো পানির রেখা। মাঝিরা বলতো, দোয়াত ঢালা পানি। শ্রাবণের বিকালে চুপচাপ একা বসে থাকতাম বারান্দায়। একটানা ঝর্ ঝর্ করে ঝরে পড়তো বৃষ্টি। মনে হতো এতো পানি, মেঘ কোথা থেকে পায়? কখন রাত্রি হয়ে যেত, বুঝতেও পারতাম না।
একদিন দেখতাম আকাশে সাদা সাদা ভেসে চলা মেঘ। বাড়ির সামনে শিউলি গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। নদীর ওপারে সাদা-কালো বন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। বুঝতাম শরৎকাল এসেছে। মাঠে মাঠে সোনার ফসল বুকে করে মানুষের মুখে মুখে হাসি ফুটিয়ে আসতো হেমন্তকাল। চাষিরা মাঠে ধান কাটতো। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে তাদের ধান কাটা দেখতাম। ওরা ধান কেটে, কেউবা মাথায় করে আবার কেউবা গরুর গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে যেতো। পাশের গাঁয়ে মেলা বসতো, আমি দেখতে যেতাম সে মেলা। কতো মানুষ আর কতো জিনিস। আমি যেন দিশেহারা হয়ে যেতাম। কতো রকমের পুতুল উঠতো সেই মেলায়। সবগুলো কিনে ফেলতে ইচ্ছে করতো। বটগাছ তলায় জমা করা থাকতো রকমারি হাঁড়ি, কলসি, ঘট– কতো কী! আমার হাঁড়ির দরকার ছিল না। তবু একটা-দুটো ছোট্ট কিনতাম। মা বলতেন, কী করবিরে হাঁড়ি দিয়ে? বলতাম, কেন, ঘর সাজিয়ে রাখব।
আবার শীত আসতো। এমনিভাবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত– কতো রূপ, কতো রং, কতো রেখা আর কতো বৈচিত্র্য নিয়ে এলো-গেলো। আমি বড় হয়ে উঠলাম। সন্ধ্যাবেলা পাখিরা ঝাঁক বেঁধে অলস ক্লান্ত পাখায় ভর করে বাড়ি ফিরত। ঝপ্ ঝপ্ করে নাও বেয়ে গান গেয়ে যেত মাঝি, মেয়েরা কলসি কাঁখে বাড়ি ফিরত। রাখাল ছেলে গরুর পাল নিয়ে যেত বাড়ির পথে, দূরের মসজিদ থেকে শোনা যেত আজানের ডাক। আমি তন্ময় হয়ে নদীর ঘাটে বসে আকাশের এই রং ফেরা দেখতাম। ছেলেবেলায় আমার দেখা এই যে আমার দেশের রূপ, এ ছবি আমার মনের পর্দায় আঁকা ছিল। তারপর যখন ছবি এঁকেছি, তখন মনের পর্দায় সেই ছবি, রং আর তুলির আঁচড়ে বেঁধে রাখতে চেয়েছি। কতোখানি পেরেছি জানি না। এরপর দুনিয়ার কতো জায়গা ঘুরে এলাম, বেড়িয়ে দেখে এলাম।
যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই সেই দেশের শিল্পীর আঁকা ছবিতে আমি যেন সেই দেশকেই দেখতে পেয়েছি। তোমরা যদি কোনো দেশের শিল্পীর আঁকা ছবি দেখ, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশের কথা মনে পড়বে তোমাদের। মনে হবে, তোমরা যেন সেই দেশ দেখছ। সেই দেশের মানুষকে দেখছ।
তাই আমি চেয়েছি আমার ছবিতে আমার দেশের মানুষের জীবন, তাদের হাসি-কান্না, আমার দেশের প্রকৃতিকে বেঁধে রাখতে। এর পরও যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ছবি আঁকতে শিখলাম কী করে, কার কাছ থেকে– তবে বলবো আমার দেশের মানুষ, মাটি আর আকাশের কাছ থেকে।

[শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে নেয়া।] 

 

#
জনপ্রিয়

শৈশবের কথা : জয়নুল আবেদিন

আপডেটের সময় : ০৭:০৮:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ছবি আঁকতে শিখলাম কী করে? বা কার কাছ থেকে? তবে উত্তর দিতে পারব না। বলব, আমার দেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ আমাকে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এ দেশের আকাশ, বাতাস, নদী, মাঠ, বন– এখানকার মানুষের চলাফেরা, ওঠা-বসা, হাসি-কান্না আমাকে ছবি আঁকতে বলেছে।
ছেলেবেলাটা আমার কেটেছে ময়মনসিংহের বিভিন্ন ছোট ছোট শহরে। আমার আব্বা পুলিশে চাকুরি করতেন। সেই উপলক্ষে এ থানা থেকে সে থানা, এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম আমাদের ঘুরতে হতো। তাই দেখার সুযোগ পেয়েছি আমি অনেক।
ব্রহ্মপুত্রের ধারে ধারে ছেলেবেলায় খেলে বেড়াতাম। শীতের নদী কুলুকুলু করে বয়ে যেত। জেলেরা মাছ ধরত, মেয়েরা কাপড় কাচতো, কলসি ভরে পানি নিয়ে যেতো বাড়ি, যাত্রী এপার-ওপার করতো খেয়া নৌকার মাঝি। আমি তন্ময় হয়ে দেখতাম মানুষের এই আসা-যাওয়া। নদীর ওপারে ছিল ঘন বন, তাকালে দেখা যেতো দূরে নীল আকাশের কোল ঘেঁষে ধূসর গারো পাহাড়। সব কিছু মিলে মায়ার মতো লাগতো আমার কাছে। একদিন সকালে উঠে বুঝতাম কেমন যেন মিষ্টি বাতাস বয়, দূরে বকুল ডালে কোকিল ডাকে। বুঝতাম বসন্ত এসেছে। বসন্তকালে গাছে গাছে কত ফুল ফুটতো। সমস্ত প্রকৃতিতে রঙের হাট বসে যেত।
হঠাৎ একদিন আকাশ অন্ধকার করে ঈশান কোণ থেকে ছুটে আসতো কালো মেঘ, সঙ্গে সঙ্গে আসতো ঝড়– কালবৈশাখী। ছুটে বেরিয়ে আসতাম আম কুড়োবার জন্যে। ঝড় আমার খুব ভালো লাগতো।
রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম, সকালে উঠে দেখি গাছের পাতা, মাঠ, রাস্তা সব ভেজা। মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা এত পানি কোথা থেকে এলো? মা বলতেন, কাল রাত্রে যে বৃষ্টি হয়েছিল। ওহ্, তাহলে বর্ষাকাল এসে গেছে! ব্রহ্মপুত্রের পানি ফুলে ফুলে দুলে দুলে উঠতো, দূরে দেখা যেতো কালো পানির রেখা। মাঝিরা বলতো, দোয়াত ঢালা পানি। শ্রাবণের বিকালে চুপচাপ একা বসে থাকতাম বারান্দায়। একটানা ঝর্ ঝর্ করে ঝরে পড়তো বৃষ্টি। মনে হতো এতো পানি, মেঘ কোথা থেকে পায়? কখন রাত্রি হয়ে যেত, বুঝতেও পারতাম না।
একদিন দেখতাম আকাশে সাদা সাদা ভেসে চলা মেঘ। বাড়ির সামনে শিউলি গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। নদীর ওপারে সাদা-কালো বন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। বুঝতাম শরৎকাল এসেছে। মাঠে মাঠে সোনার ফসল বুকে করে মানুষের মুখে মুখে হাসি ফুটিয়ে আসতো হেমন্তকাল। চাষিরা মাঠে ধান কাটতো। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে তাদের ধান কাটা দেখতাম। ওরা ধান কেটে, কেউবা মাথায় করে আবার কেউবা গরুর গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে যেতো। পাশের গাঁয়ে মেলা বসতো, আমি দেখতে যেতাম সে মেলা। কতো মানুষ আর কতো জিনিস। আমি যেন দিশেহারা হয়ে যেতাম। কতো রকমের পুতুল উঠতো সেই মেলায়। সবগুলো কিনে ফেলতে ইচ্ছে করতো। বটগাছ তলায় জমা করা থাকতো রকমারি হাঁড়ি, কলসি, ঘট– কতো কী! আমার হাঁড়ির দরকার ছিল না। তবু একটা-দুটো ছোট্ট কিনতাম। মা বলতেন, কী করবিরে হাঁড়ি দিয়ে? বলতাম, কেন, ঘর সাজিয়ে রাখব।
আবার শীত আসতো। এমনিভাবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত– কতো রূপ, কতো রং, কতো রেখা আর কতো বৈচিত্র্য নিয়ে এলো-গেলো। আমি বড় হয়ে উঠলাম। সন্ধ্যাবেলা পাখিরা ঝাঁক বেঁধে অলস ক্লান্ত পাখায় ভর করে বাড়ি ফিরত। ঝপ্ ঝপ্ করে নাও বেয়ে গান গেয়ে যেত মাঝি, মেয়েরা কলসি কাঁখে বাড়ি ফিরত। রাখাল ছেলে গরুর পাল নিয়ে যেত বাড়ির পথে, দূরের মসজিদ থেকে শোনা যেত আজানের ডাক। আমি তন্ময় হয়ে নদীর ঘাটে বসে আকাশের এই রং ফেরা দেখতাম। ছেলেবেলায় আমার দেখা এই যে আমার দেশের রূপ, এ ছবি আমার মনের পর্দায় আঁকা ছিল। তারপর যখন ছবি এঁকেছি, তখন মনের পর্দায় সেই ছবি, রং আর তুলির আঁচড়ে বেঁধে রাখতে চেয়েছি। কতোখানি পেরেছি জানি না। এরপর দুনিয়ার কতো জায়গা ঘুরে এলাম, বেড়িয়ে দেখে এলাম।
যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই সেই দেশের শিল্পীর আঁকা ছবিতে আমি যেন সেই দেশকেই দেখতে পেয়েছি। তোমরা যদি কোনো দেশের শিল্পীর আঁকা ছবি দেখ, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশের কথা মনে পড়বে তোমাদের। মনে হবে, তোমরা যেন সেই দেশ দেখছ। সেই দেশের মানুষকে দেখছ।
তাই আমি চেয়েছি আমার ছবিতে আমার দেশের মানুষের জীবন, তাদের হাসি-কান্না, আমার দেশের প্রকৃতিকে বেঁধে রাখতে। এর পরও যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ছবি আঁকতে শিখলাম কী করে, কার কাছ থেকে– তবে বলবো আমার দেশের মানুষ, মাটি আর আকাশের কাছ থেকে।

[শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে নেয়া।]