প্রজ্ঞার মায়ের পেটে টিউমার হয়েছে। হাত দিয়ে চাপ দিলে পেটের মধ্যে বড় বড় চাকার মত মনে হয়। আর কিছু খেলেই বমি করে। এখনো কোন ডাক্তার দেখাইনি। ভয়ে আছি টিউমার থেকে আবার ক্যান্সার হয়ে যায় কিনা। কোন ডাক্তার দেখাবো তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে আছি।
জেড. আর. খান নামে এক ডাক্তার ক্যান্সার চিকিৎসায় ইদানিং নাম করেছে। আমি প্রথমেই বিদেশে যেতে চেয়েছিলাম। আমি শিল্পপতি মানুষ, টাকার পরোয়া করি না। এইদেশের ডাক্তারদের উপর আমার ভরসা নেই। প্রজ্ঞার মা বললো, উনাকে একবার দেখাই তারপর না হয় বিদেশে যাওয়া যাবে।
এদেশের ডাক্তারদের উপর ভরসা না থাকার পেছনে কারন আছে।
আমার প্রথম মেয়ের নাম ছিল মেধা। মেধার তখন ৬ বছর বয়স। স্ট্যান্ডার্ড ওয়ান এ পড়ে। প্রজ্ঞা তখনো হয় নি। সেবার আমরা ঠিক করলাম কোরবানী ঈদ দেশের বাড়িতে করবো। আমারা তিন ভাই। আমি মেজো। বাকি দুই ভাই গ্রামেই থাকে। মেধা গ্রামের বাড়ি খুব পছন্দ করে। চাচাত ভাইবোনদের সাথে খেলাধুলা, পুকুরে গোসল করা আর গ্রামের মুক্ত পরিবেশে তার খুবই ভালো লাগে।
ঈদের তিন দিন আগে আমরা গ্রামে গেলাম। ঈদের আগের দিন হাট থেকে গরু কিনে আনবো। হাটে যাওয়ার আগের দিন মেধা এসে আবদার করলো,
‘বাবা, আমাকে একটা গোট কিনে দিবে’
জানতে পারলাম পাশের বাড়িতে ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে দেখে তার ভালো লেগেছে।
মেধা জেদ ধরলো সে কুরবানির হাটে যাবে। যতই বুঝাই, ‘মেয়েরা হাটে যায় না, মা’
সে নাছোড়বান্দা। বলে, ‘ছেলেরা গেলে মেয়েরা কেন যেতে পারবে না’! অগ্যতা তাকে নিয়েই হাটে গেলাম। সাথে ছোট ভাই ও কাজের ছেলে গেল।
মেধা একটি লাল ষাড় গরু পছন্দ করলো। সে বইয়ে লাল গরুর কথা পড়েছে। ৮০ হাজার টাকায় একটি লাল গরু ও ৬০ হাজার টাকায় একটি গাইগরু ও মেধার পছন্দে সাদাকালো একটি খাসি কিনে বাড়ি এলাম। পরের দিন ঈদ।
***
ঈদের দিন সকালে মেধা মত পাল্টালো। সে তার গোটটি কুরবানী দিবে না। এটাকে ঘাস খাওয়াবে।
গরু কোরবানী হল। ষাড় গরুটায় সাড়ে ৪ মন মাংস হল। গরু কাটার সময় একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলাম। ষাড় গরুটার পাক¯’লীতে চর্বি চাকা চাকা হয়ে জমাট বেধে আছে! কুরবানির বেশীরভাগ মাংসই আমরা গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিলাম। মেধা কিš‘ তার গোট নিয়েই ব্যস্ত। সকাল-বিকাল তার ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যায়।
ঈদের দ্বিতীয় দিন বিকালবেলা শানবাধানো পুকুরঘাটে সবাই বসে কোরবানীর মাংস খা”িছ। মেধা তার চাচাত বোন পুটিকে নিয়ে পাশের জমিতে ছাগলকে ঘাস খাওয়া”েছ। হঠাৎ ছোট ভাইয়ের মেয়ে পুটি এসে জানাল মেধা বমি করছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি মেধা বমি করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। পাশে তার ছাগলটি নিশ্চিন্তমনে ঘাস খা”েছ!
***
ঈদের ছুটি চলছে। হাসপাতাল বন্ধ। আশেপাশে কয়েকটি প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। আমি সেখানে মেধাকে নিয়ে যেতে চাইলাম। ছোটভাই বললো বাড়ির পাশের উপজেলা হাসপাতালে এক নতুন ডাক্তার এসেছে। খুব ভালো ডাক্তার নাকি। আমি একটু সংকোচ করছিলাম। একে তো সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার তার উপরে আবার গ্রামের ডাক্তার। ছোট ভাইয়ের বউ বললো ‘ভালো ডাক্তার দাদা, আমারা তো সবসময় উনাকেই দেখাই’
ডাক্তারের সরকারী কোয়ার্টারে তার প্রাইভেট চেম্বারে মেধাকে নিয়ে গেলাম। একদম অল্পবয়সী ডাক্তার।সাতাশ আটাশ বছরের এক সুদর্শন তরুন।৬ মাস হলো নাকি জয়েন করেছে। ছোটভাই আমার পরিচয় দিল। ডাক্তার মেধাকে কাছে ডেকে নিল,
‘এদিকে আসো মামনি, তোমার নাম কি?
‘মুমতাহিনা মেধা’
‘বাহ! সুন্দর নাম’
‘তুমি কোন ক্লাশে পড়?’
‘ক্লাশ ওয়ান এ’
‘গুড। তোমার কি ব্যাথা হয়?’
‘হ্যাএএ’
‘কোথায় ব্যাথা হয়?’
মেধা হাত দিয়ে মাথার উপরের দিকে বা পাশে দেখালো। ডাক্তার ব্রেইনের এক্সরে করে নিয়ে আসতে বললো। পাশের একটি ক্লিনিক থেকে এক্সরে করে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার এক্সরে ফিল্মটি লাইটে দিয়ে আমাকে একটি সাদা বৃত্ত দেখালো। জিজ্ঞেস করলাম কি এটি।
‘মনে হয় টিউমার। এক্সরেতে ততটা স্পষ্ট নয়। সিটিস্ক্যান করলে স্পষ্ট বুঝা যাবে।’ আতকে উঠলাম।
‘আমার মনে হয় টিউমারটি এখনো প্রাইমারী লেভেলে আছে। এখনই অপারেশন করলে সু¯’ হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।’
ডাক্তার ছেলেটি এক প্রফেসরের ঠিকানা লিখে দিয়ে বললো, ‘ঢাকা গিয়ে সিটিস্ক্যান করিয়ে উনাকে দেখান। উনি অনেক বড় ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। উনি আমার স্যার ছিলেন। আপাতত একটা বমির সিরাপ লিখে দি”িছ এটা খাওয়ান, আর একটা হালকা পেইন কিলার দিলাম’
রাত্রে বমির সিরাপ খাওয়ানোর পরেও মেধা বমি করলো। পরের দিন সকালেই ঢাকা চলে এলাম। ছেলেটির দেয়া প্রফেসরের কাছে যাওয়ার প্র¯‘তি নি”িছলাম। আমার ব্যবসায়ী বন্ধু আরশাদ বললো, ওর পরিচিত এক বড় নিউরোলজিস্ট আছে, ওর বড় ভাইয়ের অপারেশন নাকি তিনিই করেছেন। তার কাছেই মেধাকে নিয়ে গেলাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর তিনি। তার কাছেই নিয়ে গেলাম। ওই ডাক্তার ছেলেটির ঠিকানা দেওয়া ডাক্তারের কাছে আর যাইনি। সিটিস্ক্যান রিপোর্ট দেখে তিনি বললেন ব্রেইনে একটি ছোট টিউমার হয়েছে। অপারেশন করা লাগবে কিনা জানতে চাইলে বললো ‘অপারেশন করা লাগবে না, আমি এক মাসের ঔষধ দি”িছ। এক মাস পর দেখা করবেন।’
রাত্রে ঔষধ খাইয়ে মেধাকে ভাত খাওয়ালাম। সেদিন রাত্রে মেধার আর বমি হলো না। আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাচলাম। সেই বোকা জুনিয়র ডাক্তারটা বলেছিল অপারেশন করতে হবে, সেই কথা ভেবে মনে মনে হাসলাম। এভাবে আরো দুই দিন বমিছাড়া কাটলো। এই কয়দিনের টেনশন থেকে ভারমুক্ত হয়ে কোথাও বেড়াতে যাবো ঠিক করলাম। কাছেই গাজীপুর নুহাশ পল্লী ঠিক হলো।
মেধার মা ব্যাগ গুছালো। ঠিক হলো সকালের খাবার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। মেধার মা সেই জন্য ভুনাখিচুড়ি রান্না করলো। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে মেধা জেগে উঠলো, বললো,
‘মা, আমার বমি বমি লাগছে’
বলতে না বলতেই প্রচন্ডভাবে বমি করে মেধা সেন্সলেস হয়ে গেল।
পরের দিন সেই ডাক্তারের কাছে মেধাকে আবার নিয়ে গেলাম। তিনি এবার একটি বিদেশী এনার্জী ড্রিংকস লিখে দিয়ে বললো বমি হলে এটা খাওয়াতে। সেটা খাওয়ানোর পরেও মেধা আগের মতোই বমি করতে লাগলো। মেধা কিছু খেতে পারতো না, খেলেই বমি করে সব ফেলে দিত। মেধার অব¯’া দিনকে দিন খারাপ হ”িছল। ডাক্তারের কাছে গেলে সে নতুন নতুন ঔষধ লিখে দিতো কিš‘ মেধার অব¯’ার কোন পরিবর্তন হলো না। আর এইভাবেই মেধার জীবন থেকে হারিয়ে গেল মূল্যবান তিনটি মাস। তিনমাস পরে মেধার অব¯’া ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল। শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে আমরা বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা-কাগজপত্র ঠিক করে মেধাকে ভারতের মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ক্যান্সার হাসপাতাল ‘কোকিলাবান ধীরুভাই অম্বানী হাসপাতালে’ নিয়ে গেলাম। কিš‘ ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডক্টররা বললো অপারেশন ভয়াবহ ঝুকিপূর্ণ। তব্ওু আমরা অপারেশনের মত দিলাম। অপারেশনের আগে ডক্টর এসে আমাদের বন্ড সই নিয়ে গেল। মুম্বাইয়ের ¯’ানীয় সময় বিকাল ৫.১৩ মিনিটে মেধাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হলো এবং সেই অপারেশন থিয়েটারের টেবিলেই মেধার শ্বাসপ্রশাস চীরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
***
বিকাল ৫ টায় ড. জেড. আর. খানের এপয়েন্টমেন্ট। রাস্তায় যেতে যেতে মেধার মা বারবার আফসোস করছিল, সেদিন যদি সেই জুনিয়র ডাক্তারটার কথা শুনতাম তবে আজ হয়তো মেধা বেচে থাকতো। মেধার মৃত্যুর পরে আমি সেই ডাক্তারের বিরুদ্ধে কেইস করেছিলাম। মেধার মা বললো, আমার মেয়েকেতো আর ফেরত পাবোনা, তুমি আর ঝামেলা বাড়িও না, তাছাড়া ডাক্তারদের সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী, তাই মামলা তুলে নিলাম। ভক্তি উঠে গেছে এই দেশের ডাক্তারদের উপর থেকে, মনে মনে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম জেড. আর. খানকে দেখিয়েই মেধার মাকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবো।
জেড. আর. খানের বয়স ৪৫-৫০ এর মত হবে। ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশজুড়ে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি মেধার মায়ের সমস্যা শুনে ও পরীক্ষা করে বললেন,
‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এটা টিউমার নয়। পাক¯’লীতে চর্বির চাকা জমেছে। কুরবানীর সময় দেখবেন অনেক গরুর পেটে এরকম চর্বির চাকা জমে। এটা সমস্যা নেই। খুব বেশী হলে আসবেন। আর উনার বমি হয় গ্যাস্ট্রিকের কারনে।আমি গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ দি”িছ। আর কিছু লাগবে না!’
সেই একই কথা। অপারেশন করা লাগবে না। যেটা মেধার ডাক্তার বলেছিল। মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। কিš‘ বাইরে তা প্রকাশ করলাম না। আর কিছু না বলে উঠে চলে এলাম। আমরা বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে চলে এসেছি এমন সময় ডাক্তার জেড. আর. খান পেছন থেকে ডাক দিলো,
‘একটু দাড়ান, আপনি কি শিল্পপতি শামসুল আহসান? মেধার বাবা?’
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমাকে কিভাবে চিনেন। মেধা মারা গেছে আজ থেকে বিশ বছর আগে, মেধার কথাই বা জানলো কিভাবে?
‘আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেননি’ ডাক্তার বললো।
‘না, মানে….. আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে?
‘এক মিনিট’
ডাক্তার সামনে থাকা আলমারীর ড্রয়ার খুলে একটি পুরোনো ছবির এলবাম বের করে একটা ছবি আমার হাতে দিয়ে বললো ‘দেখুনতো চিনতে পারেন কিনা?’
একটি ২৬-২৭ বছরের যুবকের ছবি। হ্যা, চিনতে পেরেছি। এই সেই সেদিনের জুনিয়র ডাক্তার! ড. জেড. আর. খানই সেদিনের সেই জুনিয়র ডাক্তার। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো,
‘মেধার কি খবর?’
ডাক্তারের হাতদুটো ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠলাম।
***