মারুফ ইসলাম :
ছোট্ট এক ডিভাইসের মধ্যে ইদানিং সব এঁটে যাচ্ছে—বই, খাতা, কলম, আঁকাআঁকির সরঞ্জাম! বলছি মোবাইল ফোনের কথা। আপনি চাইলেই মোবাইল ফোনে ই বুক পড়তে পারেন, নোট প্যাডে লেখালেখি করতে পারেন। এমনকি আঁকাআঁকিও করতে পারেন।
প্রযুক্তির এ এক বিস্ময়কর আশির্বাদই বটে। তবে মুদ্রার অপর পিঠ বলেও তো একটা কথা আছে। গবেষকেরা মাথা চুলকে ভাবতে বসলেন। অপর পিঠটা একটু উল্টেপাল্টে দেখতে চাইলেন। খতিয়ে দেখতে চাইলেন, ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়া কতটা আশির্বাদ আর কতটাই বা অভিশাপ।
সেই চাওয়া থেকে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে বই পড়েছেন এমন ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষের পাঠাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করলেন।
তারপর দীর্ঘ শ্রমসাধ্য সেই গবেষণার ফলাফল নিয়ে একট প্রবন্ধ লিখলেন রিভিউ অব এডুকেশন রিসার্চ জার্নালে। সম্প্রতি প্রকাশিত সেই গবেষণা প্রবন্ধে তাঁরা বলেছেন, ডিজিটাল মাধ্যমে পড়ার চেয়ে ছাপা বইয়ের পড়া মানুষের বোঝার ক্ষমতাকে ছয় থেকে আটগুণ পর্যন্ত বাড়ায়।
গবেষণা প্রবন্ধটির সহলেখক ও ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যাডিসলাও সালমেরন বলেন, ‘কোনো কিছু দ্রুত বুঝে ফেলা এক ধরনের দক্ষতা। আর এই দক্ষতা বাড়াতে ডিজিটাল মাধ্যমের পড়া কোনো ভূমিকা রাখে না। কিন্তু ছাপা বই মানুষের মস্তিষ্কের বোঝার দক্ষতা বাড়ায় বহুগুণ।’
ডিজিটাল মাধ্যমের পাঠাভ্যাস বলতে আমরা বুঝি অনলাইনে, ফেসবুক, টুইটার কিংবা অন্যান্য ওয়েব পোর্টালে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সংবাদ ও বই পড়া। গবেষকেরা বলছেন, এসব মাধ্যমে আমরা যা পড়ি তার ভাষাগত গুণমান ছাপা বইয়ের তুলনায় একটু কম হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব লেখা হয়, সেগুলোর সিংহ ভাগ হয় সরল, যুক্তিহীন অতি সাধারণ ও চটুল কথাবার্তা। এসব লেখা পড়তে তাই মস্তিষ্ক খাটাতে হয় না। গভীরভাবে ভাবতে হয় না। আর এভাবে ভাবনাহীনতার প্র্যাকটিস করতে করতে মানব মস্তিষ্ক এক সময় ভাবার ও বোঝার দক্ষতা হারিয়ে ফেলে।
আর কম বয়সে ডিজিটাল ডিভাইজে পড়ার অভ্যাস তৈরি হওয়া তো আরও ভয়ঙ্কর বলে মত দিয়েছেন অধ্যাপক সালমেরন। তিনি বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়। ওই সময়েই বোঝার ক্ষমতা অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা তৈরি হয়। ওই সময়ে যদি শিশু কিশোরেরা অগভীর ও ভাবনা-চিন্তাহীন পড়ার জগতের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে কখনোই তার বোঝার দক্ষতা তৈরি হবে না।’ তাই শিশু কিশোরদের ডিজিটাল ডিভাইসে না পড়তে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সালমেরন।
গবেষণা প্রবন্ধটির আরেকজন সহলেখক লিডিয়া আলতামুরা বলেন, ‘ডিজিটাল ডিভাইসে পড়ার বিরুদ্ধে আমরা নই। আমাদের ভুল বুঝবেন না। আমরা গবেষণায় যা জানতে পেরেছি তাই তুলে ধরেছি। সত্যি বলতে, গবেষণার তথ্য, উপাত্ত ও ফলাফল দেখে আমরা নিজেরাই অবাক হয়েছি। আমরা ভেবেছিলাম, ডিজিটাল মাধ্যমের পাঠক আর ছাপা মাধ্যমের পাঠকদের বোধগম্যতার পার্থক্য এতটা বেশি হবে না। কিন্তু গবেষণার ফলাফল আমাদের হতবাক করেছে।’
সব শেষে গবেষকেরা তাদের সুপারিশমালায় স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া তরুণ পাঠকদের ডিজিটাল ডিভাইসের চেয়ে ছাপা মাধ্যমে পড়ার প্রতি বেশি জোর দিতে বলেছেন।
এটা ঠিক যে এখন বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টদের জীবনী থেকে শুরু করে চাঁদের বুকে নভোযান পাঠানোর মতো জটিল প্রায় সব তথ্যই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এই সহজলভ্যতার ফাঁদে পড়ে আপনি যদি পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে পড়েন, তাহলে আপনার মস্তিষ্কের বোধগম্যতা বিকশিত হবে না। এ জন্য ইন্টারনেট নির্ভরতা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও মেন্টাল ফ্লস