6:54 pm, Monday, 16 September 2024

 সম্পদ : খুরশিদা বেগম

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ১১:৪১:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 181 ভিউ
শেয়ার করুন

১৯৭১ সালের ঊত্তাল মার্চ। আমার বয়স তখন সাড়ে দশ। দিনাজপুর সদরের লালবাগ গ্রামে আমার নিবাস। বাড়ির সাথে লাগোয়া লালবাগ দ্বিতীয় মসজিদ। বাড়ির পূবদিকে খেলার জায়গা। অনেকটা মাঠের মতো। খেলা জমে আসরের নামাজের পর।

আমার আব্বার  নিজের ভাই ও চাচাতো ভাই মিলে তাঁরা ষোলজন। আমাদেরও ভাই বোনের কমতি নেই। বিকেলে মাঠে খেলতে যাই। উচ্চতা অনুযায়ী একদল খেলছেÑ কুমির তোর জলে নেমেছি। আরেক দল খেলছে বৌচি, কেউ বা দাড়িয়াবাধা কেউ গুটিবল। মা- চাচিরা রাস্তার যে দিকে আড়াল আছে সেখানে বসে আমাদের খেলা, চিৎকার-চেঁচামেচি ও মারামারি উপভোগ করেন। কমবয়সী চাচিরা আমাদের বড়বোনদের সাথে খেলায় নেমে পরেন। বৃষ্টি-বাদল ছাড়া প্রতিদিনের এই আয়োজন চলে আসছে বহুদিন ধরে।

কিছু একটা হয়েছে!  আব্বাসহ চাচারা জটলা করছে ক’দিন ধরে। খেয়াল করছিÑ তাঁদের মুখে ভয়ের কালোছায়া । কয়েকদিন আগে সবাই একসাথে বসে রেডিওর খবর শুনতেন আর সেসব শুনে নানা কথা’র ঝড় উঠতো। তো এখন আবার কি হলো!

আমাদেরকে খেলতে যেতে দিচ্ছেন না তাঁরা। ধমকে বাড়িতে ঢুকিয়ে রাখছেন। আমি আম্মাকে প্রশ্ন করে জেনেছিÑ নির্বাচনে বাঙালিদের ভোটে শেখ মুজিবুর রহমানের দল জয়লাভ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকে দিচ্ছে না। আম্মা বলছে, গণ্ডগোল বাধবেÑ যুদ্ধ লাগবে। এমন হলে বাড়িতেই থাকা যাবে না। বিভিন্ন জেলায় গোলমাল, মারামারি শুরু হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই বিহারীরা বাঙালিদেরকে মারছে। এসব শুনে ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেছি!

লালবাগ দ্বিতীয় মসজিদের সামনে তিনটি রাস্তা মিলিত হয়েছে। তিনরাস্তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটা প্রকাণ্ড আমগাছ। সারাদিন দফায় দফায় আমগাছের নিচে এ এলাকার অনেকেই জড়ো হন। রেডিওর খবর, দেশের খবর কে কি শুনলেন, কোথায় কি ঘটলোÑ এসব হরদম আলোচনা চলতে থাকে।

সে সময় স্কুল-কলেজে আমার পড়ুয়া চাচারা কেউ ছাত্র ইউনিয়ন, কেউ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কেউ ন্যাপ, কেউ কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িটা বড়বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। এই বাড়ির লোকদের উপরে যে কোন সময় হামলা হতে পারে। আব্বাসহ চাচারা ষোলোজন, আবার চাচাতো ভাইদের মধ্যে বড় ছিল কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে শলা-পরামর্শ হলো। হামলা হলে তা প্রতিহত করা হবে।

আমগাছটার নিচে রাত্রে পালা করে পাহারা থাকবে। হাতে লাঠি, চাকু আর বল্লম। আমাদের বাড়ির বড় চাকুটা নিয়ে আব্বাকে পাহারা দিতে দেখেছি।

এতো ভয়ের মধ্যেও আমরা কয়েকজন ভাইবোন একটা ব্যাপারে বেশ আনন্দে আছি। সে হলোÑ বিশেষ এই পরিস্থিতিতে পড়াশুনার বিষয়ে খানিকটা ছাড় পাওয়া।

সন্ধ্যায় মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমাদের লেখাপড়া চলতো। পড়া মুখস্ত করে আম্মাকে পড়া দিয়ে তারপর রেহাই। পড়তে পড়তে যখন ঘুমে টুপতে থাকি কিংবা কখনো ঢুলে পরলে আম্মা ধরে বসিয়ে দিতেন। বলতেনÑ পড়া শেষ করে তারপর খাওয়া। আম্মার এই কঠোর নজরদারির সময় কই আর!। যে চাচারা  রাজনীতি করতেন তারা রাতে বাড়িতে থাকতেন না। নদীর পাড়ে মাচায় শুয়ে থাকতেন। অবস্থা বুঝে সকালে বাড়ি আসতেন।

আমাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পূনর্ভবা নদী। স্থানীয় নাম কাঞ্চন নদী। শীতকালে আমরা নদীর ওপারে বনভোজন করতাম। নেতৃত্বে থাকতেনÑ বড় ভাইবোনেরা। আট বছরের কম বয়সে বনভোজনে কাউকে নেওয়া হয় না। দুইবছর থেকে আমি ছাড় পেয়েছি।

বনভোজনের সময় হলে আয়োজনের ধুম পরে যায়। চাঁদা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে কে কি দায়িত্ব নেবে তার তালিকা করা নিয়ে আলোচনা চলে বাইরের বৈঠক খানায়। বনভোজনের আগের রাতে বড় ভাইবোনেরা ঘুমাবেন না।  তাঁরা মজা করবেন, হইচই করবেন। আর দেখবেনÑ আয়োজনে কিছু কমতি আছে কি না। আগেরবার দেশলাই নেয়া হয়নিÑ যার কারণে চুলা জ¦ালাতে দেরি হওয়ায় রান্না, খাওয়াতেও দেরি হয়েছিল।এবার দেশলাই নিতে ভুল হয়নি।

বনভোজনের রাতে আমারও ঘুম হয়না এই ভেবেÑ যদি আমকে ফেলে সবাই চলে যায়। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসি। আম্মা বলেন, এখনো ভোর হয়নি, তুই ঘুমা। আমি তোকে ডকে দেব।

 

ভোরে যখন আকাশ ফর্সা হয়Ñ আমরা যাত্রা শুরু করি। নদীর ওপারে একটা গোলচত্ত্বর আছে শ্যাওড়া গাছ দিয়ে ঘেরা। ঐ জায়গাটাই আমাদের পিকনিক স্পট। আমাদের দলনেতা মানিক ভাই ছড়ি হাতে দলটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কারো উপর রেগে গেলে বলেনÑ এই ব্যাটা। আমাকেও বলবে এই ব্যাটা। আমার খুব রাগ হয়, আমাকে ব্যাটা কেন বলবেÑ আমি যে মেয়ে।

রান্না হয়ে গেলে সবাই একসাথে গোসল করতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরতাম। হুড়োহুড়ি করে একসময় পানি থেকে উঠে পরি। সে যে কি মজার দিন! খাওয়া দাওয়া, ছুেটাছুটি, হাসাহাসি, ঘাসের উপর গড়াগড়িÑ কত যে আনন্দ পেতাম।

সূর্য ডুবছে এমন সময় বাড়ির পথে আমরা রওনা হই। মানিক ভাই সবাইকে গুনে দেখবেনÑ জনসংখ্যা ঠিক আছে কি-না। নদী পার হয়ে, বাঁধ পেরিয়ে, কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে বাঁশবাগান। সেখানেই শুরু হয়ে যায় থালায় গ্লাস দিয়ে ঢোল বাজানো। আর একটু এগিয়ে তিন রাস্তার মধ্যখানে সেই আমগাছ। আম্মা চাচিরা বাড়ি থেকে জেনে যায় বাঁদরের দল ফিরে আসছে।

আব্বার নিজের ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে অন্যরকম একতা ছিল। কারো বড় অসুখ হলে সবাই পরামর্শে বসতেনÑ কোন ডাক্তার দেখালে ভাল হবে। ছেলেমেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে সব ভাইদের সম্মতি ছাড়া পাকা কথা দেয়া যাবে না। ছেলেমেয়েরা কোন স্কুল-কলেজে পড়বেÑ পড়ুয়া চাচা ফুপুরা সেটি ঠিক করবে। এই একতা ছিল বড়বাড়ির শক্তি। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে বড়বাড়ির বড়রা ঠিক করে ফেলেছেনÑ জীবন বাঁচাতে হলে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে।

বড়বাড়ির লোকসংখ্যা একশ’জনের বেশি। সিদ্ধান্ত হয়েছেÑ কে কোথায় যাবে। কাঞ্চন নদীর ওপারে গ্রামে যাঁদের আত্মীয় আছেন তারা সেখানে যাবেন। যার আত্মীয় নেই তিনি যাবেন আধিয়ার বা বর্গাদারের বাসায়।

মার্চ মাসের শেষদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া বেশি কিছু নিলেন না কেউ। গ্রামের লোকেরা দুই এক ঘর সরে গেছে। আমাদের গোষ্ঠির লোকজন পরিবার নিয়ে সবাই চলে গেলাম নদী পার হয়ে। একেক পরিবার একেক দিকে।

তেঘরা গ্রামে আমরা এক আধিয়ারের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে আরো কয়েক বাড়ি আত্মীয় হওয়ার কারণে আমাদের লোকজন সে সব বাড়িতে উঠলেন। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে বাড়ির লোকদের খবরাখবর নেয়া চলছিল। খুব মজা হচ্ছিলো। এ পাড়া ও পাড়ার লোকজন আমাদেরকে দেখতে আসছিল।

ওখানে একটা তালপুকুর ছিল। পুকুরের পাড় তাল গাছে ঘেরা। এখানে আসার আগে আমি সাঁতার শিখেছিলাম। পুকুরে গোসল করতে নেমেছি। পুকুরের পানি এতো কালো যে আমার ভয় লাগছিলÑ এই বুঝি কেউ পা ধরে টানলো। আমার মতো ছেলেমেয়েরা সাঁতার দিয়ে পুকুর এপার ওপার করছিল।

উত্তরের জেলাগুলোতে মার্চ মাসে সকাল-সন্ধ্যা শীত থাকে, হালকা কুয়াশা পড়ে। গাঁয়ে শীত আরো বেশি। আম্মা আমাদের জন্য হালকা শীতের কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন বলে রক্ষা।

ধানকাটা ও ধানমাড়াইয়ের মরশুম শেষ। সবার বাড়ির সামনে খড়ের স্তুপ। খড়-বিচালি জ¦ালানি দিয়ে মাটির হাঁড়িতে রান্না হচ্ছিলো। ঘরবাড়ি ছেড়ে কারোরই ভালো লাগছিল না। পাঁচদিন পর সিদ্ধান্ত হলোÑ আপাতত ভয়ের কিছু নেই, তাই বাড়ি  ফেরাই উত্তম।

বড়দের কথামতো বংশের সব পরিবার বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ। বাড়ির পুরুষরা পালা করে আবার পাহারা দিতে শুরু করলেন। লাঠি, চাকু, বল্লম সাথে নিয়ে সেই আমগাছটার নিচে।

সন্ধ্যার পর ভয়ে আমরা টু শব্দটি করি না। দেশে যুদ্ধ লাগবে। লোকজন গরু ছাগল বিক্রি করে হাতে টাকা রাখছে। কি জানি কখন কোন বিপদ হয়। আব্বার কাছে শুনলামÑ ব্যবসায়ীরা যেমন নতুন করে পণ্য কিনছেন না তেমনি কাউকে বাকিও দিচ্ছেন না। অফিসে কর্মচারিদের নামমাত্র উপস্থিতি। স্কুল-কলেজে যাচ্ছে না কেউ। লোকজনের মধ্যে দু:শ্চিন্তা, ভয়, অস্থিরতা বিরাজ করছে!

 

প্রাণের ভয়ে মানুষ বাড়ি ঘর ফেলে চলে যাচ্ছে। মানুষ বলাবলি করছে সারাদেশে  মারামারি, যুদ্ধ লাগবে বিহারী ও বাঙালিদের মধ্যে। দেশের কোন কোন জেলায় বাঙালিদের মেরে ফেলা হচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে খাওয়া নাওয়া ছেড়ে নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে। প্রতিদিন কোন না কোন পরিবার ঘরছাড়া হচ্ছে। এই অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশে আমরা সাতদিন থাকলাম। বংশের বড়রা বলছেনÑ  আর নয়। সবাই যে যার মতো শহর ছেড়ে চলে যাবো।

নদীর ওপারে সবাই মিলিত হবো। আম্মা সুটকেস গুছাচ্ছেন, পোটলা বাঁধছেন আর বলছেন, কপালে কি যে আছে? সহজে বাড়ি ফেরা হবে না এবার। বেশি প্রয়োজনীয় জিনিস, কাপড়, টুকিটাকি, আম্মার সোনার গহনা, হাতে যা টাকা পয়সা ছিল আর আমার ছোট চার ভাইবোনের দুধ রুটি খাওয়ার চারটা করে কাঁসার বাটি চামুচ পোটলায় ভরা হলো। এ ছাড়াও প্রথমবার যে জিনিসগুলোর প্রয়োজন বোধ করছিলেন আম্মা সেসবও নিলেন।  এবারে বাঁধা-ছাদা হলো দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে থাকার।

আমার পুতুল আর পুতুলের জামা-কাপড় যে গুলো দর্জির দোকান থেকে এÑে বুবুর হাতে সেলাই করে নিতাম, সেগুলো পোটলা করে আম্মার বেঁধে রাখা মালপত্রের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম। আম্মা দেখা মাত্রইÑ আমার পুতুলের ছোট পোটলাটা নিয়ে মারলেন এক ঢিল! আম্মা রাগ করে বলছেন, মানুষের জীবন বাঁচেনা। কোথায় থাকবো? কি খাবো? তার ঠিক নাই। এ পুতুল নিয়ে শখে বাঁচে না!

আমি সুযোগ বুঝে আম্মার চোখ এড়িয়ে পুতুলের পোটলা পরে ঠিকই মালপত্রের ভেতর ঢুকিয়ে  রেখেছিলাম। আমরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পরলাম অজানার উদ্দেশ্যে।

চৈত্র মাসে নদীর পানি কম কোথাও হাঁটু পানি কোথাও আরো কম। পানির নিচে ছোট মাছ আর বালি চিকচিক করছে। জীবন বাঁচাতে আমাদের মতো অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে নদী পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে।

আমরা প্রথমবার তেঘরায় যে লোকের বাসায় উঠেছিলামÑসেই অধিয়ারের বাড়িতেই উঠলাম। তারাও আতংকিত। শহর ছেড়ে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মৃত্যুর আতংক।

চারদিন পর আমার কাকা, ফুপু, চাচারা ছয়জন লালবাগের বাড়িতে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। আমি জেদ ধরে বসলাম, বললামÑ আমিও যাবো। আম্মা আমাকে কিছুতেই যেতে দেবেন না। আমার ছোট চাচাকে বংশের সব ভাইবোন কাকা বলে ডাকেন। কাকা বললেন, আমি তো যাচ্ছিÑ  রানী যাক। আমি ওকে দেখে রাখবো। জয়ের আনন্দে আমি সবার আগে দৌঁড়ে দৌঁড়ে হাঁটা দিলাম।

গত ক’দিনে নদী পারাপারে আমি চিনে রেখেছিলাম কোনদিকে কম পানি। নদীতে নামতে ভয় হলো না। পানিতে হাঁটতে মজা পাচ্ছিলাম। অল্প পানি হলেও তাতে বাতাসের টান থাকায় স্রোতের মতো সচল পানিতে হাঁটতে যেয়ে জোর খাটানোয় পা ব্যথা করছিল। সে জন্য আম্মা আমাকে বারণ করছিলেন।

বাড়ি পৌঁছে দেখি সবদিক কেমন খাঁ খাঁ করছে। আশেপাশের কোন বাড়িতে লোকজন নেই। থাকলেও দুই একজন বাড়ি পাহারায় আছেনÑ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমরা বাড়িতে ঢুকে আব্বাকে পাই। খুব ভোরবেলায় রওনা করে আমাদের অনেক আগে বাড়িতে এসেছেন। ফিরে এসেই গরু ছাগল সব ঠিক আছে কিনা দেখে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এদিকে ফুপুরা রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। মুরগী ধরেছেন, এখন আতপ চাল বের করছেন। আমি দারুণ খুশি। ছোট বলে আমার উপরে সবার চোখ। পুকুরে নামিস না, এখানে ওখানে যাস নে, আমাদের কাছে বসে থাক।

খানিকটা বসে থেকে আমি বাড়ির বাইরে বের হই। আমগাছের নিচটা একদম ফাঁকা। ক’দিন আগেও এখানে সবসময় লোকজনের আড্ডা লেগে থাকতো।

 

মসজিদের আঙিনায় প্রকাণ্ড ফজলি আমগাছটার নিচে আমের মুকুল ঝড়ে পরেছে। তার সাথে সাবু দানার মতো ছোট ছোট আম। তার কতকগুলো কুড়িয়ে হাতে নিয়ে ঘ্রান নিচ্ছিলাম। কি মিষ্টি গন্ধ আমের!

আব্বা আমাকে বললেন, তোর জামিল চাচা কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে এখন তেঘরা যাচ্ছে তুই চলে যা মা। কখন কি হয় বলা যায় না। আমি তোর ফুপুদের সাথে বিকেলে যাবো। আমিও ভয় পেলাম কারণ পরিবেশটা ভীষণ নিশ্চুপ ছিল। দূরে কেউ কথা বললেও কাছে শোনা যেতো।

দুপুর বারটার দিকে জামিল চাচা সহ বাড়ি থেকে বের হলাম। দলে দলে লোক পালাচ্ছে। গন্তব্য নদীর ওপার। আমি চাচার পিছন পিছন হাঁটছি। রাস্তা পার হয়ে নদীর বাঁধের নীচে লোকমানের আমবাগানে ঢুকেছি ঠিক তখন উত্তর দিক থেকে ভয়ানক শব্দে প্রচন্ড গতিতে ঝড় যেমন ধেয়ে আসে তেমনি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ, মেশিন গানের গুলির ঠা ঠা শব্দ, সাথে আতংকিত, ভীত মানুষের তুমুল চিৎকার। যারা পালিয়ে যাচ্ছিলো, তারা দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগলো নদীর পাড়ে।

চাচার ঘাড়ে ভারী একটা বোঝা ছিল কি সব জিনিসের। সেটা ফেলে আমাকে বললেন, রানী মা তুমি এখানে বসে থাক, আমি একটু এগিয়ে গিয়ে তোমার চাচা ফুপুুদের নিয়ে আসি। আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করছিলাম।

চাচা চলে যাওয়ার পরেই আমার সামনে দিয়ে সাঁ সাঁ করে একঝাঁক গুলি চলে গেল। আম গাছের কিছু পাতা আমার সামনে ঝরে পড়লো। আমি মাটিতে শুয়ে পরেছিলাম। ও আব্বা বলে কাঁদতে কাঁদতে উঠে একদেঁৗঁড়ে নদীর ঘাটে চলে এলাম। এক ভয়াবহ দৃশ্য। পুরো নদী সন্নিহিত এলাকা লোকে লোকারন্য। যে যে দিকে পারছে নদীতে নামছে। ওপারে গেলে কিছুটা নিরাপদ। নদীর উপরে একটা রেলওয়ে সেতু আছে। মানুষ বা যানবাহন পারাপারের কোন পুল নেই। আমি পানিতে হাঁঁটছি কখনো দৌঁড়াচ্ছি। একবার পরে গেলাম জামাকাপড় ভিজে গেল।

দেখলাম একটা সুটকেস পানিতে ভাসছে, এক মা তার দুই বাচ্চা কোলে নিয়ে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে এগিয়ে যেতে পারছেন না। এক লোক সাইকেলে পটলা পুটলি বেঁধে নিয়ে দুই বাচ্চাকে সিটে বসিয়ে নদীতে নামছে মাঝ নদীতে সাইকেল আটকে গেছে পোটলা দুটি পানিতে ভিজে এত ভারী হয়ে গেছে যে সাইকেলটা এগুচ্ছে না।

 

সমানে চলছে গোলাগুলি আর বোমা বিস্ফোরণের ভয়াল সব শব্দ। কখনো বোমার শব্দ মনে হচ্ছে বোমা বুঝি মাথার উপরেই পরছে! তখন ভয়ে সবাই হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠছেন, কেউ কেউ পানিতে দুমদাম শুয়ে পড়ছেন। আমিও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলেছি। পাগলের মতো প্রলাপ বকছিলামÑ আমার আব্বা কই রে, আমার কাকা কই রে, আমি হারিয়ে যাবো, আমি মরে যাবো।

নদী পার হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁদেছি। তারপর মানুষের ভীড়ে কিছুক্ষণ হেঁটেছি। পাকা রাস্তায় উঠে মনে পরে গেলো পূব দিকের রাস্তা দিয়ে গেলেই তেঘরা গ্রাম। সেখানে আম্মা আছেন, ভাইবোনেরা আছে। কোনদিকে না তাকিয়ে হাঁটছি, কখনো দৌঁড়াচ্ছি। এভাবে একসময় আম্মার কাছে পৌঁছে গেছিলাম সেদিন।

আমাকে একা দেখে আম্মা কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই সবার কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম। আমি হাঁপাচ্ছিলামÑ কিছু বলতে পারছিলাম না। এর কিছুক্ষণ পর আব্বা, কাকা, ফুফু, চাচারা নিরাপদে গ্রামে পৌঁছে গেলেন। আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এ গ্রামের লোকেরা  গোলাগুলি, বোমার শব্দে ভীত-সন্তস্ত্র! সবাই মনে করছিলেনÑ পুরো দিনাজপুর শহরটাই বুঝি মিলিটারিরা ধ্বংস করে দিচ্ছে।

 

তেঘরায় যে বাড়িতে আমরা ছিলামÑ সে বাড়ির লোকজন বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। কুয়ার ভিতরে কাঁসা পিতলের তৈজসপত্র ফেলে দিচ্ছেন।

আমাদের পরিবারের বড়রা সিদ্ধান্ত নিলো যে যেভাবে পারবে ভারতে যাবে। কোন কারণে যদি দলছুট হয়ে যায় একটাই গন্তব্যÑ পাশের দেশ ভারত। ছোট ছোট ভাই বোন নিয়ে আমরা বেশি দূর যেতে পারলাম না। আব্বার মামার বাড়ি গেলাম।

সেখানেও মাটির হাঁড়িতে ভাত, তরকারী রান্না হচ্ছে। খড়ের উপর বিছানা পেতে আমাদের শুতে দেয়া হলো। ওখানে দুইদিন থাকলাম।

 

পরদিন সকালে শহরের দিকে, দূরে থেকে দেখা যাচ্ছিল ধোঁয়া, আগুন বোমা বিস্ফোরণের শব্দে আকাশ-মাটি কেঁপে ওঠছিল। এখানকার গ্রামবাসীরা আমাদের মতো ভয়ে নিজেদের আবাস ও সহায় সম্বল  ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন।

কাঁধের ওপর ভার নিয়ে এর দুদিকে জিনিসপত্র, গরুছাগল, হাঁস-মুরগী, মুড়িরটিন এসব নিয়ে চলছেন। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে গরুর গাড়িতে করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। হয়তো অনেক দূরে তাদের কোন আত্মীয়ের বাড়ি তাদের গন্তব্য।

 

আমরা অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে পথে নামলাম। রাস্তায় জনস্রোত। যানবাহন বলে কিছুই নেই। আতঙ্কিত মানুষ হাঁটছে। কখনো কখনো বিকট শব্দে বোমা ফাটছেÑ মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথায় পড়লো। মানুষ ত্রাহি ত্রাহি চিৎকারে হুড়মুড় করে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিলোÑ আর রক্ষা নেই, এবার বুঝি আমরা মরেই যাবো।

শহরের আগুন পিছনে ফেরে আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে এমন সময় আমার এক খালুর সঙ্গে দেখা। খালা, খালাতো ভাইবোনদের সাথেও দেখা হলো। হাসিন খালু বললেন, সামনে রামপুর গ্রাম। সেখানে আমার পরিচিত লোক আছে। থাকার একটা ব্যবস্থা হবে।

খালুর পরিচিত লোকের বাড়িতে গেলাম। তাদের ঘর-বারান্দা, বৈঠকখানা পালিয়ে আসা লোকে ভর্তি। আমাদের জায়গা হলো বারান্দায়। আম্মা আর খালা এক সাথে কিছু একটা রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন।

বাড়িওয়ালার কাছ থেকে দুটা সপ নিয়ে আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা হলো। আব্বা কাপড় বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনদিন এভাবে থাকলাম। কারো হাঁটার শক্তি ছিল না। ছোটরা পা ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। চারদিনের দিনÑ দুপুরে আমরা খেতে বসবো ঠিক তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। শোরগোল পরে গেল মানুষেরÑ কে কেথায় আছো পালাও। মিলিটারিরা নদী পেরিয়ে গ্রামগুলোতে ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছে।

আম্মা ও খালার সে কি কান্না। এবার বোধহয় বাঁচবো না। খালু বলল, মরলে এক সাথে মরবো। দূরে ছেড়ে আসা গ্রামগুলোতে আগুন জ¦লছে। খাল, বিল, ক্ষেত, জঙ্গল দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার খালাতো বোন বানু আপা অন্তসত্ত্বা ছিলেন। তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। একটা পুকুরপাড়ে বানু আপা বসে পরলেন। কিছুতেই উঠতে পারছিলেন না, একটানা কেঁদেই চলেছেন। এই চরম বিপদের সময় তার প্রসবের ব্যাথা ওঠেছে।

কামানের শব্দ বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ক্রমে এগিয়ে আসছে। খালু আব্বাকে বললেনÑ ভাই তোরা চলে যা। আব্বা যেতে চাচ্ছিলেন না। খালু রাগ করলেন, তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেনÑ আল্লাহর দোহাই লাগে ওদের নিয়ে তুই চলে যা। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। পরিস্থিতি বুঝে আমরাও এখান থেকে চলে যাবো।

চলতে চলতে আখরগাঁ নামে একাট গ্রামে পৌঁছালাম। ওখানে নাড়াবাড়ির হাঁট বসে। দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল, তহসিল অফিস আছে। আমার ছোট খালু এই তহসিল অফিসে একসময় তহসিলদার ছিলেন। আমার ঠিক মনে নেই, শুনেছিÑ আব্বা আম্মা ছেলে মেয়ে নিয়ে একবার বেড়াতে এসেছিলেন।

আব্বার চেনা একজনের খোঁজ করে তার বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে গোলাগুলি থেমেছে।  তখন সন্ধ্যা। তহসিলদারের আত্মীয় বলে আমাদের খুব খাতির করলেন তাঁরা। মুরগি ধরে রান্না করে ভাত খাওয়ালেন। ঘর ছেড়ে দিলেন।

রাত পেরিয়ে সকাল হলো। আব্বা গ্রামটা ঘুরে দেখে এসে আম্মাকে বললেন, পরিচিত অনেকে এই গ্রামে এসেছে। তাদের কাছে  খবর পাওয়া গেল বানু আপুর ছেলে হয়েছে। মহিউদ্দিন ভাই বললেনÑ তারা ভারতে যাবেন না। আব্বা বললেনÑ আর যদি কোন  বিপদ না হয়, তাহলে আমরা এখানেই থেকে যাবো।

আমাদের সাথে আমার বৃদ্ধ দাদি ছিলেন। সবার পায়ে ব্যথা শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন। পরদিন কাকা আসলেন। আম্মার নানা প্রশ্নÑ কোথায় ছিলে? কোথা থেকে এলে? আর সবাই কই? কাকা বললেনÑ বোমা বর্ষণের দিনেই সবাই ভারতে চলে গেছ্ িএখান থেকে তিনচার মাইল দূরে ভারত। কাকা আব্বাকে বলল, এখানে থাকা ঠিক হবে না দাদা। তোমরা কালকে সকাল সকাল বের হয়ে ভারতে চলে আসো। আমি থাকার ব্যবস্থা করছি। আব্বার আরো পাঁচভাই তারা কোথায় আছেন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর বাড়ির সকলেই ভারতে চলে গেছে।

কাকার কথা মতো আমরা বেরিয়ে পরলাম। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে আব্বা দাদির হাত ধরে বেশ কিছু দূরে যেয়ে দাদিকে বসিয়ে রেখে আমাদের কাছে ফিরে এসে ছোট বোনকে কোলে নিয়ে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে, আম্মা আমাদের ছোটভাইটাকে কোলে নিয়ে একটা পোটলা হাতে রওনা হলেন। আমার বুবু ছোট দুই ভাইবোনের হাত ধরে আব্বার পিছনে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি একটা ছোট সুটকেস নিয়ে তাদেরকে অনুসরণ করলাম। দাদির কাছে পৌছে আমরা সবাই সে জায়গায় জড়ো হয়ে বসে গেলাম।

আব্বা আবার দাদির হাত ধরে বেশ কিছু দূরে যেয়ে দাদিকে বসিয়ে রেখে আমাদের কাছে ফিরে এসে আবার আমাদেরকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবেই এগুচ্ছিলাম। এমনি সময় হঠাৎ বোমা, কামান, গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। যুদ্ধটা যেন তাড়া করে আমাদের পেছনে পেছনে এগিয়ে আসছে। প্রাণের ভয়ে ভীত হয়ে আমরা এক সাথে হেঁটে গেলাম। আবার কাঁচা রাস্তার উপরে ভয়ার্ত মানুষের পায়ের শব্দ। বুলেট কামান এগিয়ে আসছে মানুষকে পদদলিত করে সীমান্ত পর্যন্ত  ছুটবে। আমরা মরে যাবো পাকিস্তনি মিলিটারির হাতে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় সীমানা পার হয়ে ভারতে প্রথম রেলওয়ে স্টেশন রাধিকাপুর পৌঁছেছিলাম। রাস্তায় অনেকবার জিরিয়ে নিতে হয়েছিল নয়তো আরো আগে পৌছাতে পারতাম। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে। কাকা অস্থির হয়ে  মানুষের ভীড়ে আমাদেরকে খুঁজছিলেন। আমাদের দেখা পেয়ে তিনি নিয়ে গেলেন স্টেশন মাস্টারের কোয়াটারে। এখানেই কাকা, ফুপুরা থাকার জায়গা করে নিয়েছেন।

পরিবারের বাকি লোকজন কয়েকদিন আগেই ভারতে পৌঁছেছেন। তারা পরবর্তী রেলওয়ে স্টেশন ডালিমগাঁর মুসলমান পাড়ায় জোহাক চাচার বন্ধুর বাড়িতে উঠেছেন। এই কোয়াটার লোকে ভর্তি। সবাই শরণার্থী।

আমাদের জায়গা হলো বারান্দায়। রাতে  বেশ ক’জন ছেলে উঠানে বিছানা পেতে শুয়েছিল। পরদিন দেখলাম জুলেখা ফুপুু চাদর দিয়ে অনেকগুলো বন্দুক ঢেকে রাখছিলেন। বাচ্চাদেরকে কাছে যেতে দিচ্ছিলেন না।

বাইরে বের হলাম। আমার ছোট প্রাণটা হু হু করে উঠলো আমাদের বাড়ির জন্য। কোথায় আমাদের বাড়ি, সেদিকে তাকিয়ে চেষ্টা করলাম কিছু দেখা যায় কিনা!

অনেক দূরে ছবির মত ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে । প্লাটফরম শরণার্থী দিয়ে ভর্তি। দুইদিন পর রাতে ভয়ংকর অবস্থা! খানসেনারা সীমান্ত পর্যন্ত ছুটছে। দূরে দেশের শেষ গ্রামগুলো আগুনে জ্বলছে। গত দুইদিন আগে ঐসব গ্রাম পার হয়ে এসেছি আমরা। কামান আর বোমার শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকার বাড়ছে আগুনের শিখা। কামানের গোলা মনে হচ্ছে আশেপাশে পড়ছে।

এসব দেখে ভয়ে আমরা কান্না শুরু করেছি। আব্ব কে বলেছিÑ এখানে থাকবো না। এখান থেকে পালাই। কাকা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কাকা বললেনÑ দুর বোকা এখানে কোন ভয় নেই, আমরা ভারতে আছি, কিচ্ছু হবে না। মা তুই ঘুমা তো। আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। যখন কামানের আওয়াজ কমে গেল তখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকালে উঠে কোয়াটারের দরজা থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে গেলেÑ দেখা যাচ্ছে দূরের গ্রামগুলো পুড়ে গেছে! তখনও ধোঁয়া উঠছে সেই  পোড়াভস্ম থেকে।

দলে দলে লোক ভারতে চলে আসছে। অনেক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। সবার কাছে কাকা খবর জানতে চাচ্ছেনÑ কে কি অবস্থায় এতো দূরে এসেছেন। অমুকে কোথায়, তমুকে কোথায়, কেমন আছেÑ এইসব। ক্লান্ত অবসন্ন মানুষগুলো কিভাবে পালিয়ে এসেছেন বলতে বলতে কাঁদছেন। যারা শুনছে তারাও কাঁদছে। সবাই যেন সবার অন্তরের আপনজন।

আমরা এখন উদ্বাস্তু, শরণার্থী। লোকজনের কাছ থেকে কাকা খবর জেনেছেন মহিউদ্দিন বড় আব্বার দুই ছেলেকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে আখরগাঁ থেকে। আমরা আখরগাঁ থেকে সকালে বের হওয়ার পর দুপুরের দিকে আখরগাঁয়ে খানসেনারা হামলা চালায়।

বড় আব্বার দুইছেলে মিজু আর আসাদুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে  গেছে।

এই ভাইয়া দু’জন সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে আসতেন। আমরা সব ভাইবোনের দল ছুটে যেতাম। আমাদের সাথে কি যে মজা করতেন। আমরা আসাদুর ভাইকে নানা বলে খেপাতাম। সবার মন খারাপ । চাচা কাকা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। এই আশ্রয়টা আমাদের ছাড়তে হবে। দুই দিন পরে স্টেশন মাস্টারের পরিবার আসবে। অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রেলওয়ে বিল্ডিং এর পাশে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, সেখানে থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। ঘর তুলে নিতে হবে। বাঁশ খড় কিনে লোক দিয়ে আব্বা ঘর তুলে নিলেন। আমরা সেই ঘরে এসে উঠলাম। আমাদের আগে দুই একজন ঘর তুলে থাকতে শুরু করেছেন। আরো কিছু পরিবার এলেন। কেউ ঘর তুললেন, কেউ তাঁবু ফেললেন।

তাদের অনেকেই আব্বার পরিচিত ও একই শহরের বাসিন্দা। এরমধ্যে আর একটা ঘর উঠলোÑ সেটা চাচির ভাই জালাল মামার। মামি আর মামাতো ভাইবোনদের পেয়ে আমরা মহাখুশি। মামার বড় ছেলে ইদ্রিস ভাইয়ের কাছে আমরা অংক শিখতাম।

চাচা ফুপু কাকা দাদিকে নিয়ে ডালিম গাঁয়ে চলে গেলেন। আব্বার কথাÑ এখানেই থাকা শ্রেয়। এখান থেকে দূরে তাকিয়েও নিজের দেশটাকে দেখতে পাবো।

কিন্তু প্রতিদিন সীমান্তে যুদ্ধ চলছে। সামনে খোলাপ্রান্তর। সব দেখতে পাচ্ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা মাটিতে শুয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ কামানের শব্দ প্রকম্পিত করে রাখছে। আম্মা বলছেনÑ আরমান ঠিকই বলেছিল এ জায়গাটা নিরাপদ নয়। এখানকার ফাঁকা জায়গাগুলো ভরে গেছে খড়ের ছাউনিতে। কোনমতে একটা ঘর বা তাঁবু ফেলে মানুষ দিনযাপন করছে। মানুষের গৃহস্থালি উজাড় হয়েছে, ঘরের স্ত্রী কন্যা পথে বসেছে, লজ্জা সম্ভ্রম নষ্ট হচ্ছে। শত মানুষ ব্যবহারের ফলে বিশাল পুকুরে স্বচ্ছ পানি ঘোলাটে হয়ে গেছে।

রামকৃষ্ণমিশন থেকে শরণার্থীদের বিনা পয়সায় ঔষধ দেয়া হচ্ছিলো। পাঁচ-ছয়দিন পর আম্মার গহনা বিক্রি করতে ভোরের ট্রেনে আব্বা রায়গঞ্জে গেলেন। যাওয়ার সময় জালাল মামাকে আব্বা বলে গেলেনÑ এরা থাকলো, দেখবেন। বিকেলের ট্রেনে আমি ফিরে আসবো। পরিস্থিতি শান্ত ছিল। বেলা এগারটার দিকে সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ ভাবে। খান সেনাদের ছোড়া কামানের গোলা, ভারতের রাধিকাপুরে যত্রতত্র পড়তে শুরু করলো। আতংকিত মানুষের চিৎকার, বাঁচার আকুতি, কান্না যেন কিয়ামত হয়ে নেমে এলো।

কুটির আর তাঁবুর সংসার ফেলে ছেড়ে আসা ভয়ার্ত মানুষ পালাতে লাগলেন। আমরা আম্মাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম, আম্মা কাঁপছিলেন। আব্বা রায়গঞ্জে যাওয়ায় আম্মা দিশেহারা।

এদিকে জালাল মামা তার মালপত্র গুছিয়ে আমাদেরকে ডাকছেন। আম্মাকে বলছেন, বুবু আমাদের সাথে চলেন এখানে বিপদ। আমরা তাদের সাথে বের হয়ে গেলাম। পেছনে সবকিছু পরে থাকলো।

সরু রাস্তা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। দলে দলে লোক দৌঁড়ে পালাচ্ছে। আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে পরিমরি করে ছুটছি। জালাল মামা আর আমরা পাঁচ গজ দূরত্বে দৌড়াচ্ছি। আমরা জালাল মামাাদের পিছনে।

হঠাৎ বিকট শব্দে মনে হলো আমাদের মাথার উপর বোমা পরলো। কি হয়ে  গেল বুঝা যাচ্ছিল না। শুধু ধোয়া আর ধোয়া চিৎকার আর কান্না। দুই তিন মিনিট পর আম্মা উঠে ছেলেমেয়েদেরকে একে একে দেখে নিলেন। উঠে সবাই হাঁটতে শুরু করলাম। বোমা পরার আগে মামাদেরকে যেখানে দেখেছিলাম সেই জায়গাটায় এতো রক্ত! আম্মা ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে মামাদেরকে খুঁজছেন।

ভয়াবহ এক পরিস্থিতি চোখের সামনে! আমরা সবাই দেখতে পেলামÑ রাস্তার পাশে টিউবওয়েলের নিচে জালাল মামার ছয় বছরের মেয়েটা নেতিয়ে পরে আছে আর বার বছরের ভাই ইলিয়াস টিউওয়েল চেপে বোনের শরীরে পানি ঢালছে। পানিতে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে! আমরা হতভম্ভ হয়ে দেখছি।

আম্মা পাগলের মত করছেনÑ একি হলো! ইলিয়াস তার ছোট বোন নাসিমাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। শরীরটা নিথর হয়ে আছে। ইলিয়াসের সামনে মাথা আর দুই হাত ঝুলছে পিছনে কোমর আর দুই পা ঝুলছে। আম্মা কাছে টেনে নিলে বলল, এখানে বোমা পড়ছে আমরা তো আছি আমার সাথে চলো। আমি দেখলাম নাসিমার কোমরে একটা গর্ত লাল হয়ে আছে। আর হাটুর নিচের মাংশটা খুলে পরে ঝুলছে।

ইলিয়াস কেঁদেই চলছে। মামা মামি মামাতো ভাই বোন কোথায় হারিয়ে গেছে। আম্মা ওকে সান্তনা দিচ্ছে বলছে সামনে গেলে সবাইকে পাওয়া যাবে। মৃতবোনকে কাঁধে নিয়ে ইলিয়াস ও আমরা হেঁটে চললাম। কিছুদুর পর একটা নদী। অনেক লোক নদী পার হয়ে চলে যাচ্ছে। আমাদের সাথে বড় কোন ছেলে মানুষ নেই শুধু আম্মা অভিভাবক। ঐ সময় আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। যুদ্ধ তাড়া করছে পালাতেই হবে। নদীটা ছোট পাড় খুব উচু মাটি পিচ্ছিল আর লাল। পাড়ে উঠে ডিগবাজি খেতে খেতে নদীর পানিতে ঝুপঝাপ করে পরলাম দুই জন। নদীর ওপাড়ে যেয়ে ঘাসের উপরে সবাই বসে পরলাম। ইলিয়াস বোনকে ঘাসের উপরে শুইয়ে দিলো। প্রাণভয়ে ছুটে চলা লোকজন আমাদের দেখে উহু! আহা! করছে। অনেকে বলছে আমাদের  সাথে চলেন সামনে গেলে আপনাদের লোকজনকে অবশ্যই পাওয়া যাবে।

কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আম্মা মাঝে মাঝে আবোল তাবোল বকছেন আর কাঁদছেন, ইলিয়াসও সমানে কেঁদে চলছে।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখলামÑ তিনচারজন লোক আমাদের খোঁজে এগিয়ে এসেছেন। তারা কে কে ছিলেন ঠিক মনে নেই, তবে এর একজন ছিলেন রমজান ভাই। আম্মাকে তিনি বললেনÑ চাচি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আপনি এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। অল্প কিছু দূর গেলেই ডালিম গাঁ। ওখানে সবাই আছে। বোনের লাশটাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়া হলো।  স্থানীয় কৃষকরা মাঠে কাজ করছিল। তাদের কাছ থেকে কোদাল নিয়ে কবর খুঁড়ে রেললাইনের ধারে আমগাছের নিচে ছোট বোনটাকে কবর দেয়া হয়েছিল।

আমরা রেললাইন ধরে রাস্তা হেঁেট একসময় ডালিম গাঁয়ে পৌছালাম। কাকা, আব্বা আমাদেরকে পেয়ে নতুন প্রাণ পেলেন। আম্মাকে ঘিরে সবাই  শোকাবহ খবরটা শুনলেন। কিছু আত্মীয় চলে গেলেন নাসিমাকে কবর দিতে।

পাশেই আরেক ভীড়ের মধ্যে দেখি মাথায় ঘোমটা টানা এক মা, তাঁর মুখখানি ঠিক দেখা যাচ্ছিলো না। তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন। পরে খেয়াল করলাম ঘোমটা টানা এই নারী আর কেউ নন, তিনি আমাদের  মামি। তার কোলে মৃত বাচ্চা, শাড়িটা রক্তাক্ত! পরিচিত-অপরিচিত মহিলারা মামিকে ঘিরে আছেন।

রেলস্টেশনের ধারে মাথায় ছাদ ছিল না, সবাই মাটিতে বসেছিলেন। নাসিমাকে কবর দিয়ে এসে মামির কোলের  বাচ্চাটিকে ডালিমগাঁয়ে কবর দেয়া হয়েছিল।

রাধিকাপুর থেকে যখন আমরা জান বাঁচাতে একসাথে  আসছিলাম। জালাল মামা আর মামি ছিলেন আমাদের সামনে। ছেলেমেয়েরা সব তাঁদের সাথেই ছিল। একটা বোমা ঠিক তাদের উপরেই এসে পড়ে। ইদ্রিস ভাইর পিঠের ওপর ছিল ছোট বাচ্চাটা। বোমার আঘাতে সে ক্ষত বিক্ষত হয়।

ঐ সময় লাইনে একটা ট্রেন থেমে ছিল ডালিমগাঁ অভিমুখী। ঘটনার আকস্মিকতায়  হতভম্ব হয়ে তাঁরা ঐ ট্রেনে উঠে পরেন। ভুলে যান ইলিয়াস আর নাসিমার খোঁজ করতে। তারা ভেবেছিলেনÑ ইলিয়াস আর নাসিমাকে মানুষের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে।

রেলওয়ে প্লাটফর্মে বহুলোক রাত্রিযাপন করলেন, তার মধ্যে আমরাও ছিলাম। মামির কান্না আর থামছিলো না।

পরদিন ভোরে সাহস করে আব্বা রাধিকাপুর গেলেন। সেখানে কুঁড়েঘরে আমাদের সব জিনিসপত্র ছিল। পরিস্থিতি তখন শান্ত। আব্বা সকাল দশটা নাগাদ  আমাদের সুটকেস, পোটলা, জিনিসপত্র নিয়ে ডালিমগাঁয়ে ফিরে এলেন।  কাকা আমাদের নিয়ে শংকরপুরে মুসলমান পাড়ায় উঠলেন। সেখানে আমার ছয়জন চাচা, ফুপু, দাদি, ভাইবোন বাড়ির অর্ধেক লোককে পেলাম। খুশিতে সব ভুলে গেলাম। জোহাক চাচার বন্ধু হামিদুর চাচার বাড়িতে দুইটা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। বাকি লোকদের বারান্দা, বৈঠকখানা, মসজিদের বারান্দা, পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে থাকার ব্যবস্থা হল। কয়েকদিন পর আমার আরো চার চাচা তাঁদের পরিবার নিয়ে উপস্থিত হলেন। ষাট থেকে সত্তরজন  হলাম আমরা।

ডালিমগাঁ থেকে সোজা রাস্তা ধরে দুই মাইল পর শংকরপুর, সেখানে রাস্তার ধারে একটা স্কুল। স্কুলের উল্টো দিকে মেঠোপথ ধরে গেলে একটা খাল। খালের ওপরে বাঁশের সেতু পার হয়ে আমবাগান, বাঁশবাগান পার হয়ে মুসলমান পাড়া। সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। আর স্কুলের আশেপাশে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি। স্কুলটা ছিল পাকা। চতুর্দিক বারান্দা। সেখানে পুরাতন স্কুল ছিল চৌচালা পরিত্যক্ত। বেড়া বা দেয়াল ছিল না। গ্রামপ্রধান ও স্কুলকমিটির অনুমতি নিয়ে চৌচালা স্কুলঘরটি খড় আর বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো। আমরা সহ ছায়জন চাচার পরিবার মুসলমানপাড়া থেকে স্কুলঘরে এসে উঠলাম।

কি যে আনন্দ পেলাম। বিশাল লম্বা একটা ঘর কার কোনদিকে বিছানা পাতা হবে ভাগাভাগি হয়ে গেল। একদিকে কয়েকটা চুলা তৈরি হলো।

ঘরের সদস্য-সংখ্যা সাইত্রিশ জন। গল্পগুজব, হৈচৈ, হাসিকান্না, খাওয়া দাওয়া সব একসাথে। ভাইবোনের সংখ্যা বেশি ছিল সবাই এক ঘরে বলে আমোদে ছিলাম। বড়দের মনটা কিছুটা স্থির হলো। তাড়া খেয়ে আর ছুটতে হবে না।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা খুব ভাল ছিলেন। তিনি বললেন স্কুলের টিউবওয়েল বেড়া দিয়ে ঘিরে মহিলারা ব্যবহার করবেন। স্কুল ছুটির পর টয়লেটের চাবি আমাদেরকে দিয়ে যেতেন।

পাশে একটা পুকুর ছিল সেখানে ছেলেরা গোসল করতো। মুসলমান পাড়ায় যারা আছেন তারা মাঝে  মাঝে স্কুলেঘরে বেড়াতে আসতেন। তখন আম্মা চাচি  বড়মা গল্পে মেতে উঠতেনÑ মনে হতো এ যেন লালবাগের বাড়ি।

মুসলমান পাড়ায় পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে জামিলচাচা,চাচি ও ভাইবোনের আবাস।  ঐ ঘরে চাচির ফুটফুটে একটা মেয়ে জন্ম নিল। তার নাম রাখা হয়েছিলÑ ভারতী।

সমীরবড়আব্বা সিন্ধি গাভিটাকে খুব ভালোবাসতেন, গাভীটাকে নিয়ে ভারতে গেছিলেন। আমার আরো চারজন চাচা ভারতে যাননি। আজ এ গ্রাম, কাল অন্য এক গ্রাম এভাবে পালিয়ে বাংলাদেশেই ছিলেন। আমাদের থাকার জায়গাটা ঠিক হলেও বড়রা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। বাড়ি থেকে আনা সবার হাতের টাকা পয়সা শেষ হয়ে আসছিল। কয়েকমাস হলো দেশে যুদ্ধ চলছে, বাড়ি ফেরার উপায় নেই। ভারতের ক্যাম্পগুলোতে যেসব শরণার্থী আছে তাদের রেশনকার্ড হয়েছে।

আমাদের পরিবারগুলো একে একে শরণার্থী ক্যাম্পে সারাদিন থেকে রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করে ফেললো। রেশনের মোটাচালের ভাত খেয়ে পেটব্যথ্যা করতো, পেটখারাপ হতো। তখন কারোই কিছু করার ছিল না।

 

নুরুলচাচা তাঁর রেডিওটা নিয়ে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর সবাই স্কুলমাঠে বসে খবর শুনতেন বিবিসি আর আকাশবাণী। আকাশবাণীর খবর পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ঐ নামটা এতো শুনেছি যে এখনো কানে বাজে। দেশের কোথায় কি হচ্ছে কতজন খানসেনা ঘায়েল হলো, মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় কোথায় অপারেশন করছে, বাংলাদেশ সরকার কি ব্যবস্থা নিচ্ছেÑ এসবই ছিল প্রধান খবর।

জোহাক, জাফর, জাহেদুর, সাজ্জাদ চাচা লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিলো। ঘারে বন্দুক নিয়ে কয়েকজন আসতেন। চৌচালা স্কুল ঘরের পাশে চাচাদের সাথে অনেকরাত পর্যন্ত ফিসফাস চলতো। দেশের খবর খারাপ হলে আম্মা, বড় আম্মা চাচীরা নামাজে কাঁদতেন, কোরআন পড়তেন। বড় আব্বা তাঁর সিন্ধি গাভীটা বিক্রি করে দিলো। কারো অসুখ করলে দুইমাইল হেঁটে ডালিমগাঁয়ে রামকৃষ্ণমিশন থেকে বিশ পয়সায় ঔষধ আনতে হতো।

 

বর্ষা এসে গেল। গ্রীষ্মের তাপে পুড়ে যাওয়া ঘাস-গুল্ম মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। রাস্তার দু’ধারের পাট গাছগুলো এক মানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠলো।

মুসলমান পাড়ায় যাওয়ার সাঁকোটা হঠাৎ ভেঙে যাওয়ায় চাচিরা আসতে পারছেন না, আম্মারাও যেতে পারছেন না। খালের ওপারে লোকেরা কলাগাছের ভেলায় করে খালপার হচ্ছিলেন।

ক্যাম্পে তাঁবুঘরে যারা ছিলেন তারা চরম দুরাবস্থায় পরলেন। বৃষ্টির পানি হয়তো  ঠেকানো যেত কিন্তু কলেরা আর জ¦র ঠেকানো গেল না। ক্যাম্প থেকে লোক পালাতে শুরু করলো। কিন্তু যাবেন কোথায়? কে দেবে আশ্রয়? পাকা স্কুলের চতুর্দিকে বারান্দায় মানুষ  আশ্রয় নিলেন।

ধীরে ধীরে অনেক কয়টা পরিবার স্কুলের বারান্দায় জায়গা নিয়েছেন।

স্কুলছুটির পর সবগুলো ভাইবোন বারান্দায় খেলা করতাম। আমি একদিকে পুতুল নিয়ে বসতাম। যে পুতুল আমি চুপ করে পোটলার ভিতরে ঢুকিয়ে রাখছিলাম। আম্মা পরে হেসেছেন। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি। এতো লোকের ভীড়ে আশোপাশের পরিবেশ নোংরা হয়ে গেল। যুদ্ধের তাড়া খেয়ে মানুষগুলো ঘরবাড়ি ফেলে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন কলেরা রোগের তাড়া খেয়েÑ মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকিতে আছেন।

স্কুলের বারান্দায় কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এক পরিবারের কর্তা মারা গেলেন, তাকে দুপুরের দিকে দাহ করা হলো। রাত্রে মৃত ব্যক্তির বৃদ্ধ মা মারা গেলেন। হিন্দু হওয়ার কারণে স্থানীয় লোকের সহায়তায় বৃদ্ধাকে দাহ করা হলো। পরদিন একই পরিবারের বাচ্চা মারা গেল। স্বামী, শ্¦াশুড়ী বাচ্চা হারায়ে বউটার কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে গেছিল। পরপর তিনটা মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছিল না। বউটার আহাজারিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো।

বারান্দায় অন্যান্য বাসিন্দারা কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে অন্যত্র চলে গেলেন। এতো লোক গম গম করতো যে জায়গাটা সেটা মুহুর্তে শ্মশানে পরিণত হলো। স্কুলটার দিকে তাকালেই গা ছম ছম করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা হাঁড়ি, কাগজ, আধপাড়া খড়ি, ছাই আর চুলার চিহ্ন থেকে গেল। এতগুলো লোক দুইমাস ধরে থাকলো হঠাৎ চলে যাওয়ায় অনেক বেশি শূন্য মনে হচ্ছিলো। আমরা ঐ দিকটাতে পা মাড়াই না। মানুষগুলো কোথায় গেল কে জানে!

আমাদের দিন কাটছিল ভীষণ আতঙ্কে। আগের মত নি:সংকোচে কেউ চলাফেরা করতে পারছিল না। একটা ভয় আঁকড়ে ছিল। এই সাইত্রিশজনের মধ্যে যদি কেউ কলেরায় আক্রান্ত হয়। কিছু করার ছিল না। আমরা চৌচালা স্কুলঘরটাতেই থেকে গেলাম আল্লাহর উপর ভরসা করে। ঘরের আশেপাশে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হতো। বড় আম্মা, আম্মা, চাচিরা সবসময় দোয়া পড়তেন। ছেলেরা যে যখন রাতে টের পেত নামাজ পড়ে দোয়া করতো। আল্লাহর রহমতে আমরা ভালই ছিলাম। শুধু স্কুলের বারান্দায় খেলা করা বন্ধ হয়ে গেল ভয়ে। কয়েক সপ্তাহ পর স্কুল মাঠ, বারান্দা পরিষ্কার করে, নতুন রং করে যথারীতি স্কুল চালু হয়ে গেল।

পাকিস্তানি শাসকরা জেলায় জেলায় শান্তি কমিটি করেছে। স্কুল খুলতে বলছে। অফিসে যেতে বলছে। যারা দেশে আছে তারা চাকুরি হারাবার ভয়ে অফিস করছে। তারা বলছে দেশে নাকি শান্তি বিরাজ করছে। লোকজনকে বাড়ি ফিরতে উৎসাহিত করছে। মানুষ বাড়ি ফিরে আসতে সাহস পাচ্ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন করাই ছিল বাঙালির কাম্য। আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছেনÑ লোক মারফত জানা যেতো।

দিনাজপুর উপজেলা পরিষদের পিছনে আমাদের মামাবাড়ি। আব্বা খবর পেয়েছিলেনÑ মামারা খানপুর বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকেছেন। কিছুদিন পর আবার খবর পাওয়া গেল বল্টু মামার স্ত্রী ও বাচ্চা কলেরায় মারা গেছে। দিনু মামার ছেলে মনকুটু জন্মের পর মা মারা যায়, মামা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কি যেন একটা ভাল নাম ছিল মনে নেই। সবাই মনকুটু বলে ডাকতো দশম শ্রেণিতে পড়তেন। মামার সাথে রাগারাগি করে বাড়ি চলে যাচ্ছি বলে মনকুটুভাই ক্যাম্প থেকে বের হয়ে  গেছেনÑ আর ফিরে আসে নাই। মামা খোঁজ করে নিশ্চিত হয়েছিল যে মনকুটু বর্ডার পার হয়ে বাড়ির দিকে চলে গেছে। আজও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আম্মা কাঁদতে শুরু করলো ভাত খেলো না রান্না করলো না। আমার বড়আব্বা, মেজোবাবা ভারতে যাননি। যুদ্ধের তাড়া খেয়ে আজ এক গ্রাম কাল অন্য গ্রামে আশ্রয় নিতেন। কিছুদিন পর আবার একটা খারাপ খবর এলো আমার বড় আব্বা জ¦রে মারা গেছেন। আব্বা আর কাকার সে কি কান্না। আব্বার এমন কান্না কখনো দেখি নি। আব্বা উদভ্রান্তের মতো বাড়ি চলে আসতে চাচ্ছিলেন। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে তাঁকে থামানো হলো। এখন গেলে ভাইকে দেখতে পাবে না মারা যাওয়ার তিনদিন পর খবরটা এসেছে।

আব্বা কয়েকটা দিন ঠিক মত খাওয়া করলো না। আম্মা কাঁদছে আমরা কাঁদছি। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। বড় আব্বা যে কি ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কারো উপর রাগ করতেন না। কাউকে গালি দিতেন না। আমাদেরকে খুব আদর করতেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য আব্বা অস্থির করছিলেন সাথে কয়েকজন চাচাও।

তাঁদের কথা হচ্ছে যুদ্ধের মধ্যেও দেশে মানুষ আছে। তারা কিভাবে আছে আমরাও না হয় সেভাবে থাকবো। বড় ছেলে মেয়েদেরকে মুসলমান পাড়ায় ভাইদের কাছে রেখে দেবো। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে।

দেশের মানুষেরা চরম দুশ্চিন্তায় আছে। যারা ভারতে আছে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যারা দেশে আছে সারাক্ষণ প্রাণভয় তাড়া করছে তাদের।

যে গ্রামগুলোতে লোকজন বেশি আছে, অন্যগ্রামের লোকজন সেই গ্রামে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। লোকবলে সাহস বেশি। কোন কোন গ্রাম জনশূন্য। পোড়া ঘরবাড়ি ভুতের মত দাঁড়িয়ে আছে। শহরের অবস্থাও একই রকম। যে মহল্লায় লোক বেশি, অন্য মহল্লার লোক এসে এর ওর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনাজপুর শহরের মিলিটারি ক্যাম্প কুঠিবাড়ির আশেপাশের মহল্লা লোকশূন্য।

ভারত সরকার সাহায্য সহযোগিতা আর মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিকই তবে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ আর মহামারীর প্রকোপ।

সাতমাস হয়ে গেল মানুষ ঘর ছাড়া। যুদ্ধেরমধ্যে অনেকে   দেশে ফিরে যাচ্ছে। স্কুলঘরে চৌচালায় যে কয়জন চাচা ছিলেন তারাও বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। মুসলমান পাড়ায় যে চাচারা থাকতেনÑ তারা এসে বুঝালেন মুক্তিযোদ্ধা চাচারা বুঝালেন তবু তাতে কাজ হলো না। আব্বাসহ ছয় চাচা বাড়ি ফিরে যাবেন ঠিক করলেন।

নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা বাড়ি ফিরে যাবো জেনে খুব খুশি লাগছিল। ভয়ের মধ্যেও এতোদিন পর ঘরে ফিরবো ভেবে সবাই শান্তি পাচ্ছিলো। তিনদিন  ধরে গোছগাছ চললো। ভোর চারটার সময় বের হতে হবে। সাইত্রিশজন থেকে চারজন বড় চাচাতো ভাইবোন বাদ। ওদেরকে রেখে দেয়া হলোÑ যারা ভারতে থেকে গেলেন, তাদের কাছে।

ফজরের নামাজের পর চৌচালা স্কুল ঘরটাকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। স্থানীয় বাসিন্দা বিপিন, সুকুমার, রহমান, হরিশ এদের সাথে আব্বা চাচাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ওরা বিদায় জানাতে এলেনÑ শুভ কামনা জানালেন। মুসলমানপাড়া থেকেও অনেকে দেখা করতে এসেছিলেন। চাচি ফুফুরা আম্মাদের গলা ধরে কান্নাকাটি করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা চাচা আমাদেরকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেলেন।

সূর্য যখন উঠলো তখন আমরা একটা নদীর সামনে পৌঁছে গেছি। নদী পার হয়ে একটু গেলেই বাংলাদেশ। নদীতে নৌকা ছিল না। নদীর পাড়ের মানুষেরা কলাগাছ দিরো ভেলা বানাতে সাহায্য করলেন। কেউ বাঁশ কেটে এনে দিলেন। মহিলারা আত্মীয়ের মত বাড়ি থেকে সপ এনে বসতে দিলেন, পানি খাওয়ালেন।

ছোট বড় মিলে পাঁচ ছয় জন করে খুব সাবধানে নদী পার হলাম। মালপত্র পরে পার করে আনা হলো।  সবাই সবার মতো করে খাবার এনেছিল তা দিয়ে নাস্তা  খাওয়া শেষ করে সুটকেস, পোটলা মালপত্রগুলো মাথায় ঘাড়ে, হাতে নিয়ে একসাথে হাঁটতে শুরু করলাম।

নদীর ওপার থেকে মুক্তিযোদ্ধা জোহাক ও সাজ্জাদ চাচা আমাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। কথা বলা নিষেধ হেঁটে চলছি আমরা আর ছোটদের কষ্ট হচ্ছিল বেশি।

প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটার পর গাড়ির শব্দে আমরা ভয় পেলাম। গাড়িটা আমাদের কাছে আসলো থামলো কয়েকজন মিলিটারি নেমে আসলো। আমাদের দিকে বন্দুক উচিয়ে ধরলো সবাই ভয়ে মরে যাচ্ছিল। দলের পুরুষদের কে জিজ্ঞাসাবাদ চললো মধ্য বয়সী বলে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহ করলো না। ওরা বুঝে নিলো হিন্দুস্তানে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মানুষগুলো দেশে ফিরে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন বাঙালি পুলিশ ছিলেন। তিনি বললেনÑ প্রতিদিন শরণার্থীরা ভারত থেকে দেশে ফিরছে। মিলিটারিরা বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। আমাদেরকে পুলিশভ্যানে তুলে নিলো, নিয়ে গেল নাড়াবাড়িরহাট মিলিটারি ক্যাম্পে। সেখানে তারা আমাদেরকে স্কুলে থাকতে বলল। দুপুরে খাবার খেলাম আমরা । বড়রা কেউ খাবার মুখে তুলল না। চেহারায় মৃত্যুর কালোছায়া। কখন ছাড়া পাবো এই প্রত্যাশায় আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন।

বিকেলে কমান্ডার এলেন। মিলিটারিরা দলের পুরুষ মানুষদের ডেকে নিলো। তেরো চৌদ্দ বছরের চাচাতো ভাইরা বড় দুইজন ফুফাতো ভাই আব্বা-চাচারা মিলে চৌদ্দজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালো। বাকিরা সবাই স্কুল ঘরে ছিলাম।

 

চাচিরা, আম্মা-বড় আম্মা ঘোমটার ভিতরে কাঁদছেন আর দোয়া পড়ছেন। এক খানসেনা মেশিনগান উঁচিয়ে অনেকগুলো গুলি ছুড়লো আকাশের দিকে। বড়রা কাঁপতে থাকলো ছোটভাইরা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পরে গেল। হাউ মাউ করে কাঁদতে ধরলো।

বাঙালি পুলিশ বললেনÑ ভয় পাবেন না।  কমান্ডার এসে নাম পরিচয় জিজ্ঞাস করবেন। করলেনও তাই। একেকজন করে নাম ঠিকানা জেনে ছেড়ে দিলেন। কি কি নির্দেশ দিয়ে গেলেন আমাদেরকে বাড়ি পাঠানোর জন্য ঠিক বুঝা গেল না।

বাঙালি পুলিশ এসে বললেনÑ এখন রাত হয়ে গেছে। কালকে সবাইকে বাড়ি পাঠানো হবে। কোন বাড়িতে পাঠাবে? দুশ্চিন্তা, ভয় আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত কাটলো।

সকালে চিড়া পাউরুটি বিতরণ করলো তারা। সকাল দশটার দিকে আমাদেরকে একটা গাড়িতে উঠানো হলো। খানসেনাদের ভ্যান পিছনে পিছনে এলো। কিছুদূর যাওয়ার পর রেল লাইনের ধারে আমাদেরকে নামতে বলল। একটু পরে একটা ট্রেন আসলো। তাদের কথা মতো আমরা ট্রেনে উঠলাম তখন সবার মনে হচ্ছিল বেঁচে বাড়ি ফিরবো তো?

ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় আছি এমন সময় রেললাইনের অন্যপাশের জঙ্গল থেকে শুরু হলো গোলাগুলি। খানসেনারা মাটিতে শুয়ে গুলি চালাতে লাগলো। আমরা আতংকে চিৎকার করছিলাম। ঘন্টাখানেক পর থেমে গেল গুলির অওয়াজ। আমাদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দূর থেকে দেখতে পাওয়া একটা স্কুলে  নিয়ে যাওয়া হলো। ট্রেনটা চলে গেল। তখন শেষ বিকেল। দুইজন সেনা পাহারায় থেকে বাকিরা চলে গেলেন। সন্ধ্যায় মিলিটারি ভ্যানটা আবার এলো। ওখানকার গ্রামের মেম্বারের মাধ্যমে আমাদেরকে চাল ডালসহ রান্নার জিনিসপত্র দেয়া হলো। কারো শরীর চলছিল না সবাই ক্লান্ত, ভীত, তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত। সারাদিন না খাওয়া। সবাই মিলে চালে ডালে কোনভাবে খিচুড়ি রান্না করে ক্ষুধা মিটানো হলো।

স্কুলের বেঞ্চ জোড়া দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা হলো মরণঘুম দিয়ে রাত পার হলো আমাদের। পরদিন মিলিটারির গাড়ি এলো। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে আবার গণনা হলো।

গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনায় সন্দেহ করেছিল আমাদের মধ্যে লোক কম হলে ধরে নিতো যে আমাদের দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। মিলিটারিরা সন্দেহমুক্ত হয়ে বলল, ট্রেন এসে আমাদেরকে দিনাজপুরে নিয়ে যাবে।

ট্রেন এলো দুপুর বারটায়। আমরা আবার ট্রেনে উঠলাম। এবার কোন বিপদ ছাড়াই ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। একঘন্টা পর ট্রেন দিনাজপুর প্লাটফর্মে পৌঁছাল। সবাই খুশিÑ বাড়ি চলে এসেছি। হেঁটে গেলে ত্রিশ মিনিটের পথ। প্লাটফর্ম থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়াবো, দেখলাম মিলিটারির গাড়ি। আমাদেরকে বেষ্টন করে গাড়িতে তুললো। বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত। গাড়িটা আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে চললো। ক্লান্ত অবসন্ন দেহ মনে সবাই আমরা ধরে নিলামÑ শহরের বাইরে নিয়ে  আমাদের মেরে ফেলা হবে।

পুলহাট পার হয়ে কে.বি.এম কলেজের দিকে ছুটলো গাড়ি। আমরা ছোটরা এই কয়েকমাসে আম্মাদের কাছ থেকে বিপদের দোয়া আরো কিছু ছোট দোয়া শিখে ফেলেছি। সবাই দোয়া পড়ে যাচ্ছি।

পিছনে মিলিটারির গাড়ি ছিল। রাস্তার পাশে মাইন পাতা ছিল গাড়ির চাকা মাইনে পড়া মাত্রই বিকট শব্দে চাকা ফেটে গেল। ধোঁয়ার আচ্ছন্ন হয়ে গেল জায়গাটা। গাড়িটা উল্টে যেতে যেতে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেল। পিছনে মিলিটারির গাড়িও থামল। ওরা গাড়ি থেকে ঝটপট নেমে মাটিতে শুয়ে পজিশন নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগলো।

গাড়ির ভিতরে আমাদের ত্রাহি চিৎকার কান্না আর জোরে জোরে দোয়া পড়া চলছে। সবাই ধরে নিয়েছে এবার আমাদের মেরেই ফেলবে। কিছুক্ষণ পর এক বাঙালি পুলিশ এসে গাড়ির দরজা খুলে আমাদেরকে নামতে ইশারা করলেন। আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলাম। পুলিশটা বললেনÑ সামনে মাশিমপুর স্কুল, সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। হিন্দুস্তান থেকে এসেছেন বহুদিন গরুর মাংশভাত পেটপুরে খাওয়া হয়নি। খাওয়া শেষে আপনাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া হবে। মাশিমপুর স্কুলে স্থানীয়দের তত্ত্বাবধানে রান্না হচ্ছিলো। রান্নাশেষে আমাদেরকে ভাত মাংশ  খেতে দেয়া হলো । বিকেল হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল এখান থেকে পালাই।

মিলিটারির গাড়ি এলে আমাদেরকে গাড়িতে উঠার নির্দেশ  দেয়া হলো। সবার মালপত্র নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। বাঙালি পুলিশ আমাদেরকে গুনে দেখলেন লোক ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর গাড়ি শহরের দিকে চলতে লাগলো। বাড়ির দিকে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিলো। রামনগর মোড়ে এসে আমাদের নামিয়ে দিয়ে মিলিটারির গাড়ি চলে গেল।

দুইতিনটা মহল্লার লোকদের আড্ডা, কিছু দোকানপাট আর বেতারের খবরকে কেন্দ্র এই রামনগর মোড় জমজমাট থাকে। দেশে যুদ্ধ চলছে বলে এখন লোকজনের তেমন ভিড় নেই। নয়তো রাত বারোটা অবধি লোকের আড্ডায় সরগরম থাকে এ এলাকা । তখনকার পরিস্থিতিতে বিকেল থেকে রাত আটটার মধ্যে লোকের আসা যাওয়া। কার কাছে কি খবর তা প্রচার হয় চায়ের আড্ডায়।

আমাদেরকে দেখে লোকজন ঘিরে ধরলেন। সবাই প্রায় পরিচিত । একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না। কথা বলতে যেয়ে অনেকের গলা ভারি হয়ে আসছিল। কিভাবে এসেছি তার বর্ণনা  শুনে সকলে নিরব হয়ে গেলেন।

এলাকাবাসীরা আমাদেরকে নিয়ে বাড়ির দিকে চললেন। কেউ বাচ্চা কোলে নিলেন, কেউ বাচ্চাদের হাত ধরলেন, সুটকেস পোটলা পুটলি আমাদের কাছ থেকে তাঁরাই নিয়ে নিলেন এবং বাড়ি পৌঁছে দিলেন।

লালবাগ দ্বিতীয় মসজিদের সাথে লাগানো বড়বাড়ি আর্চের উপর নকশা করা গেট পার হয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গ্রামে এখানে সেখানে ঘুরে দুই চাচা কয়েকদিন আগে বাড়ি ফিরেছেন, আমাদেরকে পেয়ে তাঁরা ভীষণ খুশি। বাড়িটা মুখর হয়ে উঠলো।

বেঁচে বর্তে বাড়ি ফিরে আসার আনন্দে বড় আম্মা কাঁদলেন। আমাদের ঘরবাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ঘরের দরজা খোলা জিনিসপত্র সব লুট হয়ে গেছে।

ফরিদপুরের ওয়াজেদ নামে এক লোককে আব্বা বাড়িতে রেখে গেছিলেন আর বলেছিলেন সুযোগ বুঝে সে যেন দেশে চলে যায়। বাড়ি এসে জানা গেল গ্রামে যখন কেউ ছিল না মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাছে সে থাকতো। মুয়াজ্জিন যখন বাড়ি চলে গেছিলেন, তখন ওয়াজেদ কোথায় গেছে নাকি দেশে ফিরে গেছে কেউ বলতে পারেন না।

বাড়ি এসে সবাই স্বস্তি পেয়েছিল। ভারতে অর্ধাহারে, মহামারিতে মৃত্যুর চেয়ে জন্মভূমিতে মৃত্যু অনেক ভাল।

যুদ্ধ বেড়ে চলছে খানসেনারা মরিয়া হয়ে উঠছে। এমন একদিন মিলিটারির গাড়ি মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ওখানে জাকারিয়া চাচাকে দেখতে পেয়ে তাঁকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়। বাড়িতে মরা কান্না, বড়রা আতঙ্কিত ছোটরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এখন তিনরাস্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আমগাছটার নিচে কেউ আর দাঁড়ায় না। বাড়ির পুরুষ লোকেরা দোকানে সওদাপাতি কিনতে যেতো চোরের মতো। দিনে কয়েকবার করে রাস্তায় মিলিটারির গাড়ি টহল দিতো। মিলিটারির গাড়ি দূর থেকে দেখা মাত্র রাস্তায় কেউ থাকলে চেনা হোক বা অচেনা Ñ কারো বাড়িতে ঢুকে আত্মরক্ষা করতো।

চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে গেল। গাড়ির শব্দ পেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। গাড়ি চলে গেলে বুকের ধুঁক ধুঁক বন্ধ হতো। পাঁচদিন পর খবর পাওয়া গেল জাকারিয়া চাচা জেলে বন্দি। এক লোকের মাধ্যমে খবরটা পৌঁছেছিল। আবার একদিন মিলিটারির গাড়ি আম গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। সে দিকেই সবার নজর ছিল। আমার দুইজন চাচাতো বোনকে কোঠাঘরের ছাদে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কারণটা পরে আম্মা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। মিলিটারিরা যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।

কয়েকটা জেলা শত্রুমুক্ত হয়েছে শুনে লোকের সাহস বেড়ে গেছিল। তার সাথে একটা খবর রটে গেলÑ যে পাকিস্তানি খানসেনারা এদেশ থেকে চলে গেলে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিয়ে যাবে। এই ভয়ানক খবরটা মানুষের খাওয়া নাওয়া রাতের ঘুম কেড়ে নিলো। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না।

রামনগর মোড়ের আড্ডা আর জমে না। দুই দিন আকাশে জঙ্গিবিমান চক্কর দিচ্ছিলো। মানুষের মনে এটাই ধারণা হলো যে এবার আকাশপথে যুদ্ধ হবে।

লোকেরা বাড়ির উঠানে বাংকার খুঁড়তে শুরুকরলো। ইংরাজি বর্ণমালার খ.ঘ.ঠ.ঋ ইত্যাদি ছাঁচে চার থেকে পাঁচ ফুট গভীর খাল তৈরি করা হচ্ছিলো। আকাশে বিমান দেখামাত্রই ছুটে বাংকারে ঢুকে পরতো। ভয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ভারত থেকে আসার এক মাস হয়ে গেল। আমরা খেলার সাথিরা ব্যাঙ্কারকে খেলার জায়গা করেছিলাম লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করতাম। কেউ রাগ করতো না হঠাৎ যদি আকাশ থেকে বোমা ফেলে আমরা তৎক্ষণাৎ  বাংকারে ঢুকে যেতে পারবো। বড়রা রেডিওর খবর শুনে কখনো ভয় পায় কখনো খুশী হয়। কুঠিবাড়ি আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি যাদের বাড়ি ছিলÑ সে গ্রামটা জনশূন্য। নানা-নানি, খালা-মামারা রামনগরে অন্যদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নানা একদিন নিজের বাড়ি দেখতে রওনা করেছিলেন। গ্রামে ঢুকে তাঁর মনে হয়েছিল এটি বুঝি ভূতের গ্রাম! কোন বাড়িতে কোন জনমানব নেই রাস্তায় বড় বড় ঘাস, কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ওদের ভয়ংকর চাহনি। নানা আর বাড়ির দিকে যান নি।

 

একেকটা দিন অতিবাহিত হচ্ছে আর শীত পড়তে শুরু করেছে। বাড়ির বাইরে ঘাসের ডগায় মুক্তাদানার মতো শিশির জমে থাকে। শিশিরে পা ভিজিয়ে কি যে আনন্দ! এখন ভয়ে ওদিক মাড়াই না।

মানুষের মধ্যে চরম উত্তেজনা একটা কিছু ঘটবে। যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করে মানুষ ভয়কে জয় করছিল। মানুষ একটা কিছু চায়Ñ হয় দেশ না হয় শেষ।

অবশেষে ডিসেম্বর এলো। জাকারিয়া চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার একমাস হয়ে গেছে। পনেরই ডিসেম্বর রেডিওর খবর শুনে মানুষ আশা নিরাশার দোলাচলে মুক্তির প্রহর গুনছিল।

আব্বা চাচারা চিন্তিত। হাতের কাছে চাকু, লাঠি, বল্লম। দফায় দফায় লোকজন জড়ো হচ্ছিলেন আর বলাবলি করছিলেনÑ আজ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা সামনে যা পাবে বোমা, কামান দিয়ে ধ্বংস করে দেবে।

সন্ধ্যার পর সব নিস্তব্ধ। ভয়ে কেউ বাড়ির বার হলো না। কোনভাবে খাওয়া সেরে বাতি নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকার। ফুপাতো ভাই মকসেদ বাংকারে বিছানা করে বউ বাচ্চা নিয়ে বসে থাকলেন। বাড়ির আর সবাই উঠানে জড়ো হয়ে একসাথে থাকলেন। অন্যান্য বাড়ির লোকেরা পরিবারসহ বড়বাড়ির উঠানে চলে আসলেন। সবাই একসাথে থাকলে সাহস বেশি। কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। প্রয়োজনে কথা বলছিলেন ফিস ফিস করে। চারিদিকে কেমন নিঝুম পরিবেশ কারো চোখে ঘুম নেই।

অনেকদূর থেকে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর পর গাড়ির শব্দ। সেই শব্দ একসময় দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল।

আমরা ছোটরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। প্রচণ্ড শব্দে চমকে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছিলোÑ বাড়ির উপরে বোমা পরলো। ঘরবাড়ি বড় এক ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো।

সবাই একসাথে  আল্লাহ আল্লাহ বলতে লাগলো। ছোটরা ভয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। বাড়ির সকলে পাগলের মতো একে অপরের হাত ধরে বাচ্চা কোলে নিয়ে হুড়মুড় করে মসজিদের দিকে ছুটলো। মসজিদে ঢুকে তার দরজা বন্ধ করে  দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পরে দরজায় টোকার শব্দ শুনে ভয়ে সবাই আড়ষ্ট।

মকসেদ ভাইযেরর গলা শুনে দরজা খোলা হলো। মকসেদ ভাই বাংকার থেকে বউবাচ্চা নিয়ে ছুটে এসেছেন। বাকরুদ্ধ হয়ে সবাই বসে থাকলাম। মেজোবাবা মোমবাতি জ¦ালিয়ে দিয়েছিলেন। বড়রা ফিস ফিস করে দোয়া দরুদ পড়ছিলেন। নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ রাত শেষ হয়ে ভোর হলো। কাকের ডাক শোনা যাচ্ছিলো। মেজোবাবা বললেনÑ ফজরের আজান দিবো। সাহস করে মসজিদের দরজা খুলে বের হয়ে আজান দিলেন তিনি। আব্বা আর চাচারা মসজিদের বারান্দায় নামাজ পড়লেন।

আকাশ আরো ফর্সা হয়ে এলো। রাস্তার আমগাছটার কাছে যেয়ে তিনরাস্তার দিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক কিছু কারো চোখে পড়ল না। মসজিদ থেকে বের হয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এলাম। রাতে ঠিক কি হয়ে গেল কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

প্রকৃতি ও পরিবেশ এতো নিরব ছিল যে কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না। সৃষ্টির এমনি এক নিয়ম যে বেঁচে থাকলে খেতে হয়। ঘরে শুধু চালের আটা আর গুড় ছিল। তা দিয়ে আম্মা চিতই পিঠা বানিয়ে আমাদেরকে খেতে দিচ্ছিলেন। আমরা রোদে বসে খাচ্ছিলাম। তখন সকাল আটটা হবে। হঠাৎ নিরব পরিবেশ খান খান হয়ে এলাপাথাড়ি গুলির শব্দ এগিয়ে আসতে লাগলো। পিঠার সম্পূর্ণ গোলাটা আম্মা কড়াইয়ে ঢেলে দিয়ে আমাদের হাত ধরে ছুটে পুকুরের ধারে আশ্রয় নিলেন।

কেউ কেউ বাংকারে ঢুকেছিলেন। দশ বা পনেরো মিনিট পর আমগাছের নিচে অনেক মানুষজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সবাই শ্লোগান তুলেছেÑ জয়বাংলা।

জাকারিয়া চাচা সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন। যে যেখানে লুকিয়ে ছিল সবাই দুমদাম করে বের হয়ে রাস্তার আমগাছের নিচে দাঁড়ালেন। বড়আম্মা চাচিরা ও আম্মাসহ বাড়ির সব বাচ্চারা ছুটে আসায় রাস্তায় ভীড় হয়ে গেল। জাকারিয়া চাচার বক্তব্য ছিল মুক্তিযোদ্ধারা জেলের তালাভেঙে বন্দিদের মুক্ত করেছে। দেশ স্বাধীন। মিলিটারিরা রাতে দিনাজপুরের সমস্ত বিহারীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে  জড়ো করেছে। রাত বারটার পরে মিলিটারির শেষ দলটি কাঞ্চন নদীর উপর রেলওয়ে ব্রীজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। রাতে ঐ শব্দটা বড় ভূমিকম্পের মতো ঘর বাড়ি কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মানুষের মন থেকে মৃত্যু ভয়, যুদ্ধ ভয় দূর হয়ে গেছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মানুষের যে কি আনন্দ উল্লাস বলে বোঝানো যাবে না। সেদিন দেখেছি  নারীপুরুষ শিশুবৃদ্ধ রাস্তায় নেমে এসেছিল। যে রমণী কখনও বাড়ির বাহির হয়নি সেও সাবলীল ভাবে লোকের ভীড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিক থেকে আসছিল মেশিন গানের গুলির শব্দে বিজয় ধ্বনি। ছয সাতজনের মুক্তিযোদ্ধার দল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আকাশে বন্দুক উচিয়ে গুলি ছুড়ছিল মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে গলা মিলিয়ে বার্তা দিচ্ছিল আমরা শত্রমুক্ত। অনেকের চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি। ছোট বেলার ঈদের আনন্দের সাথে তুলনা করলে স্বাধীনতার আনন্দ আমার হৃদয়ে অনেক বড় হয়ে জেগে উঠে আর শিহরণ জাগে। বিজয়ের দিন খুশিতে বুকভরে গেছিল সবার। ক্ষুধা তৃষ্ণা পায়নি। আম্মা আবার একটা মজা যোগ করে ছিল পিঠার পুরো গোলাটা কড়াইয়ে ঢেরে দিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়েছিল বাড়িতে এসে দেখলো খড়ির চুলার হালকা তাপে আপনা থেকে একটা বড় পিঠা তৈরি হয়ে গেছে। আমরা সবাই সেটা নিয়ে যা হাসাহাসি করছিলাম।

দুইদিনের মধ্যে সবাই বাড়ি ফিরে এলেন। প্রতিবেশীরা একে একে বাড়ি ফিরতে লাগলেন। কে কেমন ছিলেন সেই গল্পে  সবাই মুখর হয়ে উঠলেন। দিনগুলো উৎসবের মতো লাগছিল।

কয়েকদিন পর নয়নপুর থেকে দিনু মামা আম্মার কাছে এসে বলেছিল, রেজি, তোর কাছে কি মনকুটু এসছিল? আম্মা কাঁদি লেন, মামাও কাঁদছিলেন। মামা যতদিন বেঁচে ছিলেন খান সেনাদেরকে  গালি দিতেন।

মহিউদ্দিন বড়আব্বা দুইছেলে আসাদুর আর মিজুকে হারিয়ে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন। খুব একটা কথা বলতেন না।

 

আমাদের মনকুটু ভাই ফিরবেন না, আসাদুর ভাই, মিজু ভাই ফিরবেন না, সারা বাংলাদেশে আরো অনেকেই ফিরে আসেন নি, কোনদিন আসবেন না। তাদেরকে আমরা কখনো ভুলি নাই ভুলবো না। আমার মনে থাকবে আজীবন  সন্তানহারা, স্বজনহারা রক্তাপ্লুত বাংলাদেশের জন্মদিনটি। শুভ জন্মদিনÑ প্রিয় বাংলাদেশ।

 

 

লেখক পরিচিতি

খুরশীদা বেগম রানীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১০ আগস্ট দিনাজপুরে। তাঁর পিতা বদিউল আলম ও মাতা রেজিয়া খাতুন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েছেন দিনাজপুরেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার হোসেনপুর ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগে  শিক্ষকতা করেছেন। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালে ।

ছাত্রজীবন থেকেই লেখার প্রতি বিশেষ ঝোঁক। তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে দিনাজপুর উদীচীর প্রয়াসীসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত । তাঁর স্বামী দিনাজপুর সদরের রামনগরের বাসিন্দা রাজিউর রহমান বুলু । তাঁরা দুইপুত্রের গর্বিত জনক-জননী।

 

#
জনপ্রিয়

 সম্পদ : খুরশিদা বেগম

আপডেটের সময় : ১১:৪১:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

১৯৭১ সালের ঊত্তাল মার্চ। আমার বয়স তখন সাড়ে দশ। দিনাজপুর সদরের লালবাগ গ্রামে আমার নিবাস। বাড়ির সাথে লাগোয়া লালবাগ দ্বিতীয় মসজিদ। বাড়ির পূবদিকে খেলার জায়গা। অনেকটা মাঠের মতো। খেলা জমে আসরের নামাজের পর।

আমার আব্বার  নিজের ভাই ও চাচাতো ভাই মিলে তাঁরা ষোলজন। আমাদেরও ভাই বোনের কমতি নেই। বিকেলে মাঠে খেলতে যাই। উচ্চতা অনুযায়ী একদল খেলছেÑ কুমির তোর জলে নেমেছি। আরেক দল খেলছে বৌচি, কেউ বা দাড়িয়াবাধা কেউ গুটিবল। মা- চাচিরা রাস্তার যে দিকে আড়াল আছে সেখানে বসে আমাদের খেলা, চিৎকার-চেঁচামেচি ও মারামারি উপভোগ করেন। কমবয়সী চাচিরা আমাদের বড়বোনদের সাথে খেলায় নেমে পরেন। বৃষ্টি-বাদল ছাড়া প্রতিদিনের এই আয়োজন চলে আসছে বহুদিন ধরে।

কিছু একটা হয়েছে!  আব্বাসহ চাচারা জটলা করছে ক’দিন ধরে। খেয়াল করছিÑ তাঁদের মুখে ভয়ের কালোছায়া । কয়েকদিন আগে সবাই একসাথে বসে রেডিওর খবর শুনতেন আর সেসব শুনে নানা কথা’র ঝড় উঠতো। তো এখন আবার কি হলো!

আমাদেরকে খেলতে যেতে দিচ্ছেন না তাঁরা। ধমকে বাড়িতে ঢুকিয়ে রাখছেন। আমি আম্মাকে প্রশ্ন করে জেনেছিÑ নির্বাচনে বাঙালিদের ভোটে শেখ মুজিবুর রহমানের দল জয়লাভ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকে দিচ্ছে না। আম্মা বলছে, গণ্ডগোল বাধবেÑ যুদ্ধ লাগবে। এমন হলে বাড়িতেই থাকা যাবে না। বিভিন্ন জেলায় গোলমাল, মারামারি শুরু হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই বিহারীরা বাঙালিদেরকে মারছে। এসব শুনে ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেছি!

লালবাগ দ্বিতীয় মসজিদের সামনে তিনটি রাস্তা মিলিত হয়েছে। তিনরাস্তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটা প্রকাণ্ড আমগাছ। সারাদিন দফায় দফায় আমগাছের নিচে এ এলাকার অনেকেই জড়ো হন। রেডিওর খবর, দেশের খবর কে কি শুনলেন, কোথায় কি ঘটলোÑ এসব হরদম আলোচনা চলতে থাকে।

সে সময় স্কুল-কলেজে আমার পড়ুয়া চাচারা কেউ ছাত্র ইউনিয়ন, কেউ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কেউ ন্যাপ, কেউ কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িটা বড়বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। এই বাড়ির লোকদের উপরে যে কোন সময় হামলা হতে পারে। আব্বাসহ চাচারা ষোলোজন, আবার চাচাতো ভাইদের মধ্যে বড় ছিল কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে শলা-পরামর্শ হলো। হামলা হলে তা প্রতিহত করা হবে।

আমগাছটার নিচে রাত্রে পালা করে পাহারা থাকবে। হাতে লাঠি, চাকু আর বল্লম। আমাদের বাড়ির বড় চাকুটা নিয়ে আব্বাকে পাহারা দিতে দেখেছি।

এতো ভয়ের মধ্যেও আমরা কয়েকজন ভাইবোন একটা ব্যাপারে বেশ আনন্দে আছি। সে হলোÑ বিশেষ এই পরিস্থিতিতে পড়াশুনার বিষয়ে খানিকটা ছাড় পাওয়া।

সন্ধ্যায় মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমাদের লেখাপড়া চলতো। পড়া মুখস্ত করে আম্মাকে পড়া দিয়ে তারপর রেহাই। পড়তে পড়তে যখন ঘুমে টুপতে থাকি কিংবা কখনো ঢুলে পরলে আম্মা ধরে বসিয়ে দিতেন। বলতেনÑ পড়া শেষ করে তারপর খাওয়া। আম্মার এই কঠোর নজরদারির সময় কই আর!। যে চাচারা  রাজনীতি করতেন তারা রাতে বাড়িতে থাকতেন না। নদীর পাড়ে মাচায় শুয়ে থাকতেন। অবস্থা বুঝে সকালে বাড়ি আসতেন।

আমাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পূনর্ভবা নদী। স্থানীয় নাম কাঞ্চন নদী। শীতকালে আমরা নদীর ওপারে বনভোজন করতাম। নেতৃত্বে থাকতেনÑ বড় ভাইবোনেরা। আট বছরের কম বয়সে বনভোজনে কাউকে নেওয়া হয় না। দুইবছর থেকে আমি ছাড় পেয়েছি।

বনভোজনের সময় হলে আয়োজনের ধুম পরে যায়। চাঁদা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে কে কি দায়িত্ব নেবে তার তালিকা করা নিয়ে আলোচনা চলে বাইরের বৈঠক খানায়। বনভোজনের আগের রাতে বড় ভাইবোনেরা ঘুমাবেন না।  তাঁরা মজা করবেন, হইচই করবেন। আর দেখবেনÑ আয়োজনে কিছু কমতি আছে কি না। আগেরবার দেশলাই নেয়া হয়নিÑ যার কারণে চুলা জ¦ালাতে দেরি হওয়ায় রান্না, খাওয়াতেও দেরি হয়েছিল।এবার দেশলাই নিতে ভুল হয়নি।

বনভোজনের রাতে আমারও ঘুম হয়না এই ভেবেÑ যদি আমকে ফেলে সবাই চলে যায়। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসি। আম্মা বলেন, এখনো ভোর হয়নি, তুই ঘুমা। আমি তোকে ডকে দেব।

 

ভোরে যখন আকাশ ফর্সা হয়Ñ আমরা যাত্রা শুরু করি। নদীর ওপারে একটা গোলচত্ত্বর আছে শ্যাওড়া গাছ দিয়ে ঘেরা। ঐ জায়গাটাই আমাদের পিকনিক স্পট। আমাদের দলনেতা মানিক ভাই ছড়ি হাতে দলটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কারো উপর রেগে গেলে বলেনÑ এই ব্যাটা। আমাকেও বলবে এই ব্যাটা। আমার খুব রাগ হয়, আমাকে ব্যাটা কেন বলবেÑ আমি যে মেয়ে।

রান্না হয়ে গেলে সবাই একসাথে গোসল করতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরতাম। হুড়োহুড়ি করে একসময় পানি থেকে উঠে পরি। সে যে কি মজার দিন! খাওয়া দাওয়া, ছুেটাছুটি, হাসাহাসি, ঘাসের উপর গড়াগড়িÑ কত যে আনন্দ পেতাম।

সূর্য ডুবছে এমন সময় বাড়ির পথে আমরা রওনা হই। মানিক ভাই সবাইকে গুনে দেখবেনÑ জনসংখ্যা ঠিক আছে কি-না। নদী পার হয়ে, বাঁধ পেরিয়ে, কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে বাঁশবাগান। সেখানেই শুরু হয়ে যায় থালায় গ্লাস দিয়ে ঢোল বাজানো। আর একটু এগিয়ে তিন রাস্তার মধ্যখানে সেই আমগাছ। আম্মা চাচিরা বাড়ি থেকে জেনে যায় বাঁদরের দল ফিরে আসছে।

আব্বার নিজের ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে অন্যরকম একতা ছিল। কারো বড় অসুখ হলে সবাই পরামর্শে বসতেনÑ কোন ডাক্তার দেখালে ভাল হবে। ছেলেমেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে সব ভাইদের সম্মতি ছাড়া পাকা কথা দেয়া যাবে না। ছেলেমেয়েরা কোন স্কুল-কলেজে পড়বেÑ পড়ুয়া চাচা ফুপুরা সেটি ঠিক করবে। এই একতা ছিল বড়বাড়ির শক্তি। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে বড়বাড়ির বড়রা ঠিক করে ফেলেছেনÑ জীবন বাঁচাতে হলে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে।

বড়বাড়ির লোকসংখ্যা একশ’জনের বেশি। সিদ্ধান্ত হয়েছেÑ কে কোথায় যাবে। কাঞ্চন নদীর ওপারে গ্রামে যাঁদের আত্মীয় আছেন তারা সেখানে যাবেন। যার আত্মীয় নেই তিনি যাবেন আধিয়ার বা বর্গাদারের বাসায়।

মার্চ মাসের শেষদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া বেশি কিছু নিলেন না কেউ। গ্রামের লোকেরা দুই এক ঘর সরে গেছে। আমাদের গোষ্ঠির লোকজন পরিবার নিয়ে সবাই চলে গেলাম নদী পার হয়ে। একেক পরিবার একেক দিকে।

তেঘরা গ্রামে আমরা এক আধিয়ারের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে আরো কয়েক বাড়ি আত্মীয় হওয়ার কারণে আমাদের লোকজন সে সব বাড়িতে উঠলেন। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে বাড়ির লোকদের খবরাখবর নেয়া চলছিল। খুব মজা হচ্ছিলো। এ পাড়া ও পাড়ার লোকজন আমাদেরকে দেখতে আসছিল।

ওখানে একটা তালপুকুর ছিল। পুকুরের পাড় তাল গাছে ঘেরা। এখানে আসার আগে আমি সাঁতার শিখেছিলাম। পুকুরে গোসল করতে নেমেছি। পুকুরের পানি এতো কালো যে আমার ভয় লাগছিলÑ এই বুঝি কেউ পা ধরে টানলো। আমার মতো ছেলেমেয়েরা সাঁতার দিয়ে পুকুর এপার ওপার করছিল।

উত্তরের জেলাগুলোতে মার্চ মাসে সকাল-সন্ধ্যা শীত থাকে, হালকা কুয়াশা পড়ে। গাঁয়ে শীত আরো বেশি। আম্মা আমাদের জন্য হালকা শীতের কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন বলে রক্ষা।

ধানকাটা ও ধানমাড়াইয়ের মরশুম শেষ। সবার বাড়ির সামনে খড়ের স্তুপ। খড়-বিচালি জ¦ালানি দিয়ে মাটির হাঁড়িতে রান্না হচ্ছিলো। ঘরবাড়ি ছেড়ে কারোরই ভালো লাগছিল না। পাঁচদিন পর সিদ্ধান্ত হলোÑ আপাতত ভয়ের কিছু নেই, তাই বাড়ি  ফেরাই উত্তম।

বড়দের কথামতো বংশের সব পরিবার বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ। বাড়ির পুরুষরা পালা করে আবার পাহারা দিতে শুরু করলেন। লাঠি, চাকু, বল্লম সাথে নিয়ে সেই আমগাছটার নিচে।

সন্ধ্যার পর ভয়ে আমরা টু শব্দটি করি না। দেশে যুদ্ধ লাগবে। লোকজন গরু ছাগল বিক্রি করে হাতে টাকা রাখছে। কি জানি কখন কোন বিপদ হয়। আব্বার কাছে শুনলামÑ ব্যবসায়ীরা যেমন নতুন করে পণ্য কিনছেন না তেমনি কাউকে বাকিও দিচ্ছেন না। অফিসে কর্মচারিদের নামমাত্র উপস্থিতি। স্কুল-কলেজে যাচ্ছে না কেউ। লোকজনের মধ্যে দু:শ্চিন্তা, ভয়, অস্থিরতা বিরাজ করছে!

 

প্রাণের ভয়ে মানুষ বাড়ি ঘর ফেলে চলে যাচ্ছে। মানুষ বলাবলি করছে সারাদেশে  মারামারি, যুদ্ধ লাগবে বিহারী ও বাঙালিদের মধ্যে। দেশের কোন কোন জেলায় বাঙালিদের মেরে ফেলা হচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে খাওয়া নাওয়া ছেড়ে নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে। প্রতিদিন কোন না কোন পরিবার ঘরছাড়া হচ্ছে। এই অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশে আমরা সাতদিন থাকলাম। বংশের বড়রা বলছেনÑ  আর নয়। সবাই যে যার মতো শহর ছেড়ে চলে যাবো।

নদীর ওপারে সবাই মিলিত হবো। আম্মা সুটকেস গুছাচ্ছেন, পোটলা বাঁধছেন আর বলছেন, কপালে কি যে আছে? সহজে বাড়ি ফেরা হবে না এবার। বেশি প্রয়োজনীয় জিনিস, কাপড়, টুকিটাকি, আম্মার সোনার গহনা, হাতে যা টাকা পয়সা ছিল আর আমার ছোট চার ভাইবোনের দুধ রুটি খাওয়ার চারটা করে কাঁসার বাটি চামুচ পোটলায় ভরা হলো। এ ছাড়াও প্রথমবার যে জিনিসগুলোর প্রয়োজন বোধ করছিলেন আম্মা সেসবও নিলেন।  এবারে বাঁধা-ছাদা হলো দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে থাকার।

আমার পুতুল আর পুতুলের জামা-কাপড় যে গুলো দর্জির দোকান থেকে এÑে বুবুর হাতে সেলাই করে নিতাম, সেগুলো পোটলা করে আম্মার বেঁধে রাখা মালপত্রের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম। আম্মা দেখা মাত্রইÑ আমার পুতুলের ছোট পোটলাটা নিয়ে মারলেন এক ঢিল! আম্মা রাগ করে বলছেন, মানুষের জীবন বাঁচেনা। কোথায় থাকবো? কি খাবো? তার ঠিক নাই। এ পুতুল নিয়ে শখে বাঁচে না!

আমি সুযোগ বুঝে আম্মার চোখ এড়িয়ে পুতুলের পোটলা পরে ঠিকই মালপত্রের ভেতর ঢুকিয়ে  রেখেছিলাম। আমরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পরলাম অজানার উদ্দেশ্যে।

চৈত্র মাসে নদীর পানি কম কোথাও হাঁটু পানি কোথাও আরো কম। পানির নিচে ছোট মাছ আর বালি চিকচিক করছে। জীবন বাঁচাতে আমাদের মতো অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে নদী পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে।

আমরা প্রথমবার তেঘরায় যে লোকের বাসায় উঠেছিলামÑসেই অধিয়ারের বাড়িতেই উঠলাম। তারাও আতংকিত। শহর ছেড়ে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মৃত্যুর আতংক।

চারদিন পর আমার কাকা, ফুপু, চাচারা ছয়জন লালবাগের বাড়িতে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। আমি জেদ ধরে বসলাম, বললামÑ আমিও যাবো। আম্মা আমাকে কিছুতেই যেতে দেবেন না। আমার ছোট চাচাকে বংশের সব ভাইবোন কাকা বলে ডাকেন। কাকা বললেন, আমি তো যাচ্ছিÑ  রানী যাক। আমি ওকে দেখে রাখবো। জয়ের আনন্দে আমি সবার আগে দৌঁড়ে দৌঁড়ে হাঁটা দিলাম।

গত ক’দিনে নদী পারাপারে আমি চিনে রেখেছিলাম কোনদিকে কম পানি। নদীতে নামতে ভয় হলো না। পানিতে হাঁটতে মজা পাচ্ছিলাম। অল্প পানি হলেও তাতে বাতাসের টান থাকায় স্রোতের মতো সচল পানিতে হাঁটতে যেয়ে জোর খাটানোয় পা ব্যথা করছিল। সে জন্য আম্মা আমাকে বারণ করছিলেন।

বাড়ি পৌঁছে দেখি সবদিক কেমন খাঁ খাঁ করছে। আশেপাশের কোন বাড়িতে লোকজন নেই। থাকলেও দুই একজন বাড়ি পাহারায় আছেনÑ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমরা বাড়িতে ঢুকে আব্বাকে পাই। খুব ভোরবেলায় রওনা করে আমাদের অনেক আগে বাড়িতে এসেছেন। ফিরে এসেই গরু ছাগল সব ঠিক আছে কিনা দেখে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এদিকে ফুপুরা রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। মুরগী ধরেছেন, এখন আতপ চাল বের করছেন। আমি দারুণ খুশি। ছোট বলে আমার উপরে সবার চোখ। পুকুরে নামিস না, এখানে ওখানে যাস নে, আমাদের কাছে বসে থাক।

খানিকটা বসে থেকে আমি বাড়ির বাইরে বের হই। আমগাছের নিচটা একদম ফাঁকা। ক’দিন আগেও এখানে সবসময় লোকজনের আড্ডা লেগে থাকতো।

 

মসজিদের আঙিনায় প্রকাণ্ড ফজলি আমগাছটার নিচে আমের মুকুল ঝড়ে পরেছে। তার সাথে সাবু দানার মতো ছোট ছোট আম। তার কতকগুলো কুড়িয়ে হাতে নিয়ে ঘ্রান নিচ্ছিলাম। কি মিষ্টি গন্ধ আমের!

আব্বা আমাকে বললেন, তোর জামিল চাচা কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে এখন তেঘরা যাচ্ছে তুই চলে যা মা। কখন কি হয় বলা যায় না। আমি তোর ফুপুদের সাথে বিকেলে যাবো। আমিও ভয় পেলাম কারণ পরিবেশটা ভীষণ নিশ্চুপ ছিল। দূরে কেউ কথা বললেও কাছে শোনা যেতো।

দুপুর বারটার দিকে জামিল চাচা সহ বাড়ি থেকে বের হলাম। দলে দলে লোক পালাচ্ছে। গন্তব্য নদীর ওপার। আমি চাচার পিছন পিছন হাঁটছি। রাস্তা পার হয়ে নদীর বাঁধের নীচে লোকমানের আমবাগানে ঢুকেছি ঠিক তখন উত্তর দিক থেকে ভয়ানক শব্দে প্রচন্ড গতিতে ঝড় যেমন ধেয়ে আসে তেমনি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ, মেশিন গানের গুলির ঠা ঠা শব্দ, সাথে আতংকিত, ভীত মানুষের তুমুল চিৎকার। যারা পালিয়ে যাচ্ছিলো, তারা দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগলো নদীর পাড়ে।

চাচার ঘাড়ে ভারী একটা বোঝা ছিল কি সব জিনিসের। সেটা ফেলে আমাকে বললেন, রানী মা তুমি এখানে বসে থাক, আমি একটু এগিয়ে গিয়ে তোমার চাচা ফুপুুদের নিয়ে আসি। আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করছিলাম।

চাচা চলে যাওয়ার পরেই আমার সামনে দিয়ে সাঁ সাঁ করে একঝাঁক গুলি চলে গেল। আম গাছের কিছু পাতা আমার সামনে ঝরে পড়লো। আমি মাটিতে শুয়ে পরেছিলাম। ও আব্বা বলে কাঁদতে কাঁদতে উঠে একদেঁৗঁড়ে নদীর ঘাটে চলে এলাম। এক ভয়াবহ দৃশ্য। পুরো নদী সন্নিহিত এলাকা লোকে লোকারন্য। যে যে দিকে পারছে নদীতে নামছে। ওপারে গেলে কিছুটা নিরাপদ। নদীর উপরে একটা রেলওয়ে সেতু আছে। মানুষ বা যানবাহন পারাপারের কোন পুল নেই। আমি পানিতে হাঁঁটছি কখনো দৌঁড়াচ্ছি। একবার পরে গেলাম জামাকাপড় ভিজে গেল।

দেখলাম একটা সুটকেস পানিতে ভাসছে, এক মা তার দুই বাচ্চা কোলে নিয়ে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে এগিয়ে যেতে পারছেন না। এক লোক সাইকেলে পটলা পুটলি বেঁধে নিয়ে দুই বাচ্চাকে সিটে বসিয়ে নদীতে নামছে মাঝ নদীতে সাইকেল আটকে গেছে পোটলা দুটি পানিতে ভিজে এত ভারী হয়ে গেছে যে সাইকেলটা এগুচ্ছে না।

 

সমানে চলছে গোলাগুলি আর বোমা বিস্ফোরণের ভয়াল সব শব্দ। কখনো বোমার শব্দ মনে হচ্ছে বোমা বুঝি মাথার উপরেই পরছে! তখন ভয়ে সবাই হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠছেন, কেউ কেউ পানিতে দুমদাম শুয়ে পড়ছেন। আমিও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলেছি। পাগলের মতো প্রলাপ বকছিলামÑ আমার আব্বা কই রে, আমার কাকা কই রে, আমি হারিয়ে যাবো, আমি মরে যাবো।

নদী পার হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁদেছি। তারপর মানুষের ভীড়ে কিছুক্ষণ হেঁটেছি। পাকা রাস্তায় উঠে মনে পরে গেলো পূব দিকের রাস্তা দিয়ে গেলেই তেঘরা গ্রাম। সেখানে আম্মা আছেন, ভাইবোনেরা আছে। কোনদিকে না তাকিয়ে হাঁটছি, কখনো দৌঁড়াচ্ছি। এভাবে একসময় আম্মার কাছে পৌঁছে গেছিলাম সেদিন।

আমাকে একা দেখে আম্মা কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই সবার কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম। আমি হাঁপাচ্ছিলামÑ কিছু বলতে পারছিলাম না। এর কিছুক্ষণ পর আব্বা, কাকা, ফুফু, চাচারা নিরাপদে গ্রামে পৌঁছে গেলেন। আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এ গ্রামের লোকেরা  গোলাগুলি, বোমার শব্দে ভীত-সন্তস্ত্র! সবাই মনে করছিলেনÑ পুরো দিনাজপুর শহরটাই বুঝি মিলিটারিরা ধ্বংস করে দিচ্ছে।

 

তেঘরায় যে বাড়িতে আমরা ছিলামÑ সে বাড়ির লোকজন বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। কুয়ার ভিতরে কাঁসা পিতলের তৈজসপত্র ফেলে দিচ্ছেন।

আমাদের পরিবারের বড়রা সিদ্ধান্ত নিলো যে যেভাবে পারবে ভারতে যাবে। কোন কারণে যদি দলছুট হয়ে যায় একটাই গন্তব্যÑ পাশের দেশ ভারত। ছোট ছোট ভাই বোন নিয়ে আমরা বেশি দূর যেতে পারলাম না। আব্বার মামার বাড়ি গেলাম।

সেখানেও মাটির হাঁড়িতে ভাত, তরকারী রান্না হচ্ছে। খড়ের উপর বিছানা পেতে আমাদের শুতে দেয়া হলো। ওখানে দুইদিন থাকলাম।

 

পরদিন সকালে শহরের দিকে, দূরে থেকে দেখা যাচ্ছিল ধোঁয়া, আগুন বোমা বিস্ফোরণের শব্দে আকাশ-মাটি কেঁপে ওঠছিল। এখানকার গ্রামবাসীরা আমাদের মতো ভয়ে নিজেদের আবাস ও সহায় সম্বল  ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন।

কাঁধের ওপর ভার নিয়ে এর দুদিকে জিনিসপত্র, গরুছাগল, হাঁস-মুরগী, মুড়িরটিন এসব নিয়ে চলছেন। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে গরুর গাড়িতে করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। হয়তো অনেক দূরে তাদের কোন আত্মীয়ের বাড়ি তাদের গন্তব্য।

 

আমরা অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে পথে নামলাম। রাস্তায় জনস্রোত। যানবাহন বলে কিছুই নেই। আতঙ্কিত মানুষ হাঁটছে। কখনো কখনো বিকট শব্দে বোমা ফাটছেÑ মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথায় পড়লো। মানুষ ত্রাহি ত্রাহি চিৎকারে হুড়মুড় করে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিলোÑ আর রক্ষা নেই, এবার বুঝি আমরা মরেই যাবো।

শহরের আগুন পিছনে ফেরে আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে এমন সময় আমার এক খালুর সঙ্গে দেখা। খালা, খালাতো ভাইবোনদের সাথেও দেখা হলো। হাসিন খালু বললেন, সামনে রামপুর গ্রাম। সেখানে আমার পরিচিত লোক আছে। থাকার একটা ব্যবস্থা হবে।

খালুর পরিচিত লোকের বাড়িতে গেলাম। তাদের ঘর-বারান্দা, বৈঠকখানা পালিয়ে আসা লোকে ভর্তি। আমাদের জায়গা হলো বারান্দায়। আম্মা আর খালা এক সাথে কিছু একটা রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন।

বাড়িওয়ালার কাছ থেকে দুটা সপ নিয়ে আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা হলো। আব্বা কাপড় বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনদিন এভাবে থাকলাম। কারো হাঁটার শক্তি ছিল না। ছোটরা পা ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। চারদিনের দিনÑ দুপুরে আমরা খেতে বসবো ঠিক তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। শোরগোল পরে গেল মানুষেরÑ কে কেথায় আছো পালাও। মিলিটারিরা নদী পেরিয়ে গ্রামগুলোতে ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছে।

আম্মা ও খালার সে কি কান্না। এবার বোধহয় বাঁচবো না। খালু বলল, মরলে এক সাথে মরবো। দূরে ছেড়ে আসা গ্রামগুলোতে আগুন জ¦লছে। খাল, বিল, ক্ষেত, জঙ্গল দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার খালাতো বোন বানু আপা অন্তসত্ত্বা ছিলেন। তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। একটা পুকুরপাড়ে বানু আপা বসে পরলেন। কিছুতেই উঠতে পারছিলেন না, একটানা কেঁদেই চলেছেন। এই চরম বিপদের সময় তার প্রসবের ব্যাথা ওঠেছে।

কামানের শব্দ বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ক্রমে এগিয়ে আসছে। খালু আব্বাকে বললেনÑ ভাই তোরা চলে যা। আব্বা যেতে চাচ্ছিলেন না। খালু রাগ করলেন, তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেনÑ আল্লাহর দোহাই লাগে ওদের নিয়ে তুই চলে যা। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। পরিস্থিতি বুঝে আমরাও এখান থেকে চলে যাবো।

চলতে চলতে আখরগাঁ নামে একাট গ্রামে পৌঁছালাম। ওখানে নাড়াবাড়ির হাঁট বসে। দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল, তহসিল অফিস আছে। আমার ছোট খালু এই তহসিল অফিসে একসময় তহসিলদার ছিলেন। আমার ঠিক মনে নেই, শুনেছিÑ আব্বা আম্মা ছেলে মেয়ে নিয়ে একবার বেড়াতে এসেছিলেন।

আব্বার চেনা একজনের খোঁজ করে তার বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে গোলাগুলি থেমেছে।  তখন সন্ধ্যা। তহসিলদারের আত্মীয় বলে আমাদের খুব খাতির করলেন তাঁরা। মুরগি ধরে রান্না করে ভাত খাওয়ালেন। ঘর ছেড়ে দিলেন।

রাত পেরিয়ে সকাল হলো। আব্বা গ্রামটা ঘুরে দেখে এসে আম্মাকে বললেন, পরিচিত অনেকে এই গ্রামে এসেছে। তাদের কাছে  খবর পাওয়া গেল বানু আপুর ছেলে হয়েছে। মহিউদ্দিন ভাই বললেনÑ তারা ভারতে যাবেন না। আব্বা বললেনÑ আর যদি কোন  বিপদ না হয়, তাহলে আমরা এখানেই থেকে যাবো।

আমাদের সাথে আমার বৃদ্ধ দাদি ছিলেন। সবার পায়ে ব্যথা শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন। পরদিন কাকা আসলেন। আম্মার নানা প্রশ্নÑ কোথায় ছিলে? কোথা থেকে এলে? আর সবাই কই? কাকা বললেনÑ বোমা বর্ষণের দিনেই সবাই ভারতে চলে গেছ্ িএখান থেকে তিনচার মাইল দূরে ভারত। কাকা আব্বাকে বলল, এখানে থাকা ঠিক হবে না দাদা। তোমরা কালকে সকাল সকাল বের হয়ে ভারতে চলে আসো। আমি থাকার ব্যবস্থা করছি। আব্বার আরো পাঁচভাই তারা কোথায় আছেন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর বাড়ির সকলেই ভারতে চলে গেছে।

কাকার কথা মতো আমরা বেরিয়ে পরলাম। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে আব্বা দাদির হাত ধরে বেশ কিছু দূরে যেয়ে দাদিকে বসিয়ে রেখে আমাদের কাছে ফিরে এসে ছোট বোনকে কোলে নিয়ে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে, আম্মা আমাদের ছোটভাইটাকে কোলে নিয়ে একটা পোটলা হাতে রওনা হলেন। আমার বুবু ছোট দুই ভাইবোনের হাত ধরে আব্বার পিছনে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি একটা ছোট সুটকেস নিয়ে তাদেরকে অনুসরণ করলাম। দাদির কাছে পৌছে আমরা সবাই সে জায়গায় জড়ো হয়ে বসে গেলাম।

আব্বা আবার দাদির হাত ধরে বেশ কিছু দূরে যেয়ে দাদিকে বসিয়ে রেখে আমাদের কাছে ফিরে এসে আবার আমাদেরকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবেই এগুচ্ছিলাম। এমনি সময় হঠাৎ বোমা, কামান, গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। যুদ্ধটা যেন তাড়া করে আমাদের পেছনে পেছনে এগিয়ে আসছে। প্রাণের ভয়ে ভীত হয়ে আমরা এক সাথে হেঁটে গেলাম। আবার কাঁচা রাস্তার উপরে ভয়ার্ত মানুষের পায়ের শব্দ। বুলেট কামান এগিয়ে আসছে মানুষকে পদদলিত করে সীমান্ত পর্যন্ত  ছুটবে। আমরা মরে যাবো পাকিস্তনি মিলিটারির হাতে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় সীমানা পার হয়ে ভারতে প্রথম রেলওয়ে স্টেশন রাধিকাপুর পৌঁছেছিলাম। রাস্তায় অনেকবার জিরিয়ে নিতে হয়েছিল নয়তো আরো আগে পৌছাতে পারতাম। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে। কাকা অস্থির হয়ে  মানুষের ভীড়ে আমাদেরকে খুঁজছিলেন। আমাদের দেখা পেয়ে তিনি নিয়ে গেলেন স্টেশন মাস্টারের কোয়াটারে। এখানেই কাকা, ফুপুরা থাকার জায়গা করে নিয়েছেন।

পরিবারের বাকি লোকজন কয়েকদিন আগেই ভারতে পৌঁছেছেন। তারা পরবর্তী রেলওয়ে স্টেশন ডালিমগাঁর মুসলমান পাড়ায় জোহাক চাচার বন্ধুর বাড়িতে উঠেছেন। এই কোয়াটার লোকে ভর্তি। সবাই শরণার্থী।

আমাদের জায়গা হলো বারান্দায়। রাতে  বেশ ক’জন ছেলে উঠানে বিছানা পেতে শুয়েছিল। পরদিন দেখলাম জুলেখা ফুপুু চাদর দিয়ে অনেকগুলো বন্দুক ঢেকে রাখছিলেন। বাচ্চাদেরকে কাছে যেতে দিচ্ছিলেন না।

বাইরে বের হলাম। আমার ছোট প্রাণটা হু হু করে উঠলো আমাদের বাড়ির জন্য। কোথায় আমাদের বাড়ি, সেদিকে তাকিয়ে চেষ্টা করলাম কিছু দেখা যায় কিনা!

অনেক দূরে ছবির মত ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে । প্লাটফরম শরণার্থী দিয়ে ভর্তি। দুইদিন পর রাতে ভয়ংকর অবস্থা! খানসেনারা সীমান্ত পর্যন্ত ছুটছে। দূরে দেশের শেষ গ্রামগুলো আগুনে জ্বলছে। গত দুইদিন আগে ঐসব গ্রাম পার হয়ে এসেছি আমরা। কামান আর বোমার শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকার বাড়ছে আগুনের শিখা। কামানের গোলা মনে হচ্ছে আশেপাশে পড়ছে।

এসব দেখে ভয়ে আমরা কান্না শুরু করেছি। আব্ব কে বলেছিÑ এখানে থাকবো না। এখান থেকে পালাই। কাকা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কাকা বললেনÑ দুর বোকা এখানে কোন ভয় নেই, আমরা ভারতে আছি, কিচ্ছু হবে না। মা তুই ঘুমা তো। আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। যখন কামানের আওয়াজ কমে গেল তখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকালে উঠে কোয়াটারের দরজা থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে গেলেÑ দেখা যাচ্ছে দূরের গ্রামগুলো পুড়ে গেছে! তখনও ধোঁয়া উঠছে সেই  পোড়াভস্ম থেকে।

দলে দলে লোক ভারতে চলে আসছে। অনেক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। সবার কাছে কাকা খবর জানতে চাচ্ছেনÑ কে কি অবস্থায় এতো দূরে এসেছেন। অমুকে কোথায়, তমুকে কোথায়, কেমন আছেÑ এইসব। ক্লান্ত অবসন্ন মানুষগুলো কিভাবে পালিয়ে এসেছেন বলতে বলতে কাঁদছেন। যারা শুনছে তারাও কাঁদছে। সবাই যেন সবার অন্তরের আপনজন।

আমরা এখন উদ্বাস্তু, শরণার্থী। লোকজনের কাছ থেকে কাকা খবর জেনেছেন মহিউদ্দিন বড় আব্বার দুই ছেলেকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে আখরগাঁ থেকে। আমরা আখরগাঁ থেকে সকালে বের হওয়ার পর দুপুরের দিকে আখরগাঁয়ে খানসেনারা হামলা চালায়।

বড় আব্বার দুইছেলে মিজু আর আসাদুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে  গেছে।

এই ভাইয়া দু’জন সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে আসতেন। আমরা সব ভাইবোনের দল ছুটে যেতাম। আমাদের সাথে কি যে মজা করতেন। আমরা আসাদুর ভাইকে নানা বলে খেপাতাম। সবার মন খারাপ । চাচা কাকা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। এই আশ্রয়টা আমাদের ছাড়তে হবে। দুই দিন পরে স্টেশন মাস্টারের পরিবার আসবে। অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রেলওয়ে বিল্ডিং এর পাশে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, সেখানে থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। ঘর তুলে নিতে হবে। বাঁশ খড় কিনে লোক দিয়ে আব্বা ঘর তুলে নিলেন। আমরা সেই ঘরে এসে উঠলাম। আমাদের আগে দুই একজন ঘর তুলে থাকতে শুরু করেছেন। আরো কিছু পরিবার এলেন। কেউ ঘর তুললেন, কেউ তাঁবু ফেললেন।

তাদের অনেকেই আব্বার পরিচিত ও একই শহরের বাসিন্দা। এরমধ্যে আর একটা ঘর উঠলোÑ সেটা চাচির ভাই জালাল মামার। মামি আর মামাতো ভাইবোনদের পেয়ে আমরা মহাখুশি। মামার বড় ছেলে ইদ্রিস ভাইয়ের কাছে আমরা অংক শিখতাম।

চাচা ফুপু কাকা দাদিকে নিয়ে ডালিম গাঁয়ে চলে গেলেন। আব্বার কথাÑ এখানেই থাকা শ্রেয়। এখান থেকে দূরে তাকিয়েও নিজের দেশটাকে দেখতে পাবো।

কিন্তু প্রতিদিন সীমান্তে যুদ্ধ চলছে। সামনে খোলাপ্রান্তর। সব দেখতে পাচ্ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা মাটিতে শুয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ কামানের শব্দ প্রকম্পিত করে রাখছে। আম্মা বলছেনÑ আরমান ঠিকই বলেছিল এ জায়গাটা নিরাপদ নয়। এখানকার ফাঁকা জায়গাগুলো ভরে গেছে খড়ের ছাউনিতে। কোনমতে একটা ঘর বা তাঁবু ফেলে মানুষ দিনযাপন করছে। মানুষের গৃহস্থালি উজাড় হয়েছে, ঘরের স্ত্রী কন্যা পথে বসেছে, লজ্জা সম্ভ্রম নষ্ট হচ্ছে। শত মানুষ ব্যবহারের ফলে বিশাল পুকুরে স্বচ্ছ পানি ঘোলাটে হয়ে গেছে।

রামকৃষ্ণমিশন থেকে শরণার্থীদের বিনা পয়সায় ঔষধ দেয়া হচ্ছিলো। পাঁচ-ছয়দিন পর আম্মার গহনা বিক্রি করতে ভোরের ট্রেনে আব্বা রায়গঞ্জে গেলেন। যাওয়ার সময় জালাল মামাকে আব্বা বলে গেলেনÑ এরা থাকলো, দেখবেন। বিকেলের ট্রেনে আমি ফিরে আসবো। পরিস্থিতি শান্ত ছিল। বেলা এগারটার দিকে সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ ভাবে। খান সেনাদের ছোড়া কামানের গোলা, ভারতের রাধিকাপুরে যত্রতত্র পড়তে শুরু করলো। আতংকিত মানুষের চিৎকার, বাঁচার আকুতি, কান্না যেন কিয়ামত হয়ে নেমে এলো।

কুটির আর তাঁবুর সংসার ফেলে ছেড়ে আসা ভয়ার্ত মানুষ পালাতে লাগলেন। আমরা আম্মাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম, আম্মা কাঁপছিলেন। আব্বা রায়গঞ্জে যাওয়ায় আম্মা দিশেহারা।

এদিকে জালাল মামা তার মালপত্র গুছিয়ে আমাদেরকে ডাকছেন। আম্মাকে বলছেন, বুবু আমাদের সাথে চলেন এখানে বিপদ। আমরা তাদের সাথে বের হয়ে গেলাম। পেছনে সবকিছু পরে থাকলো।

সরু রাস্তা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। দলে দলে লোক দৌঁড়ে পালাচ্ছে। আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে পরিমরি করে ছুটছি। জালাল মামা আর আমরা পাঁচ গজ দূরত্বে দৌড়াচ্ছি। আমরা জালাল মামাাদের পিছনে।

হঠাৎ বিকট শব্দে মনে হলো আমাদের মাথার উপর বোমা পরলো। কি হয়ে  গেল বুঝা যাচ্ছিল না। শুধু ধোয়া আর ধোয়া চিৎকার আর কান্না। দুই তিন মিনিট পর আম্মা উঠে ছেলেমেয়েদেরকে একে একে দেখে নিলেন। উঠে সবাই হাঁটতে শুরু করলাম। বোমা পরার আগে মামাদেরকে যেখানে দেখেছিলাম সেই জায়গাটায় এতো রক্ত! আম্মা ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে মামাদেরকে খুঁজছেন।

ভয়াবহ এক পরিস্থিতি চোখের সামনে! আমরা সবাই দেখতে পেলামÑ রাস্তার পাশে টিউবওয়েলের নিচে জালাল মামার ছয় বছরের মেয়েটা নেতিয়ে পরে আছে আর বার বছরের ভাই ইলিয়াস টিউওয়েল চেপে বোনের শরীরে পানি ঢালছে। পানিতে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে! আমরা হতভম্ভ হয়ে দেখছি।

আম্মা পাগলের মত করছেনÑ একি হলো! ইলিয়াস তার ছোট বোন নাসিমাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। শরীরটা নিথর হয়ে আছে। ইলিয়াসের সামনে মাথা আর দুই হাত ঝুলছে পিছনে কোমর আর দুই পা ঝুলছে। আম্মা কাছে টেনে নিলে বলল, এখানে বোমা পড়ছে আমরা তো আছি আমার সাথে চলো। আমি দেখলাম নাসিমার কোমরে একটা গর্ত লাল হয়ে আছে। আর হাটুর নিচের মাংশটা খুলে পরে ঝুলছে।

ইলিয়াস কেঁদেই চলছে। মামা মামি মামাতো ভাই বোন কোথায় হারিয়ে গেছে। আম্মা ওকে সান্তনা দিচ্ছে বলছে সামনে গেলে সবাইকে পাওয়া যাবে। মৃতবোনকে কাঁধে নিয়ে ইলিয়াস ও আমরা হেঁটে চললাম। কিছুদুর পর একটা নদী। অনেক লোক নদী পার হয়ে চলে যাচ্ছে। আমাদের সাথে বড় কোন ছেলে মানুষ নেই শুধু আম্মা অভিভাবক। ঐ সময় আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। যুদ্ধ তাড়া করছে পালাতেই হবে। নদীটা ছোট পাড় খুব উচু মাটি পিচ্ছিল আর লাল। পাড়ে উঠে ডিগবাজি খেতে খেতে নদীর পানিতে ঝুপঝাপ করে পরলাম দুই জন। নদীর ওপাড়ে যেয়ে ঘাসের উপরে সবাই বসে পরলাম। ইলিয়াস বোনকে ঘাসের উপরে শুইয়ে দিলো। প্রাণভয়ে ছুটে চলা লোকজন আমাদের দেখে উহু! আহা! করছে। অনেকে বলছে আমাদের  সাথে চলেন সামনে গেলে আপনাদের লোকজনকে অবশ্যই পাওয়া যাবে।

কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আম্মা মাঝে মাঝে আবোল তাবোল বকছেন আর কাঁদছেন, ইলিয়াসও সমানে কেঁদে চলছে।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখলামÑ তিনচারজন লোক আমাদের খোঁজে এগিয়ে এসেছেন। তারা কে কে ছিলেন ঠিক মনে নেই, তবে এর একজন ছিলেন রমজান ভাই। আম্মাকে তিনি বললেনÑ চাচি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আপনি এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। অল্প কিছু দূর গেলেই ডালিম গাঁ। ওখানে সবাই আছে। বোনের লাশটাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়া হলো।  স্থানীয় কৃষকরা মাঠে কাজ করছিল। তাদের কাছ থেকে কোদাল নিয়ে কবর খুঁড়ে রেললাইনের ধারে আমগাছের নিচে ছোট বোনটাকে কবর দেয়া হয়েছিল।

আমরা রেললাইন ধরে রাস্তা হেঁেট একসময় ডালিম গাঁয়ে পৌছালাম। কাকা, আব্বা আমাদেরকে পেয়ে নতুন প্রাণ পেলেন। আম্মাকে ঘিরে সবাই  শোকাবহ খবরটা শুনলেন। কিছু আত্মীয় চলে গেলেন নাসিমাকে কবর দিতে।

পাশেই আরেক ভীড়ের মধ্যে দেখি মাথায় ঘোমটা টানা এক মা, তাঁর মুখখানি ঠিক দেখা যাচ্ছিলো না। তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন। পরে খেয়াল করলাম ঘোমটা টানা এই নারী আর কেউ নন, তিনি আমাদের  মামি। তার কোলে মৃত বাচ্চা, শাড়িটা রক্তাক্ত! পরিচিত-অপরিচিত মহিলারা মামিকে ঘিরে আছেন।

রেলস্টেশনের ধারে মাথায় ছাদ ছিল না, সবাই মাটিতে বসেছিলেন। নাসিমাকে কবর দিয়ে এসে মামির কোলের  বাচ্চাটিকে ডালিমগাঁয়ে কবর দেয়া হয়েছিল।

রাধিকাপুর থেকে যখন আমরা জান বাঁচাতে একসাথে  আসছিলাম। জালাল মামা আর মামি ছিলেন আমাদের সামনে। ছেলেমেয়েরা সব তাঁদের সাথেই ছিল। একটা বোমা ঠিক তাদের উপরেই এসে পড়ে। ইদ্রিস ভাইর পিঠের ওপর ছিল ছোট বাচ্চাটা। বোমার আঘাতে সে ক্ষত বিক্ষত হয়।

ঐ সময় লাইনে একটা ট্রেন থেমে ছিল ডালিমগাঁ অভিমুখী। ঘটনার আকস্মিকতায়  হতভম্ব হয়ে তাঁরা ঐ ট্রেনে উঠে পরেন। ভুলে যান ইলিয়াস আর নাসিমার খোঁজ করতে। তারা ভেবেছিলেনÑ ইলিয়াস আর নাসিমাকে মানুষের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে।

রেলওয়ে প্লাটফর্মে বহুলোক রাত্রিযাপন করলেন, তার মধ্যে আমরাও ছিলাম। মামির কান্না আর থামছিলো না।

পরদিন ভোরে সাহস করে আব্বা রাধিকাপুর গেলেন। সেখানে কুঁড়েঘরে আমাদের সব জিনিসপত্র ছিল। পরিস্থিতি তখন শান্ত। আব্বা সকাল দশটা নাগাদ  আমাদের সুটকেস, পোটলা, জিনিসপত্র নিয়ে ডালিমগাঁয়ে ফিরে এলেন।  কাকা আমাদের নিয়ে শংকরপুরে মুসলমান পাড়ায় উঠলেন। সেখানে আমার ছয়জন চাচা, ফুপু, দাদি, ভাইবোন বাড়ির অর্ধেক লোককে পেলাম। খুশিতে সব ভুলে গেলাম। জোহাক চাচার বন্ধু হামিদুর চাচার বাড়িতে দুইটা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। বাকি লোকদের বারান্দা, বৈঠকখানা, মসজিদের বারান্দা, পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে থাকার ব্যবস্থা হল। কয়েকদিন পর আমার আরো চার চাচা তাঁদের পরিবার নিয়ে উপস্থিত হলেন। ষাট থেকে সত্তরজন  হলাম আমরা।

ডালিমগাঁ থেকে সোজা রাস্তা ধরে দুই মাইল পর শংকরপুর, সেখানে রাস্তার ধারে একটা স্কুল। স্কুলের উল্টো দিকে মেঠোপথ ধরে গেলে একটা খাল। খালের ওপরে বাঁশের সেতু পার হয়ে আমবাগান, বাঁশবাগান পার হয়ে মুসলমান পাড়া। সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। আর স্কুলের আশেপাশে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি। স্কুলটা ছিল পাকা। চতুর্দিক বারান্দা। সেখানে পুরাতন স্কুল ছিল চৌচালা পরিত্যক্ত। বেড়া বা দেয়াল ছিল না। গ্রামপ্রধান ও স্কুলকমিটির অনুমতি নিয়ে চৌচালা স্কুলঘরটি খড় আর বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো। আমরা সহ ছায়জন চাচার পরিবার মুসলমানপাড়া থেকে স্কুলঘরে এসে উঠলাম।

কি যে আনন্দ পেলাম। বিশাল লম্বা একটা ঘর কার কোনদিকে বিছানা পাতা হবে ভাগাভাগি হয়ে গেল। একদিকে কয়েকটা চুলা তৈরি হলো।

ঘরের সদস্য-সংখ্যা সাইত্রিশ জন। গল্পগুজব, হৈচৈ, হাসিকান্না, খাওয়া দাওয়া সব একসাথে। ভাইবোনের সংখ্যা বেশি ছিল সবাই এক ঘরে বলে আমোদে ছিলাম। বড়দের মনটা কিছুটা স্থির হলো। তাড়া খেয়ে আর ছুটতে হবে না।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা খুব ভাল ছিলেন। তিনি বললেন স্কুলের টিউবওয়েল বেড়া দিয়ে ঘিরে মহিলারা ব্যবহার করবেন। স্কুল ছুটির পর টয়লেটের চাবি আমাদেরকে দিয়ে যেতেন।

পাশে একটা পুকুর ছিল সেখানে ছেলেরা গোসল করতো। মুসলমান পাড়ায় যারা আছেন তারা মাঝে  মাঝে স্কুলেঘরে বেড়াতে আসতেন। তখন আম্মা চাচি  বড়মা গল্পে মেতে উঠতেনÑ মনে হতো এ যেন লালবাগের বাড়ি।

মুসলমান পাড়ায় পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে জামিলচাচা,চাচি ও ভাইবোনের আবাস।  ঐ ঘরে চাচির ফুটফুটে একটা মেয়ে জন্ম নিল। তার নাম রাখা হয়েছিলÑ ভারতী।

সমীরবড়আব্বা সিন্ধি গাভিটাকে খুব ভালোবাসতেন, গাভীটাকে নিয়ে ভারতে গেছিলেন। আমার আরো চারজন চাচা ভারতে যাননি। আজ এ গ্রাম, কাল অন্য এক গ্রাম এভাবে পালিয়ে বাংলাদেশেই ছিলেন। আমাদের থাকার জায়গাটা ঠিক হলেও বড়রা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। বাড়ি থেকে আনা সবার হাতের টাকা পয়সা শেষ হয়ে আসছিল। কয়েকমাস হলো দেশে যুদ্ধ চলছে, বাড়ি ফেরার উপায় নেই। ভারতের ক্যাম্পগুলোতে যেসব শরণার্থী আছে তাদের রেশনকার্ড হয়েছে।

আমাদের পরিবারগুলো একে একে শরণার্থী ক্যাম্পে সারাদিন থেকে রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করে ফেললো। রেশনের মোটাচালের ভাত খেয়ে পেটব্যথ্যা করতো, পেটখারাপ হতো। তখন কারোই কিছু করার ছিল না।

 

নুরুলচাচা তাঁর রেডিওটা নিয়ে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর সবাই স্কুলমাঠে বসে খবর শুনতেন বিবিসি আর আকাশবাণী। আকাশবাণীর খবর পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ঐ নামটা এতো শুনেছি যে এখনো কানে বাজে। দেশের কোথায় কি হচ্ছে কতজন খানসেনা ঘায়েল হলো, মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় কোথায় অপারেশন করছে, বাংলাদেশ সরকার কি ব্যবস্থা নিচ্ছেÑ এসবই ছিল প্রধান খবর।

জোহাক, জাফর, জাহেদুর, সাজ্জাদ চাচা লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিলো। ঘারে বন্দুক নিয়ে কয়েকজন আসতেন। চৌচালা স্কুল ঘরের পাশে চাচাদের সাথে অনেকরাত পর্যন্ত ফিসফাস চলতো। দেশের খবর খারাপ হলে আম্মা, বড় আম্মা চাচীরা নামাজে কাঁদতেন, কোরআন পড়তেন। বড় আব্বা তাঁর সিন্ধি গাভীটা বিক্রি করে দিলো। কারো অসুখ করলে দুইমাইল হেঁটে ডালিমগাঁয়ে রামকৃষ্ণমিশন থেকে বিশ পয়সায় ঔষধ আনতে হতো।

 

বর্ষা এসে গেল। গ্রীষ্মের তাপে পুড়ে যাওয়া ঘাস-গুল্ম মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। রাস্তার দু’ধারের পাট গাছগুলো এক মানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠলো।

মুসলমান পাড়ায় যাওয়ার সাঁকোটা হঠাৎ ভেঙে যাওয়ায় চাচিরা আসতে পারছেন না, আম্মারাও যেতে পারছেন না। খালের ওপারে লোকেরা কলাগাছের ভেলায় করে খালপার হচ্ছিলেন।

ক্যাম্পে তাঁবুঘরে যারা ছিলেন তারা চরম দুরাবস্থায় পরলেন। বৃষ্টির পানি হয়তো  ঠেকানো যেত কিন্তু কলেরা আর জ¦র ঠেকানো গেল না। ক্যাম্প থেকে লোক পালাতে শুরু করলো। কিন্তু যাবেন কোথায়? কে দেবে আশ্রয়? পাকা স্কুলের চতুর্দিকে বারান্দায় মানুষ  আশ্রয় নিলেন।

ধীরে ধীরে অনেক কয়টা পরিবার স্কুলের বারান্দায় জায়গা নিয়েছেন।

স্কুলছুটির পর সবগুলো ভাইবোন বারান্দায় খেলা করতাম। আমি একদিকে পুতুল নিয়ে বসতাম। যে পুতুল আমি চুপ করে পোটলার ভিতরে ঢুকিয়ে রাখছিলাম। আম্মা পরে হেসেছেন। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি। এতো লোকের ভীড়ে আশোপাশের পরিবেশ নোংরা হয়ে গেল। যুদ্ধের তাড়া খেয়ে মানুষগুলো ঘরবাড়ি ফেলে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন কলেরা রোগের তাড়া খেয়েÑ মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকিতে আছেন।

স্কুলের বারান্দায় কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এক পরিবারের কর্তা মারা গেলেন, তাকে দুপুরের দিকে দাহ করা হলো। রাত্রে মৃত ব্যক্তির বৃদ্ধ মা মারা গেলেন। হিন্দু হওয়ার কারণে স্থানীয় লোকের সহায়তায় বৃদ্ধাকে দাহ করা হলো। পরদিন একই পরিবারের বাচ্চা মারা গেল। স্বামী, শ্¦াশুড়ী বাচ্চা হারায়ে বউটার কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে গেছিল। পরপর তিনটা মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছিল না। বউটার আহাজারিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো।

বারান্দায় অন্যান্য বাসিন্দারা কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে অন্যত্র চলে গেলেন। এতো লোক গম গম করতো যে জায়গাটা সেটা মুহুর্তে শ্মশানে পরিণত হলো। স্কুলটার দিকে তাকালেই গা ছম ছম করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা হাঁড়ি, কাগজ, আধপাড়া খড়ি, ছাই আর চুলার চিহ্ন থেকে গেল। এতগুলো লোক দুইমাস ধরে থাকলো হঠাৎ চলে যাওয়ায় অনেক বেশি শূন্য মনে হচ্ছিলো। আমরা ঐ দিকটাতে পা মাড়াই না। মানুষগুলো কোথায় গেল কে জানে!

আমাদের দিন কাটছিল ভীষণ আতঙ্কে। আগের মত নি:সংকোচে কেউ চলাফেরা করতে পারছিল না। একটা ভয় আঁকড়ে ছিল। এই সাইত্রিশজনের মধ্যে যদি কেউ কলেরায় আক্রান্ত হয়। কিছু করার ছিল না। আমরা চৌচালা স্কুলঘরটাতেই থেকে গেলাম আল্লাহর উপর ভরসা করে। ঘরের আশেপাশে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হতো। বড় আম্মা, আম্মা, চাচিরা সবসময় দোয়া পড়তেন। ছেলেরা যে যখন রাতে টের পেত নামাজ পড়ে দোয়া করতো। আল্লাহর রহমতে আমরা ভালই ছিলাম। শুধু স্কুলের বারান্দায় খেলা করা বন্ধ হয়ে গেল ভয়ে। কয়েক সপ্তাহ পর স্কুল মাঠ, বারান্দা পরিষ্কার করে, নতুন রং করে যথারীতি স্কুল চালু হয়ে গেল।

পাকিস্তানি শাসকরা জেলায় জেলায় শান্তি কমিটি করেছে। স্কুল খুলতে বলছে। অফিসে যেতে বলছে। যারা দেশে আছে তারা চাকুরি হারাবার ভয়ে অফিস করছে। তারা বলছে দেশে নাকি শান্তি বিরাজ করছে। লোকজনকে বাড়ি ফিরতে উৎসাহিত করছে। মানুষ বাড়ি ফিরে আসতে সাহস পাচ্ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন করাই ছিল বাঙালির কাম্য। আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছেনÑ লোক মারফত জানা যেতো।

দিনাজপুর উপজেলা পরিষদের পিছনে আমাদের মামাবাড়ি। আব্বা খবর পেয়েছিলেনÑ মামারা খানপুর বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকেছেন। কিছুদিন পর আবার খবর পাওয়া গেল বল্টু মামার স্ত্রী ও বাচ্চা কলেরায় মারা গেছে। দিনু মামার ছেলে মনকুটু জন্মের পর মা মারা যায়, মামা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কি যেন একটা ভাল নাম ছিল মনে নেই। সবাই মনকুটু বলে ডাকতো দশম শ্রেণিতে পড়তেন। মামার সাথে রাগারাগি করে বাড়ি চলে যাচ্ছি বলে মনকুটুভাই ক্যাম্প থেকে বের হয়ে  গেছেনÑ আর ফিরে আসে নাই। মামা খোঁজ করে নিশ্চিত হয়েছিল যে মনকুটু বর্ডার পার হয়ে বাড়ির দিকে চলে গেছে। আজও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আম্মা কাঁদতে শুরু করলো ভাত খেলো না রান্না করলো না। আমার বড়আব্বা, মেজোবাবা ভারতে যাননি। যুদ্ধের তাড়া খেয়ে আজ এক গ্রাম কাল অন্য গ্রামে আশ্রয় নিতেন। কিছুদিন পর আবার একটা খারাপ খবর এলো আমার বড় আব্বা জ¦রে মারা গেছেন। আব্বা আর কাকার সে কি কান্না। আব্বার এমন কান্না কখনো দেখি নি। আব্বা উদভ্রান্তের মতো বাড়ি চলে আসতে চাচ্ছিলেন। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে তাঁকে থামানো হলো। এখন গেলে ভাইকে দেখতে পাবে না মারা যাওয়ার তিনদিন পর খবরটা এসেছে।

আব্বা কয়েকটা দিন ঠিক মত খাওয়া করলো না। আম্মা কাঁদছে আমরা কাঁদছি। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। বড় আব্বা যে কি ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কারো উপর রাগ করতেন না। কাউকে গালি দিতেন না। আমাদেরকে খুব আদর করতেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য আব্বা অস্থির করছিলেন সাথে কয়েকজন চাচাও।

তাঁদের কথা হচ্ছে যুদ্ধের মধ্যেও দেশে মানুষ আছে। তারা কিভাবে আছে আমরাও না হয় সেভাবে থাকবো। বড় ছেলে মেয়েদেরকে মুসলমান পাড়ায় ভাইদের কাছে রেখে দেবো। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে।

দেশের মানুষেরা চরম দুশ্চিন্তায় আছে। যারা ভারতে আছে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যারা দেশে আছে সারাক্ষণ প্রাণভয় তাড়া করছে তাদের।

যে গ্রামগুলোতে লোকজন বেশি আছে, অন্যগ্রামের লোকজন সেই গ্রামে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। লোকবলে সাহস বেশি। কোন কোন গ্রাম জনশূন্য। পোড়া ঘরবাড়ি ভুতের মত দাঁড়িয়ে আছে। শহরের অবস্থাও একই রকম। যে মহল্লায় লোক বেশি, অন্য মহল্লার লোক এসে এর ওর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনাজপুর শহরের মিলিটারি ক্যাম্প কুঠিবাড়ির আশেপাশের মহল্লা লোকশূন্য।

ভারত সরকার সাহায্য সহযোগিতা আর মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিকই তবে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ আর মহামারীর প্রকোপ।

সাতমাস হয়ে গেল মানুষ ঘর ছাড়া। যুদ্ধেরমধ্যে অনেকে   দেশে ফিরে যাচ্ছে। স্কুলঘরে চৌচালায় যে কয়জন চাচা ছিলেন তারাও বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। মুসলমান পাড়ায় যে চাচারা থাকতেনÑ তারা এসে বুঝালেন মুক্তিযোদ্ধা চাচারা বুঝালেন তবু তাতে কাজ হলো না। আব্বাসহ ছয় চাচা বাড়ি ফিরে যাবেন ঠিক করলেন।

নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা বাড়ি ফিরে যাবো জেনে খুব খুশি লাগছিল। ভয়ের মধ্যেও এতোদিন পর ঘরে ফিরবো ভেবে সবাই শান্তি পাচ্ছিলো। তিনদিন  ধরে গোছগাছ চললো। ভোর চারটার সময় বের হতে হবে। সাইত্রিশজন থেকে চারজন বড় চাচাতো ভাইবোন বাদ। ওদেরকে রেখে দেয়া হলোÑ যারা ভারতে থেকে গেলেন, তাদের কাছে।

ফজরের নামাজের পর চৌচালা স্কুল ঘরটাকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। স্থানীয় বাসিন্দা বিপিন, সুকুমার, রহমান, হরিশ এদের সাথে আব্বা চাচাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ওরা বিদায় জানাতে এলেনÑ শুভ কামনা জানালেন। মুসলমানপাড়া থেকেও অনেকে দেখা করতে এসেছিলেন। চাচি ফুফুরা আম্মাদের গলা ধরে কান্নাকাটি করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা চাচা আমাদেরকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেলেন।

সূর্য যখন উঠলো তখন আমরা একটা নদীর সামনে পৌঁছে গেছি। নদী পার হয়ে একটু গেলেই বাংলাদেশ। নদীতে নৌকা ছিল না। নদীর পাড়ের মানুষেরা কলাগাছ দিরো ভেলা বানাতে সাহায্য করলেন। কেউ বাঁশ কেটে এনে দিলেন। মহিলারা আত্মীয়ের মত বাড়ি থেকে সপ এনে বসতে দিলেন, পানি খাওয়ালেন।

ছোট বড় মিলে পাঁচ ছয় জন করে খুব সাবধানে নদী পার হলাম। মালপত্র পরে পার করে আনা হলো।  সবাই সবার মতো করে খাবার এনেছিল তা দিয়ে নাস্তা  খাওয়া শেষ করে সুটকেস, পোটলা মালপত্রগুলো মাথায় ঘাড়ে, হাতে নিয়ে একসাথে হাঁটতে শুরু করলাম।

নদীর ওপার থেকে মুক্তিযোদ্ধা জোহাক ও সাজ্জাদ চাচা আমাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। কথা বলা নিষেধ হেঁটে চলছি আমরা আর ছোটদের কষ্ট হচ্ছিল বেশি।

প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটার পর গাড়ির শব্দে আমরা ভয় পেলাম। গাড়িটা আমাদের কাছে আসলো থামলো কয়েকজন মিলিটারি নেমে আসলো। আমাদের দিকে বন্দুক উচিয়ে ধরলো সবাই ভয়ে মরে যাচ্ছিল। দলের পুরুষদের কে জিজ্ঞাসাবাদ চললো মধ্য বয়সী বলে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহ করলো না। ওরা বুঝে নিলো হিন্দুস্তানে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মানুষগুলো দেশে ফিরে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন বাঙালি পুলিশ ছিলেন। তিনি বললেনÑ প্রতিদিন শরণার্থীরা ভারত থেকে দেশে ফিরছে। মিলিটারিরা বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। আমাদেরকে পুলিশভ্যানে তুলে নিলো, নিয়ে গেল নাড়াবাড়িরহাট মিলিটারি ক্যাম্পে। সেখানে তারা আমাদেরকে স্কুলে থাকতে বলল। দুপুরে খাবার খেলাম আমরা । বড়রা কেউ খাবার মুখে তুলল না। চেহারায় মৃত্যুর কালোছায়া। কখন ছাড়া পাবো এই প্রত্যাশায় আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন।

বিকেলে কমান্ডার এলেন। মিলিটারিরা দলের পুরুষ মানুষদের ডেকে নিলো। তেরো চৌদ্দ বছরের চাচাতো ভাইরা বড় দুইজন ফুফাতো ভাই আব্বা-চাচারা মিলে চৌদ্দজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালো। বাকিরা সবাই স্কুল ঘরে ছিলাম।

 

চাচিরা, আম্মা-বড় আম্মা ঘোমটার ভিতরে কাঁদছেন আর দোয়া পড়ছেন। এক খানসেনা মেশিনগান উঁচিয়ে অনেকগুলো গুলি ছুড়লো আকাশের দিকে। বড়রা কাঁপতে থাকলো ছোটভাইরা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পরে গেল। হাউ মাউ করে কাঁদতে ধরলো।

বাঙালি পুলিশ বললেনÑ ভয় পাবেন না।  কমান্ডার এসে নাম পরিচয় জিজ্ঞাস করবেন। করলেনও তাই। একেকজন করে নাম ঠিকানা জেনে ছেড়ে দিলেন। কি কি নির্দেশ দিয়ে গেলেন আমাদেরকে বাড়ি পাঠানোর জন্য ঠিক বুঝা গেল না।

বাঙালি পুলিশ এসে বললেনÑ এখন রাত হয়ে গেছে। কালকে সবাইকে বাড়ি পাঠানো হবে। কোন বাড়িতে পাঠাবে? দুশ্চিন্তা, ভয় আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত কাটলো।

সকালে চিড়া পাউরুটি বিতরণ করলো তারা। সকাল দশটার দিকে আমাদেরকে একটা গাড়িতে উঠানো হলো। খানসেনাদের ভ্যান পিছনে পিছনে এলো। কিছুদূর যাওয়ার পর রেল লাইনের ধারে আমাদেরকে নামতে বলল। একটু পরে একটা ট্রেন আসলো। তাদের কথা মতো আমরা ট্রেনে উঠলাম তখন সবার মনে হচ্ছিল বেঁচে বাড়ি ফিরবো তো?

ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় আছি এমন সময় রেললাইনের অন্যপাশের জঙ্গল থেকে শুরু হলো গোলাগুলি। খানসেনারা মাটিতে শুয়ে গুলি চালাতে লাগলো। আমরা আতংকে চিৎকার করছিলাম। ঘন্টাখানেক পর থেমে গেল গুলির অওয়াজ। আমাদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দূর থেকে দেখতে পাওয়া একটা স্কুলে  নিয়ে যাওয়া হলো। ট্রেনটা চলে গেল। তখন শেষ বিকেল। দুইজন সেনা পাহারায় থেকে বাকিরা চলে গেলেন। সন্ধ্যায় মিলিটারি ভ্যানটা আবার এলো। ওখানকার গ্রামের মেম্বারের মাধ্যমে আমাদেরকে চাল ডালসহ রান্নার জিনিসপত্র দেয়া হলো। কারো শরীর চলছিল না সবাই ক্লান্ত, ভীত, তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত। সারাদিন না খাওয়া। সবাই মিলে চালে ডালে কোনভাবে খিচুড়ি রান্না করে ক্ষুধা মিটানো হলো।

স্কুলের বেঞ্চ জোড়া দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা হলো মরণঘুম দিয়ে রাত পার হলো আমাদের। পরদিন মিলিটারির গাড়ি এলো। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে আবার গণনা হলো।

গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনায় সন্দেহ করেছিল আমাদের মধ্যে লোক কম হলে ধরে নিতো যে আমাদের দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। মিলিটারিরা সন্দেহমুক্ত হয়ে বলল, ট্রেন এসে আমাদেরকে দিনাজপুরে নিয়ে যাবে।

ট্রেন এলো দুপুর বারটায়। আমরা আবার ট্রেনে উঠলাম। এবার কোন বিপদ ছাড়াই ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। একঘন্টা পর ট্রেন দিনাজপুর প্লাটফর্মে পৌঁছাল। সবাই খুশিÑ বাড়ি চলে এসেছি। হেঁটে গেলে ত্রিশ মিনিটের পথ। প্লাটফর্ম থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়াবো, দেখলাম মিলিটারির গাড়ি। আমাদেরকে বেষ্টন করে গাড়িতে তুললো। বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত। গাড়িটা আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে চললো। ক্লান্ত অবসন্ন দেহ মনে সবাই আমরা ধরে নিলামÑ শহরের বাইরে নিয়ে  আমাদের মেরে ফেলা হবে।

পুলহাট পার হয়ে কে.বি.এম কলেজের দিকে ছুটলো গাড়ি। আমরা ছোটরা এই কয়েকমাসে আম্মাদের কাছ থেকে বিপদের দোয়া আরো কিছু ছোট দোয়া শিখে ফেলেছি। সবাই দোয়া পড়ে যাচ্ছি।

পিছনে মিলিটারির গাড়ি ছিল। রাস্তার পাশে মাইন পাতা ছিল গাড়ির চাকা মাইনে পড়া মাত্রই বিকট শব্দে চাকা ফেটে গেল। ধোঁয়ার আচ্ছন্ন হয়ে গেল জায়গাটা। গাড়িটা উল্টে যেতে যেতে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেল। পিছনে মিলিটারির গাড়িও থামল। ওরা গাড়ি থেকে ঝটপট নেমে মাটিতে শুয়ে পজিশন নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগলো।

গাড়ির ভিতরে আমাদের ত্রাহি চিৎকার কান্না আর জোরে জোরে দোয়া পড়া চলছে। সবাই ধরে নিয়েছে এবার আমাদের মেরেই ফেলবে। কিছুক্ষণ পর এক বাঙালি পুলিশ এসে গাড়ির দরজা খুলে আমাদেরকে নামতে ইশারা করলেন। আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলাম। পুলিশটা বললেনÑ সামনে মাশিমপুর স্কুল, সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। হিন্দুস্তান থেকে এসেছেন বহুদিন গরুর মাংশভাত পেটপুরে খাওয়া হয়নি। খাওয়া শেষে আপনাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া হবে। মাশিমপুর স্কুলে স্থানীয়দের তত্ত্বাবধানে রান্না হচ্ছিলো। রান্নাশেষে আমাদেরকে ভাত মাংশ  খেতে দেয়া হলো । বিকেল হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল এখান থেকে পালাই।

মিলিটারির গাড়ি এলে আমাদেরকে গাড়িতে উঠার নির্দেশ  দেয়া হলো। সবার মালপত্র নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। বাঙালি পুলিশ আমাদেরকে গুনে দেখলেন লোক ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর গাড়ি শহরের দিকে চলতে লাগলো। বাড়ির দিকে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিলো। রামনগর মোড়ে এসে আমাদের নামিয়ে দিয়ে মিলিটারির গাড়ি চলে গেল।

দুইতিনটা মহল্লার লোকদের আড্ডা, কিছু দোকানপাট আর বেতারের খবরকে কেন্দ্র এই রামনগর মোড় জমজমাট থাকে। দেশে যুদ্ধ চলছে বলে এখন লোকজনের তেমন ভিড় নেই। নয়তো রাত বারোটা অবধি লোকের আড্ডায় সরগরম থাকে এ এলাকা । তখনকার পরিস্থিতিতে বিকেল থেকে রাত আটটার মধ্যে লোকের আসা যাওয়া। কার কাছে কি খবর তা প্রচার হয় চায়ের আড্ডায়।

আমাদেরকে দেখে লোকজন ঘিরে ধরলেন। সবাই প্রায় পরিচিত । একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না। কথা বলতে যেয়ে অনেকের গলা ভারি হয়ে আসছিল। কিভাবে এসেছি তার বর্ণনা  শুনে সকলে নিরব হয়ে গেলেন।

এলাকাবাসীরা আমাদেরকে নিয়ে বাড়ির দিকে চললেন। কেউ বাচ্চা কোলে নিলেন, কেউ বাচ্চাদের হাত ধরলেন, সুটকেস পোটলা পুটলি আমাদের কাছ থেকে তাঁরাই নিয়ে নিলেন এবং বাড়ি পৌঁছে দিলেন।

লালবাগ দ্বিতীয় মসজিদের সাথে লাগানো বড়বাড়ি আর্চের উপর নকশা করা গেট পার হয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গ্রামে এখানে সেখানে ঘুরে দুই চাচা কয়েকদিন আগে বাড়ি ফিরেছেন, আমাদেরকে পেয়ে তাঁরা ভীষণ খুশি। বাড়িটা মুখর হয়ে উঠলো।

বেঁচে বর্তে বাড়ি ফিরে আসার আনন্দে বড় আম্মা কাঁদলেন। আমাদের ঘরবাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ঘরের দরজা খোলা জিনিসপত্র সব লুট হয়ে গেছে।

ফরিদপুরের ওয়াজেদ নামে এক লোককে আব্বা বাড়িতে রেখে গেছিলেন আর বলেছিলেন সুযোগ বুঝে সে যেন দেশে চলে যায়। বাড়ি এসে জানা গেল গ্রামে যখন কেউ ছিল না মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাছে সে থাকতো। মুয়াজ্জিন যখন বাড়ি চলে গেছিলেন, তখন ওয়াজেদ কোথায় গেছে নাকি দেশে ফিরে গেছে কেউ বলতে পারেন না।

বাড়ি এসে সবাই স্বস্তি পেয়েছিল। ভারতে অর্ধাহারে, মহামারিতে মৃত্যুর চেয়ে জন্মভূমিতে মৃত্যু অনেক ভাল।

যুদ্ধ বেড়ে চলছে খানসেনারা মরিয়া হয়ে উঠছে। এমন একদিন মিলিটারির গাড়ি মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ওখানে জাকারিয়া চাচাকে দেখতে পেয়ে তাঁকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়। বাড়িতে মরা কান্না, বড়রা আতঙ্কিত ছোটরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এখন তিনরাস্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আমগাছটার নিচে কেউ আর দাঁড়ায় না। বাড়ির পুরুষ লোকেরা দোকানে সওদাপাতি কিনতে যেতো চোরের মতো। দিনে কয়েকবার করে রাস্তায় মিলিটারির গাড়ি টহল দিতো। মিলিটারির গাড়ি দূর থেকে দেখা মাত্র রাস্তায় কেউ থাকলে চেনা হোক বা অচেনা Ñ কারো বাড়িতে ঢুকে আত্মরক্ষা করতো।

চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে গেল। গাড়ির শব্দ পেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। গাড়ি চলে গেলে বুকের ধুঁক ধুঁক বন্ধ হতো। পাঁচদিন পর খবর পাওয়া গেল জাকারিয়া চাচা জেলে বন্দি। এক লোকের মাধ্যমে খবরটা পৌঁছেছিল। আবার একদিন মিলিটারির গাড়ি আম গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। সে দিকেই সবার নজর ছিল। আমার দুইজন চাচাতো বোনকে কোঠাঘরের ছাদে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কারণটা পরে আম্মা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। মিলিটারিরা যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।

কয়েকটা জেলা শত্রুমুক্ত হয়েছে শুনে লোকের সাহস বেড়ে গেছিল। তার সাথে একটা খবর রটে গেলÑ যে পাকিস্তানি খানসেনারা এদেশ থেকে চলে গেলে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিয়ে যাবে। এই ভয়ানক খবরটা মানুষের খাওয়া নাওয়া রাতের ঘুম কেড়ে নিলো। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না।

রামনগর মোড়ের আড্ডা আর জমে না। দুই দিন আকাশে জঙ্গিবিমান চক্কর দিচ্ছিলো। মানুষের মনে এটাই ধারণা হলো যে এবার আকাশপথে যুদ্ধ হবে।

লোকেরা বাড়ির উঠানে বাংকার খুঁড়তে শুরুকরলো। ইংরাজি বর্ণমালার খ.ঘ.ঠ.ঋ ইত্যাদি ছাঁচে চার থেকে পাঁচ ফুট গভীর খাল তৈরি করা হচ্ছিলো। আকাশে বিমান দেখামাত্রই ছুটে বাংকারে ঢুকে পরতো। ভয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ভারত থেকে আসার এক মাস হয়ে গেল। আমরা খেলার সাথিরা ব্যাঙ্কারকে খেলার জায়গা করেছিলাম লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করতাম। কেউ রাগ করতো না হঠাৎ যদি আকাশ থেকে বোমা ফেলে আমরা তৎক্ষণাৎ  বাংকারে ঢুকে যেতে পারবো। বড়রা রেডিওর খবর শুনে কখনো ভয় পায় কখনো খুশী হয়। কুঠিবাড়ি আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি যাদের বাড়ি ছিলÑ সে গ্রামটা জনশূন্য। নানা-নানি, খালা-মামারা রামনগরে অন্যদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নানা একদিন নিজের বাড়ি দেখতে রওনা করেছিলেন। গ্রামে ঢুকে তাঁর মনে হয়েছিল এটি বুঝি ভূতের গ্রাম! কোন বাড়িতে কোন জনমানব নেই রাস্তায় বড় বড় ঘাস, কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ওদের ভয়ংকর চাহনি। নানা আর বাড়ির দিকে যান নি।

 

একেকটা দিন অতিবাহিত হচ্ছে আর শীত পড়তে শুরু করেছে। বাড়ির বাইরে ঘাসের ডগায় মুক্তাদানার মতো শিশির জমে থাকে। শিশিরে পা ভিজিয়ে কি যে আনন্দ! এখন ভয়ে ওদিক মাড়াই না।

মানুষের মধ্যে চরম উত্তেজনা একটা কিছু ঘটবে। যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করে মানুষ ভয়কে জয় করছিল। মানুষ একটা কিছু চায়Ñ হয় দেশ না হয় শেষ।

অবশেষে ডিসেম্বর এলো। জাকারিয়া চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার একমাস হয়ে গেছে। পনেরই ডিসেম্বর রেডিওর খবর শুনে মানুষ আশা নিরাশার দোলাচলে মুক্তির প্রহর গুনছিল।

আব্বা চাচারা চিন্তিত। হাতের কাছে চাকু, লাঠি, বল্লম। দফায় দফায় লোকজন জড়ো হচ্ছিলেন আর বলাবলি করছিলেনÑ আজ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা সামনে যা পাবে বোমা, কামান দিয়ে ধ্বংস করে দেবে।

সন্ধ্যার পর সব নিস্তব্ধ। ভয়ে কেউ বাড়ির বার হলো না। কোনভাবে খাওয়া সেরে বাতি নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকার। ফুপাতো ভাই মকসেদ বাংকারে বিছানা করে বউ বাচ্চা নিয়ে বসে থাকলেন। বাড়ির আর সবাই উঠানে জড়ো হয়ে একসাথে থাকলেন। অন্যান্য বাড়ির লোকেরা পরিবারসহ বড়বাড়ির উঠানে চলে আসলেন। সবাই একসাথে থাকলে সাহস বেশি। কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। প্রয়োজনে কথা বলছিলেন ফিস ফিস করে। চারিদিকে কেমন নিঝুম পরিবেশ কারো চোখে ঘুম নেই।

অনেকদূর থেকে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর পর গাড়ির শব্দ। সেই শব্দ একসময় দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল।

আমরা ছোটরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। প্রচণ্ড শব্দে চমকে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছিলোÑ বাড়ির উপরে বোমা পরলো। ঘরবাড়ি বড় এক ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো।

সবাই একসাথে  আল্লাহ আল্লাহ বলতে লাগলো। ছোটরা ভয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। বাড়ির সকলে পাগলের মতো একে অপরের হাত ধরে বাচ্চা কোলে নিয়ে হুড়মুড় করে মসজিদের দিকে ছুটলো। মসজিদে ঢুকে তার দরজা বন্ধ করে  দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পরে দরজায় টোকার শব্দ শুনে ভয়ে সবাই আড়ষ্ট।

মকসেদ ভাইযেরর গলা শুনে দরজা খোলা হলো। মকসেদ ভাই বাংকার থেকে বউবাচ্চা নিয়ে ছুটে এসেছেন। বাকরুদ্ধ হয়ে সবাই বসে থাকলাম। মেজোবাবা মোমবাতি জ¦ালিয়ে দিয়েছিলেন। বড়রা ফিস ফিস করে দোয়া দরুদ পড়ছিলেন। নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ রাত শেষ হয়ে ভোর হলো। কাকের ডাক শোনা যাচ্ছিলো। মেজোবাবা বললেনÑ ফজরের আজান দিবো। সাহস করে মসজিদের দরজা খুলে বের হয়ে আজান দিলেন তিনি। আব্বা আর চাচারা মসজিদের বারান্দায় নামাজ পড়লেন।

আকাশ আরো ফর্সা হয়ে এলো। রাস্তার আমগাছটার কাছে যেয়ে তিনরাস্তার দিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক কিছু কারো চোখে পড়ল না। মসজিদ থেকে বের হয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এলাম। রাতে ঠিক কি হয়ে গেল কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

প্রকৃতি ও পরিবেশ এতো নিরব ছিল যে কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না। সৃষ্টির এমনি এক নিয়ম যে বেঁচে থাকলে খেতে হয়। ঘরে শুধু চালের আটা আর গুড় ছিল। তা দিয়ে আম্মা চিতই পিঠা বানিয়ে আমাদেরকে খেতে দিচ্ছিলেন। আমরা রোদে বসে খাচ্ছিলাম। তখন সকাল আটটা হবে। হঠাৎ নিরব পরিবেশ খান খান হয়ে এলাপাথাড়ি গুলির শব্দ এগিয়ে আসতে লাগলো। পিঠার সম্পূর্ণ গোলাটা আম্মা কড়াইয়ে ঢেলে দিয়ে আমাদের হাত ধরে ছুটে পুকুরের ধারে আশ্রয় নিলেন।

কেউ কেউ বাংকারে ঢুকেছিলেন। দশ বা পনেরো মিনিট পর আমগাছের নিচে অনেক মানুষজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সবাই শ্লোগান তুলেছেÑ জয়বাংলা।

জাকারিয়া চাচা সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন। যে যেখানে লুকিয়ে ছিল সবাই দুমদাম করে বের হয়ে রাস্তার আমগাছের নিচে দাঁড়ালেন। বড়আম্মা চাচিরা ও আম্মাসহ বাড়ির সব বাচ্চারা ছুটে আসায় রাস্তায় ভীড় হয়ে গেল। জাকারিয়া চাচার বক্তব্য ছিল মুক্তিযোদ্ধারা জেলের তালাভেঙে বন্দিদের মুক্ত করেছে। দেশ স্বাধীন। মিলিটারিরা রাতে দিনাজপুরের সমস্ত বিহারীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে  জড়ো করেছে। রাত বারটার পরে মিলিটারির শেষ দলটি কাঞ্চন নদীর উপর রেলওয়ে ব্রীজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। রাতে ঐ শব্দটা বড় ভূমিকম্পের মতো ঘর বাড়ি কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মানুষের মন থেকে মৃত্যু ভয়, যুদ্ধ ভয় দূর হয়ে গেছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মানুষের যে কি আনন্দ উল্লাস বলে বোঝানো যাবে না। সেদিন দেখেছি  নারীপুরুষ শিশুবৃদ্ধ রাস্তায় নেমে এসেছিল। যে রমণী কখনও বাড়ির বাহির হয়নি সেও সাবলীল ভাবে লোকের ভীড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিক থেকে আসছিল মেশিন গানের গুলির শব্দে বিজয় ধ্বনি। ছয সাতজনের মুক্তিযোদ্ধার দল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আকাশে বন্দুক উচিয়ে গুলি ছুড়ছিল মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে গলা মিলিয়ে বার্তা দিচ্ছিল আমরা শত্রমুক্ত। অনেকের চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি। ছোট বেলার ঈদের আনন্দের সাথে তুলনা করলে স্বাধীনতার আনন্দ আমার হৃদয়ে অনেক বড় হয়ে জেগে উঠে আর শিহরণ জাগে। বিজয়ের দিন খুশিতে বুকভরে গেছিল সবার। ক্ষুধা তৃষ্ণা পায়নি। আম্মা আবার একটা মজা যোগ করে ছিল পিঠার পুরো গোলাটা কড়াইয়ে ঢেরে দিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়েছিল বাড়িতে এসে দেখলো খড়ির চুলার হালকা তাপে আপনা থেকে একটা বড় পিঠা তৈরি হয়ে গেছে। আমরা সবাই সেটা নিয়ে যা হাসাহাসি করছিলাম।

দুইদিনের মধ্যে সবাই বাড়ি ফিরে এলেন। প্রতিবেশীরা একে একে বাড়ি ফিরতে লাগলেন। কে কেমন ছিলেন সেই গল্পে  সবাই মুখর হয়ে উঠলেন। দিনগুলো উৎসবের মতো লাগছিল।

কয়েকদিন পর নয়নপুর থেকে দিনু মামা আম্মার কাছে এসে বলেছিল, রেজি, তোর কাছে কি মনকুটু এসছিল? আম্মা কাঁদি লেন, মামাও কাঁদছিলেন। মামা যতদিন বেঁচে ছিলেন খান সেনাদেরকে  গালি দিতেন।

মহিউদ্দিন বড়আব্বা দুইছেলে আসাদুর আর মিজুকে হারিয়ে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন। খুব একটা কথা বলতেন না।

 

আমাদের মনকুটু ভাই ফিরবেন না, আসাদুর ভাই, মিজু ভাই ফিরবেন না, সারা বাংলাদেশে আরো অনেকেই ফিরে আসেন নি, কোনদিন আসবেন না। তাদেরকে আমরা কখনো ভুলি নাই ভুলবো না। আমার মনে থাকবে আজীবন  সন্তানহারা, স্বজনহারা রক্তাপ্লুত বাংলাদেশের জন্মদিনটি। শুভ জন্মদিনÑ প্রিয় বাংলাদেশ।

 

 

লেখক পরিচিতি

খুরশীদা বেগম রানীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১০ আগস্ট দিনাজপুরে। তাঁর পিতা বদিউল আলম ও মাতা রেজিয়া খাতুন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েছেন দিনাজপুরেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার হোসেনপুর ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগে  শিক্ষকতা করেছেন। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালে ।

ছাত্রজীবন থেকেই লেখার প্রতি বিশেষ ঝোঁক। তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে দিনাজপুর উদীচীর প্রয়াসীসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত । তাঁর স্বামী দিনাজপুর সদরের রামনগরের বাসিন্দা রাজিউর রহমান বুলু । তাঁরা দুইপুত্রের গর্বিত জনক-জননী।