“এক শতাব্দী ঘৃণার বিজয়োল্লাস আমাকে ধ্বসাতে পারে না
এক শতাব্দী বর্বরতা আমাকে ভাসিয়ে নিতে পারে না যে কোনো অন্ধকারে”
কবিতা আমার কাছে সত্য, সুন্দর ও মর্মবাণী। কবিতা মানুষকে ছন্দে ছন্দে দোলাতে পারে এবং বিভিন্ন স্পন্দন নিয়ে রচিত একগুচ্ছ শব্দমালা। কবিতা বা পদ্য একগুচ্ছ শব্দের ছন্দ্যোময় বিন্যাস; যা একজন কবি তার আবেগ, অনুভূতি উপলব্দি চিন্তাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করেন কবিতার মধ্যে দিয়ে এবং বিভিন্ন উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্পের সাহায্য উদ্ভাসিত করে আর তা শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে।
কবিতা হচ্ছে তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ মাত্র। তবে এর বিশালতা আর গভীরতা অকল্পনীয়। আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রীয় বা প্রতিটা মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি উপাদান আর উপাত্ত নিয়েই সৃষ্টি হয় কবিতা। একটি জীবনের আলোকে সামগ্রিক জীবন নিয়ে লেখা হয় কবিতা বা পদ্য। কবিতা মানুষকে হাসায়, কবিতা কাঁদায়। কবিতা মানুষকে আনন্দ দেয়। বেদনা দেয়, কবিতা মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করে। যেমনটা আমরা দেখেছি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ (কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়) কবিতার কথা মনে আসে। মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শাশ^ত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি সুলাইমান সাদীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সুলাইমান সাদীর ফ্যাসিবাদী কবিতা’ শিরোনামে। বইটির প্রচ্ছদ করেছে কবি নিজেই। প্রচ্ছদ বেশ মানানসই হয়েছে কাব্যগ্রন্থের কাব্যগুলোর অনুসারে। কবি যেহেতু নিজেই তার কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন। সেহেতু তার অনুভূতির উপর প্রতিটা ছাপ প্রচ্ছদে রয়েছে। খুবই সাদামাটা একটি প্রচ্ছদ। যতটুকু অর্থপূর্ণ হওয়ার দরকার ততটুকুই হয়েছে। আমার কাছে ভালো লেগেছে বইটির পেইজ বাইন্ডিং। বেশ স্ট্যান্ডার্ড মানের হয়েছে। আর গাউন পেপারের ব্যবহার যেন বইটির আউটলুককে আরো পরিপূর্ণ করেছে। প্রতিটা কবিতা অসাধারণ উপমায় লেখা। অসাধারণ সব বাক্য।
কবিতা এমন একটি বিষয় যেটা আসলে পড়ে অনুভব করে তা অন্যকে ভাষায় প্রকাশ করা আমার কাছে খুব কষ্ট সাধ্য বিষয় আমার কাছে মনে হয়। গল্প, উপন্যাস পড়ে সেই গল্পটি সবাইকে সারমর্ম বলা যতটা সহজ কবিতার ক্ষেত্রে তা নয় আমি মনে করি। কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষে তেমন কিছু কথা জড়ো হয়েছে মনের গহিনে। এই কাব্যগ্রন্থে প্রায় ৫৮টি কবিতা নিয়ে সাজানো হয়েছে। সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করলে এই পর্যালোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আর পাঠকের ধৈর্য্যাচ্যুাতি ঘটবে। আমি সেসব কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো যেসব কবিতা ভাবনার খোরাক যোগাতে সক্ষম হয়েছে। সেগুলো নিয়েই বরং আলোচনা করবো।
পাঠকের মনের সব অজানা কথাগুলোই যেন ভেসে উঠে পঙক্তি হয়ে কবির কবিতায়। পাঠক নিজের না বলা কথাগুলো গুচ্ছ আকারে লিপিবদ্ধ দেখে আনন্দে হয় আত্নহারা। কিন্তু কখনো কী চিন্তা করে কবির কথা। অনুভব করে কবির ব্যথা। কবিরা অসম্ভবভাবে প্রেমে পড়ে প্রকৃতির, প্রেমে পড়ে রমনীর। আমার কাছে মনে হয়েছে কবি এই কবিতাখানা লিখতে গিয়ে তার হাতিয়ার খুব কষ্টভরা বুক নিয়ে লিখেছেন কোন এক রমনীকে উদ্দেশ্য করে।
“তুমি শব্দটা বিষিয়ে তুলছিল দিনদিন
আমার কবিতায় যতটা তোমাকে পাবে ততটা ‘তুমি’ নেই
তোমার যন্ত্রণা ভুলে থাকতে অভিধান নামিয়ে কেটে দিলাম ‘ত’ দিয়ে লেখা সবগুলো শব্দ”।
কবির আক্ষেপটাই যেন প্রতিবাদের ভাষায় রুপান্তরিত হয়ে ঘৃণায় পরিণত হয়। সেই সময় বিভিন্ন মানুষের মাঝে এক ধরনের ছেলে মানুষি ঘাড়ে চাপে। অনেকে ভাবে প্রিয় মানুষের ছবিতে ছাগ কেটে দিলে ঘৃণা বা ক্ষোভ কমে যায়। কবি সে রকমেই করেছে।
একজন কবির কাছে তার কবিতা নিজের সন্তানের মতো। নিজের সহধর্মিনীর মতো যে তাকে ভালোবেসে থাকে সর্বদা পাশে। সুখ, দুঃখের মাঝেও তাকে খুঁজে পায়। এই নষ্ট সভ্যতাকে সত্যপথে পরিচালিত করার একমাত্র পথ হচ্ছে কবির কলম। তাই তো কবি সুলাইমান সাদী বলেছেন কবিতায় কবিতায়-
“যে কোনো মুহূর্তে ঘুরে দাড়াতে পারি এই নষ্ট সভ্যতার বিরুদ্ধে
শব্দে শব্দে গড়ে তুলতে পারি মহাদূর্গ সত্যের সুন্দরের”।
আমাদের সমাজে যখন মানুষ খুব দুঃখ কষ্টে জর্জরিত তখনেই তারা সৃষ্টির বেদনাকে উপলব্দি করতে পারে। কিছু মানুষ সারাজীবন কষ্টকে নিয়ে বেঁচে থাকে। পথে ঘাটে পড়ে থাকে এদের দেখার কেউ নেই। কবি তার কবিতায় বলেছে-
“খুব কষ্ট পেলে মানুষ সৃষ্টির বেদনা বোঝে
ওড়াল সেতুর মতো ঝুলে পড়ে আকাশের সবগুলো পথ
উর্ধ্বগামী সবগুলো আধপাকা পথে জ্যাম পড়ে যায়।
শুধু একটি পথ কান্নার গোঙানি নিয়ে পড়ে থাকে এই তুমুল নশ^রে”।
মুসা (আ:), ইসা (আ:) হযরত মোহাম্মদ (স) এর দেওয়া আল্লাহর দিন প্রতিটা মুসলমানের শক্তি। ইসলাম এমন একটি শক্তি যা যুগে যুগে প্রমানিত হচ্ছে। কোটি কোটি মুমিন ব্যক্তিদের বুকে রয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন। তাই তো কবি বলেছেন-
“বুকের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বেরিয়ে আসবে মহাগ্রন্থ
নিবিড়তম রাত্রীর সুতোয় বোনা জ¦লজ¦লে দিন।
মুসা, ইসা মুহাম্মাদেও দীন ও দরিয়ার পথ
নাবিকের চওড়া সিনার মতো শক্ত সমতট নোঙরের”।
কবি আক্ষেপ এবং কষ্ট থেকে বলেছেন তা বুঝা যাচ্ছে। বর্তমান এই আঠারো শতকের শেষ ভাগে উনিশ শতকের পর থেকে শুরু একুশ শতকে ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। সত্য কথা বলা নিষেধ। সত্য কথা লিখা মানা। এযেন নিজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। স্বাধীনদেশে কখনও এটা কাম্য নয়। যার কারণে অনেক লেখক সত্য বলতে পায় ভয়। তবে সাদাত হাসান মান্টো, কাজী নজরুল ইসলামসহ অসংখ্য লেখকগণ সত্য থেকে পিছপা হয়নি বলে তারা আজ বিখ্যাত। কারো হুমকি ধমকিতে পিছপা হয়নি বলে যুগ যুগ তাদের মানুষ স্মরণ করছে। তারপরেও তার লিখার মাঝে রয়েছে মনের কিছু চাপা কথা। তাই তো কবি বলেছেন
“যান্ত্রিক সময়ের ভুঁিড় ফেড়ে বের করে আনি একেকটি কবিতা
দিস্তায় দিস্তায় বিক্রি করি মিল বেমিলের কিছু ফাঁপা বাক্য
অথচ বা অধিকন্তু লিখে দিয়ে ধুয়ে ফেলি সত্য ও সাহসের বাণী”।
রাষ্ট্রে কারণে অকারণে প্রতিদিন খুন হচ্ছে। যার ফলে রাষ্ট্রই খুনি হয়ে উঠছে। সেই খুন হোক টাকার বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। সরকারি অফিসে ঘুষ না দিতে পেরে শিক্ষিত ছেলে মেয়ে করছে আত্যহত্যা। কেউ আবার হচ্ছে দালালের কাছে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে পরিবার।
“একটি রাষ্ট্র প্রতিদিন খুন হচ্ছে
একটা রাষ্ট্র প্রতিদিন খুনী হয়ে উঠছে
প্রতিদিন এককটা রাষ্ট্রের হাত রক্তাক্ত হচ্ছে
প্রতিদিন একটা রাষ্ট্রের বুক ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে
এই খুন আর খুনী রাষ্ট্র এই রক্তাক্ত আর বিক্ষত রাষ্ট্র
আর কত দিন আমাদের বয়ে বেড়াবে?”।
কবি হাসসান আতিক খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, দরজায় কড়া নাড়তে নয়, দেয়াল সরাতে বেরিয়েছে সাদীর ফ্যাসিবাদী কবিতা। নরমালি একজন তরুণ কবির প্রথম যেমন হয় প্রকাশ, ফ্যাসিবাদী তেমন না। এই কবিতাগ্রন্থ সময়ের নান্দনতাত্ত্বিক দিকগুলো উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এছাড়াও রয়েছে প্রেম নিয়ে কবিতা। সাদীর কবিতায় প্রেম এমন এক জালের সন্ধানে রত যাতে নিরাপদে ধরা পড়া যায়। কবিতাগুলো সম্পর্কে তিনি বলেছেন। পাঠকগণও নিজ নিজ জালের ব্যাপারে ভাবতে পারবেন। একেকটি কবিতা যেন হোমিও ঔষধ; এক বাড়িতে বহু দাওয়াই। সাদীর কবিতাসমূহের পাতায় এবং ডালে এমন অসাধারণসব পাখি ডাকে এই মলাটের ভেতর-যারা জাদুর শহরে থাকে। মৃত্যু যেখানে জীবনের মতো। সাদী কি চেষ্টা করছেন মৃত্যুর সংজ্ঞায়ন করতে বা জীবন আর মৃত্যুর সংযোগহীন তার? কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। কবি হাসসান আতিক (কবি, সাংবাদিক) খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। মনে হচ্ছে যে প্রতিটা অনুভূতি আমার সঙ্গে মিলে গেছে। প্রতিটা কথা যেনও আমার। কবির বইটি পড়ে আমার এমন লেগেছে। তবে অসংখ্য প্রশ্ন উঠে আসে।
কবি সুলাইমান সাদী। একজন নম্র ও ভদ্র, মিষ্টি হাসির উজ্জল নক্ষত্র। যার হাসি প্রতিদিন ঝরে। এই কবি বিলবর্তী গ্রামে জয়কৃষ্ণনগরে জন্ম। বারহাট্টা, নেত্রকোনা। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে জন্ম। খুব ভালো লাগার একটি জায়গা হচ্ছে এই কবি আর আমার বাড়ি পাশাপাশি। আমার গ্রামও বারহাট্টা, মনাষ। এটা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। আমি কবি সুলাইমান সাদীর এই কাব্যগ্রন্থের সাফল্য কামনা করি।
তারিকুল আমিন
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, আবৃত্তি ও অভিনয় শিল্পী