বাস্তবতা এক বড় কঠিন রুপ, আমরা একটি কল্পনার জগতে বাস করি, একটি মায়ার জগতে। আর এই জগতে আমাদের প্রধান কাজ হলো বাস্তবতা খুঁজে বের করা। স্বর্ণনগর গ্রামে রফিক নামের এক লোক বাস করতেন। রফিক যখন ছোট তখন তার বাবা মারা যায়। রফিক ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা মারা যাওয়ার পর তার কাঁধে পড়ে সংসার জীবনের এক কষ্টদায়ক কাজ। যে বয়সে রফিকের স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে রফিক পেটের খাবার জোগাতে কাজে নেমে যায়। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। চিন্তা-ভাবনা হয়ে ওঠে উপলব্ধিতে এবং উপলব্ধি থেকে পরিণত হয় বাস্তবে। স্বর্ণ নগর গ্রামে একটা ছোট নদী ছিল। নদীতে রফিক ছোট একটি নৌকা তৈরি করে সেই নৌকায় মানুষ পারাপার করতো এবং যে টাকা পেতো তা দিয়ে তার মাকে নিয়ে মোটামুটি সংসার চলে যেত।
রফিকের মা মেম্বারের বাড়িতে ঝি এর কাজ করতেন। রফিকের নৌকায় তার বন্ধুরাও পার হয়ে স্কুলে যেত। তা দেখে রফিকের মনটা একটু খারাপ লাগতো। আর বলতো আজ যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে আমিও সবার সাথে স্কুলে যেতাম। পড়াশোনা করে বড় চাকরি করতাম। বাবা হারানোর চেয়ে বেশি দামী কিছুই আর নেই এই দুনিয়াতে। হতাশা হলো প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান। অনেকে রফিকের নৌকায় পার হয়ে টাকা দিতো না। রফিক টাকা চাইলে ওরে উল্টা মারধর করতো। একদিন মেম্বারের কাছে রফিকের মা বিচার দিল।
– দেহেন মেম্বর চাচা আমার ছেলে নদীতে নৌকা চালায়। এতে কয়টা টাকা রোজগার হয়। তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। কিন্তুা গ্রামের কিছু ছেলেপেলে পার হয়ে টাকা দেয় না। আর রফিক টাকা চাইলে উল্টো রফিককে মারধর করে।
মেম্বর বললো,
– দেহ রফিকের মা ওরা তো গ্রামের ছাওয়াল পাওয়াল। আমি কি বলবো বলো। তাও বলে দিবানি। রফিককে যেন টাকা পয়সা দেয়।
– মেম্বর চাচা এভাবে বললে তো আমাগোর না খেয়ে মরতে হইবো। বাপ মরা আমার ছেলে রফিক কতো কষ্ট করে দেহেন।
– আইচ্ছা রফিকের মা বলে দিবানি বলছি তো। বাস্তবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র হলো আমাদের কল্পনা। আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তকে নতুনভাবে শুরু করতে হবে।
এলাকার মেম্বর বেশি ভালো ছিল না, গরিব মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করতেন। এবং সরকারের দেয়া ত্রান তহবিল সব খেয়ে ফেলতেন।
– মা মেম্বর দাদু কি বললো?
– সে ঐ ছেলে পেলেগোর বলে দিবেনে।
– আইচ্ছা মা, এহন কয়টা খাইতে দে তো, অনেক বেলা হইয়া গেছে। কতোজন জানি ঘাটে দাঁড়ায়ে আছে।
– আইচ্ছা বাজান তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমি ভাত দিতাছি তরে।
রফিক খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার নৗকা চালাতে গেল। কিন্তু দিনে দিনে অত্যাচার নির্যাতন আরো বেড়েই চলছে রফিকের সাথে।
– মেম্বর দাদু আপনি ভাড়া দিবেন না?
– কিরে তর তো সাহস কম না। আমি গ্রামের মেম্বর আর তুই আমার কাছে টাকা চাস।
– দাদু আমার নৌকায় পার হয়েছেন তাই আমি ভাড়া চাইছি।
– আবার তুই টাকা টাকা করোছ।
এই বলে এক চড় দেয় মেম্বর। বিকেলে বাসায় গিয়ে কান্না করতে করতে রফিক ওর মার কাছে বলে।
– মা আজকে মেম্বরও পার হইছে কিন্তু টাকা দেয় নাই। আমি টাকা চাইতে গেছি বলে উল্টো আমাকে চড় মারছে।
– কি কস বাজান, মেম্বর চাচা এইটা করতে পারলো? বাজান রে আজ আমরা গরীব বলে সবাই ঘিন্না করে আমাগোর।
– হ মা হ..!
তার পরে আর এই অত্যাচার নির্যাতন সয্য না করতে পেরে মা ছেলে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। আর বলতে থাকে,
– রফিক এই গ্রামে আবার ফিরা আইমু কিন্তু তখন অনেক টাকা পয়সা নিয়ে…
আপনি যত বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি হবেন, পৃথিবী তত বেশি অবাস্তব হতে থাকবে। জীবন কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য নয়, বাস্তবতাকে অনুভব করার জন্য। রফিক ও তার মা শহরে চলে যায়। শহরে তাদের কোনো থাকার জায়গায়ও ছিল না। রাস্তায় রাস্তায় তাদের রাত কাটে। তারপর রফিক একটা চায়ের দোকানে কাজ পায় আর রফিকের মা, বড় লোক একটা বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে শুরু করে। কিছুদিন কাজ করতে করতে রফিকের মায়ের হাত থেকে একটা চায়ের কাপ পড়ে ভেঙে যায়। তারপর রফিকের মায়ের হাতটা চুলায় নিয়ে পুড়িয়ে দেয় বাড়ির মালিক।
– তুই কাপ ভাঙলি কেন হারামজাদি!
– মালিক আমি তো ইচ্ছে করে ভাঙিনি।
– না তুই ইচ্ছে করেই ভাঙচো। তোদের মতো গরীব মানুষদের ঘরে জায়গায় দিতে নেই। এই বলে বাসা থেকে বের করে দেয়।
বিকেলে আরো কয়কটি বাসায় কাজ সেড়ে বাসায় ফিরে রফিকের মা। রফিক রাতে দোকান থেকে বাসায় ফিরে দেখে ওর মা টুথপেস্ট দেয়। রফিকের আসার শব্দ পেয়ে হাত লুকাতে যায়।
– মা তোর হাতে কী হয়েছে। হাত অমন করে লুকালি কেন?
– নারে কিছু না বাজান।
– মা তোর হাত পুড়ছে কেমনে?
– বাবারে রান্না করতে গিয়ে পুড়ে গেছে।
– না মা তুই মিছা কথা বলতাছোস।
এই শুনে রফিকের মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার পর ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। অন্য এলাকা থেকে এসে রফিক ঐ চায়ের দোকানে কাজ করতেন। কিন্তু হঠাৎ করে চায়ের দোকানের মালিক মারা যায়। চায়ের দোকানদারের কেউ ছিল না। তারপর থেকে রফিক ঐ দোকানের মালিক হয়ে যায়।
আস্তে আস্তে তাদের দিনগুলো ভালো যাচ্ছে। রফিক দোকানটাকে আরো বড় করলো। এভাবেই তাদের জীবন যাপন করতে লাগলো আনন্দে। এতে রফিক বড় লোক হয়ে উঠছে। রফিক তার মাকে বলে,
– মা চল গ্রাম থেকে একটু ঘুরে আসি।
– না বাবা না। ঐ গ্রামে আর যাবো না।
– মারে চল যাই বাবার কবরখানা একটু দেখে আসি। আর মেম্বরকে দেখিয়ে আসি আমরা এখন গরীব নই। তারপর ওরা গ্রামে চলে যায়, বাবার কবর জিয়ারত করে। কিন্তু তাদেরকে গ্রামের মানুষ চিনতে পারে না। পথে মেম্বারের সাথে দেখা।
– মেম্বর বললো বাজান তোমরা কার বাড়িতে আইছো। তখন রফিক হেসে বলে
– ঐ অত্যাচারি মেম্বর তর জন্য আমি আর আমার মা গ্রাম থেকে চলে গিয়েছিলাম।
– কে বাজান। ও তুই রফিক। রফিকের মা বলল,
– হ্যা চাচা ও রফিক। আমরা এহন আর গরিব নাই এহন আমাগো অনেক টাকা আছে। মেম্বর বললো,
– হ রে মা পাপ বাপরেও ছাড়ে না। দেখ আমার অনেক অহংকার ছিল। টাকার গরম ছিল। আর দেখ এখন আমি দৈনিক দুই মুঠো খাবার ও খেতে পাই না। এ বলে মেম্বর কান্না করতে করতে চলে যায়।
রফিকের মা বললো বাজান চল আমাগোর টাকার গরম দেহান লাগবো না। দেখ পাপ বাপরেও ছাড়ে না। চলো মা বাড়িতে যাই। চল বাজান। বাস্তবতা নিছক একটি বিভ্রম, এমন কি অবিরামও বটে। আমাদের জীবনের বাস্তবতা প্রায়শই ভুল হয়ে থাকে।