তারিকুল আমিন :
মানুষে মানুষে সম্বোধনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় আমরা ব্যবহার করি আপনি, তুমি, ‘তুই’ এই তিনটি শব্দ। সম্পর্কের ধরণ এবং সিনিয়র, জুনিয়র ভেদে এই শব্দগুলোর প্রয়োগ হয়। আমরা মনে করি সিনিয়র এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হলে আপনি, সমবয়সী বা পরিচিত আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব হলে তুমি আর বেশি ঘনিষ্ঠ হলে ‘তুই’ বলতে হয়। আবার ‘তুই’ শব্দটি তুচ্ছার্থে এবং রেগে গেলে অনেকে এই শব্দটি ব্যবহার করেন। ইংরেজি এবং অনেক ভাষায় সম্বোধনের ক্ষেত্রে এমন বিভাজন নেই। ইংরেজি ভাষাতে এই তিন শব্দের একত্রে প্রকাশ ণঙট শব্দ দিয়ে। কিন্তু বাংলাতে তিনটি ভাগের তিনটি ভিন্ন অর্থ নির্দেশ করেছে। তাই বাংলাদেশে আমরা কাকে কখন কী বলে সম্বোধন করবো সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। আর এর ব্যতিক্রম হলে আমরা সাধারণত তাকে কাণ্ডজ্ঞানহীন বলে থাকি। যদিও এটা একটা তুচ্ছ আলোচনা মনে হবে আপনাদের কাছে; তবু আজ দু-কলম লিখবো এটা নিয়ে। আমি মনে করি এটা কোনো তুচ্ছ বিষয় বা আলোচনা নয়। স্থান, কাল, পাত্রভেদে আমি চাই না এই ‘তুই’ শব্দটি উচ্চারিত হোক। তবে হ্যাঁ পরিচিত হলে এই শব্দটিকে আমি সাদরে গ্রহণ করে নিব। তবে একজন অপরিচিত ব্যক্তি অন্য একজান অপরিচিত ব্যক্তিকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করাটাকে আমি প্রকৃত শিক্ষা বলে মেনে নিতে পারি না। আমি মনে করি যার মধ্যে এই পরিমিত জ্ঞানটুকু নেই তিনি প্রকৃত স্বশিক্ষায় শিক্ষিত নয়।
‘তুই’, তোর ইত্যাদি বলে অসম্মান সূচক সম্বোধন। ‘তুই’ (সর্বনাম পদ) উপেক্ষায় বা অতিশয় অন্তরঙ্গতায় তুমি। [তুই] (সর্বনাম) শব্দটি ‘তুমি’ শব্দের সংকুচিত রূপ যা তুই তোকারি (বিশেষ্য) অসম্মান প্রদর্শনের ইচ্ছায় ‘তুই’ ‘তোর’ প্রভৃতি শব্দ অশিষ্টভাবে ব্যবহার। (তৎসম বা সংস্কৃত) ত্বম্। তুই এর ব্যবহার ও উদাহরণ। সর্ব তুচ্ছার্থেক বা অনাদরার্থক ‘তুমি’ রূপভেদ যা নিম্নপদস্থ, কনিষ্ঠ বা অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ব্যক্তির প্রতি প্রযোজ্য।; [সং. ত্বম্]।; তুই-তোকারি বি. তুই, তোর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে অসম্মান দেখানো। [তুই] (সর্বনাম) শব্দটি ‘তুমি’ শব্দের সংকুচিত রূপ যা তোকারি (বিশেষ্য) অসম্মান প্রদর্শনের ইচ্ছায় ‘তুই’ ‘তোর’ প্রভৃতি শব্দ অশিষ্টভাবে ব্যবহার। {(তৎসম বা সংস্কৃত) ত্বম্>};
ইংরেজি ইউ/ণঙট শব্দটি আপনি, তুমি, তুই সব বুঝায়। আমাদের বাংলা ভাষায় এমন একটি সার্বজনীন শব্দ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু একথা সব সময় ঠিক নয় যে, সিনিয়র বা শ্রদ্ধা বুঝাতে আপনি বলতে হয়। বাংলা সিনেমায় বা সাহিত্যে মাকে তুই বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়। এরকম একটি গানও আছে, ‘মাগো মা আমারে তুই বানাইলি দিওয়ানা, আমি দুনিয়া ছেড়ে যেতে পারি তোকে আমি ছাড়বো না’। আসলে ‘তুই’ হলো সবচেয়ে কাছের প্রিয় ডাক। তারপর তুমি আর সবশেষে আপনি। সাধারণত অপরিচিত সিনিয়র মানুষকেই আপনি বলা হয়। আমি ছোট বেলায় দেখেছি সবাই বাবা-মাকে বিশেষ করে মাকে তুমি বলতো। আমরা সব ভাইবোনও মাকে তুমি বলি। ছোটবেলা থেকে তুই শব্দটি আমরা কখনো শুনিনি। এবং কী স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও কখনও কোন বন্ধু আমাকে তুই শব্দটি উচ্চারণ করেনি। সবাই আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতো।
আমি এখন একটি সাম্প্রতিক ঘটনাকে তুলে ধরবো। ঘটনাটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। যেমন কপালে টিপ পরায় লতা সমাদ্দার নামের এক নারীকে হেনস্তা করার ঘটনার কথা। সেখানে তাকে এমন ভাবে পুলিশ অফিসার কথাটি বলেছেন তাতে সেই তুই শব্দটি চলেই আসে। ‘টিপ পরছোস কেন’। আমি এখন আমার সাথে একটি ঘটে যাওয়া ঘটনা শেয়ার করবো। আমি একটি সরকারি অফিসে যাই কিছু ম্যাগাজিন নিয়ে। ভদ্রলোকটিকে দিতে গিয়েছি ম্যাগাজিনটি। ভদ্রলোকটির জন্য প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। এই ম্যাগাজিনে তার মতো আমারও একটি লেখা আছে। দুই ঘণ্টা পর সে আসে। আমি তার রুমে যাই। তিনি আমাকে দেখে যে শব্দটি উচ্চারণ করেছে তাতে আমি সেখানের দুজন কর্মকর্তার নিকট লজ্জিত হই। তিনি আমাকে বলে ‘তুই এখানে রাখ’। এই শব্দটি শুনে আমি নিজেকে এবং নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছি না। একজন সরকারি কর্মকর্তার এই ধরনের ব্যবহার। একজন অপরিচিত মানুষের সাথে যে তুই শব্দটি উচ্চারণ করতে হয় না। সেই পরিমিত জ্ঞানটি নেই। ‘তুই এখানে রাখ’ এই শব্দটি শোনার পর আমি ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি সেই সময়ের মুহূত্র্ বুঝাতে পারবো না।
আমার সাথে ঘটে যাওয়া আরাকটি ঘটনা যে ঘটনাটি এখনো আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি সেদিনের সেই অপমান এখনো ভুলতে পারিনি এই কারণে যে একজন শিক্ষক। যে কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যে জাতি ঘটনে ভূমিকা রাখে। তার মুখে একজন সদ্য স্নাতক পাসকৃত ছাত্রের সাথে তুই শব্দটি একদমেই বেমানান। আমি যখন ভাইভা পরীক্ষা দিতে যাই। তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান শিক্ষক আমাকে বলে তুমি তারিকুল। তুমিই অভিনয় কর। স্যারের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। সেই মুহূর্ত্বে স্যার আমাকে বলে ‘তুই’ অভিনয় করিস। তুই পড়াশোনা রেখে নাটক করে বেড়াস। তুই এটা করিস, তুই ওটা করিস। আচ্ছা তুই বলতো ঋত্বিক ঘটকের একটি সিনেমার নাম। ‘তুই’ এটা বলতো। তুই ওটা বলতো। আমি প্রথম তুই শব্দেই আমার সব গুলিয়ে গেছে। ‘তুই’ শব্দ শুনতে শুনতে ভিতরে ঘৃণা ধরে গেলো। চারজন শিক্ষকের নিকট যেনও আমি লজ্জায় মাথা উঠাতে পারছি না। সে আমার বিষয়ের প্রশ্ন না করে সে আমাকে অন্য বিষয়ের প্রশ্ন করতে শুরু করে। এরপর যখন দেখে স্যার আমাকে অপমান করছে। আমাদের শ্রদ্ধেও বিভাগীয় প্রধান শিক্ষক আমাকে একটি প্রশ্ন ধরেছে। আমি সেটির উত্তর পেরেছি। স্যার আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা দেয়। তখন আমি বেরিয়ে আসি। এখনো এই ‘তুই’ শব্দটি আমার কানে জগন্যভাবে কম্পোন করে। যা আমি আজও ভুলতে পারি না। কানে সর্বদা বাজে।
তবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো শিক্ষকদের ক্লাস করেছি। তাদের যেমন শিক্ষা তেমন ব্যবহার। সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করেন। তাদের দেখেই বুঝা যায় তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত। একদিন আমি একজন নামকরা লেখকের বাসায় যাই। তার মুখেল এতো সুন্দর শব্দ যা সত্যিই স্বশিক্ষার প্রতিফলন।
তাই বলবো অপরিচিত যেকোনো লোককে তুই বলে সম্বোধন করা উচিত না। সে হোক ছোট বড়। সে হোক নিম্নশ্রেণির কর্মকর্তা। আমরা আরো দেখি বাসের বয়স্ক হেলপারকেও যাত্রীরা তুই বলে সম্বোধন করে। বা রাস্তায় বেড়ে উঠা একটি শিশুকেও তুই বলা উচিত না আমি মনে করি। কারণ তুই শব্দটি সে নিজেকে অপমান হিসেবে নেয়। তাই আমি মনে করি তুই শব্দটি বলুন কিন্তু একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে না বলাই ভালো। কারণ তুই শব্দের ফলে সে আপনাকে ভালো মানুষ হিসেবে নিবে না। সর্বদা কথার মধ্যে সুন্দর আচরন করুন। দেখবেন আপনাকে সবাই ভালো মানুষ হিসেবে দেখবেন। আপনার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। আপনার পরিবার নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না।
তথ্যঋণ : উইকিপিডিয়া, অনলাইন পত্রিকা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অভিনেতা ও আবৃত্তি শিল্পী।
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭ ।