তারিকুর রাহমান খান :
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নি কো নজরুল।’
অন্নদাশঙ্কর রায় বড়ো আক্ষেপ করে কথাগুলো লিখেছেন। দেশভাগের বেদনা আর পাঁচজন বাঙালির মতো কবিকেও বিচলিত করেছিল। কিন্তু সব ভাগাভাগির উর্ধ্বে নজরুলকে স্থাপন করে, তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন নজরুল বাঙালি কবি। সকল সাম্প্রদায়িক গণ্ডির বাইরে তার স্থান। সত্যিই নজরুল আমাদের জাতিসত্তার প্রতীক। সমাজের অন্যায়, অত্যাচার যে শুধু রাইফেল, লাঠি ও গায়ের জোড় দিয়ে করা যায় তা নয়; কলম দিয়েও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় তা দেখিয়েছেন নজরুল, সাদাত হোসেন মান্টোসহ অনেক মহামানবরা। তারা প্রতি পদে পদে বাঁধা পেয়েও পিছিয়ে যায়নি। থামায়নি তাদের হাতে তুলে নেওয়া কলম। তারা সব সময় সমাজের অন্যায় দিকগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তারা সমাজের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফলে জেল খেটেছেন, তবুও তারা অন্যায়ের বিরদ্ধে লড়েছেন অবিরাম। আর এখন অন্যায় অত্যাচার দেখেও আমরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকি। তাই দিন দিন অপরাধ অপকর্ম বেড়েই চলছে সমাজে। অন্যায়ের প্রতিবাদতো করিই না তার উপরে সমাজে ভাল থাকার জন্য তেল দিতে থাকি। এতে আবার সেই বর্বর জাতিতে পরিণত হচ্ছে। তাই আবার দরকার সেই কলম হাতে তুলে ধরা নজরুল ও সাদাত হোসেন মান্টোর মতো ব্যক্তিদের।
সাম্য, মানবতাবাদী ও বিদ্রোহী এই তিনে মিলে নজরুল।
দুঘু মিয়া থেকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মে দীনদরিদ্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান আমাদের দুঘু মিয়া বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নজরুলের জন্মলগ্নেই এই ভাগ্যভূমিতে রোপিত হয়েছিল দুর্বিষহ দারিদ্র্যের বীজ। মাত্র নয় বছর বয়সে নজরুলের বাবা মারা যান। ফলে শৈশবের শিক্ষার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গাঁয়ের মক্তবের লেখাপড়া বাদ দিয়ে চুরুলিয়ার লেটো গানের দলে যোগ দেন আমাদের দুখু মিয়া। সমকালীন পরিবেশই তাঁকে দিয়েছিল দুঃখ জয়ের মহৎ উত্তরাধিকার। দুখুর মেধা ছিল প্রখর কিন্তু সীমাহীন আর্থিক সংকটের পাহাড় তাঁর গতিপথে সৃষ্টি করেছিল বাঁধা। এই বাঁধাই সরস্বতীর সূচিসুভ্র অঙ্গন থেকে কঠিন সংগ্রামের রণভূমিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ আঁছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে, গঠিত হয়েছে সাত হাজার সৈনিক নিয়ে বাঙালি রেজিমেন্ট। নজরুলের চেতনায় তখন যৌবনের উন্মাদনা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামক একটি গল্প ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ ১৯১৯ সালেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই অসহযোগ আন্দোলন তখন দেশজুড়ে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিলা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিলা ফিরে যান ১৯ জুনে-এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময় তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছেÑ ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে’ প্রভৃতি। তিনি সেখানে ১৭ দিন থেকে স্থান পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লা ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল-এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; সেই মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’-নজরুলের সে সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যা ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব বিশেষত ঔপনিবেশিক শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রবল ঝড়ের মতো তাঁর রচিত কবিতা, গান, প্রবন্ধ, পত্রিকার নিবন্ধ প্রভৃতিতে কবির বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। যার উদাহরণ ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি-
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে নাÑ
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি চির বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তখন ধূমকেতু পত্রিকা বিশেষ অবদান রাখে। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। দুঃখের কথা হলো এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিলা থেকে গ্রেফতারও করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিলা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেনÑ
‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি, আমি অপ্রকাশ্য সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…।’
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (জানুয়ারি ২২, ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত গীতিনাট্য’ গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন।
নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন- কান্ডারী হুশিয়ার, পথের দিশা, হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ প্রভৃতি কবিতা। ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন-
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনো জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’
অন্যদিকে নজরুল ইসলামকে বলা হয় সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তিনি হিন্দু-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখেছেন। ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি বলেছেন
গাহি সাম্যের গানÑ
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
তোমারি কামনা-রাণী/যুগে যুগে পশু ফেলেছে তোমায় মুত্যু-বিবরে টানি। ‘মানুষ’ কবিতায় কত সুন্দর কথা বলেছেন নজরুল। যা আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষ নামের এই পশুদের।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পান। স্বাধীনোত্তর কালে ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।
নজরুলের আবির্ভাব পরাধীন ভারতে। আজীবন দরিদ্র নিপীড়িত কবির মধ্যে ছিল এক কঠিন সংগ্রামের স্পৃহা। তাঁর ওপর সাম্রাজ্যবাদী অপশাসন তাঁর চেতনায় বিদ্রোহের অগ্নিসংযোগ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কালে এবং তার পরবর্তী ব্রিটিশ ভারতে তাঁর কবিতার উজ্জীবনী শক্তি সংগ্রামের বীজ বপন করে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সর্বহারা’, ‘ভাঙার গান’, ‘কামাল পাশা’, ‘সিন্ধুহিল্লোল’ প্রভৃতিতে তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সাম্যবাদী চেতনার আপসহীন সংগ্রামের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। ‘সাম্যবাদী’, ‘ফণীমনসা’ নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর ছোটোগল্প হলোÑ ‘ব্যাথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’; উপন্যাসঃ ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, নাটকঃ ‘আলেয়া’, ‘ঝিলিমিলি’; কবিতাঃ ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘বুলবুল’গীতগ্রন্থ ইত্যাদি।
ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে ‘কবি নজরুল ইসলাম বাংলার তথা সমগ্র ভারতের আশা প্রদানকারী কবি। তিনি অনাগত কালের কবি।’ তার সাথে বলতে ‘ইচ্ছে করে নজরুল সমগ্র অত্যাচারিত মানুষের সাহসি কণ্ঠসর’। নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে বাংলাদেশের লোকজীবন তাঁর যথার্থ স্বরূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তিনি চির বিদ্রোহী তরুণ প্রাণের বার্তাবাহক। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাঙালি থাকবে, থাকবে ততদিন বাংলার ঘরে ঘরে চিরজাগ্রত থাকবেন তাঁর কবিতায় আর গানে। তাঁর কবিতা আর গান আজও কোটি কোটি বাঙালীর জীবনের মহামন্ত্র ধ্বনিরূপে অনুরণিত। এককথায় ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল’। ১৯৭৬ সালের ২৯ শে মে, আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে রোগে আক্রান্ত হয়ে কবি গভীর আক্ষেপ বুকে নিয়ে চির বিদায় গ্রহণ করেন।
তথ্যঋণ: সঞ্চিতা, উকিপিডিয়া, নবম-দশম ক্লাসের বই ও আগমণি বার্তা।
তারিকুর রাহমান খান
লেখক, অভিনয় ও আবৃত্তি শিল্পী