মৃত্যুঞ্জয় রায় :
একপাশে সড়ক পথ, অন্যপাশে গভীর সুন্দরবন মাঝখানে প্রবহমান নদী আর অন্য পাশে ভারত সীমান্ত। তাই আপনিও আসতে পারেন, সাতক্ষীরার সড়কপথে বাঘ মামার দেখা পেতে; তবে ভাগ্যে থাকলে হয়তো দেখা হয়েও যেতে পারে। সুন্দরবন দেখার সুবিধার জন্যই এ সড়ক পথই যথেষ্ঠ। তাই তো বলা হয় ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন’।
সাতক্ষীরা শহর পেরিয়ে যতই দূরে যেতে থাকবেন বঙ্গপোসাগরের কোল ঘেঁষা সুন্দরবনের সীমানায়, ততই ভাবতে ভাবতে ভেসে যাবেন সুন্দর সত্যের কাছাকাছি।
মানচিত্রের সবুজ যে দেশের প্রাণ, সে দেশের সবুজ কত সুন্দর, মহোময় আর প্রাণবন্ত তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? দেখেছেন সবুজ ছায়াময় গ্রাম আর বন-বনানীর দিকে একবার তাকিয়ে? উপভোগ করেছেন কি এর মনোলোভা সৌন্দর্য? হয়তো কবির মতো বলবেন ‘সময় কোথা সময় নষ্ট করবার’।
নাগরিক জীবনের বিষাক্ত বাতাস, ক্লেদাক্ত কর্মময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে তাই দেখে আসুন সেই গাঢ় সবুজের মেলা। যে মেলায় শুধু সবুজ খেলা করে। আর সবুজের সঙ্গে খেলা করে হরেক জীবজন্তু, পাখপাখালি, কীটপতঙ্গ আর বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা জলভেজা বাতাস। সুন্দরবন আমাদের প্রাণে আনন্দের খোরাক যোগায়, শত ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে সময়কে উপভোগ করার প্রণোদনা দেয়। সেই সময়কে কি সময় নষ্ট বলা যায়? নিশ্চয় না।
বাংলাদেশের ৬টি জেলা জুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত হলেও একমাত্র সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ থেকে সরাসরি দেখা যায় সুন্দরবনের সবুজ আবহ। সরাসরি মুন্সিগঞ্জ গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যতদূর আপনার চোখ যাবে, শুধু দেখবেন সবুজ সীমানা। সড়ক পথে যেতে দেখতে পাবেন দেবহাটা মিনি সুন্দরবন পার্ক, শ্যামনগর ডিসি আকাশ লীনা ইকোট্যুরিজম পার্ক আর চোখ জোড়ানো গহীন সুন্দরবন।
মংলা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট যেদিক দিয়েই সুন্দরবন যান না কেন, বন দেখার জন্য নদীপথে ছুটতে হবে অনেকটা দূর। কিন্ত একমাত্র সাতক্ষীরার কোলঘেঁষা সুন্দরবন ব্যতিক্রম। বন যেন ময়ুরের মতো সুন্দর পেখম মেলে বসে আছে তার অগণিত প্রণয়ীর প্রতীক্ষায়। সাতক্ষীরা শহর পেরুলেই রাস্তার দুপাশের বড় বড় সবুজ বৃক্ষ আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে সুন্দরবনের পথে। আপনার গাড়ি চলতে থাকবে সবুজ টানেলের ভেতর দিয়ে।
গাড়ি থেকে নেমেই সাতক্ষীরার মালঞ্চ, কালিন্দী, রায়মঙ্গল, খোলপেটুয়া, বুড়িগোয়ালিনী নদীর তীর ছুঁয়ে সুন্দরবনে ঘোরার জন্য পর্যাপ্ত নৌকা চলতে শুরু করবে মাঝারি আকৃতির নদী দিয়ে। দু‘পাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। তবে বাঘ, হরিণ, বানর, বনমোরগ প্রভৃতি প্রাণী দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আপনাকে যেতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। নৌকা যখন ঢুকবে ছোট শাখা নদী বা খালগুলোতে তখন কিন্তু অপনার গায়ে কাটা দিতে শুরু করবে। এই বুঝি বাঘ এসে পড়ল আপনার গায়ের উপর। আর গাঢ় সবুজ অন্ধকারের মাঝে শীতল হাওয়া ভয়টা একটু বেশিই বাড়িয়ে তুলবে। তবে সুন্দরবনের পশ্চিম বনের ভিতর দিয়ে কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজমে নদীপথে যাওয়ার সময় দুই ধারের সারি সারি বন মুগ্ধ করে।
ইকোট্যুরিজম ঘাটে ট্রলার ভিড়লেই অসংখ্য বানরের দেখা মিলে। মূল অংশে ঢোকার পথে আছে লোহার তৈরি একটি ব্রিজ। এই ব্রিজ পার হলে একটি রেস্ট হাউজ ও কাঠের তৈরি আরেকটি ব্রিজ নজরে আসে। কাঠের সেতুর দুই পাশে আছে খলিশা, হরকোচা ও বাইন গাছের সারি। আর বনের ভিতরে আছে বানর ও হরিণের দল। ওয়াকওয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে পাঁচতলা ওয়াচ টাওয়ার থেকে পাখির চোখে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
এখানে বনের ভিতরের শিব মন্দিরে বনবিবির পূজা করা হয়। অনেকের বিশ্বাস মন্দিরে দর্শন দিয়ে বনের ভেতরে গেলে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তারপর ঘোরাঘুরির অবসান ঘটিয়ে ক্লান্ত শরীরে খাওয়ার প্রস্ততি নিবেন স্থানীয় হোটেলে। এখানে এমন কিছু বিশেষ মাছ পাওয়া যায় যা দেশের অন্য কোথাও দেখা পাওয়া যায়না বললেই চলে। মাছগুলোও কিন্তু অনেক সুস্বাদু। তবে পছন্দের খাবারের জন্য একমাত্র ভরসা টাইগার পয়েন্টের ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনে দুপুর এবং রাতের খাবার পাবেন ১০০-১২০টাকায়। এর সাথে কিছু অতিরিক্ত টাকা যোগ করে চিংড়ি, ভেটকি, ভাঙান, পাসসে, কাইন, বাঁশপাতা, খয়রা, তপস্বে, দাঁতনেসহ বিভিন্ন প্রজাতির নদীর মাছ খাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। তবে ভুল করে হরিণের মাংস খাওয়ার কথা না বলাই ভালো। কারণ এটা একবারেই নিষিদ্ধ।
থাকা–খাওয়া:
থাকার জন্য সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট এবং বর্ষার রেস্ট হাউসই ভরসা। টাইগার পয়েন্টে রুমপ্রতি ভাড়া ৫০০-১৭০০ টাকা। তবে ডরমেটরি টাইপের কিছু রুমে প্রতি বেডের ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। এখানে ৩টি আধুনিক সুবিধাসহ কনফারেন্স রুমও আছে। এছাড়া, একসঙ্গে ১০০ জন মানুষ এখানে থাকতে ও খেতে পারবে। এখানে আরও একটি স্পেশাল সুযোগ পাবেন। সেটা হলো, ছাদে বসে বাডর্স আই ভিউ থেকে সুন্দরবন দেখা। আর চাঁদনি রাত যদি পেয়ে যান, তাহলে তো কথাই নেই।
যাতায়াত:
ঢাকার কল্যাণপুর, মালিবাগ ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সোহাগ, সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস, কে লাইন, একে ট্রাভেলস, এম আর, ঈগল, এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহনসহ প্রায় ১২টি পরিবহনে সাতক্ষীরা যাওয়া যায়। একে ট্রাভেলস এবং এম আর পরিবহনে সরাসরি যাওয়া যায় সাতক্ষীরা শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে। ভাড়া ৫০০ টাকা। তবে এসি পরিবহনে যেতে পারবেন সাতক্ষীরা সদর পর্যন্ত।
ভাড়া ৭০০-১০০০ টাকা। সকাল, দুপুর ও রাতের তিনটি নির্দিষ্ট সময়ে গাড়িগুলো ঢাকা ছেড়ে যায়।
সূত্র : বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা