8:52 pm, Thursday, 19 September 2024

নিউইয়র্কের তিন বিস্ময় : আফরোজা পারভীন

  • কারুবাক
  • আপডেটের সময় : ১০:৪৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
  • 145 ভিউ
শেয়ার করুন

নিউইয়র্কে থাকার ব্যবস্থা ছিল ‘স্লিপ ইন ব্রুকলেনে।’ শিবলি স্যার বললেন, চমৎকার হোটেল, ভাড়া ২৮৯ ডলার। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকেই যেন মেলা ভেঙে গেছিল। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। নিউইয়র্কে আমাদের অফিসিয়াল প্রোগ্রাম নেই, কাজেই এক সাথে থাকার বাধ্যবাধকতাও নেই। হোটেলে না থাকলে হোটেল ভাড়া পাবেনা এই যা। নাসিমা বলল, সে তার মেয়ের বাসায় উঠবে। শিবলি স্যার বললেন, থেকে যাবেন ওয়াশিংটনেই, ছেলের কাছে। দেশ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে ওনার স্ত্রীও এসে গেছেন ছেলের বাসায়। কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে চান। মাসুদ স্যার বললেন, উনি চলে যাবেন বোস্টনে সম্বন্ধির বাসায়, ভাবি এসে সেখানে রয়েছেন। শুধু যাদের নিউইয়র্কে থাকার তেমন সুবিধা নেই বা থাকতে চাননা তারাই থাকবেন ‘স্লিপ ইন ব্রুকলেনে। সব শুনে নাসিমার মন খারাপ হল। সে চেয়েছিল সবাইকে একবেলা কোন বাংলা হোটেেেল খাওয়াতে। অনেকেই বলল, অসুবিধা কি, যারা পারবে খাবে। নাসিমা হোটেলে এসে সবাইকে নিয়ে যাবে। আমি ভাবলাম, এ সুযোগ ছাড়ি কেন, চলে যাই চাচার বাসায়। কাটিয়ে যাই দুটো দিন।
২০ অক্টোবর ২০১২ শনিবার, ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্কের পথে যাত্রা। ঢাকায় ফিরব ২২ ডিসেম্বর। সকাল ১১.০৫ এ ফøাইট ডেলটা এয়ারওয়েজে। ফ্লাইট নং ডিএল ৬০২৯। ডিপারচার গেট নং বি ৭৬, আর সিট নং ১৩ সি। দীর্ঘ দীর্ঘ ডিলের পর প্লেন ছাড়ল। নিউইয়র্ক কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম দুপুর পার করে। বাংলাদেশেও কখনও কোন ফøাইট ছাড়তে এতটা বিলম্ব হয় কিনা সন্দেহ! সত্যি বিদেশে যখন যাই আর এসব নৈরাজ্য দেখি তখন দেশের প্রতি ভালবাসা বাড়ে।
এয়ারপোর্টে খুকি চাচি এসেছিলেন। চাচা-চাচি থাকেন লং আইল্যান্ড। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পথে লংবিচ দেখে লং আইল্যান্ডে পৌঁছলাম। গাড়িতেই চাচিকে বললাম, এই একদিনে যতটা সম্ভব আমাকে যেন দেখিয়ে দেন। আর কবে আসব, আদৌও আসা হবে কিনা কে জানে। চাচি বার বার আফসোস করতে লাগলেন, ‘কেন যে প্লেনটা ডিলে হল, আর কেন যে এতটা সময় নষ্ট হল। এই সময়টা নষ্ট না হলে তিনি আমাকে অনেক কিছু দেখিয়ে দিতে পারতেন।’ এর মধ্যেই বার কয়েক বললেন, ‘পরশুদিন যাবার দরকার নেই তোমার। সামনে ঈদ। ঈদ করে যাও আমাদের সাথে।’ আমি হাসলাম। চাচির আন্তকিতা ভাল লাগল, কিন্তু দেশে যে রয়েছে নাড়ির টান। রয়েছে স্বামী, সন্তানেরা। তাদের ছেড়ে আমি এখানে ঈদ করব কি করে! তাছাড়া আমি সরকারি চাকুরে। চাইলেই কোথাও ওভার স্টে করতে পারিনে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে চাচি জানতে চাইলেন, কোন কিছু দেখার ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন আগ্রহ আছে কিনা? নাকি চাচি তার ইচ্ছেমত দেখাবেন? আমি তড়বড় করে বললাম, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, ওয়াল ট্রেড সেন্টার, টুইন টাওয়ার। চাচি সাথে সাথে চাচাতো ভাই নাবিলকে বললেন নেটে বসে ফেরির বুকিং দিতে। ফেরির টিকেট না পেলে স্ট্যাচু দেখতে হবে দূর থেকে। কাছে গিয়ে দেখা যাবে না। মন খারাপ হয়ে গেল। নিউইয়র্কে এসে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে পারব না ভাবতেই পারছি না। চাচি জানালেন, গত সপ্তাহে কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন। তাদেরও খুবই ইচ্ছে ছিল ‘স্ট্যাচু অব লিবাটির্’ দেখতে যাবার। কিন্তু ফেরির টিকেট না পাওয়ায় দেখতে পারেননি। আমার ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাবিল এসে জানালো ফেরির কোন টিকেট পাওয়া গেল না।
মন খারাপ হয়ে গেল। চাচির নিজ হাতে বানানো রকমারি খাবার বিস্বাদ লাগল। কিন্তু করার কিছুই নেই। এত আর বাংলাদেশ নয় যে ব্লাকে টিকেট পাওয়া যাবে।
চাচির কোন তুলনা হয় না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়ে আমাকে বললেন তৈরি হতে। নাবিলকে আগেই বলে রেখেছিলেন। নাস্তা সেরে বেরিয়ে গেলাম। নাবিল গাড়ি চালিয়ে আমাদের ‘সাবওয়ে’ পর্যন্ত দিয়ে আবার গড়ি নিয়ে ফেরৎ গেল। দ্রুত টিকেট কেটে ততধিক দ্রুত টিউবের উদ্দেশ্যে ছুটলেন চাচি। পেছনে আমি হিমশিম খেতে লাগলাম। দুবার টিউব বদলে যেখানে নামলাম সেখান থেকে খানিকটা এগিয়ে চাচি একটা কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেন। দাঁড়ানোমাত্র চারদিক থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে চাচিকে ছেঁকে ধরল। প্রত্যেকের হাতে ব্রশিওর। তারা তাদের ট্রিপ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে লাগলেন। চাচি শুনলেন তবে হাতে ব্রশিওর নিয়ে নিজেই উল্টেপাল্টে দেখে একটা টিকেট কিনলেন। পাশেই হুড় খোলা একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। চাচি বললেন, ‘উপরে উঠে যাও।’ আমি সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম। চারপাশে সবই সাদা চামড়া তার মাঝে আমি আর চাচি দুই কালো মানবী। সাদারা ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখতে লাগল। আমার সামনের দিকে চেয়ারে বসে একজন মাইকে ধারাভাষ্য দিয়ে চলল। আর আমাদের কানে দেয়া হল এয়ারফোন। তাতে আমরা ধারাভাষ্যের পুরোটাই শুনতে পেলাম। চাচি জানালেন, এটা ডাউনটাউন ট্যুর। এই ট্যুরে দেখানো হবে মেসিজ, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, চায়না টাউন, লিটিল ইটালি, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ওয়াল স্ট্রিট, ব্যাটারি পার্ক, সাউথ স্ট্রিট সি পোর্ট, ইউনাইটেড নেশনস, রকফেলার সেন্টার, গ্রিনউইচ ভিলেজ, রেয়ার ইস্ট সাইড, টাইমস স্কয়ার, থিয়েটার ডিস্ট্রিক্টসহ আরো অনেক কিছু। টিকেট প্রাপ্ত বয়স্কদে জন্য ৪৪ ডলার, আর ১১ বছরের কম বয়সিদের জন্য ৩৪ ডলার। টিকেটের মেয়াদ থাকে ২৪ ঘন্টা। ব্রডওয়ের ৪৯ ও ৫০ স্ট্রিটের ৮ এভিনিউ থেকে বাস ছাড়ে। চাচি জানালেন, প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত বিরতিহীনিভাবে এই বাস চলে। কোন একটা জায়গায় নেমে ঘুরে দেখার পর পার্শ্ববর্তী স্টপেজে দাঁড়ালেই এ ধরনের যে কোন বাসে একই টিকেট দিয়ে যাওয়া যায়। চাচি বললেন, ‘বুঝলে এখানে ট্যুরের ছড়াছড়ি। কত রকমের যে ট্যুর আছে, সুপার ডাউন টাউন ট্যুর, আপটাউন ট্রেজার ও হারলেম ট্যুর, ব্রুকলেন ট্যুর, নাইট ট্যুর, অল এরাউন্ড টাউন ট্যুর, সুপার নিউইয়র্ক ট্যুর, এসকোর্টেড ডে ট্রিপস, আরো কত কি। তুমি যেসব জায়গা দেখতে চাইলে সেগুলোর অনেকটাই এ ট্যুরে দেখা যাবে। তাই এ টিকেটটা নিলাম। যদি কয়েকটা দিন থেকে যেতে তাহলে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম।
কথা বলতে বলতে চাচি বললেন, ‘এই যে দেখ দেখ, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং।’ মুর্হূ মুর্হূ ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলতে থাকল। চাচিও সমানে ছবি তুলতে লাগলেন। আমি উপরের দিকে তাকালাম। এই সেই এম্পায়ার স্টে বিল্ডি। ধারাভাষ্য শুনে জানলাম, এটি ১০২ তলা বিশিষ্ট গগনচুম্বি অট্টালিকা যা নিউইয়র্কের মিডটাউন ম্যানহাটনে অবস্থিত। ভবনটি ফিফথ এভিনিউ ও পশ্চিম ৩৪ তম স্ট্রিট যেখানে আড়াআড়িভাবে সংযুক্ত হয়েছে সেই সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই ভবনের ছাদের দৈর্ঘ্য ১২৫০ ফিট আর এন্টিনা সংযোগে এর উচ্চতা দাঁড়িয়েছে ১৪৫৮ ফিট। ভবনের নামকরণ করা হয়েছে নিউইয়র্কের ডাকনাম ‘এম্পায়ার স্টেট’ অনুসারে। ১৯৩১ সালে নির্মিত হবার পর থেকে ১৯৭২ সালে নর্থ টাওয়ারে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত ৪০ বছর ধরে এটা ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম ভবন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রান্ত হবার ফলে এটি পুনরায় নিউইয়র্কের দীর্ঘতম ভবনের পূর্ব অবস্থানে ফিরে আসে। তবে আমেরিকায় কিংবা বিশ্বে নয়। আবার ২০১২ সালে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের ফলে এটি দীর্ঘতম ভবনের স্থানটি হারায়। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় দীর্ঘতম গগনচুম্বী ভবন। অন্য দুটি হচ্ছে উইলস টাওয়ার ও ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল ও টাওয়ার। অবশ্য এ দুটিই শিকাগোতে অবস্থিত। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বিশ্বের ২৩তম দীর্ঘ বিল্ডিং। বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম ভবন হচ্ছে দুবাইএর ‘বুরি খলিফা।’
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকে আমেরিকার সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে ধরা হয়। এটি ডিসটিংটিভ আর্ট ও ডেকো স্টাইলে তৈরি। ‘আমেরিকান সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারস’ এটিকে বর্তমান বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর বর্তমান মালিক ২৮০০ বিনিয়োগকারি যারা এই বিল্ডিং এসোসিয়েশনের লোক। বর্তমানে এই ভবনে ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের পুনঃসংস্কার কাজ চলছে যার মধ্যে ১২০ মিলিয়ন ব্যয় হয়েছে ভবনটিকে জ্বালানী সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য।
১৮ শতকে থমপসন ফার্ম প্রথম এই ভবনের সাইট নির্ধারণ করে। ভবনের চুনাপাথর আনা হয় ইণ্ডিয়ানার ব্লমিংটন সংলগ্ন ‘ইমপায়ার মিল স্যানডারস’ থেকে। ভবনের নকশা করেন উইলিয়াম এফ ল্যাম্ব। এই বিল্ডিং নির্মিত হয় ‘বিশ্বের দীর্ঘতম ভবন প্রতিযোগিতা’র মধ্য দিয়ে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অপর দুটি প্রজেক্ট ছিল ৪০ ওয়াল স্ট্রিট ও ক্রিসলিয়ার বিল্ডিং। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর নির্মাণ যখন শুরু হয় তখন বাকি ভবন দুটি নির্মাণাধীন ছিল। ১৯৩১ সালের মে মাসে এক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সরকারীভাবে ভবনটি উন্মুক্ত করা হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হোবার ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে একটা বোতাম টিপে বিল্ডিং এর বাতি জ্বালিয়ে এর শুভ উদ্বোধন করেন। ১৯৩২ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হোবারের উপর ফ্রাঙ্করিন ডি রুজভেল্ট বিজয়ী হলে কাকতালীয়ভাবে একই পদ্ধতিতে এই বিল্ডিং এর উপরের টাওয়ারের লাইট জ্বালানো হয়।
এই দীর্ঘতম ভবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অঘটন ঘটেছে। ১৯৪৫ সালের ২৮ জুলাই শনিবার লেফটন্যান্ট কলোনেল উইলয়াম ফ্রাঙ্কলিন স্মিথ জার নামের একজন বৈমানিক একটা মিচেল বোম্বার চালাচ্ছিলেন। বোম্বারটি মেঘের মধ্যে পড়ে তাল হারায়। ফলে ভবনের নর্থ সাইডের ৭৯-৮০ তলার মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। সেখানে ক্যাথলিক ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের অফিস ছিল। এই ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়। এক পর্যায়ে ভবনে আগুন ধরে যায়। বেটি লু অলিভার নামে একজন এলিভেটর চালক ভবনের ৭৫ তলায় এলিভেটরে আটকা পড়ে যায়। এলিভেটরে আটকা পড়ে দীর্ঘসময় বেঁচে থাকার কারণে যা গ্রীনিজ বুক অব রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। পরের বছর অপর একটি এয়ারক্রাফট বিধ্বস্ত হতে হতে অল্পের জন্য বেঁচে যায়। দুর্ঘটনা ছাড়াও আত্মহত্যার ঘটনাও এ ভবনকে কেন্দ্র করে প্রায়শই ঘটে। প্রতিবছর বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়ে কমপক্ষে ৩০ জন লোক আত্মহত্যা করে। প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ভবনের নির্মাণ সম্পন্ন হবার আগেই। একজন শ্রমিক ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ জন শ্রমিক লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করায় ১৯৪৫ সালে পর্যবেক্ষণ টাওযার ঘেরা বেষ্টনি সরিয়ে নেয়া হয়।
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর সামনে দু’চার মিনিট বিরতি দিল বাস। অনেকে নেমে ছবি তুলল। কেউ কেউ রয়ে গেল এখানেই। বাস চলতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছালাম চায়না টাউনে। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার সারা পৃথিবী জুড়ে। চীনাদের বাণিজ্য মনস্কতার এটা একটা উজ্জ্বল প্রমাণ। পৃথিবীর যেখানে গেছি সেখানেই একটা করে চায়না টাউন বা চায়না মার্কেটের খোঁজ পেয়েছি। আমাদের কক্সবাজারেও আছে। এনট্রপিক মিউজিয়াম, পুরানো মেসিজ, ওয়ার্ল্ড আর্ট এসটোরিয়া, রক সেন্টার ক্যাফে, রক ফেলার সেন্টার, পার্ক এভিনিউ, রেডিও সিটি মিউজিক হল, কুপার ইন্সটিটিউট, টাইম স্কয়ার, সিটি হল, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, মিল স্টিট, ব্রুকলেন, ব্রুকলেন ব্রিজ দেখলাম। দেখলাম ওয়েস্ট সাইট হাইওয়ে ম্যানহাটন, ম্যানহাটন ব্রিজ, নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ফেডারেল প্লাজা। ধারভাষ্য চলছে, কিছু বুঝতে পারছি, কিছু পারছি না। যেটা বুঝতে পারছি না চাচির কাছে জেনে নেবার চেষ্টা করছি। আর এক সঙ্কট হাতে কাগজ বা নোটবই নেই। এটা আমার বরাবরের সঙ্কট। আসার সময় ভুলে খালি হাতে আসা নিয়ম, এবারও এসেছি। টিকেট কাউন্টার থেকে একটা ব্রশিওর দিয়েছে। সেটাতেই এলোপাথাড়ি ভাবে লিখছি। এ লেখা যে উদ্ধার করা কঠিন হবে, আর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ষোল আনা সেটা বলাবাহুল্য। চাচির কাছে শুনতে গেলে দেখা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মহাবিপদে আছি বলা চলে। একটা হাসপাতালের সামনে দিয়ে চলার সময় চাচি বললেন, ‘ভাল করে দেখ। এটা বেলভিউ হাসপাতাল। এখানে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন।’ মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে গেলাম। মনে পড়ল হুমায়ূনের অসুস্থতাকালীন সময়ে নিউইয়র্কে অবস্থান আর তার মৃত্যুকে ঘিরে নানান কথা। একটা রাস্তায় ঢোকার পর ভাষ্যকার জানাল এটা ওয়াল স্ট্রিট। ভাল করে দেখলাম। ছেলেবেলা থেকে এ স্ট্রিটের নাম জেনে এসেছি। সারা পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় এই স্ট্রিট থেকে। ইকনমিক্স আর এমবিএ পড়ার সুবাদে এই স্ট্রিটে ঘটে যাওয়া শেয়ার সংক্রান্ত বড় বড় কেলেঙ্কারির কথাও আমার জানা। একটা সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকল বাস। ধারাভাষ্যকারের বর্ণনা থেকে জানলাম এটা ৪৯ স্ট্রিট। এখানে জন্মেছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী ক্যাথরিন হেপবার্ন। তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির দোলাচল উপলব্ধি করলাম। মনে হচ্ছিল এই বাড়ির কোন একটা ঘরে ঘুমিয়েছেন হেপবার্ন, হেসেছেন, কেঁদেছেন। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটেছেন। মুগ্ধ দর্শকরা দেখেছে তাকে দু’চোখ মেলে। রাস্তা থেকে বেরিয়ে এল বাস। ভাবছি কখন যাব ‘টুইন টাওয়ার’ আর ‘স্ট্রাচু অব লিবার্টি’ দেখতে।
অবশেষে এলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এলাকায়। যাকে টুইন টাওয়ার নামেই মানুষ জানে। বেশ বড় একটা জায়গা টিন দিয়ে ঘেরা, মাঝে চলছে নির্মাণ কাজ। রাস্তার মুখে অনেকগুলো ছোট ছোট দোকান। দোকান আর ফুটপাতে বসে দোকানিরা বিক্রি করছে টুইন টাওয়ার আক্রমণ সংক্রান্ত নানান ধরনের বই ও পুস্তিকা। এটা নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটন এলাকায় অবস্থিত। যা রিপ্লেস করবে একই জায়গা থেকে নির্মূল হওয়া একই নামের সাতটি বিল্ডিং কমপ্লেক্সের। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পরিচিতি মূলত ছিল টুইন টাওয়ারের মাধ্যমেই যা আগেই উল্লেখ করেছি। ১৯৭৩ সালের ৪ এপ্রিল এই সেন্টার ওপেন করা হয়। ২০০১ সালের আক্রমণে আরও সাতটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ যা ধ্বংস হয়। এই কমপ্লেক্সের অন্যান্য ভবনও বিধ¦স্ত হয়। বিধ্বস্ত ভবনগুলির ধ্বংসাবশেষ আস্তে আস্তে অপসারিত করা হয়। বর্তমানে এই স্থানে পাঁচটি নতুন গগনস্পর্শী ভবন ও ১/ ১১ এর আক্রমণে নিহতদের স্মরণে একটি মেমোরিয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের আগস্টে একটা ভবনের নির্মাণ শেষ হয়েছে। অন্য দুটির নির্মাণ শেষ পর্যায়ে আছে। বাকি তিনটির নির্মাণ ২০২০ সালে শেষ হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে। ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড সেন্টার’ হবে এই ভবনের সবচেয়ে বড় ভবন এবং নিউউয়র্কের সর্ববৃহৎ ভবন।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ১ (নর্থ টাওয়ার) ও ২ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ২ (সাউথ টাওয়ার) কে একত্রে বলা হত ‘টুইন টাওয়ার’ যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ভবন। এই টাওয়ার নির্মাণ করা হয় ১৯৭৫ ও ১৯৮৫ সালে। ভবনের নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪০০ মিলিয়ন। ২০১৩ সালের হিসেবে যা ২৩০০, ০০০, ০০০. এই স্থান নিউইয়র্ক সিটি ডাউনটাউন ফাইনান্সিয়াল ডিসট্রিক্টের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মোট এলাকা ১৩.৪ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট।
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংএর মত এ ভবনকে কেন্দ্র করেও রয়েছে দুর্ঘটনার ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ সেন্টারে আগুন লাগে। ১৯৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বোম্বিং হয় আর ১৯৯৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ডাকাতি হয়। তবে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, যাতে সারা বিশ্ব স্তÍম্ভিত হয়ে পড়ে। আল কায়দার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাউজাকাররা দুটো বোয়িং ৭৬৭ যোগে এই কমপ্লেক্সে আক্রমণ চালায়। তারা টাওয়ার দুটিতে পালাক্রমে আক্রমণ করে। ৫৬ মিনিট একাধারে আগুন জ্বলার পর সাউথ টাওয়ার ধ্বংস হয়। এর আধঘন্টা পর নর্থ টাওয়ার ধ্বংস হয়। এই আক্রমণে ২৭৫৩ জন লোক মারা যায়। কমপ্লেক্সের অন্যান্য ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকার ১০ টি বড় স্থাপনা ধবংস হয়। এই ধ¦ংস¯ূÍপ পরিষ্কার করতে আট মাস সময় লাগে।
এই কমপ্লেক্স নির্মাণ নিয়ে অনেক সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এটি ছিল ‘রেডিও রো’ এলাকা। যেখানে শত শত বাণিজ্যিক ও শিল্প শ্রমিক আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা করত। ১০০ টি বাড়িও ছিল। ভবনের নির্মাণকল্পে এই সব মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়। তারা ইউনাইটেড স্টেটস সুপ্রীম কোর্টে মামলা করতে গেলে কোর্ট তাদের মামলা নিতে অস্বীকার করে।
যেতে যেতে ভাবছিলাম পৃথিবীব্যাপী সর্বত্র আইন সর্বদাই সবলের পক্ষে আর দুর্বলের ভক্ষক তাহলে আইনের নামে প্রহসনের প্রয়োজন কি!
অবশেষে এলাম ব্যাটারি পার্ক এলাকায়। বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। পার্কের মধ্যে একজন লোক অসাধারণ শারীরিক কসরত দেখাচ্ছিল। তাকে ঘিরে গোল হয়ে অনেকে সে খেলা দেখছিল। কেউ কেউ দু’চার ডলার দিচ্ছিল। আমরা এগিয়ে গেলাম। চাচির তাড়া ছিল। এখান থেকে ফিরে চাচি যাবেন একটা বিয়েতে। বাঙালির বিয়ে নিউইয়র্কের বাঙালিদের জন্য উৎসবের মত। বিয়েতে যাবেন বলে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। দূর থেকে চোখ পড়ল ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির’ উপর। এটা হচ্ছে সেই বিশাল চিরায়ত স্ট্যাচু যা বিশ্বকে আলোকিত করে বলে আমেরিকাবাসীরা মনে করে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকায় নিউইয়র্ক হারবারের মধ্যস্থিত লিবার্টি আইলান্ডে এই স্ট্যাচু অবস্থিত। স্ট্যাচুর নকশা করেছেন ‘ফ্রেডরিক অগস্টি বার্থওলডি।’ এটা ফরাসি জনগণের পক্ষ থেকে আমেরিকাবাসীকে প্রদত্ত একটা শুভেচ্ছা উপহার। ১৮৮৬ সালের ২৮ আগস্ট এই উপহার প্রদান করা হয়। স্ট্যাচুটি এক অভিজাত পোশাক পরা নারীমূর্তির যিনি রোমান স্বাধীনতার দেবী ‘লিবারটাসের’ প্রতীক। যার এক হতে ধরা একটি প্রজ্জ্বলিত মশাল, অন্য হাতে ধরা টাবুলা এনসাটা যাতে উৎকীর্ণ আছে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ জুলাই ৪, ১৭৭৬। একটা ভাঙা শিকল রয়েছে মূর্তির পায়ে। এই স্ট্যাচু আমেরিকাবাসীর কাছে স্বাধীনতার পবিত্র ও মূর্ত প্রতীক যা অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের আমেরিকায় আসতে স্বাগত জানায়।
ফরাসী আইন অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদ এডওয়ার্ড রেনি ডি লেবোলি ১৯৬৫ সালে মন্তব্য করেন, যদি আমেরিকায় কোন স্বাধীনতার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় তা ফরাসী ও আমেরিকার যৌথ সম্পদ হবে। তার এই মন্তব্যে বার্থওলডি উৎসাহিত হন। ফ্রান্সের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ১৯৮০ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সৌধের নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। লেবোলি প্রস্তার করেন ফরাসি সরকার স্ট্যাচু নির্মাণের খরচ দেবে আর আমেরিকা জায়গা ও স্ট্যাচুর স্তম্ভ (পেডেস্টাল) নির্মাণ করে দেবে। পরিপূর্ণভাবে স্ট্যাচুর নকশা তৈরি করার আগেই বার্থওলডি স্ট্যাচুর মাথা ও মশাল বহনকারী হাত বানান। প্রচারণার জন্য এগুলি একটি আন্তর্জাতিক একজিবিশনে প্রদর্শন করা হয়। ১৯৭৬ সালে মশাল বহনকারী হাতটি ফিলাডেলফিয়ার ‘সেনটিনিয়াল এক্সপোজিশনে’ প্রদর্শন করা হয়। ১৯৭৬-১৯৮২ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের ‘ মেডিসন স্কয়ার পার্কে’ দেখানো হয়। আমেরিকাবাসীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ছিল রীতিমত দুরূহ কাজ। ১৯৮৫ সালে স্তম্ভের নির্মাণ কাজ হুমকির মধ্যে পড়ে অর্থ সঙ্কটে। ওয়ার্ল্ড প্রকাশনীর বিখ্যাত প্রকাশক জোসেফ পুলিতজার প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার অর্থ সংগ্রহের জন্য দান গ্রহণের একটা প্রচেষ্ট নেন। এতে ১২০০০০ দাতা সাড়া দেন। তবে তাদের অধিকাংশই ১ ডলারের কম প্রদান করে। স্ট্যাচু নির্মাণ করা হয় ফ্রান্সে। জাহাজে করে এটি নিয়ে আসা হয়। অন্য দিকে সম্পূর্ণ নির্মিত স্তম্ভ (পেডেস্টাল) বেডলোস আইল্যান্ডে এনে দুটিকে সংযাজন করা হয়। স্ট্যাচুর সম্পূর্ণতা উদযাপন করা হয় নিউইয়র্কের প্রথম ‘টিকার টেপ’ প্যারেডের মধ্য দিয়ে। এই উপলক্ষে একটা উৎসর্গ সেরিমনির আয়োজন করা হয় যাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড সভাপতিত্ব করেন। উৎসর্গের দিন মেডিসিন স্কয়ার থেকে প্যারেড শুরু হয়ে ম্যানহাটনের সাউটার্ন টিপে অবস্থিত ব্যাটারি পার্কের দিকে যেতে থাকে। এই প্যারেড ফিফথ এভিনিউ, ব্রডওয়ে পার্ক রোড ও ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ক্রস করে। প্যারেড স্টক এক্সচেঞ্জ অতিক্রম করার সময় বিনিয়োগকারীরা জানালা দিয়ে টিকার-টেপ ছুঁড়ে মারে। যা নিউইয়র্কের ঐতিহ্যবাহী টিকার-টেপ প্যারেড শুরু করার ইঙ্গিত। সন্ধ্যায় অনুরূপ একটা প্যারেড হয়। প্রেসিডেন্ট ক্লিভল্যান্ড একটা ‘ইয়টে’ চড়েন যা তাকে বেডলোস দ্বীপের পোতাশ্রয়ে নিয়ে যায়। ফ্রেন্স কমিটির তরফ থেকে ডি লেসিপস প্রথম বক্তব্য রাখেন। এরপর নিউইয়র্ক কমিটির চেয়ারম্যান উইলিয়াম এ ইভারটস বক্তব্য দেন। একটা ফরাসী পতাকা আড়াআড়িভাবে স্ট্যাচুর মুখের সামনে রাখা হয় এবং স্ট্যাচুকে উন্মক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে বলেন, ‘মশালের আলো অজ্ঞানতার অন্ধকার ও মানুষের অবসাদ দূর করবে যতদিন স্বাধীনতার আলো এ পৃথিবীতে থাকবে।’ বার্থওলডি ডায়াসের পাশে বসে ছিলেন। তাকে ডাকলে তিনি বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন। সাধারণ জনতাকে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় না। কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিই শুধু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। নারীরাও ছিল অনুষ্ঠানে অনাহুত। শুধুমাত্র বার্থওলডির স্ত্রী ও ডি লেসিপসের নাতনিকে অনুষ্ঠানে যাবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সরকারিভাবে বলা হয়, জনতার চাপে আহত হবার ভয়ে মহিলাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। নারীবাদী নেত্রীরা একটা বোট ভাড়া করে যতদূর সম্ভব দ্বীপের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করে। নেতারা স্বাধীনতার প্রতীক স্থাপন করার জন্য করতালি দিয়ে সাধুবাদ জানায় এবং একই সাথে নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য স্লোগান দেয়। তবে খারাপ আবহাওয়ার কারণে নির্ধারিত ফায়ার ওয়ার্ক ডিসপ্লে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাতিল করা হয়।
উৎসর্গ অনুষ্ঠানের পরদিন ক্লিভলান্ড গেজেট নামের একটি আফ্রিকান আমেরিকান পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘স্ট্যাচুর হাতে প্রজ্জ্বলিত মশাল আমেরিকার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকা পর্যন্ত এক নাগাড়ে জ্বলবে না এটাই বাস্তব।’
স্ট্যাচু অব লিবার্টি ন্যাশনাল মনুমেন্টে ঢুকতে কোন টাকা লাগে না তবে ফেরিতে যাবার জন্য টাকা দিতে হয়। ফেরি জার্সি সিটির লিবার্টি পার্ক এবং লোয়ার ম্যানহাটনের ব্যাটারি পার্ক থেকে ছেড়ে এলিস আইল্যান্ড পর্যন্ত যায়। ফেরিতে ওঠার আগে এয়ারপোর্টের মতই নিরাপত্তা তল্লাশি করতে হয়। স্ট্যাচুর বেজ এবং পেডেস্টালে যাবার জন্য ফেরির টিকেটের সাথে একটা কমপ্লিমেন্টারি টিকেট দেয়া হয়। যারা স্ট্যাচুর ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে ক্রাউন পর্যন্ত উঠতে চান তাদের একটা স্পেশাল টিকেট কিনতে হয় যে টিকেটের বুকিং সাধারণত এক বছর আগেই শেষ হয়ে যায়। দশ গ্রুপে প্রতিদিন ২৪০ জনকে স্ট্যাচুতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। প্রতি ঘন্টায় তিনেটে করে গ্রুপ যেতে পারে। যারা উপরে উঠতে চান তারা সাথে শুধু ক্যামেরা এবং ওষুধ নিতে পারেন। অন্যান্য জিনিস রাখার জন্য লকারের ববস্থা আছে। উপরে ওঠার আগে আরেকবার নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়।
১৯০১ সাল পর্যন্ত স্ট্যাচু রক্ষণাবেক্ষণের প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল ইউনাইটেড স্টেটস লাইট হাউস বোর্ডের হাতে। এরপর দায়িত্ব আসে ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ারের হাতে। ১৯৩৩ সাল থেকে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস।
১৯৮০ সালে দৃশ্যমান হয় যে, স্ট্যাচুর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। ফলে সংস্কারজনিত কারণে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত স্ট্যাচু দেখা বন্ধ ছিল। এ সময় মশাল ও স্ট্যাচুর অভ্যন্তরের অনেকাংশ সংস্কার করা হয়। ১৯৩৮ সালে রিনোভেশনের কাজে পুনরায় এটি বন্ধ রাখা হয়। ২০০১ সালের ১১­সেপ্টেম্বরের আক্রমণের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে এটি বন্ধ রাখা হয়। ২০০৪ সালে প্যাডেস্টাল খুলে দেয়া হয়। ২০০৯ সালে সীমিত সংখ্যক পর্যটক ক্রাউন পর্যন্ত ওঠার অনুমতি পায়। পুনরায় ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বেজ ও পেডেস্টাল বন্ধ রাখা হয়। ফলে দ্বিতীয় একটি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। তবে লিবার্টি আইল্যান্ড উন্মুক্ত থাকে। হারিকেন স্যান্ডির কারণে স্ট্যাচু দেখা পুনরায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ৪ জুলাই এটি পুনরায় খোলা হয়। তবে মশাল ঘিরে ব্যালকনিতে যাতায়াত বন্ধ রাখা হয় ১৯১৬ সাল থেকে।
পৃথিবীব্যাপী এ স্ট্যাচুর অনুকরণে অসংখ্য রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে। মূল স্ট্যাচুর চার ভাগের এক ভাগ উচ্চতা বিশিষ্ট একটি রেপ্লিকা প্যারিসের আমেরিকান কমিউনিটি তৈরি করে তাদের শহরে স্থাপন করেছে। ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আর একটি রেপ্লিকা ম্যানহাটনের পশ্চিম ৬৪ স্ট্রিট্রের লিবার্টি ওয়ার হাউসের শীর্ষে বহু বছর ধরে ছিল। বর্তমানে এটি ব্রিকলেন মিউজিয়ামে রাখা হযেছ্।ে আমেরিকান বয় স্কাউটরা ১৯৪৯-১৯৫২ পর্যন্ত ‘স্বাধীনতার বাহু শক্ত কর’ ক্যাম্পেনকালে কপারের তৈরি ১০০ ইঞ্চি উচ্চতার ২০০ রেপ্লিকা তৈরি তরে জনগণকে উপহার দেয়। স্ট্যাচু অব লিবার্টি বা তার রেপ্লিকা এখন গণতন্ত্রের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যা ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমিয়েন স্কয়ারের আন্দোলন এবং ফরাসী গণতন্ত্রের উত্তরণপথে প্রভাব রেখেছিল।
স্ট্যাচু দেখা শেষ করে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলাম। চাচি যাবেন বিয়েতে আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু নাহারের সাথে জ্যাকসন হাইটসে যাব রাতের নিউইয়র্কের বাঙালি জীবন দেখতে। রাস্তায় এসে বাস পেলাম না। অপেক্ষা করার সময় ছিল না। দ্রুত একটা ট্যাক্সি ধরল চাচি। চললাম লং আইল্যান্ডের পথে। মনে দুঃখ রয়ে গেল, কাছ থেকে দেখা হল না ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে।’

#
জনপ্রিয়

নিউইয়র্কের তিন বিস্ময় : আফরোজা পারভীন

আপডেটের সময় : ১০:৪৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
শেয়ার করুন

নিউইয়র্কে থাকার ব্যবস্থা ছিল ‘স্লিপ ইন ব্রুকলেনে।’ শিবলি স্যার বললেন, চমৎকার হোটেল, ভাড়া ২৮৯ ডলার। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকেই যেন মেলা ভেঙে গেছিল। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। নিউইয়র্কে আমাদের অফিসিয়াল প্রোগ্রাম নেই, কাজেই এক সাথে থাকার বাধ্যবাধকতাও নেই। হোটেলে না থাকলে হোটেল ভাড়া পাবেনা এই যা। নাসিমা বলল, সে তার মেয়ের বাসায় উঠবে। শিবলি স্যার বললেন, থেকে যাবেন ওয়াশিংটনেই, ছেলের কাছে। দেশ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে ওনার স্ত্রীও এসে গেছেন ছেলের বাসায়। কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে চান। মাসুদ স্যার বললেন, উনি চলে যাবেন বোস্টনে সম্বন্ধির বাসায়, ভাবি এসে সেখানে রয়েছেন। শুধু যাদের নিউইয়র্কে থাকার তেমন সুবিধা নেই বা থাকতে চাননা তারাই থাকবেন ‘স্লিপ ইন ব্রুকলেনে। সব শুনে নাসিমার মন খারাপ হল। সে চেয়েছিল সবাইকে একবেলা কোন বাংলা হোটেেেল খাওয়াতে। অনেকেই বলল, অসুবিধা কি, যারা পারবে খাবে। নাসিমা হোটেলে এসে সবাইকে নিয়ে যাবে। আমি ভাবলাম, এ সুযোগ ছাড়ি কেন, চলে যাই চাচার বাসায়। কাটিয়ে যাই দুটো দিন।
২০ অক্টোবর ২০১২ শনিবার, ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্কের পথে যাত্রা। ঢাকায় ফিরব ২২ ডিসেম্বর। সকাল ১১.০৫ এ ফøাইট ডেলটা এয়ারওয়েজে। ফ্লাইট নং ডিএল ৬০২৯। ডিপারচার গেট নং বি ৭৬, আর সিট নং ১৩ সি। দীর্ঘ দীর্ঘ ডিলের পর প্লেন ছাড়ল। নিউইয়র্ক কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম দুপুর পার করে। বাংলাদেশেও কখনও কোন ফøাইট ছাড়তে এতটা বিলম্ব হয় কিনা সন্দেহ! সত্যি বিদেশে যখন যাই আর এসব নৈরাজ্য দেখি তখন দেশের প্রতি ভালবাসা বাড়ে।
এয়ারপোর্টে খুকি চাচি এসেছিলেন। চাচা-চাচি থাকেন লং আইল্যান্ড। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পথে লংবিচ দেখে লং আইল্যান্ডে পৌঁছলাম। গাড়িতেই চাচিকে বললাম, এই একদিনে যতটা সম্ভব আমাকে যেন দেখিয়ে দেন। আর কবে আসব, আদৌও আসা হবে কিনা কে জানে। চাচি বার বার আফসোস করতে লাগলেন, ‘কেন যে প্লেনটা ডিলে হল, আর কেন যে এতটা সময় নষ্ট হল। এই সময়টা নষ্ট না হলে তিনি আমাকে অনেক কিছু দেখিয়ে দিতে পারতেন।’ এর মধ্যেই বার কয়েক বললেন, ‘পরশুদিন যাবার দরকার নেই তোমার। সামনে ঈদ। ঈদ করে যাও আমাদের সাথে।’ আমি হাসলাম। চাচির আন্তকিতা ভাল লাগল, কিন্তু দেশে যে রয়েছে নাড়ির টান। রয়েছে স্বামী, সন্তানেরা। তাদের ছেড়ে আমি এখানে ঈদ করব কি করে! তাছাড়া আমি সরকারি চাকুরে। চাইলেই কোথাও ওভার স্টে করতে পারিনে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে চাচি জানতে চাইলেন, কোন কিছু দেখার ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন আগ্রহ আছে কিনা? নাকি চাচি তার ইচ্ছেমত দেখাবেন? আমি তড়বড় করে বললাম, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, ওয়াল ট্রেড সেন্টার, টুইন টাওয়ার। চাচি সাথে সাথে চাচাতো ভাই নাবিলকে বললেন নেটে বসে ফেরির বুকিং দিতে। ফেরির টিকেট না পেলে স্ট্যাচু দেখতে হবে দূর থেকে। কাছে গিয়ে দেখা যাবে না। মন খারাপ হয়ে গেল। নিউইয়র্কে এসে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে পারব না ভাবতেই পারছি না। চাচি জানালেন, গত সপ্তাহে কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন। তাদেরও খুবই ইচ্ছে ছিল ‘স্ট্যাচু অব লিবাটির্’ দেখতে যাবার। কিন্তু ফেরির টিকেট না পাওয়ায় দেখতে পারেননি। আমার ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাবিল এসে জানালো ফেরির কোন টিকেট পাওয়া গেল না।
মন খারাপ হয়ে গেল। চাচির নিজ হাতে বানানো রকমারি খাবার বিস্বাদ লাগল। কিন্তু করার কিছুই নেই। এত আর বাংলাদেশ নয় যে ব্লাকে টিকেট পাওয়া যাবে।
চাচির কোন তুলনা হয় না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়ে আমাকে বললেন তৈরি হতে। নাবিলকে আগেই বলে রেখেছিলেন। নাস্তা সেরে বেরিয়ে গেলাম। নাবিল গাড়ি চালিয়ে আমাদের ‘সাবওয়ে’ পর্যন্ত দিয়ে আবার গড়ি নিয়ে ফেরৎ গেল। দ্রুত টিকেট কেটে ততধিক দ্রুত টিউবের উদ্দেশ্যে ছুটলেন চাচি। পেছনে আমি হিমশিম খেতে লাগলাম। দুবার টিউব বদলে যেখানে নামলাম সেখান থেকে খানিকটা এগিয়ে চাচি একটা কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেন। দাঁড়ানোমাত্র চারদিক থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে চাচিকে ছেঁকে ধরল। প্রত্যেকের হাতে ব্রশিওর। তারা তাদের ট্রিপ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে লাগলেন। চাচি শুনলেন তবে হাতে ব্রশিওর নিয়ে নিজেই উল্টেপাল্টে দেখে একটা টিকেট কিনলেন। পাশেই হুড় খোলা একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। চাচি বললেন, ‘উপরে উঠে যাও।’ আমি সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম। চারপাশে সবই সাদা চামড়া তার মাঝে আমি আর চাচি দুই কালো মানবী। সাদারা ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখতে লাগল। আমার সামনের দিকে চেয়ারে বসে একজন মাইকে ধারাভাষ্য দিয়ে চলল। আর আমাদের কানে দেয়া হল এয়ারফোন। তাতে আমরা ধারাভাষ্যের পুরোটাই শুনতে পেলাম। চাচি জানালেন, এটা ডাউনটাউন ট্যুর। এই ট্যুরে দেখানো হবে মেসিজ, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, চায়না টাউন, লিটিল ইটালি, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ওয়াল স্ট্রিট, ব্যাটারি পার্ক, সাউথ স্ট্রিট সি পোর্ট, ইউনাইটেড নেশনস, রকফেলার সেন্টার, গ্রিনউইচ ভিলেজ, রেয়ার ইস্ট সাইড, টাইমস স্কয়ার, থিয়েটার ডিস্ট্রিক্টসহ আরো অনেক কিছু। টিকেট প্রাপ্ত বয়স্কদে জন্য ৪৪ ডলার, আর ১১ বছরের কম বয়সিদের জন্য ৩৪ ডলার। টিকেটের মেয়াদ থাকে ২৪ ঘন্টা। ব্রডওয়ের ৪৯ ও ৫০ স্ট্রিটের ৮ এভিনিউ থেকে বাস ছাড়ে। চাচি জানালেন, প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত বিরতিহীনিভাবে এই বাস চলে। কোন একটা জায়গায় নেমে ঘুরে দেখার পর পার্শ্ববর্তী স্টপেজে দাঁড়ালেই এ ধরনের যে কোন বাসে একই টিকেট দিয়ে যাওয়া যায়। চাচি বললেন, ‘বুঝলে এখানে ট্যুরের ছড়াছড়ি। কত রকমের যে ট্যুর আছে, সুপার ডাউন টাউন ট্যুর, আপটাউন ট্রেজার ও হারলেম ট্যুর, ব্রুকলেন ট্যুর, নাইট ট্যুর, অল এরাউন্ড টাউন ট্যুর, সুপার নিউইয়র্ক ট্যুর, এসকোর্টেড ডে ট্রিপস, আরো কত কি। তুমি যেসব জায়গা দেখতে চাইলে সেগুলোর অনেকটাই এ ট্যুরে দেখা যাবে। তাই এ টিকেটটা নিলাম। যদি কয়েকটা দিন থেকে যেতে তাহলে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম।
কথা বলতে বলতে চাচি বললেন, ‘এই যে দেখ দেখ, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং।’ মুর্হূ মুর্হূ ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলতে থাকল। চাচিও সমানে ছবি তুলতে লাগলেন। আমি উপরের দিকে তাকালাম। এই সেই এম্পায়ার স্টে বিল্ডি। ধারাভাষ্য শুনে জানলাম, এটি ১০২ তলা বিশিষ্ট গগনচুম্বি অট্টালিকা যা নিউইয়র্কের মিডটাউন ম্যানহাটনে অবস্থিত। ভবনটি ফিফথ এভিনিউ ও পশ্চিম ৩৪ তম স্ট্রিট যেখানে আড়াআড়িভাবে সংযুক্ত হয়েছে সেই সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই ভবনের ছাদের দৈর্ঘ্য ১২৫০ ফিট আর এন্টিনা সংযোগে এর উচ্চতা দাঁড়িয়েছে ১৪৫৮ ফিট। ভবনের নামকরণ করা হয়েছে নিউইয়র্কের ডাকনাম ‘এম্পায়ার স্টেট’ অনুসারে। ১৯৩১ সালে নির্মিত হবার পর থেকে ১৯৭২ সালে নর্থ টাওয়ারে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত ৪০ বছর ধরে এটা ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম ভবন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রান্ত হবার ফলে এটি পুনরায় নিউইয়র্কের দীর্ঘতম ভবনের পূর্ব অবস্থানে ফিরে আসে। তবে আমেরিকায় কিংবা বিশ্বে নয়। আবার ২০১২ সালে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের ফলে এটি দীর্ঘতম ভবনের স্থানটি হারায়। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় দীর্ঘতম গগনচুম্বী ভবন। অন্য দুটি হচ্ছে উইলস টাওয়ার ও ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল ও টাওয়ার। অবশ্য এ দুটিই শিকাগোতে অবস্থিত। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বিশ্বের ২৩তম দীর্ঘ বিল্ডিং। বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম ভবন হচ্ছে দুবাইএর ‘বুরি খলিফা।’
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকে আমেরিকার সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে ধরা হয়। এটি ডিসটিংটিভ আর্ট ও ডেকো স্টাইলে তৈরি। ‘আমেরিকান সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারস’ এটিকে বর্তমান বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর বর্তমান মালিক ২৮০০ বিনিয়োগকারি যারা এই বিল্ডিং এসোসিয়েশনের লোক। বর্তমানে এই ভবনে ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের পুনঃসংস্কার কাজ চলছে যার মধ্যে ১২০ মিলিয়ন ব্যয় হয়েছে ভবনটিকে জ্বালানী সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য।
১৮ শতকে থমপসন ফার্ম প্রথম এই ভবনের সাইট নির্ধারণ করে। ভবনের চুনাপাথর আনা হয় ইণ্ডিয়ানার ব্লমিংটন সংলগ্ন ‘ইমপায়ার মিল স্যানডারস’ থেকে। ভবনের নকশা করেন উইলিয়াম এফ ল্যাম্ব। এই বিল্ডিং নির্মিত হয় ‘বিশ্বের দীর্ঘতম ভবন প্রতিযোগিতা’র মধ্য দিয়ে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অপর দুটি প্রজেক্ট ছিল ৪০ ওয়াল স্ট্রিট ও ক্রিসলিয়ার বিল্ডিং। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর নির্মাণ যখন শুরু হয় তখন বাকি ভবন দুটি নির্মাণাধীন ছিল। ১৯৩১ সালের মে মাসে এক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সরকারীভাবে ভবনটি উন্মুক্ত করা হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হোবার ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে একটা বোতাম টিপে বিল্ডিং এর বাতি জ্বালিয়ে এর শুভ উদ্বোধন করেন। ১৯৩২ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হোবারের উপর ফ্রাঙ্করিন ডি রুজভেল্ট বিজয়ী হলে কাকতালীয়ভাবে একই পদ্ধতিতে এই বিল্ডিং এর উপরের টাওয়ারের লাইট জ্বালানো হয়।
এই দীর্ঘতম ভবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অঘটন ঘটেছে। ১৯৪৫ সালের ২৮ জুলাই শনিবার লেফটন্যান্ট কলোনেল উইলয়াম ফ্রাঙ্কলিন স্মিথ জার নামের একজন বৈমানিক একটা মিচেল বোম্বার চালাচ্ছিলেন। বোম্বারটি মেঘের মধ্যে পড়ে তাল হারায়। ফলে ভবনের নর্থ সাইডের ৭৯-৮০ তলার মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। সেখানে ক্যাথলিক ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের অফিস ছিল। এই ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়। এক পর্যায়ে ভবনে আগুন ধরে যায়। বেটি লু অলিভার নামে একজন এলিভেটর চালক ভবনের ৭৫ তলায় এলিভেটরে আটকা পড়ে যায়। এলিভেটরে আটকা পড়ে দীর্ঘসময় বেঁচে থাকার কারণে যা গ্রীনিজ বুক অব রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। পরের বছর অপর একটি এয়ারক্রাফট বিধ্বস্ত হতে হতে অল্পের জন্য বেঁচে যায়। দুর্ঘটনা ছাড়াও আত্মহত্যার ঘটনাও এ ভবনকে কেন্দ্র করে প্রায়শই ঘটে। প্রতিবছর বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়ে কমপক্ষে ৩০ জন লোক আত্মহত্যা করে। প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ভবনের নির্মাণ সম্পন্ন হবার আগেই। একজন শ্রমিক ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ জন শ্রমিক লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করায় ১৯৪৫ সালে পর্যবেক্ষণ টাওযার ঘেরা বেষ্টনি সরিয়ে নেয়া হয়।
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর সামনে দু’চার মিনিট বিরতি দিল বাস। অনেকে নেমে ছবি তুলল। কেউ কেউ রয়ে গেল এখানেই। বাস চলতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছালাম চায়না টাউনে। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার সারা পৃথিবী জুড়ে। চীনাদের বাণিজ্য মনস্কতার এটা একটা উজ্জ্বল প্রমাণ। পৃথিবীর যেখানে গেছি সেখানেই একটা করে চায়না টাউন বা চায়না মার্কেটের খোঁজ পেয়েছি। আমাদের কক্সবাজারেও আছে। এনট্রপিক মিউজিয়াম, পুরানো মেসিজ, ওয়ার্ল্ড আর্ট এসটোরিয়া, রক সেন্টার ক্যাফে, রক ফেলার সেন্টার, পার্ক এভিনিউ, রেডিও সিটি মিউজিক হল, কুপার ইন্সটিটিউট, টাইম স্কয়ার, সিটি হল, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, মিল স্টিট, ব্রুকলেন, ব্রুকলেন ব্রিজ দেখলাম। দেখলাম ওয়েস্ট সাইট হাইওয়ে ম্যানহাটন, ম্যানহাটন ব্রিজ, নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ফেডারেল প্লাজা। ধারভাষ্য চলছে, কিছু বুঝতে পারছি, কিছু পারছি না। যেটা বুঝতে পারছি না চাচির কাছে জেনে নেবার চেষ্টা করছি। আর এক সঙ্কট হাতে কাগজ বা নোটবই নেই। এটা আমার বরাবরের সঙ্কট। আসার সময় ভুলে খালি হাতে আসা নিয়ম, এবারও এসেছি। টিকেট কাউন্টার থেকে একটা ব্রশিওর দিয়েছে। সেটাতেই এলোপাথাড়ি ভাবে লিখছি। এ লেখা যে উদ্ধার করা কঠিন হবে, আর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ষোল আনা সেটা বলাবাহুল্য। চাচির কাছে শুনতে গেলে দেখা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মহাবিপদে আছি বলা চলে। একটা হাসপাতালের সামনে দিয়ে চলার সময় চাচি বললেন, ‘ভাল করে দেখ। এটা বেলভিউ হাসপাতাল। এখানে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন।’ মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে গেলাম। মনে পড়ল হুমায়ূনের অসুস্থতাকালীন সময়ে নিউইয়র্কে অবস্থান আর তার মৃত্যুকে ঘিরে নানান কথা। একটা রাস্তায় ঢোকার পর ভাষ্যকার জানাল এটা ওয়াল স্ট্রিট। ভাল করে দেখলাম। ছেলেবেলা থেকে এ স্ট্রিটের নাম জেনে এসেছি। সারা পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় এই স্ট্রিট থেকে। ইকনমিক্স আর এমবিএ পড়ার সুবাদে এই স্ট্রিটে ঘটে যাওয়া শেয়ার সংক্রান্ত বড় বড় কেলেঙ্কারির কথাও আমার জানা। একটা সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকল বাস। ধারাভাষ্যকারের বর্ণনা থেকে জানলাম এটা ৪৯ স্ট্রিট। এখানে জন্মেছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী ক্যাথরিন হেপবার্ন। তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির দোলাচল উপলব্ধি করলাম। মনে হচ্ছিল এই বাড়ির কোন একটা ঘরে ঘুমিয়েছেন হেপবার্ন, হেসেছেন, কেঁদেছেন। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটেছেন। মুগ্ধ দর্শকরা দেখেছে তাকে দু’চোখ মেলে। রাস্তা থেকে বেরিয়ে এল বাস। ভাবছি কখন যাব ‘টুইন টাওয়ার’ আর ‘স্ট্রাচু অব লিবার্টি’ দেখতে।
অবশেষে এলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এলাকায়। যাকে টুইন টাওয়ার নামেই মানুষ জানে। বেশ বড় একটা জায়গা টিন দিয়ে ঘেরা, মাঝে চলছে নির্মাণ কাজ। রাস্তার মুখে অনেকগুলো ছোট ছোট দোকান। দোকান আর ফুটপাতে বসে দোকানিরা বিক্রি করছে টুইন টাওয়ার আক্রমণ সংক্রান্ত নানান ধরনের বই ও পুস্তিকা। এটা নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটন এলাকায় অবস্থিত। যা রিপ্লেস করবে একই জায়গা থেকে নির্মূল হওয়া একই নামের সাতটি বিল্ডিং কমপ্লেক্সের। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পরিচিতি মূলত ছিল টুইন টাওয়ারের মাধ্যমেই যা আগেই উল্লেখ করেছি। ১৯৭৩ সালের ৪ এপ্রিল এই সেন্টার ওপেন করা হয়। ২০০১ সালের আক্রমণে আরও সাতটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ যা ধ্বংস হয়। এই কমপ্লেক্সের অন্যান্য ভবনও বিধ¦স্ত হয়। বিধ্বস্ত ভবনগুলির ধ্বংসাবশেষ আস্তে আস্তে অপসারিত করা হয়। বর্তমানে এই স্থানে পাঁচটি নতুন গগনস্পর্শী ভবন ও ১/ ১১ এর আক্রমণে নিহতদের স্মরণে একটি মেমোরিয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের আগস্টে একটা ভবনের নির্মাণ শেষ হয়েছে। অন্য দুটির নির্মাণ শেষ পর্যায়ে আছে। বাকি তিনটির নির্মাণ ২০২০ সালে শেষ হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে। ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড সেন্টার’ হবে এই ভবনের সবচেয়ে বড় ভবন এবং নিউউয়র্কের সর্ববৃহৎ ভবন।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ১ (নর্থ টাওয়ার) ও ২ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ২ (সাউথ টাওয়ার) কে একত্রে বলা হত ‘টুইন টাওয়ার’ যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ভবন। এই টাওয়ার নির্মাণ করা হয় ১৯৭৫ ও ১৯৮৫ সালে। ভবনের নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪০০ মিলিয়ন। ২০১৩ সালের হিসেবে যা ২৩০০, ০০০, ০০০. এই স্থান নিউইয়র্ক সিটি ডাউনটাউন ফাইনান্সিয়াল ডিসট্রিক্টের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মোট এলাকা ১৩.৪ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট।
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংএর মত এ ভবনকে কেন্দ্র করেও রয়েছে দুর্ঘটনার ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ সেন্টারে আগুন লাগে। ১৯৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বোম্বিং হয় আর ১৯৯৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ডাকাতি হয়। তবে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, যাতে সারা বিশ্ব স্তÍম্ভিত হয়ে পড়ে। আল কায়দার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাউজাকাররা দুটো বোয়িং ৭৬৭ যোগে এই কমপ্লেক্সে আক্রমণ চালায়। তারা টাওয়ার দুটিতে পালাক্রমে আক্রমণ করে। ৫৬ মিনিট একাধারে আগুন জ্বলার পর সাউথ টাওয়ার ধ্বংস হয়। এর আধঘন্টা পর নর্থ টাওয়ার ধ্বংস হয়। এই আক্রমণে ২৭৫৩ জন লোক মারা যায়। কমপ্লেক্সের অন্যান্য ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকার ১০ টি বড় স্থাপনা ধবংস হয়। এই ধ¦ংস¯ূÍপ পরিষ্কার করতে আট মাস সময় লাগে।
এই কমপ্লেক্স নির্মাণ নিয়ে অনেক সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এটি ছিল ‘রেডিও রো’ এলাকা। যেখানে শত শত বাণিজ্যিক ও শিল্প শ্রমিক আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা করত। ১০০ টি বাড়িও ছিল। ভবনের নির্মাণকল্পে এই সব মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়। তারা ইউনাইটেড স্টেটস সুপ্রীম কোর্টে মামলা করতে গেলে কোর্ট তাদের মামলা নিতে অস্বীকার করে।
যেতে যেতে ভাবছিলাম পৃথিবীব্যাপী সর্বত্র আইন সর্বদাই সবলের পক্ষে আর দুর্বলের ভক্ষক তাহলে আইনের নামে প্রহসনের প্রয়োজন কি!
অবশেষে এলাম ব্যাটারি পার্ক এলাকায়। বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। পার্কের মধ্যে একজন লোক অসাধারণ শারীরিক কসরত দেখাচ্ছিল। তাকে ঘিরে গোল হয়ে অনেকে সে খেলা দেখছিল। কেউ কেউ দু’চার ডলার দিচ্ছিল। আমরা এগিয়ে গেলাম। চাচির তাড়া ছিল। এখান থেকে ফিরে চাচি যাবেন একটা বিয়েতে। বাঙালির বিয়ে নিউইয়র্কের বাঙালিদের জন্য উৎসবের মত। বিয়েতে যাবেন বলে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। দূর থেকে চোখ পড়ল ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির’ উপর। এটা হচ্ছে সেই বিশাল চিরায়ত স্ট্যাচু যা বিশ্বকে আলোকিত করে বলে আমেরিকাবাসীরা মনে করে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকায় নিউইয়র্ক হারবারের মধ্যস্থিত লিবার্টি আইলান্ডে এই স্ট্যাচু অবস্থিত। স্ট্যাচুর নকশা করেছেন ‘ফ্রেডরিক অগস্টি বার্থওলডি।’ এটা ফরাসি জনগণের পক্ষ থেকে আমেরিকাবাসীকে প্রদত্ত একটা শুভেচ্ছা উপহার। ১৮৮৬ সালের ২৮ আগস্ট এই উপহার প্রদান করা হয়। স্ট্যাচুটি এক অভিজাত পোশাক পরা নারীমূর্তির যিনি রোমান স্বাধীনতার দেবী ‘লিবারটাসের’ প্রতীক। যার এক হতে ধরা একটি প্রজ্জ্বলিত মশাল, অন্য হাতে ধরা টাবুলা এনসাটা যাতে উৎকীর্ণ আছে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ জুলাই ৪, ১৭৭৬। একটা ভাঙা শিকল রয়েছে মূর্তির পায়ে। এই স্ট্যাচু আমেরিকাবাসীর কাছে স্বাধীনতার পবিত্র ও মূর্ত প্রতীক যা অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের আমেরিকায় আসতে স্বাগত জানায়।
ফরাসী আইন অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদ এডওয়ার্ড রেনি ডি লেবোলি ১৯৬৫ সালে মন্তব্য করেন, যদি আমেরিকায় কোন স্বাধীনতার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় তা ফরাসী ও আমেরিকার যৌথ সম্পদ হবে। তার এই মন্তব্যে বার্থওলডি উৎসাহিত হন। ফ্রান্সের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ১৯৮০ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সৌধের নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। লেবোলি প্রস্তার করেন ফরাসি সরকার স্ট্যাচু নির্মাণের খরচ দেবে আর আমেরিকা জায়গা ও স্ট্যাচুর স্তম্ভ (পেডেস্টাল) নির্মাণ করে দেবে। পরিপূর্ণভাবে স্ট্যাচুর নকশা তৈরি করার আগেই বার্থওলডি স্ট্যাচুর মাথা ও মশাল বহনকারী হাত বানান। প্রচারণার জন্য এগুলি একটি আন্তর্জাতিক একজিবিশনে প্রদর্শন করা হয়। ১৯৭৬ সালে মশাল বহনকারী হাতটি ফিলাডেলফিয়ার ‘সেনটিনিয়াল এক্সপোজিশনে’ প্রদর্শন করা হয়। ১৯৭৬-১৯৮২ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের ‘ মেডিসন স্কয়ার পার্কে’ দেখানো হয়। আমেরিকাবাসীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ছিল রীতিমত দুরূহ কাজ। ১৯৮৫ সালে স্তম্ভের নির্মাণ কাজ হুমকির মধ্যে পড়ে অর্থ সঙ্কটে। ওয়ার্ল্ড প্রকাশনীর বিখ্যাত প্রকাশক জোসেফ পুলিতজার প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার অর্থ সংগ্রহের জন্য দান গ্রহণের একটা প্রচেষ্ট নেন। এতে ১২০০০০ দাতা সাড়া দেন। তবে তাদের অধিকাংশই ১ ডলারের কম প্রদান করে। স্ট্যাচু নির্মাণ করা হয় ফ্রান্সে। জাহাজে করে এটি নিয়ে আসা হয়। অন্য দিকে সম্পূর্ণ নির্মিত স্তম্ভ (পেডেস্টাল) বেডলোস আইল্যান্ডে এনে দুটিকে সংযাজন করা হয়। স্ট্যাচুর সম্পূর্ণতা উদযাপন করা হয় নিউইয়র্কের প্রথম ‘টিকার টেপ’ প্যারেডের মধ্য দিয়ে। এই উপলক্ষে একটা উৎসর্গ সেরিমনির আয়োজন করা হয় যাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড সভাপতিত্ব করেন। উৎসর্গের দিন মেডিসিন স্কয়ার থেকে প্যারেড শুরু হয়ে ম্যানহাটনের সাউটার্ন টিপে অবস্থিত ব্যাটারি পার্কের দিকে যেতে থাকে। এই প্যারেড ফিফথ এভিনিউ, ব্রডওয়ে পার্ক রোড ও ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ক্রস করে। প্যারেড স্টক এক্সচেঞ্জ অতিক্রম করার সময় বিনিয়োগকারীরা জানালা দিয়ে টিকার-টেপ ছুঁড়ে মারে। যা নিউইয়র্কের ঐতিহ্যবাহী টিকার-টেপ প্যারেড শুরু করার ইঙ্গিত। সন্ধ্যায় অনুরূপ একটা প্যারেড হয়। প্রেসিডেন্ট ক্লিভল্যান্ড একটা ‘ইয়টে’ চড়েন যা তাকে বেডলোস দ্বীপের পোতাশ্রয়ে নিয়ে যায়। ফ্রেন্স কমিটির তরফ থেকে ডি লেসিপস প্রথম বক্তব্য রাখেন। এরপর নিউইয়র্ক কমিটির চেয়ারম্যান উইলিয়াম এ ইভারটস বক্তব্য দেন। একটা ফরাসী পতাকা আড়াআড়িভাবে স্ট্যাচুর মুখের সামনে রাখা হয় এবং স্ট্যাচুকে উন্মক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে বলেন, ‘মশালের আলো অজ্ঞানতার অন্ধকার ও মানুষের অবসাদ দূর করবে যতদিন স্বাধীনতার আলো এ পৃথিবীতে থাকবে।’ বার্থওলডি ডায়াসের পাশে বসে ছিলেন। তাকে ডাকলে তিনি বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন। সাধারণ জনতাকে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় না। কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিই শুধু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। নারীরাও ছিল অনুষ্ঠানে অনাহুত। শুধুমাত্র বার্থওলডির স্ত্রী ও ডি লেসিপসের নাতনিকে অনুষ্ঠানে যাবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সরকারিভাবে বলা হয়, জনতার চাপে আহত হবার ভয়ে মহিলাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। নারীবাদী নেত্রীরা একটা বোট ভাড়া করে যতদূর সম্ভব দ্বীপের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করে। নেতারা স্বাধীনতার প্রতীক স্থাপন করার জন্য করতালি দিয়ে সাধুবাদ জানায় এবং একই সাথে নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য স্লোগান দেয়। তবে খারাপ আবহাওয়ার কারণে নির্ধারিত ফায়ার ওয়ার্ক ডিসপ্লে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাতিল করা হয়।
উৎসর্গ অনুষ্ঠানের পরদিন ক্লিভলান্ড গেজেট নামের একটি আফ্রিকান আমেরিকান পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘স্ট্যাচুর হাতে প্রজ্জ্বলিত মশাল আমেরিকার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকা পর্যন্ত এক নাগাড়ে জ্বলবে না এটাই বাস্তব।’
স্ট্যাচু অব লিবার্টি ন্যাশনাল মনুমেন্টে ঢুকতে কোন টাকা লাগে না তবে ফেরিতে যাবার জন্য টাকা দিতে হয়। ফেরি জার্সি সিটির লিবার্টি পার্ক এবং লোয়ার ম্যানহাটনের ব্যাটারি পার্ক থেকে ছেড়ে এলিস আইল্যান্ড পর্যন্ত যায়। ফেরিতে ওঠার আগে এয়ারপোর্টের মতই নিরাপত্তা তল্লাশি করতে হয়। স্ট্যাচুর বেজ এবং পেডেস্টালে যাবার জন্য ফেরির টিকেটের সাথে একটা কমপ্লিমেন্টারি টিকেট দেয়া হয়। যারা স্ট্যাচুর ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে ক্রাউন পর্যন্ত উঠতে চান তাদের একটা স্পেশাল টিকেট কিনতে হয় যে টিকেটের বুকিং সাধারণত এক বছর আগেই শেষ হয়ে যায়। দশ গ্রুপে প্রতিদিন ২৪০ জনকে স্ট্যাচুতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। প্রতি ঘন্টায় তিনেটে করে গ্রুপ যেতে পারে। যারা উপরে উঠতে চান তারা সাথে শুধু ক্যামেরা এবং ওষুধ নিতে পারেন। অন্যান্য জিনিস রাখার জন্য লকারের ববস্থা আছে। উপরে ওঠার আগে আরেকবার নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়।
১৯০১ সাল পর্যন্ত স্ট্যাচু রক্ষণাবেক্ষণের প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল ইউনাইটেড স্টেটস লাইট হাউস বোর্ডের হাতে। এরপর দায়িত্ব আসে ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ারের হাতে। ১৯৩৩ সাল থেকে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস।
১৯৮০ সালে দৃশ্যমান হয় যে, স্ট্যাচুর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। ফলে সংস্কারজনিত কারণে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত স্ট্যাচু দেখা বন্ধ ছিল। এ সময় মশাল ও স্ট্যাচুর অভ্যন্তরের অনেকাংশ সংস্কার করা হয়। ১৯৩৮ সালে রিনোভেশনের কাজে পুনরায় এটি বন্ধ রাখা হয়। ২০০১ সালের ১১­সেপ্টেম্বরের আক্রমণের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে এটি বন্ধ রাখা হয়। ২০০৪ সালে প্যাডেস্টাল খুলে দেয়া হয়। ২০০৯ সালে সীমিত সংখ্যক পর্যটক ক্রাউন পর্যন্ত ওঠার অনুমতি পায়। পুনরায় ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বেজ ও পেডেস্টাল বন্ধ রাখা হয়। ফলে দ্বিতীয় একটি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। তবে লিবার্টি আইল্যান্ড উন্মুক্ত থাকে। হারিকেন স্যান্ডির কারণে স্ট্যাচু দেখা পুনরায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ৪ জুলাই এটি পুনরায় খোলা হয়। তবে মশাল ঘিরে ব্যালকনিতে যাতায়াত বন্ধ রাখা হয় ১৯১৬ সাল থেকে।
পৃথিবীব্যাপী এ স্ট্যাচুর অনুকরণে অসংখ্য রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে। মূল স্ট্যাচুর চার ভাগের এক ভাগ উচ্চতা বিশিষ্ট একটি রেপ্লিকা প্যারিসের আমেরিকান কমিউনিটি তৈরি করে তাদের শহরে স্থাপন করেছে। ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আর একটি রেপ্লিকা ম্যানহাটনের পশ্চিম ৬৪ স্ট্রিট্রের লিবার্টি ওয়ার হাউসের শীর্ষে বহু বছর ধরে ছিল। বর্তমানে এটি ব্রিকলেন মিউজিয়ামে রাখা হযেছ্।ে আমেরিকান বয় স্কাউটরা ১৯৪৯-১৯৫২ পর্যন্ত ‘স্বাধীনতার বাহু শক্ত কর’ ক্যাম্পেনকালে কপারের তৈরি ১০০ ইঞ্চি উচ্চতার ২০০ রেপ্লিকা তৈরি তরে জনগণকে উপহার দেয়। স্ট্যাচু অব লিবার্টি বা তার রেপ্লিকা এখন গণতন্ত্রের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যা ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমিয়েন স্কয়ারের আন্দোলন এবং ফরাসী গণতন্ত্রের উত্তরণপথে প্রভাব রেখেছিল।
স্ট্যাচু দেখা শেষ করে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলাম। চাচি যাবেন বিয়েতে আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু নাহারের সাথে জ্যাকসন হাইটসে যাব রাতের নিউইয়র্কের বাঙালি জীবন দেখতে। রাস্তায় এসে বাস পেলাম না। অপেক্ষা করার সময় ছিল না। দ্রুত একটা ট্যাক্সি ধরল চাচি। চললাম লং আইল্যান্ডের পথে। মনে দুঃখ রয়ে গেল, কাছ থেকে দেখা হল না ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে।’