প্রশ্ন : সাহিত্য বাসরে আপনাকে স্বাগতম। কেমন আছেন?
উত্তর : ধন্যবাদ। আমাকে এই সাক্ষাতকারে বেছে নেয়ার জন্যে। বয়স হয়েছে। নানারকম অসুখ-বিসুখ আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছে। ফলে খুব একটা ভালো নেই। মনের জোরে চলি। শরীর বিট্রে করলে মনও বিট্রে করে, সেটা এখন উপলব্ধি করতে পারছি।
প্রশ্ন : আপনি কবি হলেন কেমন করে? কবি না হলে কী হতেন?
উত্তর : আমি কতটা গুণী, সেটা বলবেন আমার পাঠকেরা। নিজের অবস্থান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ নেই। তবু আমাকে ‘গুণী’ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আর আমি কবি হয়েছি কী হইনি, তার উত্তরও দেবেন পাঠক কিংবা আপনারা। তবে কবিতা লেখালেখিতে আমি কী করে এলাম, তার একটি উত্তর হয়তো আমি দিতে পারবো। আমার পরিবার একটি শিল্পমনস্ক আলোকিত পরিবার। বাবা দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। পড়াশুনা ছিল তাঁর মজ্জাগত। মা অনেক লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু নিয়মিত বই পড়তেন। আমাদের বাড়িতে ভারত থেকে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান, সাপ্তাহিক দেশ ও অন্যান্য পত্রিকা আসতো। বোনেরা গান গাইতো, ভাইয়েরাও পড়াশুনার আবহের মধ্যে বেড়ে ওঠে। আমিও এর বাইরে ছিলাম না। আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতা আমি নিয়মিত পড়তাম। সেই সূত্রেই আমি কখন হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ কবিতার অনুকরণে একটি কবিতা লিখে ফেলি। সেটাই শুরু। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে দেশের দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় আমার লেখা ছড়া, কবিতা এবং গল্প ছাপা হতে থাকে।
আমি যদি কবি না হতাম, তাহলে আমি কৃষকের সন্তান হতাম। সুন্দর করে ক্ষেতে ধান ফলাতাম। আর এক-একটি ধানের গুচ্ছ হতো আমার শ্রেষ্ঠ কবিতা।
প্রশ্ন : বর্তমানে কবিতার পাঠকসংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। অনেকে এর জন্য কবিতার দুর্বোধ্যতাকে দায়ী করেন। এ দায় কার? কবির না পাঠকের?
উত্তর : কবিতা এমন একটি শিল্প-মাধ্যম, যার ভেতরে সূক্ষ্মতম সুরের ব্যঞ্জনা থাকে। যেমন ধ্রুপদীসঙ্গীত। স্রষ্টা এবং পাঠক বা শ্রোতার সঙ্গে পারস্পরিক একটা মেলবন্ধন তৈরি না হলে তার ভেতরকার রসাস্বাদন সম্ভব নয়। এ জন্য কবিকে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি পাঠককেও এগিয়ে আসতে হবে। তবে একটা কথা সত্যি, এখন আধুনিক কবিতার নামে যা লেখা হচ্ছে, তার মধ্যে কাব্যিক ব্যঞ্জনার চেয়ে দুর্বোধ্যতার কসরত বেশি চলে বলে পাঠকও বিভ্রান্ত হয়ে কবিতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিশীল কবি এবং বোদ্ধা পাঠকের পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া এ থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই!
প্রশ্ন : কবিতা ও পদ্যের মধ্যে কি কোনও পার্থক্য আছে?
উত্তর : অবশ্যই আছে। পদ্যকে আমি বলি ‘চানাচুর কবিতা’। তাৎক্ষণিক আস্বাদের মধ্যেই তার মুক্তি। একটু পরিশীলিত করে যদি বলি, তা হলে পদ্যকে বলা যেতে পারে সংযোগমূলক কবিতা। আর কবিতা হচ্ছে বিশুদ্ধতার প্রতীক, ক্ষণকালের প্রাপ্তির মধ্যে যার মুক্তি নেই, মহাকালের গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে যার স্ফূর্তি।
প্রশ্ন : কবিতার ছন্দ নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। বিশেষত গদ্যছন্দ নিয়ে। গদ্যছন্দ আসলে কী?
উত্তর : আমি ব্যক্তিগতভাবে গদ্যছন্দ বলে কিছু আছে, এমনটা মনে করি না। মুক্তছন্দ বা ফ্রি ভার্স যাকে বলে, তার মাধ্যমে অন্ত্যমিলবিহীন পঙ্ক্তিমালা রচনা করাকেই অনেকে গদ্যছন্দ বলেন। আমার কাছে এর সবগুলোই প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত। আমি এই ছন্দকে যে কোনোভাবে ব্যবহার করতে পারি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রচলিত ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি একমত নই। আমরা এখন যেভাবে কবিতা লিখি অর্থাৎ অন্ত্যমিলহীন কবিতা, তার নানা রূপ বা অবয়ব আছে। তাকে যদি কেউ গদ্যছন্দের মধ্যে ফেলতে চান, তাহলে ফেলতেই পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়, গদ্য তো গদ্যই। গদ্যছন্দ আবার কী? আমার কাছে অন্ত্যমিলহীন অন্তর্গত ছন্দোযুক্ত কবিতাই হলো প্রকৃত কবিতা।
প্রশ্ন : পর্ব-মাত্রা গণনা মেলালেই কি কবিতা হয়ে ওঠে? কখন একটি কবিতা যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে?
উত্তর : না, পর্ব-মাত্রা গণনা মেলালেই কবিতা হয়ে ওঠে না। বিশ্বসাহিত্যের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাংলাভাষায় মাত্রা গণনা করে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলো আসলে পদ্য, কবিতা নয়। তবে যে কোনও ধরনের কবিতাই লেখা হোক না কেন, সম বা অসম মাত্রা হলেও গণনা করতে হয় এবং গণনা করেই কবিতাকে শিল্পসম্মত হয়ে উঠতে হয়। না হলে তা যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে না।
প্রশ্ন : আধুনিক কবিতা ও উত্তরাধুনিক কবিতা আসলে কী? বুঝিয়ে বলুন।
উত্তর : রোমান্টিক কবিতার বিপরীতে পৃথিবীতে যে সব কবিতা লেখা হয়, সেগুলোই আধুনিক কবিতা। বলা হয়ে থাকে, অষ্টাদশ শতকে ফরাসি কবি বোদলেয়ারের হাত ধরেই আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু। রোমান্টিকতার কলাকৈবল্যবাদী চিন্তার বিপরীতে সমকালীন জীবনযন্ত্রণা, যন্ত্রসভ্যতার বিকাশ এবং জীবনের নানা অসঙ্গতি, জীবনক্ষয়, অবাধ যৌনতা প্রভৃতি আধুনিক কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে রোমান্টিক কবিতার অন্ত্যমিলযুক্ত ধারার বাইরে মুক্তছন্দ বা ছন্দের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে কবিতার অবয়বকে মুক্তিদান আধুনিক কবিতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আধুনিক কবিতাকে নানাভাবে উপস্থাপন করার জন্য সারাবিশ্বে নানামুখী কাব্য-আন্দোলন হয়েছে, যার মাধ্যমে আধুনিক কবিতা একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ত্রিশের দশকে বাংলায় আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র কবিদের হাত ধরে।
কিন্তু কবিরা তো বিশেষ একটি ক্ষেত্রে নিজেদের আবদ্ধ রাখতে অভ্যস্ত নয়। তাই আধুনিক কবিতার বাইরে গিয়ে উত্তর আধুনিকতার ধারা তৈরির উদ্দেশ্যে উগ্র জীবনবোধের তাড়না থেকে ফরাসি দেশের চিত্রকলায় আধুনিকতার বিরুদ্ধে নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু তা সেখানে স্ফূর্তি লাভ না করে আমেরিকায় কয়েকজন কবির হাতে নতুন অবয়ব পায়। আজ থেকে একশ’ বছরেরও বেশি সময় আগে জে. স্পেংলার ও জন ম্যুলার নামক দুজন কবিসহ আরও কেউ কেউ উত্তরআধুনিতার মেনিফেস্টো তৈরি করে আধুনিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। তারা বলতে চান “আধুনিকতার দিন শেষ। অনন্ত উত্তরআধুনিকতার মুখোমুখি আমরা।” তাদের এই প্রস্তাবনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সাড়া ফেললেও প্রকৃতপক্ষে উত্তরআধুনিক কবিতা লেখায় কেউ তেমন বড়ো ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি বলে তা ক্রমশ অবসিত হয়ে পড়ে। আধুনিকতা যদি সময়ের নির্ধারক হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে সব সময়ের সব কবিতাই আধুনিক। কিন্তু সময়প্রবাহের ফলে যে কোনো প্রপঞ্চের পরিবর্তন ঘটে বলে এখন আবার নব্যআধুনিকতার প্রবক্তাদের প্রাধান্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষায়ও উত্তরআধুনিকতার প্রবক্তারা সত্তরের দশকে কলকাতায় ‘হাংরি জেনারেশন’ এবং ‘শ্রুতি আন্দোলন’ নামে দুটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু নানা কারণে তা স্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশেও ‘স্যাড জেনারেশন’ নাম দিয়ে উত্তরআধুনিকতার আন্দোলন গড়ে তোলা চেষ্টা হয় ষাটের দশকে। কিন্তু তা স্থায়িত্ব লাভ করেনি। তাই ধীরে ধীরে এর প্রবক্তারা আধুনিক প্রপঞ্চকেই তাদের কবিতার আধার হিসেবে গ্রহণ করে মূলধারায় ফিরে আসেন। নব্বইয়ের দশকে এসে বাংলাদেশেও একদল তরুণ উত্তরআধুনিকতার একটি ধারা নির্মাণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। ফলে আধুনিক ধারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তরআধুনিক ধারাটি টিকে থাকতে পারেনি। এখনও পৃথিবীতে আধুনিক কবিতাই প্রপঞ্চ হিসেবে গ্রহণযোগ্যভাবে টিকে আছে। আসলে এ দুটো বিষয় নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার সুযোগ আছে। এখানে এরচেয়ে বিস্তৃতভাবে বলা সম্ভব নয়!
প্রশ্ন : বাংলাদেশে লিটলম্যাগাজিন আন্দোলন কখন শুরু হয়? লিটলম্যাগাজিনকে ছোটকাগজ বলা হয় কেন? কালি ও কলম, দেশ ছোট কাগজ না বড় কাগজ?
উত্তর : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু তা তখন অতো দানা বাঁধতে পারেনি। ষাটের দশকের কবিরাই প্রধানত এই আন্দোলন শুরু করেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার মাধ্যমে, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, প্রশান্ত ঘোষাল, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, মোস্তফা আনোয়ার, সিকদার আমিনুল হক প্রমুখ ‘স্যাড জেনারেশন‘ আন্দোলনের মুখপত্র ‘স্বাক্ষর’ প্রকাশ করে এই ধারার আন্দোলন শুরু করেন। অন্যদিকে ‘না’ পত্রিকা দিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রবিউল হুসাইন প্রমুখ শুরু করেন আরেকটি আন্দোলন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ছোটকাগজ বা লিটলম্যাগ আন্দোলনের প্রবল প্রবাহ তীব্রতর হয়ে ওঠে, যদিও সেই প্রবাহ শেষপর্যন্ত স্তিমিত হয়ে গিয়ে এখন আর ছোটকাগজ বলতে যা বোঝায় তা নিয়মিতভাবে তেমন প্রকাশ পায় না।
লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ মানে আকারে ছোট, তা নয়। প্রথাগতভাবে কোনো বিগ হাউজ থেকে যে পত্রিকা প্রকাশ পায়, তার সঙ্গে এর ব্যবধান বোঝাতেই এসব পত্রিকার নাম দেয়া হয়েছে লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ। সে-হিসেবে কালি ও কলম, ও দেশ বিগ কর্পোরেট হাউসের পত্রিকা। তাই তার নাম দেয়া হয়েছে ‘বড়োকাগজ’।
প্রশ্ন : পাশ্চাত্যের কবিতায় কি এখনো আমাদের মতো ছন্দ বা রাইম মান্য করা হয়? রাইমটা কী ধরনের?
উত্তর : গতানুগতিক ধারার ছন্দ বা রাইম মান্য করা না হলেও প্রত্যেকেই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নিরীক্ষার মধ্যে নিজেদের নিয়েজিত রাখেন। কবির কাজই নতুন কিছু সৃষ্টি করা। আফ্রিকার দেশগুলোতে আগেও যেমন নানামুখী নিরীক্ষা ছিল, এখনও আছে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাই। এখন যে রাইম লেখা হয়, তা শুধু গতানুগতিক অন্ত্যমিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কবিতার অবয়বে ছন্দের দোলাটা থাকে কিন্তু পঙ্িক্তর শেষে গিয়ে অন্ত্যমিল দিয়ে শেষ হবে, এমনটা নয়। আমরা মনে করি, ছড়ার ছন্দের মধ্যেই বুঝি কবিতার মুক্তি। মোটেই তা নয়। আধুনিক কবিতাতেও কী পাশ্চাত্যে, কী বাংলায়Ñছন্দযুক্ত অনেক কবিতা লেখা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এই ধারাটি অব্যাহত থাকবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
প্রশ্ন : মহৎ সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্যে মহৎ সাহিত্য কোন্গুলো?
উত্তর : যে সাহিত্য ক্ষণকালের প্রয়োজন মিটিয়ে বা না মিটিয়েও চিরকালের হয়ে ওঠে, সেটাকেই আমি মহৎ সাহিত্য বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বাংলার বহু লেখকের লেখাই মহৎ সাহিত্যের অভিধা পাওয়ার উপযুক্ত। আর পৃথিবীর সাহিত্যে তার দৃষ্টান্ত তো ভূরি ভূরি।
প্রশ্ন : এবার আপনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। আপনার জন্ম-কৈশোর-শিক্ষাজীবন ও জীবন-জীবিকা নিয়ে কিছু বলুন।
উত্তর : আমার পূর্ব-পুরুষের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার তেওতা গ্রামে, যে গ্রামে প্রমীলা নজরুলেরও জন্ম। পিতার চাকরির সূত্রে আমার শৈশব ও কৈশোরজীবন কাটে মাদারীপুর শহরে। সেখানেই প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়-জীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করি। পেশা হিসেবে বেছে নিই সংবাদিকতাকে। আগামী ডিসেম্বরে আমার সাংবাদিকতা জীবনের আটান্ন বছর পূর্ণ হবে। আমি নীতির প্রশ্নে আপোষ করতে পারিনি বলে অনেক চাকরি করলেও ৫৮ বছরে ২৬টি চাকরি ছেড়েছি। জীবনে অনেক ক্রান্তিকাল কাটিয়েছি। ঢাকা শহরে দিনের পর দিন পরিবার নিয়ে উপোস করেছি। কিন্তু কোথাও মাথা নত করিনি। আমি সবসময় মনে করেছি, বিবেক বিক্রি করে, নিজের সততা থেকে সরে গিয়ে কিংবা আমার আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। আমার এই অবস্থান থেকে আমি একচুলও নড়িনি।!
প্রশ্ন : আপনি কবে থেকে লিখছেন? এখন কী লিখছেন?
উত্তর : কিশোর বয়সেই আমার লেখলেখির হাতেখড়ি। ১৯৬৪ সালে আমি যখন এসএসসির ছাত্র, তখন প্রথম একটি অনুকৃত কবিতা লিখি। এরপর ১৯৬৫ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু হয়, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। আমি শারীরিক কারণে এখন তেমনকিছু লিখছি না। কারণ ২০২৩-এ আমি অনেকগুলো লেখা শেষ করেছি। সংস্কৃত কবি জয়দেব গোস্বামীর ‘গীতগোবিন্দ’-এর ১৪ সর্গের সহজ কাব্যিক অনুবাদ করেছি। শুধু নারীবাচক শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ ‘নারী অভিধান’ সংকলন ও সম্পাদনা করেছি। সনাতনধর্মীদের ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীগীতা’র সবচেয়ে সহজ বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেছি। তাছাড়া আমার ছন্দোবদ্ধ প্রেমের কবিতার বই ‘প্রজাপতি’ ২০২৪-এর বইমেলায় প্রকাশ পাচ্ছে। এখন ইচ্ছে আছে, কিছু ভিন্নধর্মী কবিতা লেখার। জানি না, শরীর পারমিট করবে কিনা!
প্রশ্ন : আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ কয়টি? উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কোনগুলো?
উত্তর : গদ্যপদ্য মিলিয়ে আমার মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা ৪১টি। এর মধ্যে কোন্গুলো উল্লেখযোগ্য, তা বলবেন আমার পাঠক এবং আপনারা। তবে ২০১৫ সালে রচিত আমার কাব্যগ্রন্থ ‘ম-বর্ণের শোভিত মকুট’, যেটি ২০১৬ সালে আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছে, সেটাতে আমি ভিন্ন ধরনের কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি, যা বাংলা ভাষায় আর লিখিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনার উল্লেখযোগ্য সম্মাননা বা পুরস্কার কী?
উত্তর : আমি এ-পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার, রূপসী বাংলা পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ), বঙ্গবন্ধু স্মারক পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ), বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক। সম্মাননা পেয়েছি অজস্র।
প্রশ্ন : মানুষ বারবার প্রেমে পড়ে। আপনি কবার প্রেমে পড়েছেন?
উত্তর : আমি কেন, সকল কবিই প্রেমে পড়ে, বারবার পড়ে। কিন্তু প্রেমে পড়া মানে এই নয় যে, সেখানে নারীর শরীর মুখ্য। যদিও আমি প্লেটোনিক প্রেমে বিশ্বাস করি না। মন ও শরীরের যুগলবন্দি কবিকে সৃষ্টিশীলতায় অনুপ্রাণিত করে। তবে প্রেমে ভোগ যদি মুখ্য হয়, তাহলে প্রেমের মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। বাগানের একটি গোলাপ আমার ভালো লাগবে, তার সৌন্দর্য আমি উপভোগ করবো, সৌগন্ধ্য উপভোগ করবো, কিন্তু তাকে ভোগের নামে ছিঁড়ে ফেলবো না।
সে-হিসেবে এমন প্রেম আমার অনুভূতিকে আন্দোলিত করেছে। কিন্তু তাতে আমি ডুবে যাইনি। আসলে আমার মূল প্রেম কিন্তু আমার জীবনের প্রথম প্রেমিকা কবি অঞ্জনা সাহা, যিনি এখন আমার স্ত্রী। তার বাইরে আমি অন্যকিছু তেমন করে কল্পনা করলেও গ্রহণ করতে পারি না।
প্রশ্ন : কবি-লেখকের সোস্যাল কমিটমেন্ট থাকা অপরিহার্য কিনা? আপনার কোনো সোস্যাল কমিটমেন্ট আছে কি?
উত্তর : অবশ্যই। সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সোস্যাল কমিন্টমেন্ট ছাড়া একজন মানুষ কবি হতে পারেন, এমনটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। তবে সোস্যাল কমিন্টমেন্ট মানে এই নয় যে, স্থূল দুরভিসন্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেকে সুবিধাবাদী করে তোলা। মানুষ ও সমাজের কলাণচিন্তা কবিকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে। আমি
মানবকলাণের চিন্তাকেই আমার সোস্যাল কমিন্টমেন্ট বলে মনে করি।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যত স্বপ্ন কী? কোনো পরিকল্পনা বা কোনো অন্তিম ইচ্ছা?
উত্তর : ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু করে যাওয়া আমার স্বপ্ন। কিন্তু আর্থিকভাবে একেবারেই সচ্ছল নই বলে বস্তুগত কোনোকিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই কবিতায় সোসাল কমিন্টমেন্টের জায়গায় আমি আরও বেশি নিমগ্ন হতে চাই। জীবনের প্রায় অন্তিম মুহূর্তে এসে মৃত্যুচিন্তা আমাকে গ্রাস করেছে। আমার ছোট একটি নাতনি আছে। ও একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। ও যখন আরও বড়ো হবে, তখন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না। আমার অন্তিম ইচ্ছে ছিল, ওর সুন্দর একটি সংসার দেখে যাওয়ার। কিন্তু সেই অন্তিম ইচ্ছে পূরণের আগেই আমি অনন্তলোকে চলে যাবো ভেবে দিশেহারা হয়ে যাই।
একই সঙ্গে আর একটি ইচ্ছে আমাকে অস্থির করে, তা হলো, একটি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী দেখে যাওয়া, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নিয়ে কোনো হানাহানি হবে না।
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় কবি কে? কবিদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ এবং পঞ্চাশের কবি বিনয় মজুমদার। কবিদের জন্য আমি সবসময় যেটা বলে থাকি, এখানেও তারই পুনরাবৃত্তি করছি। পাঠ, চর্চা, ধ্যান, সাধনা, তপস্যা ও প্রেম না থাকলে আর যাই লেখা যাক, কবিতা লেখা সম্ভব নয় !
প্রশ্ন : যদি আপনার নিজেকে নিজে মূল্যায়ন করতে বলা হয়, তবে আপনি নিজেকে কত নম্বর দেবেন?
উত্তর : নিজেকে নিজে নম্বর দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই।
প্রশ্ন : পাঠকের জন্য আপনার একটি প্রিয় কবিতা শুনতে চাই। যদি ক’লাইন বলেন…..
ম-বর্ণ-৫
মেঘ এসে বলে গেলো, ঝরা বকুলের কাছে যেও না প্রণয়।
বিষাদ-বেদনা নিয়ে মাধবীর বনে যাও।
নিমগ্ন ঠোঁটের কোণে ঝালাও কল্পনা;
বেগবান বাতাসের চোখে-মুখে ঝরে যাও মধুর সুরভি।
স্বরলিপি তৈরি হোক, প্রাচীনকালের কোনো মুখর সুরের কাছে
ভাষা পাক এক একটি প-বর্গীয় ধ্বনি।
শীতের কুয়াশা-ভোরে চরাচর ডুবে গেলে
সীতানাথ বসাকের নিখুঁত হাতের ছন্দে লেখা হোক আদর্শলিপি।
মাধবীর পাতাগুলো ডানা মেলে উড়ে যাক অসীমের পানে।
ইনানী বীচের সব গাংচিল ছুঁয়ে দিলে বর্গীয় ধ্বনির শরীর
উদাসী হাওয়ার সুর উড়ে যাক ম-বর্ণের স্নিগ্ধ অনুরাগে!
তারপর হাজার বছর ধরে কল্পনায় নেচে যাক
আলোকিত জলসায় মাধবীর সোনালি ঘুঙুর।
প্রশ্ন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
উত্তর : আপনাকেও।
সূত্র : ছোটকাগজ ‘সাহিত্যবাসর’