পর কখনো আপন হয়না। আজ এক বছর হয়ে গেল ছেলেটা একবারও আমায় দেখতে এলনা। অথচ তার জন্য আমার বিয়েটাই করা হলনা। অথচ আজ আমি কুমারী মা। রোহানকে মানুষ করতে আমার জীবনের শুরুটা কত না বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে।আজ সেই কথাই মনে পড়ছে।
আমার বিয়ে নিয়ে খুবই চিন্তিত বাবা। বাবা চাচ্ছেন বিয়েটা শীঘ্রই সেরে ফেলি। আশেপাশের মানুষের কানাঘুষা তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না।
তাদের ভাষ্যমতে আমি আইবুড়ো হয়ে গেছি। তারা এটাও বলছে – আমাকে ঘরের খুঁটি করা ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে না।
অথচ, সবেমাত্র মাস্টার্স শেষ করে জবে ঢুকলাম। আমার ইচ্ছে একটু নিজেকে গুছিয়ে তারপর বিয়েটা করবো। বাবাও এতোদিন এটাই চাইতেন।কিন্তু লোকজনের কথা তিনি এখন আর নিতে পারছেন না মোটেই।
আমাকে হঠাৎ দুপুরবেলা ফোন করলেন,
“তো তুমি কি বিয়েশাদী করবে না?না করলে না করো। কিন্তু মনে রেখো -সম্পত্তি এক কানাকড়ি ও পাবে না। আর হ্যাঁ,আমি মরলে আমাকে দেখতেও আসবে না। কথাটা মনে থাকে যেনো।”
বলেই দুম করে ফোন কেটে দিলেন। বাসায় আর কেউ থাকে না। বাবা একাই থাকে। মা মারা গেলো বছর খানেক হলো। এই একটা বছর বাবা অনেক কষ্ট করেছে একা একা। কোনোদিন কখনো কিছু বলেনি। হঠাৎ আজ কী হলো কে জানে!
আমিও আর ফোন দেবার সাহস পাচ্ছি না। ফোন রেখে দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম। মাম মা—-আমি। এটুকু বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা আমার। ওর নাম রোহান। তিনবছরের ছোট্ট ছেলেটা আমাকে ছাড়া আর কাউকে চেনে না। ওকে নিয়ে জব করাটা টাফ। বাবা ওর কথা জানে না। বাবা কেনো কাউকেই বলিনি।
বললেই হরেক রকম প্রশ্ন – কোত্থেকে এই ছেলে আসলো?
তোমার তো বিয়ে হয়নি!
ছেলের বাবা কে?
তার নাম কী?
বিয়ে করেছো?
কবে করলে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি একবছর বাসায় যাইনা বাবার কাছে। রোহানকে নিয়ে একা আছি বাসায়। বাবা এজন্য ও আমার উপর রাগ।
“কী এমন হলো তুই বাসায় আসিস না? আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? আচ্ছা, আমি পাপী?থাক,আসতে হবে না।” এই কথাগুলো কমন কথা।
আসলে ব্যাপারটা তা না। মা মারা যাবার পর আমি কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। কাজে মন বসতো না। অফিসে স্থির থাকতে পারতাম না। তো,তখন অফিসের কলিগরা মিলে একটা ট্যুরের আয়োজন করে। আমরা ঘুরতে যাবো আশেপাশেই কোথাও। কারন,অফিস থেকে ছুটি দিবে না। একটা শুক্রবার দেখে সিয়াম,তৌফিক,রিয়া আর আমি রিক্সা ভ্রমণে বের হলাম। আমি থাকতাম সোনাডাঙ্গা। সোনাডাঙ্গা থেকে রিক্সা নিয়ে যতদূর পারি যাবো এমন পরিকল্পনা আমাদের। সোনাডাঙ্গা বাসস্টপ থেকে কিছুটা দূরে যেতেই পিছন থেকে একটা ট্রাক এর ধাক্কা লাগলো রিক্সায়। আমি আর রিয়া ছিটকে পড়লাম রাস্তার পাশে তারপর ঢালু থেকে গড়িয়ে একদম নিচে। রাস্তাটা বেশ উঁচু আর পাড়টা ঢালু ছিলো। হাতপায়ের বেশ কিছু জায়গা কেটে গেলেও বড়রকমের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো না।
কিন্তু ঘটলো যেটা রিক্সাওয়ালার পায়ের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেলো। সিয়াম আর তৌফিক ততক্ষণে রিক্সাওয়ালার কাছে। বড়রকমের একটা জটলা বেঁধেছে। আমরা ঠিক আছি দেখে ওরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও রিক্সাওয়ালার এহেনও অবস্থা দেখে বিচলিত। ভীড় সরিয়ে সামনে আগালাম।
উনি তখন আমার হাতটা খপ করে ধরেই একটানে ওনার পাশে বসালেন। কান্নারত চোখে নরম স্বরে বলতে লাগলেন – “আপা,আমি হয়তো বাঁচুম না। আমার মা মরা একটা বাচ্চা আছে আপা। ওরে আপনি একটু দেইখেন কথা দেন। ওরে না হয় একটা এতিমখানায় দিয়েন। তবুও আপনিই যা করার কইরেন।”
আমার হাত-পা অসার হয়ে আসছে। উনি পকেট থেকে একটা ঠিকানা হাতে ধরিয়ে দিলেন। প্রচুর রক্তক্ষরণে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারান তিনি।
আমরা সবাই হাতেহাতে ধরে ওনাকে গাড়িতে তুললাম। সিয়াম আর তৌফিক ওনাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো। একটা ভ্যানগাড়িতে করে আমি আর রিয়া ওনার দেয়া ঠিকানায় গেলাম রাস্তায় পড়ে থাকা একটু আগের এক্সিডেন্ট হওয়া সেই রিক্সাটা নিয়ে। কাছেই একটা গলির ভিতর থাকতেন তিনি। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম রিক্সাওয়ালার নাম ছিলো জাকির হোসেন। একটা গলির মাথায় ছোটোছোটো অনেক গুলো ঘর। বাড়িওয়ালা আসলো এগিয়ে। তিনমাসের ভাড়া বাকিবাবদ সে ঘরের খুঁটিনাটি আসবাবপত্র আর ভাঙা রিক্সাটা রেখে দিলো । তার মা মরা ছেলেটা থাকতো আরেক ভাড়াটিয়া জয়নব এর কাছে। তারও একটি ছেলে আছে। সেই ছেলের সাথে জাকিরের ছোট্ট ছেলেটা রেখে যায় সে।
আমি গিয়ে কোলে নিলাম ছেলেটাকে । সেই থেকে হয়ে গেলো রোহান আমার সন্তান।
পড়াটা শেষ করে,ডায়রীটা চোখ বুলিয়ে ভাল করে দেখলাম। চকচকে নীল মলাটে বাধানো ডায়রীটা যেন কারও বুকের সমস্ত ব্যাথা এখানে জমে আছে। আবার ডায়রীটা খুলে লেখকের নাম ঠিকানা খুজার চেষ্টা করলাম কোথাও পেলামনা। সি এন জি চালককে জিজ্ঞেস করলাম এই ডায়রীটা কার। চালক পিছন ফিরে ডায়রীটা দেখে বলল আপনি উঠার আগে একজন বয়স্ক মহিলা নেমে গেছেন হয়তো তার। আমি আমার একটি ভিজিটিং কার্ড চালককে দিয়ে বললাম যদি ভদ্র মহিলা এই ডায়রী কখনো খুজতে আসে অথবা তার সাথে দেখা হয় তবে আমার ঠিকানাটা দিও।নিশ্চয় এটা তার জীবনের সব চেয়ে দামী সম্পদ।