সৌন্দর্য ও পরিপাট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুতেই শিল্পের সংযুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকাশনাকে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন করতে এর সঙ্গে শিল্পীদের যুক্ততা গোড়া থেকে বিদ্যমান। মুদ্রণশিল্পের শুরু থেকে শিল্পীর হাত ও মেধার প্রয়োগ ঘটেছে এখানে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশনা শিল্পের মান বেড়েছে। তবে এর সঙ্গে এখনো শিল্পীর সৃজনশীলতার সম্পর্ক নাড়ির টানের মতো অটুট আছে।
প্রকাশনার সেই শুরুর দিকেই মুদ্রাকররা ভাবলেন লেখাকে পাঠকের কাছে মেলে ধরতে হলে এর সুবিন্যাস প্রয়োজন, পাঠকের দম নেওয়ার জায়গাটাও দরকার। তাঁরা মনে করলেন- লেখার সঙ্গে মাঝে মধ্যে ছবির যোগ হলে সেটি আকর্ষণ করবে পাঠকদের। এভাবেই শিল্পীর আঁকা ছবির ছাপ নিয়ে কাঠের ব্লক বানানোর রেওয়াজ শুরু হলো। ক্রমান্বয়ে লেখার সঙ্গে সেই ছবির ব্লক ছাপাখানায় মুদ্রণ করে প্রচারপত্র, বইপত্র-পত্রিকা প্রভৃতি পৌঁছে গেল মানুষের হাতে হাতে। আমাদের এ অঞ্চলের শিল্পীরা প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়েছেন জীবিকা ও প্রাণের টানে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষে মুদ্রণযন্ত্র আসায় প্রকাশনায় গতি আসে। প্রকাশনার কেন্দ্র হয় কলকাতা। শতবর্ষ আগে বাংলাদেশের শিল্পী কাজী আবুল কাসেম কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় দোপেঁয়াজা নামে কার্টুন আঁকতেন, বইয়ের প্রচ্ছদ নকশা করতেন, ইলাস্ট্রেশন আঁকতেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়নকালীন নিজের পড়ার খরচ চালাতে বই-পত্র-পত্রিকার জন্য ছবি আঁকতেন। তিনি সওগাত ও মোহাম্মদী পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশনের কাজেও যুক্ত হন। ১৯৩৮ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীনকৃত রুশ সাহিত্যিক তুর্গেনেভের ভার্জিন সয়েলের অনুবাদে পোড়ো জমি বের হয়। জয়নুল এর প্রচ্ছদ আঁকেন। কবি জসীম উদ্দীন রচিত সোজন বাদিয়ার ঘাট ও নকশী কাঁথার মাঠ গ্রন্থ দুটির প্রচ্ছদশিল্পী জয়নুল আবেদিন। এ ছাড়াও আরো কিছু গ্রন্থের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর প্রণীত ও জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রথম সংবিধান হাতে লেখা ও অঙ্গসজ্জার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার মনোনীত কমিটির প্রধান হিসেবে তিনি এই মূল্যবান প্রকাশনার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেন।
কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৯) সারাজীবন অসংখ্য গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, অঙ্গসজ্জা করেছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার জন্য ভিমরুল নামে তিনি কার্টুন এঁকেছেন। ভারতভাগের পর আমাদের চারুশিল্পীরা এ দেশে এসে প্রকাশনাশিল্পের হাল ধরেছেন। এ ক্ষেত্রে কামরুল হাসান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খানের অবয়ব নিয়ে কামরুল হাসানের আঁকা পোস্টার- ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করুন’ এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এটি যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণ প্রেরণা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান শিল্পী ছিলেন। তিনি এবং তাঁর অধীনে বেশ কয়েকজন চিত্রশিল্পী মাতৃভূমির মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার ও বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালির স্বাধিকারের ন্যায্য দাবি তুলে ধরতে প্রচারণামূলক পোস্টার এঁকেছেন, প্রকাশ করেছেন। এই শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন-নিতুন কুণ্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, প্রাণেশ কুমার মণ্ডল, নাসির বিশ্বাস, বীরেন সোম প্রমুখ।
এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যায় কথাশিল্পী শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখা- জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসের ছবি আঁকেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। নানা সময়ে পত্র-পত্রিকার অঙ্গসজ্জা ও ইলাস্ট্রেশন করেছেন এবং কিছু বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকেছেন তিনি।
পাকিস্তান আমলে গত শতকের পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের তেতাল্লিশ বছর পর্যন্ত এই দীর্ঘ ষাট বছর আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে শিশুকাল থেকে যৌবনের সৌন্দর্যে উন্নীত করতে যাঁর অবদান মহীরুহের মতো, তিনি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২-২০১৪)। তিনি দেশের একজন বরেণ্য চিত্রশিল্পী হয়েও গ্রাফিক ডিজাইনে দুর্দান্ত পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে তাঁর অবদান আর সবার চেয়ে বেশি। বই-পত্র-পত্রিকা সাজানোসহ জীবনের নানাক্ষেত্রে নকশা প্রণয়ন করে রুচিশীল মানুষ গড়ায় তাঁর ভূমিকা ছিল পথিকৃতের। কাইয়ুমের নকশা ও টাইপোগ্রাফির স্বকীয়তা আমাদের প্রকাশনাকে করেছে মর্যাদাপূর্ণ। তিনি ফর্ম নিয়েছেন- বাংলার লোককলা থেকে, লোকশিল্পীর অংকনকে রূপরসে ঋদ্ধ করে নিজের মতো করে সাজিয়ে মেলে ধরেছেন লেখক-পাঠক দর্শকদের সামনে।
পেশাগত জীবনে প্রথমে অংকনশিল্পী হিসেবে তিনি যুক্ত হন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে। কবি আবদুল গণি হাজারীর সান্নিধ্যে থেকে ওই পত্রিকার নানা পাতায় ছবি এঁকে হাত পাকিয়েছেন। সে সময় শাড়ির নকশায় কবি জসীম উদ্দীনের কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন। ষাটদশকের প্রথমার্ধ্বে শিল্পী কামরুল হাসান তাঁকে নকশাকেন্দ্রে নকশাবিদ হিসেবে নিয়ে আসেন। এরপর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আহ্বানে তিনি ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। চার দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করেছেন চারুকলা মহাবিদ্যালয় হতে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট হয়ে বর্তমান চারুকলা অনুষদে।
বাংলাদেশে প্রকাশনাশিল্পকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করায় কাইয়ুম চৌধুরীর অবদান অসাধারণ। এর স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রবর্তিত শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ শিল্পীর পুরস্কার সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন এই গুণীশিল্পী। এ ছাড়াও তিনি মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত হয়েছেন। দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, মাসিক কালি ও কলমে তিনি বিশেষ সংখ্যাসহ সাধারণ সংখ্যাতেও ছবি এঁকেছেন, অঙ্গসজ্জা করেছেন। শেষোক্ত দুটি পত্রিকার মাস্টহেড তাঁর আঁকা। দীর্ঘ ষাট বছরের নিরন্তর চিত্রসাধনায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দেশের শীর্ষশিল্পীদের একজন। আবহমান বাংলা প্রকৃতির অপূব সৌন্দর্র্য ও এই ভূ-খণ্ডের বাসিন্দাদের তিনি চিত্রপটে তুলে এনেছেন নিজস্ব অংকনশৈলীতে। লোকশিল্পের রঙ ও রেখাকে সমকালীন আধুনিকতায় বিন্যস্ত করে নিজের একটা চিত্রভাষা তিনি নির্মাণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে বাংলা টাইপোগ্রাফির বৈচিত্র্য ও নান্দনিকতায় তাঁর অবদান অসামান্য। চিত্রকলা থেকে বই ও পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার সবক্ষেত্রে তাঁর সেই স্বকীয় অংকনরীতির প্রকাশ দেখে দেখে শৈশব থেকে আমরা পরিণত বয়সে এসেছি। আজকের শিশু থেকে বৃদ্ধরাও যারা পাঠক তারা তাঁর গ্রাফিক্সের সৃজনশীলতার ভেতরে কোনো না কোনোভাবে মুগ্ধতার অবগাহনে আবদ্ধ।
পত্র-পত্রিকায় তাঁর কাজের সূত্রপাত অবজারভার দিয়ে শুরু, তারপর একে একে দৈনিক সংবাদ, জনকণ্ঠ ও সর্বশেষ দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম আলোর মাস্টহেড তাঁর হাতে করা। গত ষোল বছর প্রথম আলোর সাময়িকীসহ নানা পাতার পর পাতা তাঁর অসংখ্য অংকন আর নকশায় নন্দিত হয়েছে।
তেমনি কালি ও কলমের এগারো বছরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বহু গল্প-উপন্যাস-কবিতার অক্ষরবিন্যাসসহ সচিত্রকরণ করেছেন। তাঁর সচিত্রকরণের দুটি বৈশিষ্ট্য প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত গল্প-উপন্যাস-রম্যলেখা-ভ্রমণ-প্রবন্ধ যাই তিনি সচিত্রকরণ করতেন, অংকনে জোর দিতেন বিষয়বস্তুর দিকে। পাঠকের পাঠের প্রাকপ্রস্তুতির কাজটি সারতেন শিল্পী, যাতে পাঠক সহজেই বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর- এ কাজে তিনি প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন তবে বিমূর্তায়নের দিকে যাননি। গ্রাফিক চিত্রকর হিসেবে এখানেই অনন্য কাইয়ুম চৌধুরী।
এ দেশের অনেক গুণী চিত্রশিল্পীরা প্রকাশনাশিল্পে কমবেশি অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন- আমিনুল ইসলাম, ইমদাদ হোসেন, মূর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কাজী আবদুল বাসেত, আবদুল মুকতাদির, সমরজিৎ রায় চৌধুরী প্রমুখ। নানা পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় তাঁরা ছবি এঁকেছেন, প্রচ্ছদ করেছেন।
সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের প্রাক্তন পরিচালক শিল্পী কালাম মাহমুদ বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে বিশেষ অবদান রেখেছেন। সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী এই শিল্পী এই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। সচিত্র বাংলাদেশ, নবারুণ ইত্যাদি পত্রিকার রুচিশীল প্রকাশনায় তাঁর মূল্যবান ভূমিকা স্মর্তব্য। প্রচুর প্রচ্ছদও এঁকেছেন তিনি।
এ প্রতিষ্ঠানের আরেক পরিচালক শিল্পী এ কে এম রউফ বাংলাদেশের হাতে লেখা সংবিধানের অন্যতম এক রূপকার। তাঁর হাতের লেখা দিয়েই মুদ্রিত হয়েছে হাতেলেখা সংবিধান। তাঁর হাতেও প্রচুর গ্রন্থের প্রচ্ছদ হয়েছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের প্রথম কিউরেটর ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের শিশুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী হাশেম খান (জন্ম-১৯৪১)। তাঁর জনপ্রিয়তার উৎস এ দেশে শিশুদের জন্য যতো বই গত ষাটবছরে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মানসম্মত প্রকাশনার অধিকাংশের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা করেছেন তিনি। শিশুতোষ গ্রন্থের বই নকশায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই আঁকিয়ে হিসেবে হাশেম খান অদ্বিতীয়। আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি বইয়ের পাতায় তাঁর আঁকা ছবি দেখতে দেখতে। তাঁর লেখা চারুকলা পাঠ নামে ছবি আঁকার কলা কৌশল নিয়ে হবু আঁকিয়েদের জন্য কার্যকর একটি বই প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৪ সালে টাঙ্গাইলে কচি-কাঁচার মেলার জেলা সম্মেলনে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি সুফিয়া কামাল ও রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ও শিল্পী হাশেম খান আমাদের শৈশবটাকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন।
রফিকুন নবী (জন্ম-১৯৪৩) আমাদের প্রকাশনা শিল্পের অসামান্য এক গুণী শিল্পী। ছোটদের আঁকা ও লেখায় যেমন তিনি সুরসিক, তেমনি বড়দের জন্য আঁকা ও লেখায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। গত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধ্বে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা উপন্যাস হাজার চুরাশির মা এর শক্তিশালী ইলাস্ট্রেশন এখনো চোখে মুগ্ধতা জাগায়। বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম কার্টুন চরিত্র টোকাই তাঁর এক অসাধারণ সৃষ্টি।
গত শতকের সত্তর-আশির দশকে শিল্পী আবদুর রোউফ সরকার অসংখ্য গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। বাংলাবাজারের গ্রন্থপ্রকাশকদের কাছে তাঁর বিশেষ কদর ছিল সেসময়।
শিল্পী আবুল র্বাক আলভী (জন্ম- ১৯৪৯) অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ ও বইয়ের ভেতরের ছবি এঁকেছেন। বিশেষ করে শিশুদের বইয়ের কাজ বেশি করেছেন তিনি। শিল্পী বীরেন সোম (জন্ম- ১৯৪৮) অগণিত বই ও অন্যান্য প্রকাশনার প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদ সাময়িকীর অঙ্গসজ্জা করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে প্রয়াত শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও সাপ্তাহিক ২০০০ এর সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। বিচিত্রার সম্পাদক হিসেবে তিনি রনবীর অংকনদক্ষতা ব্যবহার করেছেন এবং পত্রিকা প্রকাশনার মান নির্মাণ করেছেন। পত্রিকার প্রচ্ছদকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য তাঁকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখেছি। পত্রিকার ভেতরের পাতাকে নন্দিত করার ক্ষেত্রেও তিনি মনোযোগী ছিলেন।
দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রার শিল্পী সৈয়দ লুৎফুল হক (জন্ম-১৯৪৭-২০২০) বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ কাণ্ডারি। অসংখ্য বইয়ের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ ও পত্র-পত্রিকার অঙ্গসজ্জার কাজ করেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন এই হাউসে কাজ করেছেন শিল্পী অলোকেশ ঘোষ (জন্ম-১৯৪৯)। গত শতকের আশির দশকে কিশোর বাংলা নামে একটি স্বল্পায়ু পাক্ষিক পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন করতেন শিল্পী ও অভিনেতা আফজাল হেসেন। তিনি বেশ কিছু বইয়ের নন্দিত প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জাও করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর নিজের লেখা- পারলে না রুমকি উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যায়, এর প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা তিনি নিজেই করেছেন। সত্তর ও আশির দশকে অসংখ্য নন্দিত প্রচ্ছদ এঁকেছেন অকালপ্রয়াত শিল্পী কাজী হাসান হাবিব (১৯৫০-১৯৮৯)। সে সময় গ্রন্থ নকশায়, পত্র-পত্রিকার অঙ্গসজ্জায় তিনি নতুনত্ব আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবিতার বিষয়ও অনুভূতি নিয়ে ছবি এঁকে তিনি চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে প্রদর্শনী করেছেন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটে।
শিল্পী মামুন কায়সার, আনওয়ার ফারুক, সমর মজুমদার সমসাময়িক শিল্পী। প্রচুর প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাঁরা । বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অসংখ্য গ্রন্থের নকশা ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন মামুন কায়সার (জন্ম- ১৯৫৫)। এমনকি বইপত্রের ভেতরকার বিন্যাস করার কাজে তাঁর নিপুণ হাতের স্পর্শ আছে অনেক গ্রন্থে। নব্বইয়ের দশকে প্রকাশনা শিল্পে যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আসে, তার শোভনীয় নন্দিত প্রচ্ছদ এঁকে নিজের জায়গাটিকে পোক্ত করে নেন শিল্পী সমর মজুমদার (জন্ম- ১৯৫৭)। জনপ্রিয় লেখক হূমায়ুন আহমেদের অনেকগুলো গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। শিল্পী আনওয়ার ফারুক বাংলাদেশের সমকালীন প্রকাশনা শিল্পের একজন পেশাদার প্রচ্ছদশিল্পী। বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী শিল্পী লেখক সৈয়দ ইকবাল বহুসংখ্যক বই আর পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদও ছবি এঁকেছেন। শিশুদের জন্য লেখা বইয়ের উপযোগী ছবি আঁকায় তিনি সিদ্ধহস্ত শিল্পী।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানা আবুল হাসনাত সম্পাদিত শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলমের একজন নিয়মিত শিল্পী। এ কাগজে আরো আঁকেন শিল্পী শাকুর শাহ, রণজিৎ দাস, তরুণ ঘোষ, শেখ আফজাল, মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখ শিল্পী। গত চারদশকে বেশ কিছু প্রকাশনার প্রচ্ছদ-অঙ্গসজ্জা করে সুনাম কুড়িয়েছেন- শিল্পী আনোয়ার হোসেন, কেরামত মওলা, মহিউদ্দিন ফারুক, রেজাউল করিম, আবদুল মান্নান, মানিক দে ও মোস্তফা কামাল ভূঁইয়া। প্রথমোক্ত গুণিশিল্পীরা শব্দ-শ্রুতি ও ছবি সম্বলিত টেলিভিশন মাধ্যমের শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত। মুদ্রণমাধ্যমেও তাঁরা প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার কাজ করেছেন। শেষোক্তজন সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের শিল্পী হিসেবে সরকারি অসংখ্য বইয়ের মানসম্মত প্রকাশনায় শিল্পনির্দেশনা দিয়েছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রাকের নানা প্রকাশনার প্রচ্ছদ ও ছবি এঁকে শিল্পী চন্দ্রশেখর দে তাঁর উদ্ভাবনী সৃজনশীলতার পরিচয়কে নতুন মাত্রায় তুলে ধরেছেন। কালি-কলমের অসংখ্য রেখায় নিপুণভাবে তিনি আঁকার বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলেন। ব্র্যাকের প্রকাশনাকে দৃষ্টিনন্দন করায় শিল্পী প্রহ্লাদ কর্মকার ও শিল্পী হাফিজউদ্দিন অবদান রেখেছেন। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য (জন্ম-১৯৬০) কাটুন ও ক্যারিকেচার অংকনে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর আঁকা প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা এবং সর্বোপরি কার্টুন পাঠকনন্দিত। তাঁর আঁকা কার্টুনে রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসঙ্গতি, নীতিহীন রাজনীতি ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির মুখোশ উন্মোচনে তাঁর কার্টুনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ডাকসুর সাবেক সামাজিক আপ্যায়ন সম্পাদক শিল্পী অশোক কর্মকার (জন্ম-১৯৬৩) এ পর্যন্ত সহস্রাধিক গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, অঙ্গসজ্জা করেছেন। বাংলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ সাহিত্য প্রকাশ ও প্রথমার অনেক মানসম্মত প্রকাশনার প্রচ্ছদ ও গ্রন্থ নকশার কাজ করেছেন তিনি। সমসাময়িককালে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার পাতাকে দৃষ্টিনন্দন করায় তাঁর অবদান অমূল্য। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে তিনি একযুগেরও বেশি সময় পত্রিকা ও বইনকশার কাজে যুক্ত থেকে এ ক্ষেত্রে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছেন।
শিল্পী উত্তম সেন, মোমিনউদ্দিন খালেদ, মাসুক হেলাল এঁকেছেন, আজো আঁকছেন শত শত বইয়ের প্রচ্ছদ। তাঁরা প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এ সময় প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে আরো যুক্ত হয়েছেন হামিদুল ইসলাম, খন্দকার তোফাজ্জল হোসেন, সুখেন দাস, সরদার জয়নুল আবেদিন প্রমুখ শিল্পীরা। বেশ কিছু গ্রন্থের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী মনিরুজ্জামান, সেলিম আহমেদ, হিরন্ময় চন্দ, মনিরুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম মুক্তা, মাকসুদুর রহমান, অভিজিৎ চৌধুরী, কিরিটি বিশ্বাস, ফারুক আহমেদ, আবদুল কুদ্দুছপ্রমুখ শিল্পী। সেলিম আহমেদ (জন্ম- ১৯৬৩-২০২০) পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদসহ ভেতরের অঙ্গসজ্জার ধৈর্যশীল কাজ সুচারুভাবে সম্পাদন করে পাঠক-প্রকাশকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এখানে নতুন করে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন আনিসুজ্জামান সোহেল।
গত শতকের নব্বই দশকে প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় নতুন ধারার সূচনা করেন অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পী ও লেখক ধ্রুব এষ (জন্ম-১৯৬৭)। হাতে এঁকে বা তৈরি কোনো বস্তুর ছবি তুলে কম্পিউটার গ্রাফিকসের সাহায্যে তাকে মনোরমভাবে উপস্থাপনায় তাঁর জুড়ি নেই। হূমায়ুন আহমেদসহ অনেক নন্দিত লেখকদের গ্রন্থের অসংখ্য প্রচ্ছদ এঁকেছেন। শিশুদের জন্য লেখা বইয়ের অংকনে শিশুদের আঁকা-লেখার বৈশিষ্ট্য প্রয়োগ করায় তাঁর কাজ লেখক- পাঠকদের মুগ্ধ করে।
এ ধারা নিয়ে আরো অগ্রসর হয়েছেন তরুণ অংকনশিল্পীরা। এ দলে আছেন- নাজিব তারেক, সব্যসাচী হাজরা, নিয়াজ চৌধুরী তুলি, গুপু ত্রিবেদী, তারিক ফেরদৌস খান, মাহবুবুল হক, রাজিব রায়, সঞ্জীব সাহা, গৌতম ঘোষ, সব্যসাচী মিস্ত্রী, আরাফাত করিম, শতাব্দী জাহিদ প্রমুখ। এই তরুণদের মধ্যে সম্প্রতি নিয়াজ চৌধুরী তুলি ও সব্যসাচী হাজরা প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ করে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে গুণগত পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করে গত শতকের আশির দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রয়োগ বেড়ে যাওয়ায়। বিশেষ করে বাংলা বর্ণমালা লেখার সফটওয়্যার আবিষ্কারের ফলে আমাদের মুদ্রণ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাংবাদিক-লেখক-প্রকাশক মোস্তাফা জব্বার। তাঁর আবিষ্কৃত বিজয় কি বোর্ড আমাদের নতুন পথের দিশা দিয়েছে। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী প্রকাশনাশিল্পকে শিল্পিত সৌষ্ঠব দিতে এডোবি ফটোশপ ও ইলাস্ট্রেটর সফটওয়্যার শিল্পী ও অন্যান্য ব্যবহারকারীদের প্রযুক্তির সুবিধা এনে দিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রবর্তিত মুনীর কিবোর্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। টাইপ মেশিনের জন্য এর আবিষ্কার হলেও পরবর্তীতে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে বাংলালিপিতে এটির বিস্তর ব্যবহার হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই প্রকাশনাশিল্পকে গতিশীল ও মানসম্মত করতে আমাদের মুদ্রণ ও পুস্তক বিশেষজ্ঞরা সচেষ্ট ছিলেন। তেমনি প্রকাশনাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বইমেলার আয়োজন ও তা দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ দেশের প্রকাশনাশিল্পের বিকাশের জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর প্রকাশনাকে মানসম্মত করার জন্য প্রকাশক ও শিল্পীদের মধ্যে পুরস্কার প্রবর্তন করে এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে।
শেষ করি এক স্মৃতিচারণ করে। ১৯৮২ সালের শেষার্ধ্বে ঢাকার গুলিস্তানে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্যালয়ে গ্রন্থ প্রকাশনার কলা কৌশল শেখানোর জন্য ইউনেস্কো জাপানের সহযোগিতায় বাংলাদেশের চারুশিল্পী ও প্রকাশকদের অংশগ্রহণে পাঁচ দিনব্যাপী একটি কর্মশালার আয়োজন করে। ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ও নামজাদা শিল্পী এমজি রামচন্দ্রন এই কর্মশালাটি পরিচালনা করেছিলেন। শিল্পী হাশেম খান এর সমন্বয়ক ছিলেন। তখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন ফজলে রাব্বি। তাঁদের আন্তরিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছিল কর্মশালাটি। ইফতেখার রসুল জর্জসহ বেশ ক’জন প্রকাশক ও শিল্পীদের সঙ্গে ওই কর্মশালায় আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখনই জেনেছি একটি গ্রন্থ প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয় এবং প্রতিটি ধাপ পেরুতে সযত্ন দৃষ্টি থাকতে হয় সংশ্লিষ্ট গ্রন্থিক কিংবা নকশাবিদের।